ইব্রাহিম এবং আমাদের ক্যান্সার যুদ্ধ .
পর্ব ৩
আমাকে আমার বন্ধু , পরিচিত স্বজন, আত্মীয় থেকে শুরু করে অনেক অপরিচিত মানুষ ও গত এক বছরে একটা প্রশ্ন অনেক বার করেছে। সেটা হলো , আমি এবং আমরা কিভাবে সহ্য করেছি এই নিষ্ঠুর সত্য টা। কিভাবে নিজেকে শক্ত করে রেখেছি।
আমি সবাইকে একটা কথাই বলি , সবাই সহ্য করতে পারে যদি ভাগ্যে লিখা থাকে।
আমি প্রথম থেকেই মেনে নিয়েছি , আমি সহ্য করতে পারব বলেই আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তিনি তার কোন বান্দাহ কে তার সাধ্যের বাহিরে ভার বহন করতে দেন না।
আমি কখনো আমার ছেলেকেই কেন আল্লাহ এত কষ্ট দিয়েছেন এটা নিয়েও আক্ষেপ করিনি।
আমি নিজেকে বরং শক্ত হাতে সব সামলে নেয়ার জন্য তৈরি করেছি।
ইব্রাহিম এর দুটো অপারেশন হতেই ওর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় নাই। ক্যান্সার একটা দুষ্টু কোষ এটা সুযোগ পেলেই আবার চলে আসে। ডাক্তার রা সব সময় চেষ্টা করে সেই সুযোগ টা চিরজীবনের জন্য বন্ধ করে দিতে।
ডাঃ সঙ্কর ই ক্যান্সার হসপিটাল থেকে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ দের ডেকে আনলেন।
অপারেশন এর পর চিল্ড্রেন হসপিটাল থেকে আসার আগেই এপোলো ক্যান্সার হাসপাতালে র হোপ টীমের ডাঃ ভেঙ্কটেশ আসলেন ইব্রাহিম কে দেখতে।
তিনি আমাদের সঙ্গে পরিচিত হন ইব্রাহিম কে দেখেন। ওর প্রটোকলের কাগজ গুলো দেখে বললেন, এখান থেকে ডিসচার্জ হওয়ার পর হোপ টীমের সিনিয়র ডাক্তার ডাঃ রাইমা ইব্রাহিম কে দেখবেন আমরা যেন তাকে দেখাতে ক্যান্সার হাসপাতালে আসি।
বাইশ দিন চিল্ড্রেন হসপিটালে থেকে আমরা ডিসচার্জ হয়ে আসি।
বাসায় আসার দুই দিন পর ডাঃ রাইমার সঙ্গে দেখা করার পর তিনি ইব্রাহিম এর সব হিস্ট্রি দেখলেন। নতুন প্রোটোকল দিলেন। রেডিওথেরাপি দিতে হবে। এপোলো প্রোটন ক্যান্সার সেন্টার তারামানি তে রেডিওঅনকোলজিস্ট ডাঃ শ্রীনিবাস চিলকুড়ের কাছে রেফার করেন তিনি।
পরদিন আমরা ইব্রাহিম কে নিয়ে আমাদের বাসা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে তারামানি নামক স্থানে এপোলো প্রোটন ক্যান্সার সেন্টার হসপিটালে যাই।
এপোলো প্রোটন , ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে আধুনিক হাসপাতাল। বিশ্বে মাত্র ষোল টি প্রোটন হসপিটাল আছে। ইন্ডিয়াতে শুধু মাত্র চেন্নাই এপোলো তেই এই প্রোটন থেরাপি দেয়া হয়। বলা হয় প্রোটন থেরাপি ক্যান্সারে সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা। এবং অনেক ব্যয় বহুল একটি চিকিৎসা। প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা খরচ হয় এক সেশনে ।
হসপিটাল টা আড়াই বছর আগে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ফাইভ স্টার হসপিটাল। মনেই হয় না যে হসপিটালে আছি।
আমরা এপোলো প্রোটন ক্যান্সার হসপিটালে ডাঃ শ্রীনিবাস এর সঙ্গে দেখা করি। তিনি ইব্রাহিম এর জন্ম থেকে শুরু করে ক্যান্সার কিভাবে সনাক্ত হলো,কি কি লক্ষণ ছিল এবং বাংলাদেশ এ কি চিকিৎসা হয়েছে সব শুনলে।
আমাদের অনেক প্রশ্ন করলেন। উনার সঙ্গে কথা বলার সময় মনেই হয়নি যে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছি মনে হয়েছে আড্ডা দিচ্ছি পরিচিত কারো সঙ্গে।
তিনি ইব্রাহিম এর রেডিওথেরাপির প্রোটোকল দিলেন।
৩১ সাইকেল রেডিওথেরাপি দিবে। সপ্তাহে দুই দিন বাদ দিয়ে প্রতিদিন থেরাপি দেয়া হবে।
এবং এর মাঝে কেমো গুলো চলবে ২১ দিন পর পর।
ইব্রাহিম এর বাম সাইডের ফুসফুস টা টিউমার এর প্রেসারে ছিল তাই কার্যক্ষমতা কমে গেছে। এটা খুব ধীরে ধীরে এক্সপান্ড করছে। রেডিওথেরাপি দিলে এটা আর এক্সপান্ড করবে না। তাই আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করবে রেডিওথেরাপি শুরু করতে।
রেডিওথেরাপি দেয়ার সময় প্রতিদিন এনেস্থেশিয়া দিতে হবে তাই পেডিয়াটিক এনেস্থেশিয়ালিস্ট ডাক্তার ইন্দুমতি দেখলেন ইব্রাহিম কে।
এই ডাঃ ইন্দুমতির কথা বলতেই হবে, তিনি এবং তার টীম পরম মমতা নিয়ে প্রতিদিন ইব্রাহিম কে রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেছে যা আমাদের বারবার আপ্লুত করেছে।
ডাঃ ইন্দুমতি আমাদের বুঝিয়ে বললেন, প্রতিদিন কেনোলা দিয়ে এনেস্থেশিয়া দেয়া যাবে না তার মধ্যে কেমো চলবে তাই তিনি একটা পিক লাইন করবেন ইব্রাহিম এর হাতে যা আগামী পাঁচ মাস পর্যন্ত ওর হাতে থাকতে পারবে । তাহলে আর প্রতিদিন সুঁই ফোটাতে হবে না। তবে খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন ইনফেকশন না হয়। তিনি এবং রেডিওঅনকোলজিস্ট সিটি স্কেন করে দেখলেন সেদিন ইব্রাহিমের ফুসফুসের অবস্থা।
আমরা কেমোর জন্য ভর্তি হলাম ২৫ জানুয়ারি এপোলো প্রোটন ক্যান্সার হসপিটালে। সেদিন ডাঃ ইন্দুমতি পিক লাইন করলেন।
কেমো শুরু হলো। কেমো শুরু হলেই কেমোর রিয়েকশন এ বমি শুরু হয়।
কিন্তু আল্লাহর রহমতে এপোলো তে যে কয়টা কেমো নিয়েছে ইব্রাহিম এক বার ও বমি করেনি!
নিওট্রোশনিষ্ট এসে ইব্রাহিম এর ডায়েট চার্ট তৈরি করে আমাদের দিল আবার ফুড সার্ভিস কেও পাঠিয়ে দিল। ওরা সময় মতো ইব্রাহিম এর যা খেতে হবে দিয়ে যেতো।
নার্স গুলো এত দক্ষ এবং যত্নশীল।
বাচ্চা থেকে বয়স্ক রোগী সবাইকে খুব যত্নের সঙ্গে টেক কেয়ার করে।
একটা বিষয় এই হসপিটালে খেয়াল করলাম এই হসপিটালে সব স্টাফ খুব হাসিখুশি থাকে। কথা বলার সময় এত বিনয়ী হয় যা আমি লিখে বোঝাতে পারবো না।
প্রতিদিন হোপ টীমের দুই জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এসে দেখে যায়। আবার ডিউটি ডাক্তার তো আছেই।
এখানে আসার পর ইব্রাহিম এর সিটিস্কেন হল আরো কয়েক বার।
ফুসফুস টা তেমন একটা ঠিক হলো না।
কেমো শেষ হওয়ার আগেই জ্বর আসতেই ডাক্তার রা চিন্তায় পড়ে গেলেন।
এদিকে হিমোগ্লোবিন এবং হোয়াইট ব্লাড সেল অনেক কমে গেল ।
আমরা এসব দেখে অভ্যস্ত। প্রতিটি কেমোর পর এমন ই হয়।
একদিন ইব্রাহিম এর অনেক জ্বর আবার পালস রেট ও খুব বেশি সেদিন একটা বিষয় দেখে আমি এবং হাসান আবেগ আপ্লুত হয়ে গেছি।
আমরা এসব কিছু তেমন পাত্তা দিচ্ছি না কারণ এমন ওর সব কেমো তে হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়।
সেদিন ইব্রাহিম এর ডাক্তার ডাঃ রাইমা রাত সাড়ে দশটায় নার্সিং স্টেশনে বসে আছেন কারণ ইব্রাহিম এর টেম্পারেচারে বেশি পালস রেট বেশি বলে।
ডাঃ রাইমা কিন্তু চেন্নাই এপোলোর সিনিয়র একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ! তিনি ডিউটি ডাক্তারের উপর ছেড়ে দিয়ে বাসায় আরামে বসে থাকতে পারতেন কিংবা নিজের চেম্বারে। যা আমাদের দেশে হয় । কিন্তু তিনি বসেই রইলেন।
একদিন ইব্রাহিম এর কেনোলা করতে পারছে না কোন নার্স এমনকি ওটি নার্স ও না । রাত সোয়া বারটায় ডাঃ ভেঙ্কটেশ বাসা থেকে চলে এসেছে এই সামান্য কেনোলা করতে।
এসব সত্যি ই আমাদের জন্য চমৎকৃত, আবেগ আপ্লুত ব্যাপার ছিল।
ডাঃ রাইমা ৩৫ হাজার রুপির ইনজেকশন লিখে দিলেন ক্যান কীট প্রেসক্রিপশনে ফলে ফার্মেসি কোন টাকা নিলো না।
এরকম শুধু আমাদের সঙ্গে ছিল যে তা নয় গুজরাটের সুরাট থেকে একটা ছেলে এসেছে আমাদের পাশের কেবিনে ১৯ লক্ষ রুপি বিল এসেছে তার ছোট ভাই বলল, ১২ লক্ষ রুপির উপর এক রুপিও দিতে পারব না খুব উত্তেজিত সে।
এপোলো দেখলাম বলল ঠিক আছে তুমি শান্ত হও তোমার বিল দিতে সমস্যা হতেই পারে তুমি উত্তেজিত হইও না আমরা জোর করব না তোমাকে। এবং এও বলে দিলো টাকা পয়সার জন্য চিকিৎসা অসমাপ্ত করো না। আমরা আছি তোমাদের পাশে।
ইব্রাহিম এর রেডিওথেরাপি দেয়ার আগে ওকে একটা থেরাপি দেয় যাতে ফুসফুস টা আরো একটু প্রসারিত হতে পারে।
এটা যেদিন দিবে তার আগের দিন আমার শ্বশুর, ইব্রাহিম এর দাদা হার্ট অ্যাটাক করে ইন্তেকাল করেন।
মৃত্যুর সময় তিনি তার একমাত্র ছেলেকে পাশে পান নাই। কারণ ছেলে তখন নিজেই পিতার দ্বায়িত্ব পালন করতে চেন্নাই।
আব্বা প্রতিদিন বলতেন ইব্রাহিম যেদিন সুস্থ হয়ে আসবে তিনি ইব্রাহিম কে রিসিভ করতে এয়ার পোর্টে আসবেন ওকে কোলে নিয়ে বাসার ফিরবেন।
কিন্তু আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন নাই।
পরদিন ইব্রাহিম এর সেই জটিল থেরাপি হওয়ার পর ওর বাবা রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
চারদিন পর আব্বার দাফন সম্পন্ন করে হাসান আবার চেন্নাই ফিরে এলো। এই কয়দিন আমরা একা ছিলাম চেন্নাই।
ইব্রাহিম এর রেডিওথেরাপি শুরুর কথা থাকলেও যেহেতু ওর বাবা ছিলো না তাই ডাক্তার রা ওর থেরাপি পিছিয়ে দেয়।
আমরা একা আছি শুনে ডাঃ ভেঙ্কটেশ বললেন, তুমি যে কোন সমস্যা বোধ করলেই যে কোন সময় হোপ টীমের ইমার্জেন্সি নাম্বারে ফোন দিবে। রাত হলেও কখনো দ্বিধা করবে না ।
আমি মনে মনে ভাবি এরা কি সত্যিই মানুষ নাকি কোন ফেরেশতা!
একদিন ইব্রাহিম এর গায়ে একটু জ্বর এসেছিল একশো ও না পরদিন বললাম, ডাক্তার বললেন তুমি ফোন দাও নাই কোন?
আমাকে তোমার জানানো উচিত ছিল।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইব্রাহিম এর রেডিওথেরাপি শুরু হলো। ওর বাম ফুসফুস টা মাত্র ২০% এক্সপান্ড করেছে এর বেশি আর কার্যক্ষমতা বাড়বে না।
রেডিওথেরাপি শুরু হলো। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ওর বাবা ওকে নিয়ে চলে যায় হসপিটালে প্রথমেই ওর শিডিউল থাকে। ঠিক নয়টায় এনেস্থেশিয়ালিস্ট ডাঃ ইন্দুমতি ওকে রেডিওথেরাপি রুমে নিয়ে যায়।
পঁচিশ থেকে আধ ঘন্টার মতো থেরাপি দেয়া হয়।
তারপর ওকে রিকোভারি রুমে অবজারভেশন এ রাখে।
ওর জ্ঞান ফিরার পরেও অনেক টা সময় ঘুমায়।
সাড়ে এগারোটা নাগাদ উঠে যায়।
বারোটা বাজে বাসায় ফিরতে ফিরতে।
রেডিওথেরাপির কিছু সাইড ইফেক্ট আছে । থেরাপি চলার সময় গলা জ্বালাপোড়া করবে, খাওয়ার অরুচি হবে ।
খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিল ইব্রাহিম। খাওয়ার সময় জোর জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়।
৩১ টা রেডিওথেরাপি দেয়া হলো ওর। এর মাঝে চলল কেমো থেরাপি।
রেডিওথেরাপি শেষ হতেই আমরা চলে আসতে চেয়েছিলাম ডাক্তার বলল, অন্তত দশ দিনের ভেতর ফ্লাই করা ঠিক হবে না। দশ দিন পর যাও তোমরা।
দশ দিনের ভেতরে বাংলাদেশ সকল ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করল আমরা আসতে পারলাম না।
ইন্ডিয়ার কোভিড অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। যদিও তামিলনাডু র অবস্থা এতটাও খারাপ ছিল না। ফ্লাইট বন্ধ হলেও বেনাপোল দিয়ে এনওসি নিয়ে দেশে আসা যাবে।
এর মধ্যে আবার কেমোর ডেট চলে এলো আমরা ১২ নম্বর কেমো দিয়ে সেদিন রাতেই দেশে আসার জন্য রওনা হলাম।
আমরা চেন্নাই থেকে আগরতলা, আগরতলা থেকে কলকাতা ফ্লাইটে এসে কলকাতা পৌঁছালাম।
পরদিন সকালে বেনাপোল দিয়ে পাঁচ মাস পর দেশে আসলাম।
দেশে আসতেই শুরু হলো ভোগান্তি।
বেনাপোলে হাজার হাজার মানুষ। বেশিরভাগ ই রোগী এবং তাদের স্বজন।
তাদের সবাইকে বেনাপোলে কোয়ারেন্টাইন করে রাখবে।
প্রশাসনের লোকজন কারো কথা শুনবে না। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী তার কেমো আছে ১০ দিন কিংবা ৭ দিন পর তাকেও বেনাপোলের হোটেলে থাকতে হবে।
কাস্টমস এ লোকজন গাদাগাদি করে বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তাদের নজর নেই।
ডেডবডি নিয়ে এসেছে লোকজন তাদের ও এভাবেই বসিয়ে রেখেছে কোন সীদ্ধান্ত দিচ্ছে না কি করবে।
অনেক কিছু বলতে হলো আমাদের যে আমার ছেলেকে এভাবে বেনাপোলের হোটেলে রাখা সম্ভব নয়। ওর হসপিটালে র কাছাকাছি থাকতে হবে মাত্র ই কেমো দিয়ে এসেছে। ওর হিমোগ্লোবিন, ডাব্লিউ বিসি কমে যাবে। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে ব্লাড দিতে হবে।
তারা কিছুই শুনবে না।
অগত্যা হাসান চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো। তখন গিয়ে বলল, আপনারা আমাদের ঠিক করা গাড়িতে করে ঢাকা যাবেন এবং গিয়ে হসপিটালে কোয়ারেন্টাইন হবেন।
ওদের হাস্যকর যুক্তি , হসপিটাল কি কোয়ারেন্টাইন হয়ে থাকার জায়গা?
তবুও ঢাকা আসতে দিচ্ছে আমরা তাতেই সম্মতি জানিয়ে ঢাকা রওনা হলাম।
রাত আড়াইটায় ঢাকা সিএমএইচে এসে পৌঁছালাম।
এসে প্রথমেই কোভিড সেম্পল দিয়ে বাসায় চলে এলাম।
আমাদের পরিস্থিতি কে আবারও পরীক্ষার মাঝে ফেলে দিয়ে আমাদের কোভিড পজেটিভ আসলো।
আমি আপসেট হলাম না। আল্লাহ তো মেহেরবান যাওয়ার সময় পজেটিভ আসলে আমাদের তো চেন্নাই যাওয়া টাই অনিশ্চিত হয়ে যেতো এবং সেটা হত সবচেয়ে ভয়াবহ! কারণ ইব্রাহিম এর শরীরের অবস্থা তখন ছিল খুবই খারাপ।
রিপোর্ট পেয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতেই তিনি বললেন, যেহেতু আমাদের কোন সিম্পটম নেই আমরা যেন বাসায়ই থাকি সমস্যা বোধ করলে যেন হসপিটালে যাই।
আমরা বাসায় থাকব প্রশাসন থেকে মেনে নিল না ইন্ডিয়া থেকে এসেছি যেহেতু হসপিটালে ই থাকতে হবে।
কি আর করা আমরা সিএমএইচে ভর্তি হলাম।
এর মধ্যে ইব্রাহিমের হিমোগ্লোবিন কমে গেল ব্লাড দিতে হলো।
আমরা ভয় পাচ্ছিলাম ইব্রাহিম এর ফুসফুসের অবস্থা খারাপ। কি হবে জানিনা।
আমাদের সকল আশঙ্কা কে আল্লাহ রহমত করলেন ইব্রাহিম কোভিড মানিয়ে নিলো ।
আলহামদুলিল্লাহ।
তবে আমাদের নেগেটিভ আসতে লাগলো আটাশ দিন আর ইব্রাহিম এর দেড় মাস।
এর জন্য ওর ১৩,১৪ নম্বর কেমো পিছিয়ে গেল।
এপোলোর ডাক্তারদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে তারা কোভিড শুনেই ওর প্রেসক্রিপশন হোয়াটসঅ্যাপ এ পাঠিয়ে দিল।
বলল নেগেটিভ আসতেই কেমো দিয়ে দিতে।
ডেট পিছিয়ে গেছে তাই এখন কিছুটা চিন্তায় আছি।
পরশু ১৩ নম্বর কেমো দিয়ে আসলাম হসপিটাল থেকে।
আলহামদুলিল্লাহ এখন পর্যন্ত ভালো আছে।
ও যে যুদ্ধ টা করছে গত এক বছর থেকে আল্লাহর রহমত ছাড়া এত দূর আসা সম্ভব ছিল না।
আল্লাহ র উপর আমার প্রতিটি মুহূর্তে ভরসা ছিল।
এই যুদ্ধে কিছু মানুষের এত সহোযোগিতা পেয়েছি তাদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা বলে বোঝানোর ভাষা জানা নেই।
অনেক নিকটজনের কাছে যে স্বান্তনাটুকু আশা করেছিলাম তা পাইনি কিন্তু অনেক অনেক মানুষ আমাদের দোয়া আর স্বান্তনা দিয়ে সাহস দিয়েছেন।
হাসানের বন্ধু সৈকত ভাই যেভাবে আমাদের গাইড করেছেন তার এই ঋণ শোধ করার মতো নয়।
হাসানের কোর্সমেট, ক্যাডেট কলেজের ক্লাসমেট ভাই রা যে সহোযোগিতা করেছেন তার জন্য আজীবন কৃতজ্ঞতা আমাদের।
কারো উপর আমাদের কোন ক্ষোভ নেই। এদেশের ডাক্তাররা অনেক অনেক পিছিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসায়। লেখক হুমায়ূন আহমেদের ও বারবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন একটা সয়ং সম্পূর্ণ ক্যান্সার হাসপাতালের। তবে ইট কাঠ পাথরের হসপিটালের দালান থাকলেই হবে না থাকতে হবে দক্ষ ডাক্তার, নার্স এবং ইকুইপমেন্ট।
এবং সঙ্গে ডাক্তারদের মানবিক আচরণের।
ক্যান্সার একটা জটিল রোগ। সেই রোগী এবং তাদের স্বজনদের যুদ্ধটা কিছুটা কমানো যায় তাদের সঙ্গে দুটো মনবিক আচরণ করে।
ক্যান্সার শুধু রোগীকে নয় পুরো পরিবারকে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে দেয় । আমরা নিজেদের যতটা পারি শক্ত রাখার চেষ্টা করেছি।
বাকি রহমত আল্লাহর ছিল।
ইব্রাহিম এর যুদ্ধ কেমো গুলো শেষ হয়ে গেলেই শেষ নয়। আজীবন তাকে মেডিকেশন এর উপর থাকতে হবে কারণ অপ্রিয় হলেও সত্য ক্যান্সার ফিরে আসে। কতদিন পরে ফিরে আসে সেটা সবকিছুর মতো আল্লাহই জানেন।
সবাই দোয়া করবেন ইব্রাহিম যেন সুস্থ থাকে।
সব শেষে বলব সবাই দোয়া করে তার ছেলেটা যেন ডাক্তার হয়, ইন্জিনিয়ার হয়, কিংবা আইটি এক্সপার্ট আমি দোয়া করি আমার ছেলেটা যেন সুস্থ ভাবেই শুধু বেঁচে থাকুক, আমার কোলে থাকুক।
সুস্থতা হলো সবচেয়ে বড় সম্পদ এর বাহিরে আর কিছু নয়। গাড়ি,বাড়ি, টাকা, সার্টিফিকেট সব এক নিমিষেই অহেতুক হয়ে যায় একটা রিপোর্ট এর কিছু অক্ষরে ই তাই শুকরিয়া আদায় করবেন সবাই, আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি।
পরিশেষে বলব, অনেকেই আমাকে ইনবক্স করছেন নিজেদের সন্তান, আত্মীয়-স্বজন এর চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ চেয়ে। আমি বলতে চাই নির্দ্বিধায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন আমার দুটো পরামর্শ যদি কারো সাহায্যে আসে এটা অনেক বড় পাওয়া হবে আমার। কারো সাহায্যে র উছিলা হওয়া অনেক বড় নেয়ামত আমার কাছে।