#ক্যামেলিয়া পর্ব ৭
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৭
(১৯)
একটা নতুন ভোর।এই ভোরের অপেক্ষায় জাফরিনের তথাকথিত আত্মীয়রা। কারণ আজ রাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে জাফরিনের ভবিষ্যৎ এবং তার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির।
সকাল বেলার নাস্তার পর পর একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে সবাই।দুই দুলাভাই কোনো ভাবেই জাফরিন এবং সুফিয়া বেগমকে রেখে যেতে চাইছে না।কিন্তু এখন তাদের পক্ষে থেকে যাওয়াটাও সম্ভব নয়। মা ভক্ত মায়ানের পরীক্ষা আর মেঝ আপার স্কুলে গিয়ে ছুটি বাড়াতে হবে। শোকের মাঝেও জীবন কে আপন ছন্দে চলতে হয়। এটাই জীবনের নিয়ম।জাফরিনেএ
মামারা চলে যাওয়ার পূর্বে সুফিয়া বেগমকে তার ছোটো ভাই বললেন,
“আপা বুঝে থাকছিস তো এইখানে?আমি কিন্তু এই বাড়ির মানুষ বিশ্বাস করি না।”
“আরে চিন্তা করিস না।ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলে কেউ কি করবে?”
“তুই একটা যুবতি মেয়ে নিয়ে থাকবি।এটা ভুলে যাচ্ছিস কেন? শহরে চল যাই। আমাদের বাসায় দিন কয়েক থাকলে সমস্যা কী?তাছাড়া দু দিন পর তোদের এমনিতেও যেতে হবে। মন্ত্রণালয়ে তোদের প্রয়োজন হবে। তাছাড়া এখানে থাকা কি খুব দরকার?”
” আমি যে প্রতি দিন এতিম খানায় খাবার পাঠাতে চেয়েছি নিজ হাতে রান্না করে।”
“আপারে, তুই মেয়ে নিয়ে থাকবি।এই দুই দিনে তো দেখেছিস তোর মেয়ের ভালো কত মানুষ চায়। কেমন ভালো তারা চায়। তোদের মেয়েটা রাগী স্বভাবের, যদি রিয়্যাক্ট করে বসে?”
” এটা আমিও ভাবতেছি।মেয়ে মানুষ তো, বদনাম বের করতে সময় লাগবে না।”
“একবার, মাত্র একবার ভেবে দেখ।তোদের বাড়ির আশেপাশে থেকেও যদি কোনো ছেলেকে রাতের বেলা যেতে দেখে তাহলে তোর মেয়ের চরিত্রে দাগ লাগাতে ভাববে না তার চাচা ফুপুরা।”
কথাটা শুনে চমকে উঠেছে সুফিয়া বেগম।তিনি এবার ছোটো ভাইয়ের কথায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।এমনটা এই এলাকায় প্রথম হচ্ছে যে তা নয়। এর পূর্বেও অরিত্রী নামের এক মেয়েকে এই ভাবেই সমাজের মানুষের সামনে হেনস্থা করেছিল সবাই।
দুটো ফাকা ঢোক গিলে সে মেয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“জাফরিন তুমি তোমার বড় আপার সাথে যাবে? না মামার সাথে?”
“আম্মা, আপনাকে রেখে আমি কই যাবো?আপনি কী একা থাকবেন?”
“সমস্যা নেই, তোমার ফুপুরা আছে। তাদের সাথে রাত থাকতে পারবো।”
“আপনার শরীর ভালো না আম্মা।আর ইনসুলিন কেমন করবেন?”
“তুমি এখানে থাকা নিরাপদ না।”
কথার মাঝে ইউভান এগিয়ে এসে বলল,
“ফুপু এত চিন্তার কিছুই নেই। ছোটো চাচা যা বলেছে আর আপনি যা ভাবছেন এমন কখনোই হবে না। দেশে আইন কানুন বলেও কিছু আছে। আর তাছাড়া আল্লাহ্ আছেন। এতিমের উপর অন্যায় তিনি হতে দিবেন না।আপনি নিশ্চিত থাকুন।যা হবে ভালোই হবে।”
সবাই চলে যাওয়ার পর ও বাড়িতে যেন উৎসব শুরু করেছে। তারা মোটামুটি তৈরী তাদের প্ল্যান নিয়ে। এমনকি ফয়সাল কে বলা হলো আজ রাতে ফিরে আসার সময় যেন সে চুল দাঁড়ি কেটে আসে। আর জাফরিনের জন্য লাল শাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। কারণ তার বিয়ের শাড়ি তো গত দুদিন আগে আশাকেই দেওয়া হয়েছে। এবার তার জন্য হাজার খানেক টাকা দিয়ে একটা শাড়ি কিনে আনলেই হবে।
ঈশান এসব কিছু নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।সে এবার দুই মন দুই দশায় ভুগছে।
চাইলে সে জাফরিনের চূড়ান্ত ক্ষতি হতে দেখতে পারে আবার এই বিপদ থেকেও উদ্ধার করতে পারে।
(২০)
বাস্তব জীবনে কোনো শেহজাদা থাকে না। যারা গোড়ায় চড়ে শাহজাদীকে বাঁচাতে আসবে কোনো এক দুষ্ট রাক্ষস থেকে।তরবারি হাতে যুদ্ধে নেমে যাবে এবং যুদ্ধে জয়ী হয়ে, শ্বেত রঙা ঘোড়ায় করে শাহজাদী কে নিয়ে পাড়ি দিবে অচিন পুরে।
কিংবা কোনো এই যাদু বলে কাটিয়ে দিবে সকল বিপদ।
বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। আমাদের চিন্তাভাবনার থেকেও ভয়াবহ রকমের কঠিন হয় বাস্তবতা।
ট্রেড মিলে দৌড়াতে থাকা অবস্থায় মাশুহুদ জানতে পারলো জাফরিন দের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য পরিকল্পনা। সবটা শুনে তার কাজ কিংবা অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হলো বলে বুঝা গেল না। নির্দিষ্ট সময় পর সে ট্রেড মিল থেকে নেমে দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো।এবার তার দেখার পালা এই মেয়েটা কতটা কঠিন মনের অধিকারী। যে মেয়ে এত কিছু সহ্য করেছে, সেই মেয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে।
জাফরিনের আগামীকাল শুধু তার নিজের নয়, অপেক্ষা করছে মাশহুদের ভবিষ্যৎ।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে সে জানিয়ে দিলো সকল প্রকার আপডেট যেন তাকে নিয়মিত দেওয়া হয়।
নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে রাতের আধার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল মাশহুদ। আকাশে মেঘেদের আনাগোনা লেগেই আছে। সেই মেঘ গুলো একত্র হয়ে যেন একটা মুখচ্ছবির আল্পনা আঁকছে। হুট করেই মনে হলো তার চার পাশে ক্যামেলিয়া ফুলের গন্ধে ভরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তার অস্বস্তি হতে লাগলো।সে দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে রইল ব্যালকনিতে। তার চোখের সামনে হুট করেই দৃশ্য পরিবর্তন হতে লাগলো।সে নিজেকে আবিষ্কার করতে লাগলো এক মরুভূমিতে। যে খানে সে ব্যতীত কেউ নেই।তবে এটাই কী মৃত্যু? এটাই কী তার জীবনের শেষ সময়?
দীর্ঘ সময় পর তার ঘোর কাটলো ফোনের শব্দে।নিজেকে ধাতস্থ করলো ফ্লোরে৷ ঘামে তার পুরো শরীর জবজব করছে। তার আবারো এট্যাক হয়েছিল তবে? সে এবার তার হাতের কাজ দ্রুত শেষ করতে চায়। আগামীকালের ভোর যে অনেক কিছুই বদলে দিবে।ঠিক সে সময় তার মেইলে আসা জাফরিন এবং তার কম্পিউটারের স্ক্রীনের ছবি দেখে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো তার চোখে মুখে।
(২১)
নিজেকে কঠিন, আবেগহীন এবং নির্ভয় প্রমাণ করা জাফরিন একাকী ঘরে একবারে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিল সে। কোনো একটা কারণে সে নিজের ফোন ব্যবহার করছে না।কারণ হচ্ছে তার অতীত। হলুদের ছবি, বিয়ের বেনারসি পরা ছবি তাছাড়াও রয়েছে ঈশানের সাথে থাকা ছবিগুলো।ছবিগুলো ডিলিট করলেই হয়ে যাবে কিন্তু জাফরিনের বার বার মনে হচ্ছে ছবিগুলো দেখলেই তার ভিতরে বইতে থাকা ঝড়ে সব এলোমেলো না হয়ে যায়!
ল্যাপটপ অন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় লগিন করতেই দেখতে পেল তার বাবার মৃত্যুর ঠিক পনেরো মিনিট পূর্বে তার বাবা কিছু ডকুমেন্টস তাকে পাঠিয়েছে। কিছু পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে ফাইলের। তাছাড়া তার বাবা নিজের সোশ্যাল একাউন্ট এর তথ্য দিয়েছে সে।
এসব কিছু দেখে তার বেশ কৌতুহল জাগলো।তার বাবা হুট করেই তাকে এসব কেন পাঠিয়েছে? বিছানা ছেড়ে উঠে জাফরিন প্রথমে এক মগ কফি নিয়ে বসলো।ধীরে ধীরে রাতের আধার নেমে আসছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই।সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার বাবার রেখে যাওয়া এক ধাঁধার সমাধানে। তার বাবা আর্কিটেকচার ছিলেন, কিন্তু তার শখ ছিল কম্পিউটার এর কোডিং নিয়ে৷ সে সহজ ভাষা কোডিং গুলোর মাধ্যমে লিখতেন যেটা অন্যের পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। জাফরিন এসব বুঝে না তবুও চেষ্টা করছিল।না পেরে বিরক্ত হয়ে তার বাবার আইডির ম্যাসেজ গুলো দেখার সময় ঈশানের সাথে কথোপকথন দেখে অবাক হয়ে গেল।
তাদের অগোচরে যে তার বাবা ঈশানকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে, মাত্র জাফরিনকে বিয়ে করার জন্য এটা তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। বিষয়টা ইউভানকে জানিয়েছে সে।
বিরক্ত হয়ে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজের ঘরের জানালা খুলে। পর দিন সকাল বেলা সেই ঘরের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল ফয়সাল কে। তার শরীরের কয়েক জায়গায় কারো নখ লেগেছে। ব্যক্তিগত মুহুর্তেই চিহ্ন হিসেবে প্রমাণ দিচ্ছে সেসব।
বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জাফরিন এবং তার মা বেরিয়ে এলেন।
ফয়সাল কে দেখে নিজ ওড়নায় মুখ ডাকলেন তিনি।তবে কী তার অবচেতন মনের সেই ভয় সত্যি হয়ে গেল?
চলবে ….