#ক্যামেলিয়া পর্ব ২১
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ২১
(৪৮)
জাফরিনের শরীর ধীরে ধীরে কিছুটা ঠিক লাগছিল।কিছুটা পানি মুখে দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো সে। দু হাতে নিজের গায়ের ওড়না ঠিক করে বলল,
“ধন্যবাদ।”
“প্রথম বার বুঝি?”
“জি, এজন্যই হয়তো কিছুটা অস্বস্তি লাগছে।”
“আমারো প্রথম বার প্লেনে উঠা। বলতে পারেন আপনার মতোই আমিও ভুক্তভোগী।কিন্তু আপনি একটু বেশিই।”
“আপনার সাথে পরিচয় হলো না।আমি জাফরিন শিকদার।”
“আমি সুচিত্রা। কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন?”
“আমার বাবা এদের কোম্পানিতে চাকরি করতো। গত মাসে এক্সিডেন্টে ইন্তেকাল করেছেন।কোম্পানি থেকে তাই আমার আগের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে।তাই আজ যাচ্ছি।আপনারা?”
জাফরিনের কথায় একটু নড়ে চড়ে বসলো সুচিত্রা। গায়ের আঁচল ঠিক করে বলল,
“ওই যে ভদ্রমহিলাকে দেখছেন তিনি আমার দাদী।ভদ্রমহিলা আজ বায়ান্ন বছর পর সে তার স্বামীকে দেখতে পাবে এই আশা নিয়ে সাত সাগর পাড়ি দিচ্ছে।”
“ঠিক বুঝলাম না।”
“এক দেশেই যেহেতু যাচ্ছি দেখা তো হবেই। তখন না হয় এসব গল্প করা যাবে।”
ঠিক সেই সময় এমিলি এসে জাফরিন কে বলল,
“ম্যাম আপনি ঠিক আছেন?ডাক্তার এসেছে আপনার একটু চেকাপ করতে চাইছে।”
“আমি ঠিক আছি। ভয়ের কারণে এমনটা হয়েছিল।এছাড়া আমি ঠিক আছি।”
“তবুও একবার একটু দেখে নিতে দিন।আমাকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।আশা করি বুঝবেন।”
জাফরিন কিংবা সুচিত্রা বুঝতে পারলো, যে অবধি জাফরিন চেকাপ করাবে না সে অবধি এমিলি দাঁড়িয়ে থাকবে।এই মেয়েটাকে দেখে জাফরিনের কেন যেন ভয় হয়।তার গায়ে থাকা কোর্ট দেখে মনে হয় করপোরেট জগতের বিশেষ ব্যক্তি,যে অনেক কিছুই জানে। নিশ্চয়ই তার নির্দেশনায় চলে অনেকে। অথচ জাফরিনকে সে ম্যাম বলে ডাকাটা তার সমীচীন মনে হয় না।
অনুনয়ের সুরে বলা কথাটাও ফেলতে পারে না সে। তাই রাজি হয়ে যায় চেকাপের জন্য।জাফরিনকে নিয়ে একজন বিমানবালা কিছুটা দূরে বসতে বললে সে জানালার পাশে বসলো। খোলা আসমানের দিকে তাকিয়ে রইল সে।ঠিক সেই মুহুর্তে তার মনের অতীতের আসমানে ক্ষত-বিক্ষত পাখির মতোন উড়তে লাগলো তার বাবার স্মৃতি। আজ সে কাঁদতে পারবে, কেউ নেই তাকে দেখার মতোন। তার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই যে তাকে কাঁদতে দেখলে তার বোন কিংবা মা ভেঙ্গে পড়বে।
বাবার মৃত্যুর আটাশ দিন পর জাফরিন খুব করে কাঁদলো।দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে।আজ নিজেকে সত্যি এতিম লাগছে তার। মায়ের মুখ চাইলেও দেখতে পারবে না।দীর্ঘ সময় পর জাফরিন নিজেকে সামলে নিলো।তাকে শক্ত হতে হবে কারণ তার বাবার মৃত্যুর রহস্যটা তাকে জানতে হবে।বাবার সেই লাস্ট মেইল কেন এসেছিল?তাকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা অন্য একটা ডিভাইসে রেখে কেন দিতে বলেছিল তার বাবা?এরপর কেনোই বা ডিলিট হয়ে যায় জাফরিনের নিজস্ব সেই মেইল আইডিটা?
এতসব রহস্যের সমাধা করতেই জাফরিন এগিয়ে চলেছে এক অজানা গন্তব্যে। যেখানে তাকে দিন রাত পরিশ্রম করে শিখতে হবে বাবার সেই গুপ্ত পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে সে লুকিয়ে রেখেছে সকল তথ্য।
জাফরিন এটা অন্তত জানে যে তাকে পড়াতে নিয়ে আসার কথাটা নিছক বাহানা মাত্র।তারা তাকে একটা মাধ্যম হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে সেটাও জাফরিন বুঝতে পারছে। তারা ততদিন তার মাথার উপর হাত রাখবে যতদিন তার বাবার সেই ডকুমেন্টস না পায়। মেয়েটাকে তারা হালকা ভাবে নিয়ে চরম ভুলটা করে বসলো।তারা হয়তো বুঝতেই পারেনি জাফরিনকে তারা নিয়ে যাচ্ছে না বরঙ জাফরিন নিজে যাচ্ছে তাদের সাথে।তার বাবার মৃত্যুর রহস্যটা জানবার জন্য।কারণ তাদের সাথে একই কাঁদায় মাখামাখি না হলে যে কাঁদার ভিরতে ডেবে থাকা সেই সূঁচ টা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দুচোখ মুছে, মুখ মুছে সামনে থাকাতেই জাফরিন দেখতে পেল ডাক্তার বসে আছে। তারা চেকাপ করে জানালের ঠিক আছে সে। চলে যাওয়ার পর কিছুটা গা এলিয়ে দিলো মেয়েটা।ক্লান্ত লাগছে তার ভীষণ। দু চোখ ভর করে নেমে এলো ঘুমের প্রজাপতি।সেই সময় জাফরিন অনুভব করতে লাগলো সেদিনের চেনা গন্ধটা। যে গন্ধটা তাকে রাত জাগতে বাধ্য করেছিল।তার মনে হতে লাগলো ধীরে ধীরে হালকা সুগন্ধিযুক্ত ফিনফিনে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তার ঠোঁটে, চোখে, গালে কিংবা শরীরে। খুব করে চাইলো দু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে কিন্তু দুটো চোখ তার সাথে প্রতারণা করে তাকে নিয়ে গেল গভীর ঘুমের উপবনে।
(৪৯)
মেয়ে চলে যাওয়ার পর বাড়ির জন্য মন কেমন করছিল জাফরিনের মায়ের।এই সময়টা তার ইদ্দত পালনের ছিল।কিন্তু নিজের অংশ মেয়েটা দেশ ছেড়ে চলে গেল বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সে। আজ পুনরায় বাড়িতে ফিরে এলো।আসার সময় নাতীনাতকুরদের সাথে করে নিয়ে এসেছে। বড় মেয়ের ঘরের ছেলেটা তার কাছেই থাকবে কয়েক মাস। সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা।নিজ থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে আসা। কারণ জেমি আজ সকালে কল।দিয়ে তার শাশুড়ির ব্যাপারে সবটা বলেছে। এটা শোনার পর সে কিছুই জবাব দিতে পারেনি।সে বলেনি ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আয়, তোর বাবা বাড়ি দিয়ে গেছেন, সেখানে উঠ।
সে বলেছে,
“মা, তোমার সংসার।তুমি ভুল বুঝতে পেরেছো অথচ আর কয়েকটা ঘন্টা আগে বুঝতে পারলে না।তাহলে হয়তো আমার ছোটো মেয়েটা এক বুক হতাশা নিয়ে যেত না।তুমি জানো না মা,আমার মেয়েটা তোমার পথ চেয়ে বসেছিল।”
মায়ের এমন কথা শুনে দু চোখ ভিজে এলো তার৷ জেমি কিছুই বলতে পারলো না।শুধু অনুনয়ের সুরে মাকে বলল,
“মা ছেলেটার পড়া হচ্ছে না এ বাড়িতে।তোমার কাছে রাখবে?”
“জিজ্ঞেস করতে হবে না।তুমি ওকে পাঠিয়ে দাও, আমি আজ
বাড়ি ফিরবো।”
বাড়ি ফিরেই এক সমস্যার সম্মুখীন হলেন তিনি।যোহরের ওয়াক্তে জিলেপী কিনে মসজিদে মিলাদ পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।সেই জিলেপী জাফরিনের চাচাদের হাতে দিতেই তারা কেউ হাতে নিলো তো নিলোই না উল্টো দুটো কথা শুনিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“জুতো মেরে গরু দান করার কোনো দরকার নেই।একবার মেয়েকে দিয়ে অপমান করাও আবার নিজে আসো?”
“আপনারা আমার বড়, আপনাদের সাথে কিসের অপমান?”
“ছোটোর নামে থানায় মামলা দেওনি?আবার আসছো পিরিত দেখাইতে?”
“আমার মেয়েকে মারার চেষ্টা করছে সে। আপনি তো বড় চাচা, আপনি একটা বার গিয়ে দেখতেন কেমন আছে আমাত মেয়েটা?”
“তোমরা আমাদের কোনো কথা শুনছো?যে তোমাদের কথা আমাদের শুনতে হবে?আমার ভাইরে চুইষা খাইছো।সব করে দিছি রক্ত ঘাম করা পরিশ্রম দিয়ে এখন বসে বসে খাইতেছো।আমাদের হক নষ্ট করে।”
“আপনাদের হক নষ্ট করিনি।আর এই কথাটা আগেও একদিন বলেছেন, সেদিন ও জবাব পেয়েছেন।আজকেও দিচ্ছি। স্বামীর ইনকাম খাওয়াটা তাকে চুষে খাওয়া বলে না।সে আমার স্বামী ছিল আমি তার দায়িত্ব ছিলাম।ভবিষ্যতে আমার সাথে কথা বলতে এলে সাবধানে বলবেন।আর এমন কোনো কথা বলবেন না যেন আপনাকে সম্মান দিতে আমার দুই বার ভাবতে হয়।”
(৫০)
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জাফরিন পৌঁছেছে তার গন্তব্যে। এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে দম বন্ধ করা শ্বাস নিলো সে। যেন এই মাটিতে সে শ্বাস নিতে চাইছে না।এমিলি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় পর ইউভানের সেই পরিচিত লোক এসে তাকে এই দেশের একটা ব্যাংক কার্ড এবং কিছু ক্যাশ দিয়ে গেল।জাফরিন ধন্যবাদ জানাতেই এমিলি এসে বলল,
“ম্যাম, আপনার থাকার ব্যবস্থাটা আপনার বাবার ব্যক্তিগত ফ্ল্যাটেই করা হয়েছে। ওটার মালিকানা আপনার নামেই ছিল।আমি সে অবধি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
জাফরিন সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে চলল তার সাথে।ছিমছাম করে গোছানো রয়েছে ফ্ল্যাটটা।চাবি বুঝিয়ে দিয়ে এমিলি চলে যাওয়ার পর জাফরিন বসে রইল কাউচে। তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো কীভাবে কই বসে তার বাবা তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতো। ওই যে রান্নাঘরটা সেখানে দাঁড়িয়ে রান্না করতো।এসবের মাঝে রয়েছে তার বাবার স্পর্শ। একটা কুশন বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা।ঠিক সেই মুহুর্তে সে অনুভব করলো তার চোখের পানিতে কুশনের ভেজা অংশে কিছু লেখা ভেসে উঠেছে। তার বুঝতে বাকী রইল না। সে দ্রুত লবণাক্ত পানিতে দিয়ে কুশন ভেজাতেই দেখতে পেল স্পষ্ট লেখা,
“জাফরিন, মা তুমি যদি এখানে এসে থাকো তবে আমি এত দিনে মৃত।মনে রেখো তোমার আশেপাশেই রয়েছে সব কিন্তু তাদের হাতে লাগতে দিও না।কারণ পেয়ে গেলে তোমাকেও বাঁচতে দিবে না।”
চলবে…………….