#ক্যামেলিয়া পর্ব ৮
#সাদিয়া_খান ( সুবাসিনী)
#পর্ব ৮
(২২)
সুফিয়া বেগম মিনতি করে চলেছেন সবার সামনে। নত স্বরে বার বার বলে চলেছেন তার মেয়েকে এত বড় অপবাদ যেন না দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে গ্রামের সকল মানুষ জমা হচ্ছে তাদের বাড়ির সামনে। কেউ তামাশা দেখতে এসেছে। আবার কেউ এসেছে বিচার করতে।ইতিমধ্যে গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। লোক পাঠানো হয়েছে মেম্বর সাহেবের বাড়িতেও।
জাফরিনের বড় চাচা এসে তার মা কে বলছে
“ভাই মরে নাই দুই দিন, আর এখনি তোরা আমার ভাইয়ের বাড়ি বাজারের বাড়ি বানায় নিছিস?”
জাফরিনদের বাড়ির সামনে এবং ভিতরে চলছে তুমুল ঝগড়া। মেয়েটার পক্ষ নিয়ে যে কথা বলতে এসেছে তাকেই কথা শোনাতে পিছপা হচ্ছে না কেউ।তবে জাফরিন?
জফরিন একদম চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভিতর মনে হচ্ছে না কোনো অনুভূতি কাজ করছে।
এক গ্রাম লোকের সামনে সে হুট করে এসে দাঁড়ালো ফয়সালের সামনে। চোখে চোখ রাখতেই মাথা নিচু করে দাঁড়ালো ছেলেটা।
জাফরিন তাকে শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি রাতে আমার সাথে ছিলেন?”
ফয়সাল দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো
“হ্যাঁ।”
“কোন ঘরে ছিলেন আপনি?”
“তোর ঘরে। তুই ভুলে গেছিস?”
“আপনি নিশ্চিত? আপনি আমার সাথে আমার ঘরে ছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“তবে তো আপনি আমার শিৎকারেও আমার সাথেই ছিলেন?আপনার গায়ে এসব দাগের কারণ ও নিশ্চয়ই আমি?”
” লোকে যখন জেনে গেছে তখন এসব লুকিয়ে রেখে লাভ কী?”
জাফরিন সজোড়ে থাপ্পর মারলো ফয়সালের গালে। বাড়িতে উপস্থিত মানুষের সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে৷ রাগে জাফরিনের শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো।ঠিক সেই সময় তাদের বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো জাফরিনের বড় মাম-মামী এবং এলাকার চেয়ারম্যান এবং তার স্ত্রী। চেয়ারম্যানকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়ালো।সুফিয়া বেগম জাফরিনকে টেনে এনে তার পাশে দাঁড় করাতেই জাফরিন চিৎকার করে বলল,
” ঠোঁট টেনে ছিড়ে ফেলবো আমার বাবা- মায়ের সম্পর্কে কেউ কিছু বললে। কুত্তার বাচ্চারা তোদের সাহস কী করে হয় আমার বাড়িতে এসে আমার বাবা মায়ের কথা এসব বলতে?”
জাফরিনের রাগ যেন হুট করেই বেড়ে গেল।সে পাশে পড়ে থাকা চ্যালা কাঠ নিয়ে এগিয়ে গেল ফয়সালের দিকে। ঠিক সেই সময় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ইউভানের গাড়ি।সে দৌড়ে এসে জাফরিনকে দু হাতে আগলে ধরে সরিয়ে নিয়ে এলো সেখান থেকে। জাফরিনকে উঁচু করে তুলে নিয়ে সে ঘরের ভিতরে রেখে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“বাপ রে! ইদানীং কী খাচ্ছিস রে তুই?আমার হাসফাস লাগছে এতটুকুতেই।”
“ভাইয়া তুমি দরজা খোলো। আজ ওর গুষ্টির কান্দে আমি যদি হাল না জুড়েছি তখন বলিও।”
“চুপচাপ বসে থাক।আমরা দেখছি।”
ইউভান তার বাবাকে যথেষ্ট ভয় পায় তবুও নিজেকে দমিয়ে না রাখতে পেরে সে বলল,
” আমি বলেছিলাম আপনাদের। এবার বিশ্বাস হলো?আমি থানায় কল দিয়েছি পুলিশ আসছে।”
এবার পরিবর্তন লক্ষ করা গেল জাফরিনের চাচাদের মধ্যে। তারা এগিয়ে এসে বলল,
“ওদের মধ্যে যা হওয়ার হয়েছে। জাফরিন যেমন আমাদের মেয়ে, ফয়সাল নিজেও আমাদের ছেলে।পুলিশের কাজ কী এখানে?আরো সাত পাঁচ গ্রামের মানুষ জানিয়ে মান সম্মান নষ্ট করার কী প্রয়োজন?”
“আপনার কথার ঠিক মানে বুঝলাম না।আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?”
“যা ঘটেছে তা তো আর অস্বীকার করা যাবে না।”
“আপনি যদি বয়সে আমার থেকে বড় না হতেন তবে আপনার এমন কথার জন্য আমি আপনার মুখে লাগাম লাগিয়ে দিতাম।”
তর্ক বির্তকের এক সময় চেয়ারম্যান সাহেব জাফরিনের বড় চাচা আজাহার এর উদ্দেশ্যে বললেন,
“আজাহার সাহেব, আপনি কী দেখেছেন? আমি আর আমার স্ত্রী কই থেকে এখন বের হয়েছি?”
“জি না।”
“আপনি দেখেছেন।এখানে যারা আছে তারা সবাই দেখেছে আমরা আপনার ভাইয়ের বাড়ির ভিতর থেকে বের হইছি।”
“তাতে কী?”
“তাতে কিছুই না।তবে কথা হচ্ছে গত কাল রাতেই আমরা এই বাড়িতে আসি। শুধু তাই না রাতে আমরা এই বাড়িতেই খান খেয়েছি।রাতে এই মেয়েটা আমার স্ত্রীর সাথে ঘুমিয়েছে। রাত ভর আমি এবং ওর মামা আলোচনা করেছি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তাহলে কখন ফয়সাল এলো এই ঘরে? এমন কিছু হবে আগেই ওরা ধারণা করছিল।তাই আমরা এখানে।”
আজাহার সাহেব এবার বিপদে পড়লেন।তাদের জানা মতে কেউ ছিল না বাড়িতে।গত কাল সারা দিন বার বার এ বাড়ির খবর নেওয়া হয়েছে। জাফরিন এবং তার ম ব্যতীত তখন কেউ ছিল না।
আজাহার সাহেব তার ছোটো ভাই মানে আশার বাবার দিকে তাকালেন।তাকে দেখেও বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল।গতকাল সন্ধ্যের পর সে ও বাড়ি গিয়ে খবর নিয়েছিল।তখন তো দুই মা মেয়ে কোর-আন শরীফ পাঠ করছিল।আর তো কেউ ছিল না।তাহলে জাফরিনের মামা কিংবা চেয়ারম্যান সাহেব কখন এলেন?
গ্রামের মানুষের মাঝে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।কি হতে চলেছে এখন?কারণ সবাই জানে আজমল সাহেবের ছোটো মেয়ে কথা ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়, অপর দিকে তার নামে এত বড় বদনাম রটানোর দায়িত্ব নিয়েছে তার নিজের পরিবার।
চেয়ারম্যানের কথায় জাফরিনকে আনা হলো সবার সামনে। তার মতামত জানতে চাইলে সে বলল,
“আমি থানায় অভিযোগ করতে চাই।আমার নিরাপত্তার ব্যাপার নিয়ে আমি চিন্তিত। তাই আমি।চাচ্ছি আইনের লোকের মাধ্যমে এসব সমাধান হোক।”
জাফরিনকে অনেক বোঝানোর পরেও তাকে মানানো গেল না।সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল।ফয়সালের মা এসে জাফরিনের হাতে ধরে ছেলের হয়ে মাফ চাইলে জাফরিন বলল,
“আমার জায়গায় আপনি হলে হয়তো মাফ করতেন কিন্তু আমি মাফ করতে পারবো না।এর জন্য আমি মাফ চাইছি।আমি চাই একদিনের জন্য হলেও সে হাজত বাস করুক।তাকে থানা অবধি টেনে নিয়ে যাওয়াই হবে আমার আজকের অপমানের যথাযথ মূল্য।”
জাফরিনের কথা শুনে অধরে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো মাশহুদের। জাফরিনের কণ্ঠস্বর তাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে। সামনে থাকা শতবর্ষী রেড ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সে মনোযোগ দিলো ফোনের স্ক্রীনে।সরাসরি ভিডিও কলে সব কিছু দেখছিল সে।
জাফরিনের এমন প্রতিবাদে সে মনে মনে পুলকিত হচ্ছিলো।একজন নারী, সে কী পারে এতটা শক্ত হতে?
মাশহুদ অনেক মেয়ের সাথে মেলামেশা করেছে। সে এ অবধি এটাই দেখেছে যে মেয়েদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে চোখের পানি।তারা চাইতেও না চাইতেও চোখের পানিকে ব্যবহার করে অন্যের মনে নিজের কথাকে প্রাধান্য দিতে। তারা খুশিতে কাঁদে,কাঁদে অপমানেও কিংবা কষ্টে। কিন্তু এই মেয়েটা তার জীবনের চূড়ান্ত অপমান সহ্য করেও নিজেই রুখে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মেয়েদের সম্পর্কে তার দাদার কাছ থেকে যতটা শুনেছে এই দেশে এমন পরিস্থিতিতে একজন মেয়ে থাপ্পর তো দূরে থাক প্রতিবাদ অবধি করতে হাজারো বার সমাজের কথা ভাবতে থাকে।
এক চুমুকে গ্লাসের পুরো ওয়াইন শেষ করে দিয়ে এতে হালকা পরিমাণের স্কচ ঢেলে নিলো সে। যেদিন থেকে আজমল শিকদার মারা গেছেন সেদিন থেকে তার এসব পান করার অভ্যসে যেন ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। কারণটা কী তার কন্যা?যার কণ্ঠ শুনলে তার নেশা লাগে,তৃষ্ণা পায়। এক দেখা আজন্মকালের তৃষ্ণা? নাহ্ তার গলাটা পুনরায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।তার এই অসুখের ঔষধ যে সেই দূর দেশে রয়েছে।
এমিলিকে ডেকে সে তার ব্যক্তিগত ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বলল,
” বাংলাদেশে যাওয়ার সকল কাগজ পত্র আগামী তিন দিনের মধ্যে রেডি করো।”
“স্যার হঠাৎ বাংলাদেশে?”
“হ্যাঁ,এবং আজমল সাহেবের লাশ সেদিন পাঠানোর সকল ব্যবস্থা করে ফেলো।”
(২৩)
জাফরিনদের নিয়ে তার বোনেরা আর এক মুহুর্ত কোনো দুশ্চিন্তা নিতে রাজি নয়। তাদের কে যত দ্রুত সম্ভব শহরে চলে আসার জন্য দুই বোন অনুরোধ করতে লাগলো।শুধু তাই নয় বড় আপা তো কাঁদতে কাঁদতে প্রেশার হাউ করে ফেলেছে।
জাফরিনের মনে হচ্ছে এই মানুষটার জন্মই হয়েছে কাঁদার জন্য।সে কাঁদতে থাকে কোনো না কোনো।কারণেই। মায়ানের রেজাল্ট খারাপ হলেও সে কাঁদে, আবার ভালো হলেও কাঁদে।
সবার কথা এবার আর ফেলতে পারলো না তারা। সুফিয়া কে নিয়ে তার ভাই এক গাড়িতে করে চলে এলো।জাফরিন আসছিল ইউভানের সাথে।কিছু দূর আসার পর ইউভান রাস্তা পরিবর্তন করতেই জাফরিন জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“কাজী অফিস।”
জাফরিনের দুই চোখ হঠাৎ করেই আনন্দে ভরে উঠলো।কিছুটা রাগত স্বরে সে বলল,
“তবে এত দিন নাটকের কী দরকার ছিল?আমি।অন্তত একটা শাড়ি পরে আসতাম।”
“আগে এই সমাজের মুখ তো বন্ধ করি এরপর একটা না দশটা শাড়ি পরা যাবে।”
চলবে …