#বিচ্ছেদ পর্ব ৭
আশিক কয়েক বার পড়লো মেইলটা।
রিয়া তার মেইলের জবাব পাঠিয়েছে।
দুই লাইনের ছোট্ট মেইল।
“মেয়ের সঙ্গে দেখা হতে পারে।
আমার কোন আপত্তি নেই। “
রিয়া তাকে আপনি বা তুমি কোন সম্মোধন করেনি।
দীর্ঘ ১০/১১ বছরের ব্যবধান হয়তো এর কারণ।
আশিক খুব খুশী।
সে তার মেয়েকে দেখতে পারবে।
মেয়ের সঙ্গে তার তেমন কোন স্মৃতি নেই।
সাত বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল।
রায়নার যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন সে
প্রথমবার দেখেছিল মেয়েকে।
তারপর ছয় মাস খুব আনন্দে কেটেছিল মেয়ের
সঙ্গে। যখনই ছুটি পেতো ঢাকায় চলে যেতো।
তখন ওর পোস্টিং ছিল চিটাগং এ।
আশিক ভেবেছিল সবকিছু এমনই থাকবে তার
মনের মতো।কিন্তু কোনকিছুই হয়নি তেমন।
মা নীলাকে মেনে নিতে পারেননি।
মা চেয়ছিলেন রিয়া আর রায়নাকে।
হয়তো মা ঠিক ছিলেন মায়ের জায়গায়।
কিন্তু আশিক তখন খুব কঠিন সময় পার করেছিল।
মাকে উপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা,
আবার মা যেটা চেয়েছিলেন, সেটাও তখন আশিক করতে পারেনি।
তাই নীলার সঙ্গে বিয়েটা স্থগিত করেছিল ঐ সময়। ভেবেছিল মা একসময় ঠিকই রাজি হবেন।
মায়ের অমতে আশিক বিয়ে করতে চাইনি।
কিন্তু মায়ের শরীর বেশ খারাপ হয়ে পড়ে যখন তিনি জানতে পারেন রিয়া নতুন চাকুরী নিয়ে পরিচিত গন্ডি ছেড়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছে।
সেখানে তার পরিচিত কেউ নেই এবং সে আত্মীয় বন্ধু সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
সে নাকি তার নিজের বাবার বাড়ীতেও আসেনা। তার বাবা-মা মাসে ১/২ বার তাকে আর রায়নাকে গিয়ে দেখে আসে।
এসবই ইভার কাছে শোনা।
আশিক যদিও কয়েকবার বলেছিল,আমার মেয়ের সাথে আমি দেখা করবো কিভাবে ?
ইভা বলেছিল,দেখা হবেনা। কারণ রিয়া-রায়না কেউই আর দেখা করতে চায়না।
ইভার কন্ঠে শ্লেষ মেশানো ছিল।
সেসময় ইভার সঙ্গেও আশিকের মানসিক দূরত্ব তৈরী হয় খানিকটা।
ইভাও মায়ের মতোই কিছুতেই নীলাকে মেনে নেয়নি।
এবং কোনদিন নেবেনা জানিয়ে দিয়েছিল।
রাশিকও মানতে পারেনি।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে আশিক খানিকটা জেদ আর অভিমান করেই আবার আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছিল।
স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সময়ই আশিক আমেরিকায় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে রেখেছিল।
দেশে ফেরার আগে ওখাকার একটা ইঞ্জিননিয়ারিং ফার্মে জবের জন্য আবেদন করে এসেছিল।
আশিকের রেজাল্ট খুব ভালো ছিল।
ওরা বলেছিল,আশিককে ওরা সময় মতো কল করবে।
সে সময় আমেরিকার ঐ ইঞ্জিননিয়ারিং ফার্ম থেকে আশিককে কল করে ওদের ফার্মে জয়েন করার জন্য।
আশিক সাথে সাথেই সুযোগটা লুফে নেয়।
ফার্মে জয়েন করার কারণে পরবর্তীতে আশিকের নাগরিকত্ব পেতে সুবিধা হয়েছিল।
গত ছয় বছর যাবৎ আশিক আমেরিকায় আছে।
আমেরিকা চলে আসার আগেই ইভার বিয়ে দিয়ে এসেছিল। তবে মা মনে হয় আশিকের অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারেননি। দ্রুত শরীর খারাপ হয়েছিল তার এবং আশিক যাওয়ার ঠিক এক বছরের মাথায় মা মারা গেলেন।
আশিক ছুটি নিয়ে এসেছিল মায়ের গুরতর অবস্থার খবর শুনেই।
রাশিক আর ইভাই সামলেছিল মায়ের শেষ দিনগুলো। ওরা ভাবেনি মা এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবেন ওদের ছেড়ে।
কিন্তু ডাক্তার যেদিন রাশিককে ডেকে বলেছিল,আপনার বড় ভাইকে আসতে বলেন।
তখন রাশিক ফোনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল।
আশিক দ্রুত টিকিটের ব্যবস্থা করে চলে এসেছিল দেশে।
আশিক আশার পর মা কি যে খুশী হয়েছিলেন।
ওকে বার বার বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরছিলেন।
আল্লাদী মেয়ের মত করে কথা বলছিলেন।
ওরা ভেবেছিল, মা বোধহয় এ যাত্রা সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু না, আশিক দেশে ফেরার সাত দিন পরই মা চলে গেলেন।
কি কষ্ট ! কি কষ্ট ! সেই দিনগুলোতে…
ওরা তিন ভাই-বোন একা হয়ে গেল।
ইভার হাসবেন্ড মামুন সুন্দর ভাবে সবকিছু সামলে
ছিল সেসময়।
মামুন খুব ভাল ছেলে। নেভাল অফিসার।
যেমন স্মার্ট,তেমন ভালো ছেলে।
আশিকদের পরিবারের সঙ্গে দারুণ ভাবে মিশে গেছে। মামুনদের বাড়ীর সবাই খুব ভাল। ইভাকে তারা খুব পছন্দ করে।
আশিক দেশে ফেরার আগেই নাকি রিয়া রায়নাকে নিয়ে মাকে দেখে গিয়েছিল।
মায়ের মৃত্যুর দিন রায়নাকে কোলে নিয়ে রিয়ার বাবা- মা এসেছিলেন। রিয়া ওদের বিল্ডিং এর নীচে দাড়িয়েছিল। উপরে আসেনি।
হয়তো আশিকের মুখোমুখি হতে চায়নি।
পরে ইভার কাছে শুনেছে,রিয়া মায়ের মৃত চেহারা দেখতে চায়নি বলেই সেদিন উপরে আসেনি।
মায়ের মৃত্যুর এক বছর পর আশিক দেশে গিয়েছিল। রাশিক-ইভার সমর্থন না থাকায় বিয়েটা একাই করেছিল আশিক।
নীলার কিছু আত্মীয়,বন্ধুদের উপস্থিতিতে নীলার বাসাতেই হয়েছিল বিয়েটা।
আশিকের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র ওর কয়েকজন বন্ধু ছিল।কোন আত্মীয় স্বজন ছিলোনা বিয়েতে।
আশিক বিয়ের খবরটা সেসময় আত্মীয় স্বজন এমন কি রাশিক-ইভাকেও জানায় নি।
পরে জানিয়েছিল রাশিককে।
যদিও নীলার সাথে আশিকের পরিবারের কোন যোগাযোগ কখনো হয়নি।
বিয়ের পর নীলাকে দেশে রেখেই চলে আসতে হয়েছিলো। ওদের কাগজ-পত্র ঠিকঠাক হতে সময় লেগেছিল একটু বেশী। বিয়ের বছর খানেক পরেই
নীলা ওর ছেলেকে (আশিকের সন্তান হিসেবে) নিয়ে চলে এসেছিল আমেরিকায়।
নীলা কিছুদিন অড জব করার পাশাপাশি ভাল একটা চাকুরীর চেষ্টা করতে থাকে।ভালই ছিলো ওরা।
নীলা তার ছেলেকে বিশেষ প্রশিক্ষন এবং কেয়ার নেয় এমন স্কুলে ভর্তি করেছিলো।
আশিক সব রকম সহযোগিতা করেছিলো নীলাকে।
বছর দুয়েক পর থেকেই ওদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করেছিলো।
আমেরিকা আসার বছর খানেক পর থেকেই নীলা বদলে যেতে থাকলো। নীলা আরও উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার জন্য আবার পড়াশোনা শুরু করেছিলো।
আশিক না করেনি।
সেসময় নীলা আশিককে একদমই সময় দিতে পারতো না।অথচ, আশিক ঘরে ফিরে বউ এর এটেনশান চাইতো। কিন্তু চাকুরী,পড়াশোনা,ছেলেকে দেখাশোনা করার পরে আর তেমন সময়ই থাকতো না নীলার হাতে।
তেমন আগ্রহীও মনে হতোনা নীলাকে।
আশিক দেশী এবং ঘরের খাবার খেতে ভালবাসে।
প্রথম দিকে নীলা রান্না করলেও, বছর খানেক পর থেকে বাইরের কেনা খাবার খেয়েই বেশীর ভাগ
দিন কাটতে লাগলো আশিকের।
এভাবে তো চলতে পারেনা।
আশিক আপত্তি জানিয়েছিল নীলার বিভিন্ন কার্যকলাপের, স্বেচ্ছাচারিতার।
তখনই শুরু হয়েছিল দাম্পত্যকলহ।
আশিক চেয়েছিল কেয়ারিং বাঙালী বউ তবে
চাকুরী করাতে কোন আপত্তি ছিলনা তার।
আশিক মনে করে চাকুরী করেও কেয়ারিং বউ হওয়া যায়।
কিন্তুু নীলা ছিল উচ্চাভিলাষী, স্বাধীনচেতা এবং স্বার্থবাদী স্বভাবের মেয়ে। তার পক্ষে আশিকের বাধ্য বউ হয়ে থাকা সম্ভব ছিলোনা।
আশিক তো আমেরিকায় সরাসরি চাকুরী নিয়ে এসেছিলো।আশিককে বিয়ে করে আমেরিকা এসে নীলা তার আগের যোগাযোগ (স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সময়) কাজে লাগিয়ে এবং আশিকের সহযোগিতায় ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করে ফেলেছিলো।
সাথে একটা চাকুরী।
ওয়ার্ক পারমিট এবং চাকুরী পাওয়ার আগে পর্যন্ত নীলা আশিকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিলো।
আসলে আশিকের বোঝা উচিৎ ছিল আগেই। নীলার প্রথম ডিভোর্স হয়েছিল এরকম কিছু কারনেই। নীলা বরাবরই উচ্চাভিলাষী এবং ক্যারিয়ার সচেতন।
তার কাছে আগে ক্যারিয়ার পরে সংসার।
একদিন তুমুল অশান্তি হলো আশিকের সঙ্গে।
আশিকও প্রচন্ড একরোখা এবং মেজাজী।
তার পক্ষে নীলার এত ঔদ্ধত্য মেনে নেয়া সম্ভব ছিলোনা।
কঠিন গলায় আশিক বলেছিলো,সমঝোতা করতে হবে সংসার করতে হলে। তোমাকে সংসারেও সময় দিতে হবে।
নীলা রুক্ষ ভাবে জবাব দিয়েছিল,আমি আমার ক্যারিয়ার এবং ছেলের সাথে কোন কিছুই সমঝোতা করতে পারবো না। প্রয়োজনে তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো।
আশিক সেরাতে খুব অসহায় বোধ করেছিলো।
সারারাত ঘুমাতে পারেনি।কেন এমন হলো তার সঙ্গে ?
নীলাকে তো কম ভালোবাসেনি সে ?
তাহলে নীলা কেনো তার সঙ্গে এমন করলো ?
তবে কি সে মায়ের প্রতি অন্যায় করেছিলো ?
মা চাননি তবুও সে নীলাকে বিয়ে করেছিলো।
কেউই চায়নি নীলাকে।
নীলা যে স্বার্থপর রাশিক আগেই বলেছিল।
নীলার একটা কাজে রশিকের সাহায্য লেগেছিল।
রাশিক সাহায্য করেও ছিল।
নীলাকে ঐটুকু দেখেই রাশিক বলেছিল, উনি খুব স্বার্থপর। ভাইয়া এখন হয়তো বুঝতে পারছে না। কিন্তু বুঝবে একদিন।
রাশিক খুব বুদ্ধিমান,ধীর-স্হীর স্বভাবের।
এমনিতে রাশিকের কথাকে খুব গুরুত্ব দেয় আশিক।
নীলার ব্যাপারে শোনেনি বরং বিরক্ত হয়েছিল ছোট ভাই এর উপর।
সেরাতে খুব মনে পড়েছিলো প্রিয় ভাইকে,
ছোট বোনকে…ওরা সবাই ওকে কতো ভালোবাসে।
অথচ সে কারো মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি তখন।
পরদিন সকালে আরো কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছিলো আশিক।
নীলা ছেলেকে নিয়ে চলে যাওয়ার আগে আশিককে বলেছিলো,এখন তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। আমি অনেক ভেবে দেখলাম একসঙ্গে থাকা যাবে না । অশান্তি হবে। তার চেয়ে আমি আলাদা হয়ে যাচ্ছি। তোমার মাধ্যমে আমেরিকা এসেছিলাম। তবে এখন আমার ওয়ার্ক পারমিট আছে। আমি একাই সব কিছু পারবো।
আশিক হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল নীলার কথা শুনে !
মানুষ এত স্বার্থপর…নীচ হতে পারে ?
কিভাবে হয় এমন ??
নীলা আমেরিকাতেই আছে ওর ছেলেকে নিয়ে।
এক বছর হলো আশিক একা।
ডিভোর্স এখনো হয়নি নীলার সঙ্গে তবে প্রক্রিয়া চলছে।
এই এক বছর কী দূর্বিসহ ভাবে কেটেছে আশিকের
কেউ জানেনা।আশিক নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করেছে, কেন এমন হলো তার জীবনে ?
তবে কি সে তার নিজের সন্তানের সঙ্গে অন্যায় করেছে বলেই এমন শাস্তি সে পাচ্ছে ??
দীর্ঘ সাত বছর সে অন্যের সন্তানকে নিজের
সন্তান বলে মেনে নিয়েছিলো। অথচ,তার রক্ত.. তার সন্তান কোথায় আছে ? কিভাবে আছে ? কেমন আছে ?
খোঁজ রাখেনি।সে জানার চেষ্টাও করেনি।
আশিক পাগল হয়ে যায় এসব ভাবলে।
এখন যদি আশিক চায়, তাহলেও কি মেয়ে তাকে ক্ষমা করবে ? তার কাছে ফিরবে ?
এরকম হাজারও দ্বিধা নিয়ে সে রিয়াকে মেইল করেছিল।
আশিক ধরেই নিয়েছিলো নেগেটিভ উত্তর আসবে।
কারণ,সাত বছর আগে রিয়াকে সে ফিরিয়ে দিয়েছিলো।
রিয়া কি সেটা এতো সহজে ভুলে যাবে ?
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, রিয়া তাকে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে দিতে চেয়েছে !
আজ বহুদিন পর আশিকের মনে হচ্ছে, জীবনটা এতোও খারাপ নয়। বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দ আছে।
আশিকের হাতে রিয়ার ছোট্ট মেইল।
অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আশিক চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করলো,
আমাকে ক্ষমা করে দিস মা…
( চলবে
বিচ্ছেদ পর্ব ১-১০
https://kobitor.com/category/uponas/bissed/page/2/
.
.