#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
প্রথম দর্শনেই মনে হল রাই কিশোরী।
অভিমানী কিশোরীটি বুক ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে আমার সামনে বসে আছে। তার চুলের গোছা ঈষৎ অবিনাস্ত। খরখরে ঠোঁট। খড়ি ওঠা হাত। দেখে মনে হচ্ছে, রুক্ষ মরুভূমিতে পথ হারানো একটা ছোট্ট হলুদ বসন্ত পাখি।
শরীরের জ্বরের তাপমাত্রা মাপা যায়, কিন্তু মানুষের মনের কষ্টের মাত্রা মাপা যায় না। খুব কম সংখ্যক মানুষই তা বুঝতে পারে। আমরা সারা জীবন এই মানুষটিকেই খুঁজে বেড়াই। খুব সৌভাগ্যবান কেউ কেউ হয়তো খুঁজে পান। কেউ আবার পেয়েও হারিয়ে ফেলেন। (কারণ হয়তো তখন তারা জানতেন না, ভালোবাসার থেকে ভালোবাসা রক্ষা করা কঠিন। সম্পর্কগুলোকে চারা গাছের মতন লালন করতে হয়।) বাকিদের আজীবন সেই খোঁজ চলতেই থাকে। কবির ভাষায়, “আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যারে।”
কৈশোরের কষ্টের তীব্রতা সম্ভবত পৃথিবীর সব থেকে বেশি দাহিকা শক্তি সম্পন্ন। এই তীব্রতাকে স্পর্শ করার সাধ্য ও পবিত্রতা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এরিক বার্ণের কথায়, ” we all are born as prince but civilization process turns us into frogs.”
মেয়েটির বয়স ১৬ বছর। বাংলা মিডিয়ামে পড়ে, অসাধারন গান গায়, কবিতা আবৃত্তি করে, ছবি আঁকে। আমি কল্পনায় দেখার চেষ্টা করছি দুই বেণী দুলিয়ে লাল চওড়া ফিতে বেঁধে বাচ্চাটি গান গাইছে।
এমন সময় কিশোরী বলে উঠলো, “আপনার জীবনে তো কোনো কষ্ট নেই, আপনি বুঝবেন না।”
আমি, ” কিভাবে বুঝলে?”
কিশোরী, ” শুনলাম আপনার সাথে কথা বললে ভালো ফিল করবো।”
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
বললাম, ” তুমি এমন কারো কাছে শুনেছো যে আমাকে পছন্দ করে। আবার তুমি এমন মানুষও পাবে, যে তোমাকে বলতে পারে আমি কতটুকু নিকৃষ্ট। কাজেই মানুষের কথা বিশ্বাস করার কোন দরকার নাই। “
কিশোরী, ” আপনি কি কখনো আমার মত আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছেন?”
আমি, ” আমি সব সময় অনুভব করি হত্যাকাণ্ড দুই রকম। একটাকে হোমিসাইড বলে প্রচলিত আইনে শারীরিক মৃত্যুর বিচার করে, কিন্তু এর থেকে হাজারগুন বেশি অদৃশ্য হত্যাকাণ্ডে প্রতিদিন মানুষের মনটা মরে যেতে থাকে। মনের এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না। সেখানে ক্ষমতাসীনের দাপটে জোর যার মুল্লুক তার।”
মেয়েটি কেঁদে ফেলল। বলল, ” আমি বাংলা মিডিয়াম বলেই কি এত নিকৃষ্ট?”
আমি বললাম,” আমরা দুজনই তো চশমা পরি, তাই না?”
মেয়েটি আলতো করে হা’ সূচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাকালো।
আমার চশমা আর তোমার চশমার পাওয়ার কি এক?”
মেয়েটি বলল, ” না।”
আমি বললাম, ” তাহলে আমার চশমা দিয়ে তোমাকে যদি দুনিয়া দেখতে বলি সেটা কি তোমার জন্য বাস্তব সম্মত হবে?”
মেয়েটি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মুখের রেখাগুলো ক্রমশ কোমল হয়ে আসলো।
আমি বললাম, ” কেউ যদি ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ে রবীন্দ্র সংগীতকে ট্রাস বলে, স্মার্টনেস খুঁজে চুলের রঙে, স্কিন টাইট ছেঁড়া জিন্সে, ভার্জিনিটি নষ্ট করার অসুস্থ আগ্রহে, নতুন মডেলের মোবাইলে, দামী রেস্টুরেন্টের কফির চুমুকে, নোটের বান্ডিল দ্রুত উড়ানোর সক্ষমতায় তবে সেটা তার ভিন্নতা গ্রহণের অক্ষমতা। সেটা তার limitation of thoughts. অন্যের জন্য তুমি কেন রিজেক্টেড ফিল করবে? “
মেয়েকে বেশ কিছুক্ষন আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। অলক্ষ্যে চোখের কোনে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
আবার আমার মনে হলো সেই আপ্তবাক্য, “unconscious mind is much more powerful than the conscious mind.”
আমি কিশোরীকে বললাম, ” তুমি তো রবি ঠাকুরকে ভালোবাসো, তাই না? উনি কিন্তু বলেছেন, মন দেয়া নেয়া অনেক করেছি মরেছি হাজার মরনে, নুপুরের মত বেজেছি চরণে চরণে।”
মেয়েটির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ” আপনি কখনো রিজেক্টেড হননি?”
আমি, ” ভালোবাসার মানুষের থেকে, রিজেক্টেড হওয়ার তীব্র কষ্ট কি হতে পারে সেটা নিয়ে মোটামুটি আমি সপ্তখণ্ড রামায়ণ লিখে ফেলতে পারব। তুমি যদি আমাকে ভিজিট দিতে থাকো, আমি তোমাকে এপিসোড ওয়াইজ সেই গল্প শোনাতে পারি। তার জন্য তুমি কি তোমার মূল্যবান টাইম, এনার্জি এবং মানি খরচ করবে?”
মেয়েটি হেসে ফেললো। আমার কাছে মনে হল, সাইবেরিয়ায় শীত শেষ। এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি ডানা মেললো ফিরতি পথে নিজ বাড়িতে।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
আমরা কাউকে পছন্দ করতেই পারি। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, সেও বিনিময়ে আমাকে পছন্দ করবেই। হতেও পারে নাও পারে। এটাই বিশ্বকর্মার বিশ্বপটে বৈচিত্রের তুলির আচর।
আমরা বাচ্চাদের পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে শেখাই সাথে উপজাত দ্রব্য হিসেবে নাচ, গান, ছবি আঁকা, আবৃত্তি, সাঁতার, তাইকোন্ডো, কারাতে, দাবা, কোডিং ইত্যাদি কত কিছুতো শেখাই। কিন্তু কখনো কি
বাচ্চাটাকে শিখিয়েছি, ক্লাসে যেই বাচ্চাটা ফেল করেছে তার কষ্টটা অনুভব করতে? করোনার কারণে যে বাচ্চাটার বাবার চাকরি চলে গেছে, তার হীনমন্যতাকে জড়িয়ে ধরতে? ক্লাসের যেই মেয়েটি শ্বেতী হওয়ায় সবার পেছনে লুকিয়ে থাকে তার সাথে টিফিন ভাগ করতে?
মানুষের না বলতে পারাটা যতটুকু শেখা দরকার, না শুনতে পারা শেখাটাও এবং বৃহত্তর অর্থে গ্রহণ করতে পারাটাও ঠিক ততটুকুই প্রয়োজন। সন্তানের মাথায় একটা তথ্য বীজমন্ত্রর মত মাথায় গেঁথে দিতে যে, সৌরজগৎ আমাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। বরং আমি সৌরজগতের একটা অংশ। তাই আমি নিজেকে যতটুকু সম্মান করবো, অন্য কাউকেও ঠিক ততটুকুই সম্মান দেবো। নিজের বেলা আঁটি শুটি পরের বেলায় চিমটি কাটি হবো না।
যারা ভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষ এবং প্রকৃতিকে সম্মান করতে জানেন, তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া চিকিৎসক,
কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।