ক্যামেলিয়া .
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ২৬
“আমি! আমিহ্, আমিহ্ সব সময় তোমাকে রক্ষা করবো।কখনো তোমাকেহ্ দূরে যেতে দিব না।যাই হয়ে যাক না কেন?ক্যামেলিয়া!চোখ তুলে তাকাও ক্যামেলিয়া?দেখো কিছুই হয় নি।”
কথাগুলো বলে দ্রুত পানির ছিঁটেফোঁটা দিতে লাগলো জাফরিনের মুখে মাশহুদ।স্থানীয় পুলিশ এসে পৌঁছেছে, মেডিকেল টিমটা আসতে কেন দেরি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না।ছোটো বেলায় গ্রানিকে দেখেছিল একবার।বাসার এক সার্ভেন্ট হুট করে সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল, তার চোখে মুখে পানি দেওয়ার পর সে জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল।কিন্তু জাফরিন কেন পাচ্ছে না?সাদা শার্টের একটা কোণা দিয়ে চুইয়ে পড়া রক্ত মুছে দিলো সে। দীঘির জলের মতোন স্থির,শান্ত দক্ষিণে হাওয়ার মতোন মোলায়েম, কিংবা চাঁদের আলোর মতোন নরম তুলতুলে স্বভাবের মাশহুদের এতোটা অস্থিরতা দেখে ঘাবড়ে গেল এমিলি।কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন জ্ঞান ফিরলো না তখন জাফরিনকে কোলে তুলে নিয়ে ছুট লাগালো সে। লিফটের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল কুঞ্জ সাথে মেডিক্যাল টিম।স্ট্রেচারে আর শুইয়ে দিলো না মেয়েটাকে। ওই অবস্থায় ছুটে এসে এম্বুল্যান্সের কাছে এলো তারা।বাতাসের পেট ফুড়ে চলতে লাগলো এম্বুল্যান্সটা।
জাফরিনের মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
“একজন কেউ ছাড়বো না।কাউকেই না।যে তোমার বাবাকে মেরেছে তাকেও না, আর যে তোমাকে আঘাত করেছে তাকেও না।শুধু একটা বার, শেষ বারের মতোন সুস্থ হয়ে ফিরে এসো।তোমাকে আমি হারতে দিবো না, তুমি নিজেও হেরে যেও না।”
জাফরিন আলগোছে হাতটা ছুঁয়ে দিলো মাশহুদের হাত।মাশহুদ কুঞ্জকে তাড়া দিয়ে বলল,
“কিল দো’স ব্লাডি বাস্টার্ড’স।”
কুঞ্জ তার কাধে হাত রেখে বলল,
“রিল্যাক্স হো,ওদের পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।”
কিছু সময় পূর্বে মাশহুদ যখন দেখতে পাচ্ছিলো তার চোখের সামনেই টেনে হিচড়ে নিয়ে গেল তিনজন জাফরিনকে। তারা টেনে নিয়ে তাকে জোর করে বসালো চেয়ারে।জাফরিনের শরীর থেকেই তার ওড়না টেনে নিয়ে বেধেছিল হাত।ছোট্ট বিড়াল ছানার মতোন ছটফট করতে থাকা জাফরিনের দিকে তাকিয়েই রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে ছিল মাশহুদ।একই বিল্ডিংয়ে ছিল সে।এই বিল্ডিংটা মূলত তাদের কোম্পানির অধীনস্থ উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের জন্য।এখানে ব্যক্তিগত ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে থাকে সে। আজও ছিল তাই খুব একটা দেরি হওয়ার পূর্বেই সে পৌঁছেছিল।যারা জাফরিনকে জেরা করছিল তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।মিনিট দুয়ের মাথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে। আশেপাশে থাকা জিনিস তছনছ করেও কিছু পায়নি।মাঝে সময় লেগেছিল মাত্র চার মিনিট। মাশহুদের এপার্টমেন্ট ছিল পনেরো তলায়, জাফরিন ছিল সাত তলাতে।লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল কিন্তু মাশহুদের দেরি করার সময় ছিল না বলেই সিড়ি হয়ে আসতে হয়েছে তাকে।ততক্ষণে যারা ঘরে গিয়েছিল তারা বের হতে চাইলেও বের হতে পারেনি।কারণ বের হওয়ার জন্য তারা যখন জাফরিনের ফিংগার প্রিন্টেও কাজ করলো না তখন কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল তারা।সেই মুহুর্তে পুলিশ অফিসার সমেত প্রবেশ করে মাশহুদ।কারণ জাফরিনের নিরাপত্তার জন্য লিগ্যালভাবে কিছু পুলিশের ব্যবস্থা করার কথা হয়েছিল আজ তার। তারাই দ্রুত চলে এসেছে ঘটনা স্থলে।জাফরিনকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা আততায়ীর দল তাকে ফেলেই চলে যাচ্ছিল। একজন অবস্থা বেগতিক দেখে দেখে একজন জাফরিনের গলায় ছুড়ি ধরে ভয় দেখালেও শেষ অবধি তাদের হার মানতে হয়।এরপর তারা কী করেছে? তাদের কি হয়েছে সে সম্পর্কে তার কিছুই জানা নেই। সে ছুটেছে তার ক্যামেলিয়ার কাছে।
(৫৭)
আঘাতটা খুব বেশি লাগেনি।বাহিরের চামড়াটা কেটে গিয়েই ব্লিডিং হয়েছে মেয়েটার। কিছু সময় পূর্বে দীর্ঘ সময় ঘুমানো এবং কিছু মেডিসিন এর কারণে এমন হয়েছে। এছাড়াএ আরো একটা কারণ রয়েছে সেটা হলো জাফরিনের ভয়। সে ভয় পেয়েছিল আর তার মস্তিষ্ক এতোটা চাপ নিতে পারেনি বলেও এমনটা হয়েছে। তবে নিউরো সার্জারী বিশেষজ্ঞ বিষয়টা শুনে বললেন,
“কিছু পরীক্ষা করিয়ে ফেলুন।আপনি যেহেতু রিস্ক নিতে চাচ্ছেন না।আর হ্যাঁ এই সময় সাথে সাথে হাতের চিকিৎসাটাও করিয়ে নিন।”
“অবশ্যই।”
জাফরিনকে কেবিনে শিফট করা হলে তার পাশে পুরো রাত বসেছিল মাশহুদ।এই সময়টাতেই সে কথা বলেছে লোকাল থানায়।পুলিশ জানিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে তারা বলেছে তাদের এই কাজের জন্য পেমেন্ট করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছিল মেয়েটাকে কিছু প্রশ্ন করতে এবং সে যদি ঠিকঠাক জবাব না দেয় তবে তাকে তুলে নিয়ে আসতে।যেহেতু বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি অনেক কড়া তাই তারা তিনজন তিনটে ফ্ল্যাটে ফুড ডেলিভারি বয় হিসেবে প্রবেশ করে।এরপর জাফরিনের কাছে যায়।জাফরিন সম্পর্কে তারা কেবল এটুক জানে, মেয়েটা এদেশী নয়।যে দেশ থেকে এসেছে, সে দেশের মানুষকে ইমোশনালী দ্রুত কনভেন্স করা যায়।মানে তাকে যদি বলা হয় তার চাকরি চলে যাবে বা সে খুব অসহায় তবে সে দরজা খুলে দিবে।হয়েছেও ঠিক এমনি জাফরিন দরজা খুলে দিয়েছিল।তবে জ্ঞান হারানোর পর তারা তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি।মেইন ডোর লক করা ছিল যেটা খুলছিল না।
“কারা পাঠিয়েছিল ওদের?”
“তেমন কিছুই জানা যায়নি।তবে হ্যাঁ কোনো একজন শাড়ি পরিহিতা মহিলা তাদের পেমেন্ট করেছিল।”
“শাড়ি?”
“হ্যাঁ।আমরা তিন জন তাদের আলাদা আলাদা স্টেটমেন্ট নিয়েছি।তিন জনেই একই কথা বলেছে। খোলা চুলের শাড়ি পরা কেউ একজন তাদের টাকা পেমেন্ট করেছে।”
“অফিসার, আপনি কি তাদের দিয়ে আমাকে একটা স্কেচ করিয়ে দিতে পারবেন?”
“অলরেডি আমরা তৈরী করে ফেলেছি।তদন্ত চলছে।সিসিটিভি ফুটেজ ও চেক করা হচ্ছে।তবে সমস্যা হচ্ছে যে এসেছিল তার মুখ কেউ দেখতে পায়নি।পিছন দিক এবং সাইড থেকে দেখা যাচ্ছে।আশ্চর্য হচ্ছে তাকে সিসিটিভিতেও একই ভাবে দেখা যাচ্ছে।যে এসেছিল সে অবশ্যই একটা ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিয়ে এসেছিল।সে আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলায় নামতে চাইছে। কারণ নিজেকে সামনে এনেও শেষমেশ লুকিয়েই কিন্তু রেখেছে সে।”
“ধন্যবাদ। আপনি কী দয়াকরে আমাকে স্কেচ টা মেইল করে দিবেন?”
“অবশ্যই, অহ হ্যাঁ মি.মাশহুদ। আরো একটি কথা, আপনার কী আইনী নিরাপত্তা লাগবে?আপনি চাইলে আমরা প্রোভাইড করতে পারি।”
“আপাতত আর প্রয়োজন নেই।আমি এজেন্সি থেকে বডিগার্ড হায়ার করেছি।আপনি কেবল এর পিছনের মানুষটাকে সামনে আনার ব্যবস্থা করুন।”
“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”
“আরো একটি কথা,এসবের কিছু আপাতত গোপন রাখবেন।আমার পরিবার যেন না জানতে পারে।তাছাড়া মেয়েটার লাইফের ব্যাপার।”
“চিন্তা করবেন না।মিডিয়া অবধি পৌঁছাবে না।”
পুনরায় ধন্যবাদ দিয়ে কল কেটে দিলো।কিন্তু এই মুহুর্তে
অফিসারের কথা শুনে কিছুটা গম্ভীর হলো মাশহুদ। এই দেশে শাড়ি পরা কেউ?এতোটা স্বাভাবিক বিষয় নয়।সে বুঝতে পারলো যে জাফরিনকে নিয়ে এসব প্ল্যান করছে সে জাফরিন এবং তার সম্পর্কে সবটা জেনেই খেলায় নেমেছে। ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে নিয়ে সে দেখতে পেল জাফরিনের মৃদু নড়াচড়া। তার পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত রেখে শান্ত স্বরে ডাকলো,
“জাফরিন।”
শান্ত, গভীর স্বর শুনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চোখ মেলে তাকালো সে।এই মুহূর্তে কাকে দেখছে, কে তার সামনে বসে আছে কিছুই জানে না মেয়েটা।কিন্তু বুঝতে পারলো তার মাথায় রাখা হাতটা একটা ভরসার হাত। অন্য যে হাতটা তার হাত ধরেছে সেই হাতটা তাকে শক্তি দিচ্ছে, সাহস দিচ্ছে। সামনে বসে থাকা গভীর কৃষ্ণ বর্ণের পিউপিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখ দুটো যেন চকচক করছে। অপর হাতটা তার গালে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কে আপনি?আপনাকে আমার এতো আপন লাগছে কেন?”
বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা।তার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু সময়ের মাঝে তাকে শান্ত করে নিয়ে মাশহুদ সবে মাত্র ফোনে আসা মেইলটা চেক করলো।স্কেচের দিকে তাকিয়ে সে বিস্ময় দৃষ্টিতে মনে মনে বলল,
“সুচিত্রা?”
চলবে…..