#চেম্বার_কথন_১৭
ভদ্রমহিলা, ” আমি আর নিতে পারছি না! একটু ভালোবাসবে এমন কেউ নেই আমাকে? আমার সম্পর্কগুলো শুরুতে থাকে অদ্ভুত সুন্দর। স্বর্গীয়! তারপর একটা লম্বা সময় বন্ধুত্ব! যে যেমন ঠিক সেভাবেই পরস্পরকে নেয়া। কিন্তু প্রত্যেকটা সম্পর্ক শেষ হয় বিচ্ছেদে। তীব্র তিক্ততা, বেদনা, ক্লান্তি, হতাশা!”
আমি, ” প্রতেকেটা সম্পর্কের নিশ্চই একটা অদৃশ্য প্যাটার্ন আছে। একটু কি খেয়াল করা যায় কি সেটা?”
ভদ্রমহিলা, ” প্রথমে ভালোলাগা, তারপর ক্রমান্বয়ে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা, আস্তে আস্তে নিজেদের প্রতি অধিকার বোধ বাড়তে থাকে, প্রথমে যেটা ছিল নিছক তোমার জন্য এই এই করছি কারণ তোমার জন্য করতে ভালো লাগে, ধীরে ধীরে সেটা হয়ে যায় তোমার জন্য এত এত করলাম কিন্তু তুমি আমার জন্য কি কি করছো? প্রথমে না বলা খারাপ লাগা, অদৃশ্য অভিমান। তারপর দৃশ্যমান অভিযোগের তীর ছোড়াছুড়ি। এরপর মন খারাপ আর রাগের পাল্লা ভারী হতে শুরু করে। কিন্তু মুগ্ধতা কমে না। ফলে চুপ করে থাকার পালা শুরু হারাই-হারাই ভয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয়কে পার হয়ে রাগ আর মন খারাপ জয়ী হয়। বুক ভাঙ্গা বেদনা আর রাগের চোটে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়।”
আমি, ” এককথায় কি বলা যায় এক পক্ষের Rejection আর অপর পক্ষের missing acceptance এর টানা-পোঁড়েনে সম্পর্কটা ভেঙে যায়?”
ভদ্রমহিলা, ” ঠিক তাই।”
আমি, ” আমাদের প্রতিটি সম্পর্ক তৈরি করতে দ্বিতীয় একজন মানুষ লাগে। একটু ভাবুন তো, প্রতিবারেই কি দ্বিতীয় মানুষটি যাকে আপনি বেছে নিচ্ছেন তিনি বিবাহিত?”
ভদ্রমহিলা, ” হাঁ।”
আমি, ” কেন?”
ভদ্রমহিলা, ” সবার সাথে তো মন মিলে না!”
আমি, ” মন মিললেই কি ভালোবাসতে হবে?”
ভদ্রমহিলা, ” হবে না?”
আমি, ” আপনার মনটা কি বলে? মন মিললেই ভালোবাসতে হয়?”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ ভেবে, ” হাঁ।”
আমি, ” এটাই কি আপনার ভাবনার প্যাটার্ন?”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে, ” হাঁ।”
আমি, ” আপনাকে সম্পর্কগুলো কষ্ট দেয় না, কষ্ট দেয় এই প্যাটার্নটা।”
ভদ্রমহিলা, ” কিভাবে?”
আমি, ” সম্পর্কগুলো আপনাকে আনন্দও দেয় তাই না? আমরা তো সেটা নিয়ে আলোচনা করছি না। আমরা শুধু কষ্টটা নিয়ে আলাপ করছি এখানে। আর কষ্টটা দেয় এই সম্পর্ক ভাঙাটা, আমি কি আপনাকে বুঝতে পারছি?”
ভদ্রমহিলা, ” আপনি একদম ঠিক বুঝেছেন।”
আমি, “একটি বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে কিছুদিন তুমুল ভালোবাসায় একসাথে পথ চলার পরে, আপনি কি বিবাহিত সম্পর্কের কমিটমেন্ট সেখান থেকে চাইতে শুরু করেন? “
ভদ্রমহিলা চুপ করে থাকলেন।
আমি, “তাহলে তো আর তখন আপনারা এক প্লাটফর্মে থাকলেন না। কারণ শুরুতে তো এই চাওয়া ছিল না। এবং খেয়াল করে দেখেন এই চাওয়া থাকলে সম্পর্কটাই শুরু হতো না। ফলে সম্পর্কটি ভাঙবেই। তাই না?”
ভদ্রমহিলা স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
আমি, ” আবার একটু খেয়াল করুন এই প্রতিটি সম্পর্ক থেকে আপনি কি মিস করছেন? একটা শব্দে বলবেন।”
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ” স্বীকৃতি?”
আমি, ” আবার ভাবুন।”
ভদ্রমহিলা, ” হুঁ! স্বীকৃতি।”
আমি, ” কিসের স্বীকৃতি?”
ভদ্রমহিলা চুপ।
আমি, ” বৈবাহিক সম্পর্কের স্বচ্ছতার স্বীকৃতি কি বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে দেয়া সম্ভব? নাকি চাইলেই পাওয়া সম্ভব?”
ভদ্রমহিলা তাকিয়ে থাকলেন।
আমি, ” এটাই আপনার প্যাটার্ন যে এই স্বীকৃতি আপনি বারবার বিবাহিতের কাছে কাছে খোঁজেন। রবীন্দ্রনাথের কথায়,
দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ
ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ
পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে
চিরজনমের বেদনা
তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি
অবুঝ আঁধারে কেন মরি কাঁদি
দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে
বহিয়া বিফল বাসনা!’
প্রতিবার এই বৃত্তে আপনি ঘুরপাক খান। এটাই আপনার চক্রব্যূহ। এই প্যাটার্ন থেকে আপনি নিজে বের হয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে একই কষ্ট আপনি আবার পাবেন। আম গাছ থেকে কাঁঠাল চাইলে তো হবেনা। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে বৈবাহিক মনোদৈহিক উষ্ণতা চাইলে পাবেন কিন্তু মনোসামাজিক উষ্ণতা পাবেন না। আর আপনি সেটাই মিস করছেন। এসবের মাঝখানে শুধু লাভ হয় আমার মত পেশাজীবীদের রুজি রুটি বাড়ে। আগামীবার সম্পর্ক করলে যিনি মর্যাদার সাথে আপনার সম্পর্কের মনোদৈহিক এবং মনোসামাজিক মূল্য দিতে পারবেন তাকেই বেছে নেবেন। কেমন?”
( কথোপকথনের এই অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাক্টিশনার।