.
ইব্রাহিম এবং আমাদের ক্যান্সার যুদ্ধ….
পর্ব – ২
#এখন_আমি_একজন_অসাধারন_ডাক্তারের_গল্প_বলব
স্থানীয় সময় দুপুর ১২ টার পরে আমরা চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। পুরো দুই ঘণ্টা আমি ইব্রাহিম এর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, অলটিটিউট এর জন্য ওর না আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয় প্লেনে।
আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাবেই প্লেন জার্নি শেষ হলো।
হসপিটাল থেকে গাড়ি এসেছিল আমাদের নেয়ার জন্য। আমরা এপোলো ক্যান্সার হসপিটাল চেন্নাই এর পাশে তেনামপেট নামক জায়গায় একটা হোটেলে উঠলাম।
হসপিটাল ছিল হোটেলের সামনে।
পরদিন আমাদের এপোয়েন্টমেন্ট করা ছিল ডাঃ শঙ্কর রুদ্রমূর্তি র সঙে। সকালে তার সঙ্গে দেখা হলো তিনি সব রিপোর্ট দেখে বললেন, কেমো গুলো কেন কাজ করলো না এটাই অবাক করছে আমাকে ?
তাকে দেখে আমি এবং হাসান অবাক হচ্ছি কারণ তিনি কোন পিপিই পড়া নেই, মুখে শুধু মাস্ক এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনি ইব্রাহিম এর গায়ে হাত দিয়ে দেখছেন সব।
যেখানে এত দিন একজন ডাক্তার ও আমার ছেলেকে হাত দিয়ে ধরে দেখেনি। এভাবেই কোভিডের ভয় তাদের তাড়াচ্ছে । কিন্তু এই ভীন দেশী ডাক্তার হেসে হেসে ইব্রাহিম এর সাথে কথা বলছে, আমাদের ভরসা দিচ্ছে।
তিনি একবারও উচ্চারণ ও করেন নাই বাংলাদেশের ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করেছে কিংবা ভুল ইনভেস্টিগেশন হয়েছে! তিনি বললেন, সারকোমা তো কেমো তে কাজ করে ওর ক্ষেত্রে করল না কেন??
হাসান তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমি আবার বায়োপসি করতে চাই এবং যেহেতু পেট সিটি করা হয়নি আগে, তাই এখন আগে পেট সিটি এবং ইমোনো হিস্ট্রো ক্যামিস্ট্রি করব ।
আমরা বললাম ওর হাইপোকসিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা।
হাসান উনাকে বলল, ডাক্তার তুমি তো অর্থোপেডিক সার্জন আমার তো অনকো সার্জন দরকার?
তিনি ইনসাল্ট ফীল তো করেন ই নাই মুচকি হেসে বললেন, তুমি চিন্তা করো না তোমার ছেলে সঠিক হাতেই আছে।
তিনি সব শুনে আমাদের এপোলো চিল্ড্রেন হসপিটালে আসতে বললেন।
পরদিন আমরা এপোলো চিল্ড্রেন হসপিটাল গ্রীমস রোড গেলাম। সেখানে তিনি চাইল্ড কার্ডিও এনেস্থেশিয়ালিস্ট ডাক্তার সন্জয় প্রভু এবং হেমলতাকে ইব্রাহিম কে দেখালেন। ওরা সব রিপোর্ট দেখে বলল, একটা ইকো করে দেখতে হবে আগে।
সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ সঙ্কর চাইল্ড কার্ডিওলজিস্ট কে ফোন দিয়ে ডেকে আনলেন। সব রিপোর্ট দেখালেন। তিনি ইকো করতে বললেন। ডাঃ সঙ্কর আমাদের ইকো করতে পাঠালেন। তখনই ইকো এবং সকল টেস্ট করানো হয়।
ইকোর রিপোর্ট দেখে ডাঃ নিজেই আমাদের ফোন দিলেন পরদিন।
বললেন আগামীকাল আবার হসপিটালে আসো।
সেদিন আমরা হোটেল থেকে চেক আউট করে একটা বাসা ভাড়া করলাম। দিনের পর দিন হোটেলে থাকা সম্ভব নয়। ইব্রাহিম কে বাসায় রান্না করা খাবার খাওয়াতে হয়। আর সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার আমরাই খেতে পারি না ও খাবে কি !
আমাদের বাসাটা ছিল ক্যান্সার হসপিটালের কাছেই। হেঁটেই যাওয়া যায়।
পরদিন আবার চিল্ড্রেন হসপিটালে গেলাম। ডাক্তার সেদিনই বায়োপসি করবেন।
ডাঃ সঙ্কর এবং তার টীম ইব্রাহিম কে নিয়ে গেল। আমার শুধু ওর হাইপোকসিয়া হয়ে যাওয়ার ভয়।
ওটির বাহিরে দাঁড়িয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছি।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে এসে আমাকে দেখে বললেন, চেহারার এই অবস্থা কেন? ছেলে তো ঠিক আছে। মা তোমার চিন্তার কোন কারন নেই।
বলে রাখি ডাঃ সঙ্কর আমাকে সবসময় মা ডাকতেন।
তোমার ছেলে পারফেক্ট আছে। ঘুমাচ্ছে। এখন অনেকক্ষণ ঘুমাবে তোমরা একজন একজন করে ওর পাশে থাকো।
ওটির পাশে রিকোভারি রুম একজন নার্স ঠায় ইব্রাহিম এর মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
ও ঘুমাচ্ছে আমি যতবার বললাম আপনি সিস্টার বসুন ।
সিস্টার সুজি বসলো না বিনয়ের সঙ্গে বারবার বলল, ম্যাম আমি ঠিক আছি আপনি তো লাঞ্চ করেন নাই আমি কি আপনার জন্য একটু নারিকেল পানি ( ডাব ) এনে দিব ?
সন্ধ্যার আগে আগে আমরা ডিসচার্জ হয়ে বাসায় এলাম।
বলে রাখি ডাঃ সঙ্কর সেই প্রথম দিন থেকে বায়োপসি পর্যন্ত কোন ভিজিট নেন নাই।
কোন এক অজানা কারণে তিনি সব সময়ই আমাদের খরচ যেন কম হয় প্রথম থেকেই সেই চেষ্টা করতেন।
তাঁর এক কথায় চিল্ড্রেন হসপিটালে অনেক কিছু পরিবর্তন হয় দেখলাম। তিনি ইব্রাহিম কে অনেক কিছুতেই এত বেশি সময় দিতেন যা আমাদের অবাক করতেন । সেই গল্প ও করব।
চারদিন পর বায়োপসি রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাঃ সঙ্কর ই ফোন দিল হাসান কে।
হাসান বায়োপসি রিপোর্ট পেয়েছি সারকোমাই আগের রিপোর্ট ই।
কিন্তু কেন কেমো কাজ করলো না অবাক হচ্ছি! এখন অবশ্য সেটা নিয়ে পড়ে থাকতে চাইছি না তুমি আগামীকাল পেট সিটি টা করে ফেলো।
চিল্ড্রেন হসপিটাল থেকে কার্ডিও এনেস্থেশিয়ালিস্ট রা ক্যান্সার হসপিটালে যাবে তুমি চিন্তা করো না।
হাসান বলল, স্যার আগামীকাল কি সিডিউল পাব ?
তিনি বললেন, আমি বলে দিচ্ছি সকালে প্রথম পেট সিটি হবে ইব্রাহিম এর।
রাতে ইব্রাহিম এর জ্বর আসলো হঠাৎ। ক্যান্সেল হয়ে গেল পেট সিটি।
হঠাৎ খুব ফুড পয়জনিং হলো ইব্রাহিম এর। আবার কিছুদিন পিছিয়ে গেল সব।
চার দিন পর ২৬ ডিসেম্বর খুব সকালে চলে গেলাম এপোলো ক্যান্সার হাসপাতালে। আজকে ইব্রাহিম এর পেট সিটি হবে।
সকাল ঠিক সাতটায় চিল্ড্রেন হসপিটাল এর এনেস্থেশিয়ালিস্টদের টীম টা চলে এসেছে। ওরা টাইমের ব্যাপারে এত সচেতন। সবচেয়ে বড় কথা বাচ্চা টা বেশি সময় না খেয়ে থাকবে এটা ওরা হতে দিবে না।
পেট সিটি হয়ে গেল । ওকে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারা এম্বুলেন্স এ করে চিল্ড্রেন হসপিটালে নিয়ে গেল। কারণ রিকোভারি ট্রিটমেন্ট বাচ্চাদের টা এপোলো ক্যান্সার হসপিটাল তেনামপেট এ নেই। ( চেন্নাই তে এপোলোর প্রায় ১১ টা হসপিটাল । ক্যান্সারের জন্য দুইটা )
একদিন পর পেট সিটির রিপোর্ট দেখে ডাক্তার সঙ্কর বললেন , ভালো খবর ওর ক্যান্সার আর কোথাও ছড়িয়ে যায় নাই। এক জায়গা তেই আছে। আমরা পরশু অপারেশন করব তোমরা আগামীকাল ভর্তি হয়ে যাও।
পরদিন কোভিড টেস্ট করে আমরা হসপিটালে ভর্তি হয়ে গেলাম।
আমরা গত এক বছরে এত বার কোভিড টেস্ট করেছি যে এত বাজে একটা জিনিস এখন আমাদের কাছে ডাল ভাত টাইপ হয়ে গেছে। ইব্রাহিম আগে অনেক হাত পা ছুড়তো সেম্পল নেয়ার সময়, এখন আর ছুড়ে না ব্যাপারটা মেনেই নিয়েছে সে।
২৯ ডিসেম্বর আমরা এপোলো চিল্ড্রেন হসপিটালে ভর্তি হলাম।
সেদিন ওর বাবাকে ডেকে নিয়ে গেল সব ডাক্তারদের সঙ্গে কনফারেন্সের জন্য এবং পুরো কনফারেন্স টা ওরা ভিডিও করে রাখলো।
ছয়জন ডাক্তার অপারেশন এ কি হবে বুঝিয়ে বলল।
তাঁরা বলল, অপারেশন টা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু আমাদের করতেই হচ্ছে। তুমি কি রাজি হাসান অপারেশন করাতে ?
ওর বাবা বলল, যদি অপারেশন না করাই তাহলে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে?
ডাক্তার বলল, তাহলে হয়তো আর মাস খানেক সময় ও পাবে ।
আবার অপারেশন এর টেবিলেও কিছু হয়ে যেতে পারে কারণ টিউমার টা অনেক জটিল জায়গায় এবং অনেক বড় হয়ে গেছে।
তখন ওর বাবা বলল, দেখো ডাক্তার আমাকে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং কি হতে পারে আমি জানি এবং জানিও না। আমি প্রস্তুত এক অনিশ্চয়তা কে মেনে নিতে।
আমাকে তোমাদের এত কিছু বোঝানোর দরকার নেই তোমরা তোমাদের কাজ টা করো ঠিক ভাবে তাহলেই হবে। তোমাদের উপর আমার আস্থা আছে।
আমি যেন আমার ছেলেকে বলতে পারি আমি তার জন্য সবচেয়ে বেষ্ট চেষ্টা করেছি।
বাবা হিসেবে আমি হাল ছেড়ে দেই নাই।
ডাক্তাররা বলল, আমরাও ওর জন্য আমাদের বেষ্ট টুকুই করব হাসান। তুমি চিন্তা করো না।
ঐ কনফারেন্স ওরা ভিডিও করে রেখেছে কারণ ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন এ অনেক কিছুই হতে পারে ,পরে যেন ডাক্তারদের উপর কোন ব্লেইম না আসে যে রোগীর অবস্থা বুঝিয়ে বলা হয় নাই।
সেই রাতটা আমি আর ইব্রাহিম হসপিটালে যখন, সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। আসলে ঘুমাতে চাই নাই। আমি পুরো রাত ছেলের দিকে তাকিয়ে ওর জন্মের আগের থেকে পরে সব কিছু চিন্তা করছিলাম।
ফ্লেশ ব্যাক এর মতো সব আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
ওর জন্মের আগে আমার বেশ কিছু জটিলতা হয়েছিল প্রেসার বেশি ছিল আমি কখনো আক্ষেপ করতাম না যা হোক আমার উপর দিয়ে হোক তবুও বাচ্চা টা সুস্থ থাকুক ভাবতাম।
ও দেখতে পুরোই ওর বাবার কার্বন কপি আমি সব সময় ওর বাবাকে বলি তোমার ছোটবেলাটা দেখি হাসান।
ইব্রাহিম সব সময় সবার খুব আদর পায় আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে সবাই আমার বাচ্চাদের খুব ই আদর করে।
ওরা নানাবাড়িতে গেলে আনন্দের ধুম পড়ে সব কাজিন রা মিলে হৈচৈ , হাজার আয়োজন। আবার দাদার পরিবারে একমাত্র ছেলের দিকের নাতি অন্যরকম আদর আবার সেখানে। সবার সব অনুভূতি আমি তখন ফীল করছিলাম সেই রাতে।
আইশার কথা গুলো ভাবছিলাম। ভাইয়ের জন্য ওর এত ভালোবাসা কিন্তু মেয়েটা দেশে রয়ে গেছে। এই সময়ে ভাইয়ের পাশে থাকতে পারছে না।
খুব ভোরে সিস্টার নন্দিনী আমাকে ডেকে বলল ওকে গোসল করিয়ে তৈরি করতে হবে। আমি বললাম এত সকালে গোসল করালে কাঁদবে। আটটায় নিয়ে যাব কেবিন থেকে আরো একটু ঘুমাক ওর বাবা আসলে করাব।
ওর বাবা আসার পর গোসল করিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ওটির উদ্দেশ্যে নিয়ে গেলাম।
ওটির সামনে ওর বাবার কোলে রেখেই এনেস্থেশিয়ালিস্ট ডাঃ সন্জয় প্রভু ওকে ইনজেকশন গুলো দিয়ে দিলেন , বাবার কোলেই ঘুমিয়ে গেল ওর বাবা ওকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিলো।
আমি আমার ছেলেকে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলাম। ওর কানে কানে বললাম, ভয় পেয়ো না বাবা অনেক অনেক মানুষ তোমার জন্য দোয়া করছে। কারো না কারো দোয়া তো আল্লাহ কবুল করবেন।
ওকে ওটিতে নিয়ে চলে গেল ডাক্তার।
ডাঃ সঙ্কর আমাকে কাঁদতে দেখে বলল, মা কাঁদছো কেন? তোমার গড কে ডাকো এখানে আমরা সবাই আছি। কেঁদো না আমরা সবাই আছি তোমার ছেলের পাশে।
কেবিনে যাও আর দুজন তোমরা ব্রেকফাস্ট করো । মুছো মুছো চোখের পানি মুছো।
আমাদের চোখের পানি মুছতে মুছতে আমরা কেবিনে এসে বসলাম।
ছয় ঘণ্টা কিভাবে কাটবে বুঝতে পারছিলাম না।
ঘন্টা দুয়েক পর ওটির সামনে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম। উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি। ব্রাদার দুই একজন বলল, চিন্তা করবেন না সব স্যার রা আছেন ওটিতে। সেদিন এপোলো চিল্ড্রেন এ আর কোন অপারেশন হয় নাই কারন সব সার্জন রা ইব্রাহিম কে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
তিন ঘণ্টা পর ডাঃ সঙ্কর আমাদের কাছে এসে বললেন, টিউমার রিমুভ করে দিয়েছি এবং গুড নিউজ হলো টিউমার টা অনেক বড় হলেও মেটাসটেসিস ছিল না।
কাঁদছো কেন তোমার ছেলের শরীর থেকে ক্যান্সার গন ।
কাঁদে না মা একটু পরেই ছেলেকে দেখবে সুস্থ। তিনি আবার ওটিতে ঢুকে গেলেন।
উনার সেক্রেটারি সিস্টার কথাই টিউমার টার ছবি দেখালেন।
আমি আর হাসান তাজ্জব হয়ে গেলাম সাইজ দেখে! এই জিনিস আমার ছেলের বুকে না জানি কতদিন ধরে আছে আর তাই নিয়ে আমার ছেলে দৌড়ে বেড়িয়েছে।
ছয় ঘণ্টা লাগলো অপারেশন। কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ নেভিল ওটি থেকে বের হয়ে বললেন চিন্তার কিছু নেই।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম ওর হার্ট যে ডানদিকে চলে এসেছিল সেটা কি ঠিক হয়েছে ডাক্তার ?
তিনি বললেন সব ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই।
আমার চোখ ভিজে উঠলো!
তিনি বললেন, একটা জিনিস ঠিক নেই । আমরা উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকালাম ডাঃ নেভিল বললেন, তোমাদের মুখে হাসি নেই এটাই মিসিং।
আমরা হেসে উঠলাম।
তিনি হেসে বললেন, now everything is perfectly alright.
আরো কিছুক্ষণ পর আমাদের আইসিইউ তে ডেকে নিয়ে গেল।
গিয়ে দেখি অনেক অনেক লাইন দিয়ে ছেলেকে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। অক্সিজেন মাস্ক পড়া। ইপিডুরাল লাইন করা।
ছেলে ভয়ে চিৎকার করছে সবাইকে দেখে।
ওর হাত গুলো হ্যান্ডকাফ দিয়ে বেঁধে দিল বেডের সঙ্গে। তা না হলে সব টেনে খুলে ফেলছিল ও।
ডাঃ সঙ্কর বললেন, সব ঠিক আছে। টিউমার টা ওর বাম দিকের ফুসফুস টা কে চেপে ছিল তাই ঐ ফুসফুস টা ইফেক্টেড হয়েছে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে তবে বুকের তিন নম্বর রিব টা কেটে ফেলেছি কিছুটা যেখানে টিউমার টা ঝুলে ছিল।
তোমরা একজন ওর পাশে থাকো । তিনি আমাদের হাসতে বললেন এবং বললেন খাওয়া খেয়ে আসো এখানে সব সময় ডাক্তার আছে নার্সরা আছে।
এরপর যতদিন ইব্রাহিম চিল্ড্রেন হসপিটালে ছিল ডাঃ সঙ্কর সকালে, বিকেলে দেখতে আসতেন। এমনকি তাদের পোঙ্গল উৎসব ছিল সরকারি ছুটি, তবুও তিনি রাতে এসে দেখে গেছেন।
বার দিন পর ইব্রাহিম এর আবার একটা অপারেশন করেন তিনি। এবার বুকের চার নম্বর রিব কিছুটা কেটে ফেলেন।
তিনি এমন একজন মানুষ প্রথম যেদিন ইব্রাহিম কে দেখলেন বললাম অনেক ডাক্তার বলেছে আর কিছু করার নেই তিনি বলেছেন, how can a doctor say like this!
ডাক্তার শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে এটাই তো তার কাজ!
তিনি আমাদের ইন্টারন্যাশনাল পেসেন্ট হিসেবে ট্রিট করেন নাই তাই আমাদের খরচ হয়েছে অন্যান্য বিদেশি রোগীদের থেকে কম।
আবার তাঁর রোগী ছিল বলে সব জায়গায় প্রায়োরিটি পেয়েছে ইব্রাহিম বেশি।
কোন এক অজানা কারণে তিনি এবং তার পুরো টীম ইব্রাহিম কে খুব আদর যত্ন করতো। পরেও কখনো গেলে দৌড়ে সবাই চলে আসতো দেখতে।
ডাঃ অনুরাধা এমআর আই করতে কোন পেমেন্ট ই নিলেন না। এসব কোন কারণ ছাড়াই, আমরা কখনো টাকার প্রসঙ্গ ই তুলি নাই।
এত মানবিক ডাক্তার দেখে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম না।
সবচেয়ে বড় কথা উনারা রোগীর সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেন। যেটা আমাদের দেশে বিরল!
আমি কাউকে আঘাত বা ছোট করতে চাই না আমাদের দেশের ডাক্তারদের ধৈর্য খুব কম রোগীদের কথা, সমস্যা শোনার। কিন্তু চেন্নাই গিয়ে দেখলাম এর বেতিক্রম ।
একদিন আইসিইউতে আমি বসা ডাঃ সঙ্কর আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন মা আসো তো আমার এক পেসেন্ট তোমার দেশ থেকে এসেছে ওর সঙ্গে র লোক আমার কথা বুঝতে পারছে না তুমি আমার কথা ওকে বুঝিয়ে দাও আর ওর কথা আমাকে বুঝিয়ে বলো।
এই হলো ডাক্তার!
আর আমার দেশের ডাক্তার এবং রোগীর ভাষা এক কিন্তু শোনার ইচ্ছা তাদের নেই।
কেউ কেউ বলবে এসব পাবলিসিটি !
তাহলে করেন আপনি সেই পাবলিসিটি কে না করেছে।
আপনি যদি আমার কথা না শোনেন আমার আস্থার জায়গায় প্রবেশ না করেন আমি কিভাবে আপনাকে ভরসা করব ? রোগীর অন্তরে প্রবেশ করতে হলে রোগীর সব কথা প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক শুনতে হবে।
যারা বলবে আমাদের দেশে রোগী অনেক বেশি এত সময় কোথায়?
তাদের বলব একবার চেন্নাই এপোলো থেকে ঘুরে আসুন কী ভীড় দেখে এসে মন্তব্য করুন। বাংলাদেশ, ওয়েস্ট বেঙ্গল, আসাম, ত্রিপুরা, শ্রীলঙ্কা আর ইন্ডিয়ান রোগী তো আছেই।
ডাঃ সঙ্কর এবং তাঁর টীম এপোলো চিল্ড্রেন হসপিটাল এর প্রতিটি নার্স যে পরম মমতা, ভালোবাসা নিয়ে আমার ছেলের চিকিৎসা করেছেন তাদের এই ঋণ আমি আমৃত্যু দোয়া করেও শোধ করতে পারব না।
আমি চাই ও না শোধ করতে।
কিছু ঋণ থাকুক আজীবন। কিছু ঋণ শোধ করতে হয় না।যার জন্য তাদের কাছে আমি নতজানু হব যত দিন বেঁচে থাকব।
চলবে….