#বিচ্ছেদ পর্ব ২০
রায়নার ডাকে রিয়ার ঘুম ভাঙ্গলো।
লেপের ভেতর থেকে মুখ বের করে বহু কষ্টে চোখ মেলে তাকালো রিয়া।
মা, প্লিজ উঠো ! আমরা এখন খেঁজুরের রস খাবো, উঠো না মা!
রিয়ার একটুও ইচ্ছে করছে না লেপের ভেতর থেকে উঠতে। কিন্তু মেয়ের মুখের এতো মিষ্টি ডাক শুনে না উঠে পারলো না রিয়া।
প্রচন্ড ঠান্ডা !
রিয়া মোটা উলের সোয়েটার পরে নিলো।
গলায় মাফলার জড়িয়ে রায়নার দিকে তাকালো। হাটু সমান মোটা জ্যাকেট, টুপি আর মোজাসহ কেডস পরে আছে মেয়েটা।
জ্যাকেটটা আশিক নিয়ে এসেছিলো দেশে আসার সময়। রায়নাকে মানিয়েছে সুন্দর।
ঠিকঠাক মতো শীতের পোষাক পরে আছে দেখে মনে মনে খুশী হলো রিয়া।
নিশ্চয় মা পরিয়ে দিয়েছেন।
মেয়ের হাত ধরে দো’তলা থেকে নিচে নেমে এলো। বাড়ীর ভিতরের দিকে চমৎকার উঠোন। সেখানে একপাশে মাটির চুলোয় গরম গরম ভাপা পিঠা তৈরী হচ্ছে।
উঠোনে কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার দেয়া হয়েছে। সেখানে বসে আছেন বাবা,দুলাভাই,ভাইয়া,আপু, ভাবী…
আশে-পাশের বাড়ীর জ্ঞাতী আত্মীয় স্বজনরা আসছেন মাঝে মাঝে।
এভাবে সবাই একসঙ্গে বহুদিন পর বাড়ীতে এসেছে বলে গ্রামের আত্মীয়-স্বজন খুব খুশী। মা চাচীর সঙ্গে পিঠা বানাতে ব্যস্ত।
ছোট চাচা গ্লাসে গ্লাসে রস ঢেলে দিচ্ছেন।
বাবা বললেন,
— খেয়ে দ্যাখ্…এমন সুস্বাদু খেজুরের রস গ্রাম ছাড়া কোথাও পাবিনা। ঢাকায় এসব পাওয়ার কথা ভাবাই যায়না।
সবাই স্বাদ মিটিয়ে রস খেলো।
রায়না রসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে অভিভূত হয়ে গেল। বললো, ma I love this juice.
from now it’s my favorite.
রায়নার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।
রসের গ্লাস হাতে নিয়ে আশিককে মনে পড়লো রিয়ার। আশিকও খেজুরের রস খুব ভালবাসতো। মেয়েটা একেবারেই ওর বাবার মতো হয়েছে।
শীতের দিনে ছুটির সকালে রায়নার দাদী ভাপা পিঠা বানাতেন যাতে আশিক গরম পিঠা খেতে পারে। আশিকের কতো বাহানা ছিলো।
গুড় বেশী দিতে হবে, নারকেল দেয়া যাবেনা,আবার পিঠা খুব মজা হতে হবে…. মা সেরকম করেই বানিয়ে দিতেন।
সেই দিন গুলো অন্যরকম ছিল !
ফিরে পেলে মন্দ হতো না।
গরম ভাপা পিঠা থেকে নতুন গুড়ের একটা সুঘ্রাণ আসছে।
রিয়া রসের গ্লাসে চুমুক দিলো।
আজ কি একটু কষ্ট হচ্ছে আশিককে রেখে এসব খেতে ?
পিঠা খাওয়ার পরে ওরা সবাই গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিলো।
ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির,হলুদ শরিষার ক্ষেত, ফুল কপি,বাঁধা কপি, টাটকা ধনিয়া পাতা, গাজর,মুলার ক্ষেত দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল সবাই। রায়না যেন প্রজাপতির মত উড়ছিল..
শীতের টাটকা শাক-সবজি আর নদীর তাজা মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই যার যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলো।
রিয়া দো’তলার বারান্দায় পুরনো ইজিচেয়ারে আধা-শোয়া হয়ে বই পড়ছিলো।
ঘুমিয়ে পড়েছিলো বোধহয়।
কেউ তাকে ডাকছে বহুদূর থেকে। রিয়া দৌড়াচ্ছে সেই ডাক লক্ষ্য করে।
রায়নার হাত ধরে ঠিকমতো দৌড়াতেও পারছেনা।
রিয়া অবাক হয়ে খেয়াল করলো সে রায়নাকে নিয়ে রেল লাইনের উপর দিয়ে ছুটছে।
অনেক দূরে আশিক হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে..
রিয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে.. খুব কষ্ট।
কিছুতেই এগোতে পারছে না।
রায়না বলছে,মা.. ঐ যে বাবা, আরো জোরে চলোনা মা ! প্লিজ মা !!
আর একটু এগোলেই আশিকের হাতটা ধরতে পারবে রিয়া। আর একটু…আর একটু…
— এই রিয়া.. ওঠ ! মশা কামড়াবে তো !
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো রিয়ার।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
আশিক রেললাইনের উপরে দাড়িয়ে ওকে ‘ রিয়া রিয়া ‘ বলে ডাকছিলো না ?
এতোক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলো রিয়া ?
রিয়া কিছুতেই মনে করতে পারছেনা, ও কি আশিকের হাতটা ধরতে পেরেছিলো ?
একবার মনে হচ্ছে পেরেছিলো। আবার মনে হচ্ছে, নাহ্ ! ধরতে পারেনি।
কোনটা সঠিক ?
স্বপ্নের কথা মনে থাকে না ঠিকমতো।
খাবার ঘরে তুমুল আড্ডা চলছে…
রিয়া এক মগ গরম চা নিয়ে বসলো সবার সাথে। পারিবারিক আড্ডা।
সবার ছোটবেলা নিয়ে কথা হচ্ছে আর এই নিয়ে হাসাহাসিও হচ্ছে।
সবার মনে কতো আনন্দ !
রিয়ার দেখেও ভালো লাগছে।
ছোট চাচী এরই মধ্যে দু’বার চা বানিয়ে দিয়েছেন, সাথে ঝাল্ নিমকি।
মা চোখ গরম করে বলেছেন,আর কিন্তু চা হবেনা। শেষে রাতে আর কেউ ঠিকমতো খেতে পারবেনা।
গতরাতে আশিকের মেসেজ দেখা মাত্র অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল রিয়া।
সেই প্রথম জীবনের মতো।
একটু ভালো লাগা…একটু অস্বস্তি..
মেসেজ পড়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো রিয়ার।
রায়নার আমেরিকান নাগরিকত্বের কাজ বেশ খানিকটা এগিয়েছে। আরো সময় লাগবে, তবে হয়ে যাবে।
এটা ভালো খবর।
রিয়া চায় রায়নার ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় হোক।
সে যেন তার বাবার কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়। আমেরিকার মতো দেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতে পারে।
দশ মিনিট চ্যাট করেছিলো ওরা।
এই প্রথম। এর আগে কখনো চ্যাট হয়নি আশিকের সঙ্গে। মেইলে যোগাযোগ হয়েছে।
আশিক কি আরো কিছু বলতে চাইছিলো ?
হয়তো।
রিয়া কথা বাড়ায়নি।
তবে আশিক কথা বললে হয়তো আরো কিছুক্ষণ চ্যাট হতে পারতো।
ওরা কেমন আছে জানতে চাইছিলো।
রিয়া জানিয়েছে, ওরা গ্রামে বেড়াতে এসেছে।
রায়না খুব আনন্দে আছে জেনে আশিক খুশী হয়েছে।
শুভরাত্রি বলার আগে আশিক লিখলো,
‘তোমরা দু’জন সাবধানে থেকো।
ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলো না।’
রিয়ার মন কেমন করে উঠলো !
কতো বছর পরে আশিক এভাবে বললো।
অথচ,আগে এভাবে বলা এবং শোনাটা অভ্যেস ছিল।
বিয়ের পর যতোদিন একসাথে সংসার করেছে, তার প্রতিটা দিনই অফিসে যাওয়ার সময় আশিক রিয়াকে বলতো, সাবধানে থেকো।
আর দু’জন যদি পরষ্পর থেকে দূরে থাকতো,তাহলে তো কথাই নেই।
বার বার ফোন করে রিয়ার খোঁজ নিতো।
সাবধানে থাকতে বলতো।
সময়ের ব্যবধানে আজ এগুলো শুধুই স্মৃতি।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ট্রেন ছুটছে…
রিয়া জেগে বসে আছে জানালার পাশের সীটে। ট্রেনের জানালার গ্লাসের ভিতর দিয়ে রাতের অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও, রিয়া তাকিয়ে আছে বাইরে।
মাঝে মাঝে দূরের স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে।
গত দশদিনে ওরা খুব আনন্দ করেছে।
নদীতে সাঁতার কেটেছে। এক বিকেলে নদীতে নৌকায় চড়েছে সবাই মিলে।
বিভিন্ন রকম পিঠা-পায়েস খাওয়া,আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়ানো,তাদের আন্তরিক আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়েছে বার বার।
কিভাবে সবার সঙ্গে আনন্দে কেটে গেল
দশটা দিন টের পেলো না কেউ।
রায়না খুব খুশী।
এই ক’দিনে মাঝে মধ্যে আশিকের সঙ্গে চ্যাটিং হয়েছে রিয়ার। প্রয়োজনীয় কথা দিয়ে শুরু করতো আশিক। তারপর দু’চারটা সাধারণ কথা বলতো।
রিয়া খেয়াল করেছে, আশিক এবং সে একে অপরের সঙ্গে কিছুটা সহজ হয়েছে।
এটা একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে।
যেকোন ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে সুবিধা হয়। এই জীবনে বহুবার আশিকের সঙ্গে তাকে কথা বলতে হবে।
রায়নার ব্যাপারে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই এখন তো আশিকের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।
কারণ, রায়না তাদের দু’জনেরই সন্তান।
যদিও আশিক এমন দাবী জানায়নি তবে রিয়া রায়নার প্রতি আশিকের অধিকারকে অস্বীকার করতে চায়না।
রিয়া শুনেছে কিছু কিছু পরিবারে সন্তানদের ব্যাপারে বাবা বা মা যেকোন একজন যা সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই শেষ কথা হয়।
কিন্তু রিয়া সেরকম কিছু করতে চায়না।
আশিক যখন ছিলোনা,তখন রিয়া সব সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছে মেয়ের ব্যাপারে।
আজ যখন আশিক তার মেয়ের পাশে এসে দাড়িয়েছে,তখন শক্ত করেই মেয়ের হাতটা ধরুক..
রিয়া মনে মনে চায়।
রিয়া জানালার গ্লাসটা একটু খানি খুলে দিলো। বাইরে অনেক ঠান্ডা।
ট্রেনটা মনে হয় থেমেছে কোন স্টেশনে।
কোন স্টেশন এটা ?
ইন্টারসিটি ট্রেন সব স্টেশনে থামেনা।
নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেনটা থামে খুব অল্প সময়ের জন্য। ছোট স্টেশনগুলোতে কেমন টিমটিমে আলো জ্বলে।
ছোট খাট দু’একটা চা,পান,সিগারেট, চিপস,কলা,
পাউরুটির দোকান থাকে। শীতের রাতে কিছু যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে আর গরম চা- সিগারেট খায়।
সারারাত খোলা থাকে দোকানগুলো।
স্টেশনের বেঞ্চের নীচে একটা কুকুর শুয়ে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে। আহা বেচারার শীত লাগছে বোধ হয় খুব।
রিয়ার খুব মায়া হলো।
অল্প বয়সী এক দম্পতি তাদের ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলো স্টেশনে।
ট্রেনে উঠার পর মেয়ের জন্য চিপস্ কিনতে কিনতেই ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিয়ে দিলো।
ছোট্ট মেয়েটা ‘বাবা.. বাবা..ট্রেন ছেড়ে দিলো, চলে এসো তাড়াতাড়ি…’ বলে কাঁদতে শুরু করলো।
রিয়া মেয়েটিকে এখন আর দেখতে পাচ্ছেনা।
মনে হয় পাশের কেবিনে উঠেছে ওরা।
বাবা কিন্তু মেয়ের জন্য চিপস কিনে নিয়ে তবেই দৌড়ে এসে ট্রেনে উঠলো।
ট্রেনটা ততোক্ষণে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে। বাচ্চা মেয়েটি নিশ্চয় শেষ মূহুর্ত্যে চিপস কেনার বায়না করেছিলো।
রিয়ার খুব ভালো লাগলো দৃশ্যটি দেখে।
সেইসাথে বুকের ভেতর একটা হাহাকার অনুভব করলো। কারণ,রায়না এই ছোট ছোট আনন্দ গুলো পায়নি তার জীবনে।
আজ রায়নার স্কুল খুলেছে।
বছরের প্রথম দিন ওদের স্কুল থেকে আজ নতুন বই দেবে। কোন্ সেকশন, কতো রোল নম্বর, সব জানতে পারবে আজ ক্লাসে গেলেই।
রিয়ারও আজ অনেক ব্যস্ততা স্কুলে।
সাতটার আগেই ওরা স্কুলে চলে এসেছে।
আজ অনেকটা স্বাভাবিক লাগছে রিয়ার।
ছুটিতে যাওয়ার আগে যা অবস্থা হয়েছিলো !
ঐ বিষয় গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে একটু একটু করে। গ্রামের বাড়ীতে থাকতে একদিন মেঝো খালা মাকে ফোন দিয়েছিলেন।
কি বলেছেন কে জানে। তবে, মা খালাকে বলেছেন,
— মেঝোআপা আমি ঢাকায় এসে তোমার সঙ্গে কথা বলবো।
মা রিয়াকে কিছু বলেননি।
তবে বড় আপু একদিন বলেছিলো,
— কি সিদ্ধান্ত নিলি রে রিয়া ? যা করবি খুব ভেবে চিন্তেই করিস।
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল।
গতকাল খুব ভোরে ওরা ঢাকায় পৌছে গিয়েছিলো।
স্টেশন থেকে ওদেরকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বাবা আর ভাইয়া।
রায়না তার মামুকে জড়িয়ে ধরে থ্যাঙ্কস্ দিয়েছিলো রাতের ট্রেন জার্নি করতে পেরেছে বলে। রায়নার জন্যেই রাতের ট্রেনে আসা।
বড় আপুরা চিটাগং ফিরে গেছে গতকালই।
ভাইয়া দেশে থাকবে মাস খানেক…
টিচার্স রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই মায়ের ফোন।
রিয়া ফোন রিসিভ করে বললো,
—- মা আমি তোমাকে বাসায় ফিরে ফোন দিবো। এখন অনেক ব্যস্ত, মা।
মা বললেন, মনে করে ফোন করিস কিন্তু !
রিয়া ব্যাগটা টেবিলে নামিয়ে রেখে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব।
টিচার্স রুমের আয়া পারুলকে ক্যান্টিন থেকে চা আনতে বললো।
পারুল চট্ করে চা নিয়ে এলো।
চায়ে চুমুক দিয়েই মনে পড়লো আশিককে জানানো হয়নি ওরা ঢাকায় ফিরেছে।
ইস্ ! ইভাকেও একটা ফোন করা হয়নি।
ঢাকায় ফিরেই ফোন দিতে বলেছিলো ইভা।
বাসায় ফিরে সবাইকে ফোন করতে হবে।
ঘন্টা পড়তেই রিয়া আবার ক্লাসের দিকে ছুটলো।
ইভার সঙ্গে কথা হয়েছে।
আজ রায়নাকে নিয়ে যাবে ওর বাসায়। রাতে ডিনার করিয়ে নিজেই আবার দিয়ে যাবে।
একটু পরেই আসবে ইভা।
রায়না রেডী হচ্ছে। ফুপির বাসায় যাবে বলে।
রিয়া শাওয়ার নিয়ে বারান্দার রোদে বসেছে।
শীতের রোদে বসে থাকতে বেশ ভাল লাগছে।
ইভার গাড়ীর আওয়াজ পাওয়া গেল।
ইভা উপরে এসে রায়নাকে নিয়ে গেল।
রিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলো।
গত এক বছরে এই পরিবর্তন গুলো এসেছে রায়নার জীবনে। সে তার পরিবারকে ফিরে পেয়েছে। তার চাচ্চু-ফুপি নিয়মিত যোগাযোগ এবং আসা-যাওয়া করে। রায়নাও অনেক সহজ হয়েছে। ওর হতাশাও অনেকটা কমেছে বলেই মনে হয় রিয়ার।
স্কুল থেকে ফিরে আসার পর রায়না তার বাবার সঙ্গে কথা বলেছে। নতুন ক্লাস, নতুন বই নিয়ে কতো কথা যে তার বলার ছিলো বাবাকে !
রায়নার এই ছোট ছোট আনন্দ গুলো রিয়াকে ছুঁয়ে যায়। আহা ! এভাবেই ভালো থাকুক তার মেয়েটা।
রুমে এসে মাকে ফোন করলো রিয়া।
মা ওপ্রান্ত থেকে নরম গলায় বললেন,
— তোর মেঝো খালার সঙ্গে কথা হয়েছে। ওদের কোন ডিমান্ড নেই। তবে তোর খালা বলেছে আমরা নিজে থেকে কিছু দিলে ওরা নিশ্চয় খুব খুশীই হবে। এখন তুই বললেই একটা ডেট ঠিক করা হবে। এটা শুধু কাজগে-কলমেই হবে, তুই চিন্তা করিস না …মা আরো কি কি যেন বলছিলেন।
রিয়ার কানে আর কিছু যাচ্ছিলো না।
ওর শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করলো।
পরে কথা বলবে বলে রেখে দিলো মোবাইলটা।
রিয়া ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলো।
খুব কষ্ট হচ্ছে রিয়ার।
আশিকের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
রিয়া বারান্দার চেয়ারে বসে দূরের কামিনী গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল।
মনে মনে বললো,এমন জীবন কি চেয়েছিলো রিয়া ?
নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।
রিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। রায়নার মুখটা ভেসে উঠলো।
রিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।
মোবাইলটা বেজেই চলেছে।
রিয়া শুনতে পাচ্ছেনা। বারান্দার চেয়ারে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলো সে।
সিদ্ধান্তটা নিতে পারার পর খানিকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে ওর মনে।
হঠাৎই খেয়াল করলো, মোবাইলটা বাজছে অনেকক্ষণ ধরেই…ইভার ফোন। বললো,
—- ভাবী, তুমি জলদি ধানমন্ডি সাতাশে চলে এসো। চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ঠিকানা এসএমএস করে দিচ্ছি। ওয়েটিং ফর য়্যু।
প্লিজ জলদি এসো…
রিয়া না করতে পারলো না।
ইভা বললো,
— আমি তোমার জন্য গাড়ী পাঠিয়েছি সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে। প্লিজ, না করো না। আমার গাড়ীতেই এসো।
রিয়া হাসলো,
—- প্রয়োজন হতো না। আমি চলে আসতে পারতাম ট্যাক্সিতে। পাঠিয়েই দিয়েছো যখন, তখন তোমার গাড়ীতেই আসবো। ধন্যবাদ।
রিয়া একটা নীল শাড়ী পরলো।
নীল টিপ্ আর নীল শেডের কাজল পরলো।
রিয়া সবসময় খুব গুছিয়ে পরিপাটি করে সাঁজে। স্কুলের প্রোগ্রাম গুলোতে শাড়ী পরতে হয় ওদের। সবাই ওর পরিমিত স্নিগ্ধ সাজ খুব পছন্দ করে।
রায়না মাকে শাড়ী পরতে দেখলে খুব খুশী হয়। আজ মেয়েটার জন্যেই শাড়ী পরলো রিয়া। নীল রঙের শাড়ী পরলে রায়না খুব খুশী হয়। আজ মেয়েটার পছন্দের সবকিছু পরতে ইচ্ছে করলো রিয়ার।
অনামিকায় ছোট্ট নীল পাথরের আংটি।
গাড়ীতে বসে মাকে ফোন করে জানালো,
— আমি কাল একবার বাসায় আসবো। তখন কথা হবে।
রিয়া বাসায় যাবে শুনে মা খুশী হলেন।
রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর। টিপটপ করে সাজানো। হালকা নিলাভ আলোয় মায়াবী একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
রিয়া রিসেপশনে পরিচয় দিতেই একজন ওয়েটার ওকে দোতলায় নিয়ে এলো।
এখানে একটু নিরিবিলি।
কোনার দিকে একটি সুন্দর টেবিল দেখিয়ে বললো,
— ম্যাম আপনি বসুন। এই টেবিলটাই আপনাদের জন্য বুকিং দেয়া হয়েছে।
রিয়া কিছু বলার আগেই চলে গেল ওয়েটারটা।
রিয়া টেবিলটার দিকে তাকালো।
ধবধবে সাদা চাদরের উপরে আরো একটি ছোট চারকোনা হালকা নীলাভ চাদরে ঢাকা টেবিলের দু’পাশে দু’টো মাত্র চেয়ার।
টেবিলের মাঝখানে এক গুচ্ছ নীলাভ অর্কিড জাতীয় ফুল। অর্কিডের মাঝে মাঝে সাদা সাদা হাসনাহেনা ফুল দিয়ে সাজানো।
মিষ্টি একটা সুবাস এসে লাগছে নাকে।
রিয়ার ভালো লাগছে।
তবে, তারচেয়েও অবাক লাগছে বেশী।
রায়না কোথায় ? রাশিক, ইভা.. এরা সব কোথায় ? সবাই থাকবে বলেছিলো।
মোবাইল বের করার জন্য হ্যান্ডব্যাগে হাত দিলো রিয়া। ফোনটা বের করার আগেই শুনতে পেলো,
—কেমন আছো রিয়া ?
ঝট্ করে মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল রিয়া।
আশিক দাড়িয়ে আছে সামনে।
কেঁপে উঠলো রিয়া ভিতরে ভিতরে।
কিভাবে সম্ভব ?
আশিক কবে আসলো দেশে ?
একবারও বলেনি তো দেশে আসবে সে ?
— খুব অবাক হয়েছো তাইনা ?
বলতে বলতে সামনের চেয়ারে বসলো আশিক।
রিয়া কোন কথা বলতে পারলো না।
আশিক মিষ্টি করে হাসলো,
— আমার মেয়েকে কথা দিয়েছিলাম ওকে দেখতে আসবো এই সময়। আর তোমার সঙ্গে দেখা করাটাও খুব জরুরী হয়ে পড়েছিলো…তাই চলে এলাম।
রিয়া আস্তে করে বললো,
—- খুব ভালো হয়েছে।
কিছুক্ষণ কোন কথা বললো না ওরা।
রিয়া মুখ নিচু করে বসে থাকলো।
আশিক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রিয়ার দিকে।
নীল শাড়ীতে ওকে অপরুপা লাগছে।
আশিক ভাবছে, কিভাবে শুরু করা যায় কথা।
নীরবতা ভাঙ্গলো রিয়া।
— রায়না, ইভা এরা কোথায় ?
প্রশ্নটা আশিককেই করলো রিয়া।
আশিক জানালো,
—- সে দেশে এসেছে গতকাল রাতে। রায়নার সঙ্গে বিকেলেই দেখা হয়েছে।
বাবাকে দেখে প্রচন্ড অবাক এবং খুশী হয়েছে মেয়েটা। কি করবে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না।
সারাবিকেল রায়নার সঙ্গেই খুব আনন্দে সময় কাটিয়েছে আশিক। আশিক হাসলো,
—- তোমাকেও অবাক করে দিতে ইচ্ছে করলো,তাই এই আয়োজন।
রিয়া হাসলো, হুম খুব অবাক হয়েছি।
আশিক বললো, কফি হতে পারে ?
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, হতে পারে।
আশিক কফি অর্ডার করলো।
পাঁচ মিনিটেই কফি চলে আসলো।
বহু বছর পর আবার দু’জন এক সঙ্গে
কফি খেতে খেতে কথা বলা শুরু করলো।
আশিক বললো,
—-বহু বছর পর- বহু ঘটনা আর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আজ আমরা এখানে এসে দাড়িয়েছি। এখন আর এমন কিছু করতে চাইনা যা তোমাকে আমাকে ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।
রিয়া তাকিয়ে থাকলো আশিকের মুখের দিকে। কোন কথা বললো না।
সত্যিই তো !
ওদের সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়েছে।
কিন্তু আজ ওরা কঠিন একটা অবস্থার মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে। রিয়া বললো,
—- আমরা রায়নার বাবা-মা, এই সম্পর্কটা কিন্ত কখনোই মিথ্যা হয়ে যায়নি এবং হবেও না।
আমি এই সম্পর্কটাকে খুব সম্মান করি।
তবে, ফিরে আসার পথটা খুব সহজ নয়।
আশিক সাথে সাথেই বললো,
— তোমাকে নতুন করে কোন কষ্ট দিতে বা অসম্মান করতে চাইনা আমিও।
রিয়া কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো আশিকের দিকে।
আশিক বললো,
—- আমাদের অপরিণত সিদ্ধান্তের ফলে রায়নাকে এতো দূর্ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তবে আর রায়নাকে কষ্ট পেতে দেবো না। আমরা দু’জন এক হতে না পারলেও রায়নাকে মানুষ করবো একসঙ্গেই।
রিয়া দুঃখী গলায় বললো,
— তোমার খুব কাছে না আসতে পারলেও, আমরা বন্ধু হয়ে পাশাপাশি পথ চলতেই পারি।
আশিক আলতো করে রিয়ার হাতে হাত রেখে প্রগাঢ় কন্ঠে বললো,
— পারি.. অবশ্যই পারি।
রিয়া নিজের বুকের ভিতরে নদীর পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো…
গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন আশিক বিষর্ন্ন চোখে তাকিয়ে আছে রিয়ার চোখে।
রিয়ার হাত ওর হাতের মুঠোয় ধরা
কি গভীর মায়া রিয়ার চোখে !
রিয়ার চোখ টলটল করছে জলে
একবার পলক পড়লেই টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়বে
ফোঁটা ফোঁটা জল !
— প্লিজ ! রিয়া…পলক ফেলো না…
এতো জল আমি রাখবো কোথায় ???
( সমাপ্ত )
ডিভোর্স রিলেটেড গল্পের লিংক (all)
#উপন্যাস_বিচ্ছেদ
#লেখক_মাশাওফি_আমিন
মাশাওফি আমিন
.