#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব ২
মাহাবুবা বিথী
রুমি আমাকে বললো,
—-আপু আপনি আমার গল্প শুনে বোর হচ্ছেন নাতো?
আমি বললাম,
—-একদম না,
ও আবারো বলা শুরু করলো।
প্রথম থেকেই আবীরদের অনেক কিছু অসঙ্গতি রুমির চোখে ধরা পড়তে লাগলো। ওরা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করতে চায়নি। তখন ছিলো মে মাস।আবীরের মার কথা হচ্ছে এখন অনেক গরম। ওনারা আক্দ করিয়ে বউ উঠিয়ে নিবেন।পরে শীতকালে ডিসেম্বর মাসে উনি অনুষ্ঠান করবেন। উনার এক ভাই বিদেশে থাকেন।তখন উনিও দেশে থাকবেন। যাইহোক বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো আর রুমিরও অস্বস্তি, ভীতি বাড়তে লাগলো।
ইতিমধ্যে বিয়ের কেনাকাটা শুরু হলো। রুমির মা রুমি আর আবীরকে সাথে নিয়ে শপিং এ বের হলেন। আবীরের বিয়ের পাঞ্জাবী কিনলো আট হাজার টাকায় আর পনেরো হাজার টাকায় স্যুট কিনলো। আবীরের আংটি ঘড়ি জুতো সবই কেনা হলো। রুমিও আশা করেছিলো ওর হবু শাশুড়ী ওকে সাথে নিয়ে শপিং করবেন। কিন্তু উনি তা করেননি। এই নিয়ে রুমির একটু দুঃখবোধ ছিলো। রুমির মা রুমিকে বললো,
—-এসব ছোটো খাট বিষয়ে মন খারাপ করিস না। দেখিস বিয়ের পর আবীর তোকে খুব আদরে রাখবে।
রুমি ভাবছে,
—হয়তোবা। আমার ভবিতব্যই জানে কপালের লিখন।
রুমিদের আত্মীয় স্বজন আর ছেলে পক্ষ নিয়ে দেড়শ মানুষ বিয়েতে আসবে। রুমির মা একটা রেস্টুরেন্টে বিয়ের আয়োজন করলো। সেদিন সকালে বাসায় কাবিন হবে।
অতঃপর বিয়ের দিন চলে আসলো। কাজি সাহেব কবুল পড়ালেন। রুমি কবুল বলে উপস্থিত সবাইকে মৃদু হেসে সালাম দিলো। এই মৃদু হাসাটা পরবর্তীতে রুমির জীবনে কাল হলো। এর পর আবীরের মা বিয়ের শাড়ি গয়না রুমির মার হাতে তুলে দিলো।
ওরা চলে যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজন বিয়ের শাড়ি গয়না দেখে অবাক হলো। এতো সস্তা দামের বিয়ের শাড়ি। সর্বসাকুল্যে তিনহাজার টাকা দাম হবে।আর গয়না একভরির মতো।গলার একটা চিক সাথে কানের দুল। এর সাথে ইমিটিশনের চুড়ি। রুমির আত্মীয় স্বজন সবাই কানাঘুষা করতে লাগলো। বাপ মরা মেয়েটাকে ওর মা আস্তাকুঁড়ে ফেলছে। অথচ একটা ভালো প্রপোজাল কেউ আনেনি।সমালোচনার বেলায় সবাই এক পায়ে খাড়া। বউ সাজার টাকাও আবীর দেয়নি। যাক এর মধ্যে রুমি মায়ের কাছে টাকা নিয়ে বোন রুম্মানকে সাথে নিয়ে পারলার থেকে বউ সেজে আসলো। রুমির বিয়ের শাড়ি গয়না দেখে রুম্মানের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।ও রুমিকে বললো,
—-আপু আমার মনে হচ্ছে এরা তোকে ঠকাবে।
রুমি বললো,
—-না জেনে কারো সম্পর্কে মন্দ কথা বলতে নেই
রাতে রেস্টুরেন্টে বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। রুমির কাছে কেন যেন মনে হচ্ছিলো ওরা খুব দায়সারা ভাবে ছেলের বিয়ে দিচ্ছে।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রুমি প্রথম আবীরের হাত স্পর্শ করে চমকে উঠলো। পুরুষের হাত এতো নরম তুলতুলে হয় কিভাবে? কোন উষ্ণতা নেই। রুমি নিজেকে এই বলে সান্তনা দিলো বাবা মার আদুরে সন্তান তাই হয়ত এরকম।
রাত এগারটা বাজে। রুমি আবীরের সাথে শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা হলো। শাশুড়ী আগেই পৌছে গেছেন।বৌকে বরণ করে বাসরঘরে নিয়ে বসালেন। বাসর খাটটা খুব সাদামাটা ভাবে সাজানো হয়েছে। শাশুড়ী দুগ্লাস দুধ আর ডালিমের সরবত দিয়ে গেলো। রুমির একটু তন্দ্রা এসেছিলো। হঠাৎ দরজার ছিটকিনি লাগানোর শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।
ঘরে ঢুকেই আবীর রুমিকে বললো,
—-দেখ রুমি আমার বয়স ছত্রিশ।যৌবনের টগবগে ভাবটা এখন আর আমার মাঝে খুঁজে পাবে না। তোমারও তো বয়স কম না। তিরিশের কোটায় পৌছে গেছো। আর এটাও শুনে রাখো, আমি বাচ্চাও এই মূহুর্তে নিতে চাই না। তুমি কাপড় চেঞ্জ করে ফেলাে।
ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে আমাকে দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দাও।
রুমি দুধের গ্লাস আবীরের হাতে দিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে অঝোর ধারায় চোখের পানি ঝরালো। তারপর ফ্রেস হয়ে এসে নামাজ পড়ে রুমি খাটের একপাশে জড়সড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
মনে মনে রুমি ভাবল,এই রাত নিয়ে কল্পনায় কত
রোমান্টিক ছবি এঁকেছিলো।আর বাস্তবে ওর জীবনে কি ঘটে গেলো?পৃথিবীর প্রতিটা নারী সুখ আর সৌন্দর্যের বরণডালা নিয়ে একটি স্বপ্নের বাসর রাতের জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষার কামনার মোহনীয় রাতটা দুঃখ ও কাঁটার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পার হয়ে গেলো।
পরদিন খুব ভোরে রুমির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ফজরের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসেছিলো। আবীরদের বাসাটা কলাবাগান বশিরউদ্দিন রোডে। তখনও মহল্লাটা জেগে উঠেনি। এমনসময় পিঠে কারো হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করলো। রুমি তাকিয়ে দেখে পিছনে আবীর দাঁড়িয়ে আছে। আবীর রুমিকে বললো,
—-তোমার সাথে গতরাতে আমার ভালো করে কথা বলা উচিত ছিলো। ক্লান্ত থাকার কারনে সেটা সম্ভব হয়নি। তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?
রুমি বললো,
—-তুমি কি রাগ করার মতো কিছু করেছো?
আবীর বললো,
—-আসলে গতরাতটা আমাদের বাসর রাত ছিলো।সবারই বাসর রাত নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। আমি আসলে খুব ক্লান্ত ছিলাম।কি বলতে তোমাকে কি বলছি তুমি মনে কোন কষ্ট নিওনা।
রুমি মুখে কিছু বললো না তবে আবীরের apology তে ওর কষ্টের পরিমানটা একটু কমলো। আবীর বললো,
—-চলো সবাই অপেক্ষা করছে একসাথে নাস্তা করবো।
আবীরের সাথে রুমি ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো।আবীরের বাবা মা ভাইয়ের সাথে রুমিও নাস্তা সেরে নিলো। এমন সময় আবীরের বাসার এ্যাসিসটেন্ট আবীরের মাকে বললো,
—-খালাম্মা আমার পাওনাটা বুঝিয়ে দেন।আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবো।
রুমি আবীরকে বললো,
—-উনি চলে গেলে বাসার কাজ কে করবে?
আবীরের মা বললো,
—-আমরা পাঁচজন মানুষ। নিজেদের কাজ নিজেরাই করে নিবো।
রুমি কিছু বললো না।কিন্তু মনে মনে ভাবলো সংসারে কতো কাজ থাকে। বিশেষকরে বাথরুম ধোওয়া আর ঘর মোছা।এদুটো কাজ করতে রুমির একদম ভাললাগে না। রুমির আবার ব্যাকপেইনের সমস্যা আছে।
আবীরের মা রুমিকে বললো,
—-আজকাল ভদ্রতার কোন মুল্য নেই। আমার ছেলে দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনি অনেক ভালো একটা ছেলে।তাইতো কবুল বলার পর তােমার মুখে একগাল হাসি ছিলো। আর আমার ছেলে কিছু চায়নি বলে তোমাদের বাসা থেকে কিছুই দিলো না।
রুমি মনে মনে আহত হলো।কিন্তু আবীরের মাকে বুঝতে না দিয়ে বললো,
—-আমি নিতে চাইনি। তবে আমার বিয়েতে গিফট হিসেবে একটা খাট আলমারি আর ড্রেসিং টেবিল দেওয়া হয়েছে। আমার চাচারা দিয়েছে। আজকে মা পাঠিয়ে দিবে।
সাথে সাথে আবীরের মার গলার স্বর বদলে গেলো।
আবীরের মা বললো,
—-আমি তো জানি,তোমাদের পরিবার অনেক ভদ্রপরিবার।
রুমি শ্বশুর বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই এবাড়ির মানুষের আচরণে বারবার আহত হতে লাগলো। তাই শাশুড়ীকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে চলে আসলো।
লাঞ্চের পরপর রুমিদের বাসা থেকে ফার্নিচার গুলো চলে আসলো। আবীরের বাসার সবার মুখে হাসি ধরে না। এমন সময় আবীরের মামা মামী ওদের বাসায় আসলো। আবীরের মা গর্ব করে বললো,
—-তোমরা সবাই বলেছিলে আবীরকে নাকি কেউ মেয়ে দিবে না। দেখেছো আমি ঠিক আমার আবীরের জন্য বউ নিয়ে এসেছি।
আবীরের মামারা চার ভাই আর ওর মা খালা দুবোন। ওর ছোটো মামা বিশেষ কারনে বিয়েতে যেতে পারেনি।তাই আজ আবীরের মামীকে নিয়ে রুমির সাথে পরিচিত হতে এবাড়িতে এসেছে।এই সুযোগে আবীরের মা দু,কথা শুনিয়ে দিলো। এতে মামা মামীর মুখটা কালো হয়ে গেলো।কৌশলে আবীরের মা রুমিকে চা বানাতে কিচেনে পাঠিয়ে দিলো।কিচেন থেকে রুমি শুনতে পেলো,
আবীরের মামা আবীরের মাকে বলছে,
—-বুবু তুমি জেদের বশবর্তী হয়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলে।
আবীরের মা বললো,
—-ওরা স্বেচ্ছায় ওদের মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছে।
আবীরের মামা বললো,
—-ওরা তো আবীরের বিষয়টা জানে না।
আবীরের মা রেগে গিয়ে বললো,
—-আমার সংসারের শান্তি নষ্ট না করে চা খেয়ে এখান থেকে বিদেয় হও।
চলবে……….