#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৩৩
এই ছোটো এক জীবনে কারোর কারোর সাথে দেখা না হওয়াটাই বোধ হয় ভালো হতো।কেননা তাদের সাথে একটু দেখা, সময় কাটানো হুট করেই আমাদের অভ্যসে পরিণত হয়ে যায়।এরপর বাকী জীবনটা কেটে যায় এক অসহনীয় প্রতিক্ষা নিয়ে।বিলবোর্ডে নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে নানান ধরনের কথা ভাবছিল জেসমিন আরা।এই শহরে সবাই তাকে জ্যাস বলেই চিনে।চার দিকে তার রূপের প্রসংশা অপর দিকে রয়েল’স মুন এর কসমেটিকস শাখার ব্রান্ড এম্বাসাডর সে।এদিকটা মাশহুদ নিজে সামলায় না।বড়জোড় খুব প্রয়োজন পড়লে বিদেশী বায়ারদের সাথে মিটিংয়ে থাকে। কিন্তু এই মুহুর্তে জ্যাস তাকে ডেকেছে অন্য একটা কারণে।কোম্পানিতে তাদের একত্রে এই গভীর রাতে মিটিং করা নিয়ে কানাঘুষা চলে কিন্তু জ্যাসের সময় কই এই রাত ছাড়া?
মাশহুদের দাদার লাল রঙের প্রতি আলাদা একটা মোহ কাজ করে।কেন করতো সেটা এখন মাশহুদ জানে।প্রথম স্ত্রীর লাল রঙ ভীষণ প্রিয়। দাদা মাঝে মধ্যে বলতেন,
নারী যখন লজ্জায় লাল রঙা হয়ে যায় তখন তার কোনো প্রসাধনীর প্রয়োজন হয় না। সেই লাল রঙ হয় গোলাপের থেকেও কোমল।এই কোমল গোলাপের রঙ কেমন হয় সেটা জানতে চাইতো গ্র্যানি।আর এটার হাত ধরেই এই কসমেটিক শাখার পথ চলা শুরু। জ্যাস সম্পর্কে মাশহুদের চাচাতো বোন।আপন নয়, মাশহুদের দাদা যুদ্ধের পর পর তার দেশ থেকে নিয়ে আসেন তার চাচাতো ভাইকে।একটা চিঠিতে সে জানিয়েছিল যুদ্ধের সময় গ্রামের সব শেষ হয়ে গেছে।কেউ বেঁচে নেই।সে নিজেই কত রাত ঘুমিয়েছে কাঁদা পানিতে কিংবা কেবল নাক ডুবিয়ে ভেসে থেকেছে লাশের সাথে।যুদ্ধটা সব শেষ করে দিলো।ভদ্রলোকের প্রথম স্ত্রী লেখাপড়া জানতেন না তাই চিঠিপত্র সব যেত তার চাচাতো ভাইয়ের কাছেই।সেই আবার ফিরতি চিঠি লিখে জানাতো। স্ত্রী বলে দিতো আর সব সে লিখে দিতো।যুদ্ধে কেবলমাত্র পরিবারের একজন বেঁচে আছে এটা শুনে তাকে এ দেশে নিয়ে এসেছিল মাশহুদের দাদা।নিজের সাথে ব্যবসায়িক কাজে সাহায্য করতো। এখানেই এক অফিসের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিল তার। এরপর থেকে তারাও এই দেশের বাসিন্দা হয়ে আছে। সেই ভদ্রলোকের নাতনী জ্যাস।বয়স বাইশের এক অসম্ভব সুন্দরী রমনী।যার দেহের ভাঁজ শত পুরুষের উন্মাদনার কারণ।বিলবোর্ডে থাকা আবেদনময়ী ছবিগুলোর কারণে যে তাদের কসমেটিক প্রডাক্ট বিক্রি হু হু করে বাড়তেছিল এটা বুঝতে বাকী ছিল না কারোর।তবে জ্যাস সিংগেল মাদার।খুব অল্প বয়সেই মা হয়েছে সে।তার বছর পাঁচের এক ছেলে রয়েছে। যে ছেলেটা মাশহুদ বলতে পাগল।অধিকাংশ সময় জ্যাস তার ছেলে ইনায়াতকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে মাশহুদের সাথে দেখা করার জন্য।মাশহুদ একবার তার দাদাকে বলেছিল,
“একজন নারীর সাথে তার বাবা, ভাই এবং স্বামীর সম্মান জড়িত থাকে।এই যে জেসমিনের পেশাটা,অনেকটা নিজের শরীর দেখানোর মতই।এর কারণে কি তাদের সম্মানে লাগছে না?”
কিন্তু তার সেই কথাটা কেউ পাত্তা দেয় নি।তাদের মতে মাশহুদ অনেকটা পসেসিভ ধরনের মানুষ।ছোটো বেলায় তার মা তাকে ছেড়ে চলে গেল বলেই সে এমন হয়েছে। নারীদের অগ্রগতি তার খুব একটা পছন্দ নয় কিংবা সে চায় না কেউ উন্নতি করুক এমন অনেক কথা তার চাচার পরিবার থেকে তাকে বলা হয়েছিল।কিন্তু ঠিক সতেরো বছর বয়সে যখন জেসমিন বাচ্চা জন্ম দিল সেদিন মাশহুদ যায়নি তাকে দেখতে।মাশহুদের তো বরাবর পছন্দ একটু নাজুক ধরনের মেয়ে।যে মেয়েকে স্পর্শ করলে পুরো স্পর্শ সুগন্ধীতে ভরে যাবে।ফুলের মতোন নাজুক কিন্তু তার সৌরভের মতো স্পষ্টভাষী।নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হয় না তাকে সবাই যেমন বুঝে। জ্যাস আজ তাকে ডেকেছিল আগামীকালের অনুষ্ঠানের জন্য।দাদা দাদীর বিবাহ দিবস।এই বছর তাদের বিবাহের বয়স ৫০ পূর্ণ হতে চলেছে।কী উপহার দেওয়া যায় এটা নিয়েই তাকে ডাকা।
“সামান্য একটা উপহারের জন্য এভাবে ডেকে না আনলেও হতো।এমিলিকে বলতে পারতে।”
“ইনায়াতের জ্বর।তোমাকে দেখতে চেয়েছিল।”
“এত রাতে ও নিশ্চয়ই ঘুমিয়েছে।যাই হোক বাকী কাজ তুমি সামলে নিও।আমার কাজ আছে ফিরতে হবে।”
“কোথায় ফিরবে?চল যেতে যেতে কথা হবে।”
“আমি কোথায় যাচ্ছি।”
“তবে বলো যেতে হবে।এভাবে বলছিলে মনে হচ্ছে কেউ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে আর তুমি এই সময় না ফিরলে সে অভিমান করবে।”
মাশহুদ থমকালো।কিছুটা নিভে গেল তার ফিরে যাওয়ার উদ্দীপনা।হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল,
“সত্যি কি সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে?না ফিরলে অভিমান করবে?”
নিজেকে ধাতস্থ করে সে হাসলো।কেমন দাম্ভিকতা সে হাসিতে।শক্ত চোয়ালে, নাক ফুলিয়ে হাসে সে।ঠোঁটের একটা পাশ প্রসারিত করে।টাইয়ের নব ঢিলে করে সে বলল,
“কেউ কি কারোর জন্য অপেক্ষা করে?আমি যদি কাউকে অপেক্ষা করিয়ে থাকি সেটা আমি নিজেই।নিজের শান্তির জন্য কেউ কেউ কারোর কারোর কাছে ছুটে যায়।কারণ দিন শেষে আমরা সবাই নিজেকে শান্তি দিতে চাই।আর সে আমার সব ক্লান্তির প্রশান্তি।”
“ক্যামেলিয়া?নিশ্চয়ই তোমার ক্যামেলিয়া ফুটেছে।বাগানের সব ফুটেছে?”
মাশহুদ কিছু জবাব দেয় না।সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।হাসপাতালে পৌঁছেই সে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে।ইনায়াতের শারিরীক অবস্থা জানার জন্য।তার শরীরে রক্ত স্বল্পতা রয়েছে,যখন হিমোগ্লোবিন কমে যায় বাচ্চাটার জ্বর আসে।জন্মের পূর্বে মায়ের বেহায়াপনার জীবন,নিয়মিত ড্রিংক্স এবং স্মোক করার কারণে নানান শারীরিক জটিলতা নিয়ে জন্ম নিয়েছে বাচ্চাটা। এই বাচ্চাটার জন্য মাশহুদের মায়া হয়। কেন?যখন জেসমিন তাকে ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায় শ্যুটের জন্য তখন ইনায়াতের কান্নারত মুখটা তার ছোটো বেলাটা মনে করিয়ে দেয়।কেন এমন হতে হবে?পৃথিবীতে তো আরো অনেক মা আছে যারা কাজ এবং ঘর দুটোই সামলে চলেছে। তবে তার আশেপাশের নারীগুলো এমন কেন?ক্যারিয়ারের জন্য কেন ঘরটাকেই ছাড়তে চায়? অথচ বঙ্গদেশের নারী গুলোর মাঝে কতো মায়া। বঙ্গনারীরা মায়ায় পড়েই পুরো জীবনটা আগলে রাখে পরিবারকে।এতো মায়া তারা কোথায় পায়?
কেবিনে প্রবেশ করার পর দেখল জাফরিন ঘুমিয়ে আছে।বেরিয়ে যাবে সেই মুহুর্তে জাফরিন জিজ্ঞেস করল,
“আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”
মাশহুদ ফিরে এলো।জাফরিনের মুখোমুখি বসলো না।ওয়াশরুম থেকে হাত মুখে পানি দিয়ে এসে বসলো কাউচের উপর।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে জাফরিন।এমন সময় মাশহুদের মুখে ফুটে উঠেছে হাসিটা।দৃষ্টিতে দৃষ্টিতে দ্বিতীয় বার মিল হলো তাদের।ওই চোখের দিকে তাকিয়ে জাফরিনের কী হলো সে বুঝলো না।তার মনে হচ্ছিলো সে তাকিয়ে দেখতে অসীম নীল আকাশ কিংবা গভীর সমুদ্র।তাকে বিভ্রম করে দিচ্ছে এই দুই চোখ। মায়া জিনিসটা তার নেই, এক জীবনে সে সব মায়া দিয়ে দিয়েছে ঈশানকে। এই চোখের দিকে তাকিয়ে তার যে অনুভূতি হলো সেটা হলো ভয়। নিজের অস্তিত্বকে ভুলে বসবার এক বেশুমার ভয়।
“বলুন।”
“আপনি কেন আমার বাবার লাশের সাথে গিয়েছিলেন?”
“আমি যাই নি।”
“আপনি গিয়েছিলেন।আপনার এই দুই চোখ, গায়ের গন্ধ সবটা আমার পরিচিত।”
“তাহলে গিয়েছিলাম।”
“আমাকে এতো যত্নের কারণ জানতে পারি?”
“কোনো কারণ ছাড়াই যত্ন করি।”
কথাগুলো বলতে বলতে মাশহুদ নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকালো।ধ্বিক করে জ্বলে উঠলো জাফরিন।এতো দিন সে যা খুঁজছিল সেটার উত্তর তার সামনেই রয়েছে। তার সামনে বসে থাকা মানুষটা নিজেও জানে না যে সকল প্রশ্নের জবাব রয়েছে তার নিজের কাছেই।
চলবে.