#চেম্বার_কথন_20
ভদ্রলোক, ” বাবা যখন মারা যান তখন আমার মায়ের বয়স ২৩ বছর। প্রচণ্ড অভাব। যেভাবেই হোক কামাই করতে হবে। তাই একদম অল্পবয়সে দেশ ছাড়ি। ছোটো ৫ ভাইবোনের পড়ালেখা করিয়েছি, বিয়ে দিয়েছি। প্রত্যেকে বিসিএস ক্যাডার। এখন ওদের আমাকে নিয়ে সমাজে লজ্জা লাগে। আমি দেশে ফিরলে বলে কবে বিদেশে ফিরবো! এমনকি ওদের বাচ্চাদের জন্য কিছু আনলে বলে এসব জামা কাপড় ওরা পড়ে না। ওদের রুচি আলাদা। আমি বুঝি না আমিই কি ভুল? এখন শরীর আর কুলায় না। বিদেশের হাড় ভাঙ্গা খাটুনি! বিয়ে করে থিতু হতে ইচ্ছে করে! একটা জমি, পুকুর। অনেক তো বিদেশি জীবন হলো। এখন একটু দেশের মাটিতে গ্রামের বাড়িতে থাকি। কিন্তু আমার মত বয়স্ক অশিক্ষিতকে কে মেয়ে দেবে? যেসব প্রস্তাব আসে তাতে নাকি ভাই বোনদের মানসম্মান নষ্ট হয়।”
মনে হলো আমিতো প্রতি বছর সাইবেরিয়ান হাঁস দেখি। দুঃখও কি পরিযায়ী হয়? এই পরিযায়ীর দুঃখ কি আদৌ আমি বুঝি? ‘পরিযায়ী দুঃখ’ বলে কি একটা শব্দ মনস্তত্ত্বে অন্তর্ভুক্ত করা যায়? আমি এমন কোনো শব্দ পড়িনি। ইদানিং মনে হয় এত কম জানি! এত কম বুঝি! তারও থেকে ভয়ঙ্কর হলো আমি কি জানি না সেটাও বুঝি না।
ভদ্রলোক, ” আমি কি ভুল? ওরাই কি ঠিক?”
আমি, ” আমরা চাই আমি যেমন আছি সেভাবেই সামনের মানুষটি আমাকে মেনে নিক। নিতে পারল কি পারল না সেটা সামনের মানুষটি সীমাবদ্ধতা। আমি ঠিক ভুল বলে জাজমেন্টাল তকমা আটকাবো না। যার যার বিবেচনাবোধ একান্ত নিজস্ব উপলব্ধি। সেখানে অন্য কেউ হাত দিতে পারে না। আপনার কাছ থেকে খাওয়া-পরা, পড়াশোনার পুরো খরচ নিয়ে বেড়ে উঠে এখন ডানা শক্ত হওয়ার পরে যদি ওদের মনে হয় আপনি অপ্রয়োজনীয়, তবে সেটাকে তাদের অকৃতজ্ঞতা বলেও লেবেল করা যায় আবার ভাবনার সীমাবদ্ধতাও বলা যায়। আমি জাজমেন্টাল সমালোচনায় ঢুকছি না। কারণ সেই আলাপ করলে দিন পার হয়ে যাবে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন আপনি। কারন তারা তো আমার সামনে নেই। কাজেই তারা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি নিজেকে কোথায় কোথায় বঞ্চিত করেছেন এতদিন সেই জায়গাগুলো একটু খেয়াল করুন। এখন এই পরিণত বয়সে আপনি কিভাবে নিজের সেই অপ্রাপ্তিগুলোকে মেটাতে পারেন, সেই ভাবনাটাই ভাবো বেশি জরুরি। তাই না?”
ভদ্রলোক, ” আর ওরা যেটা আমার সাথে করছে? সেটা কি ঠিক? আমার অপমান লাগে।”
আমি, ” ওদের মনে হয়েছে ওরা করছে। আপনার যেমন মনে হয়েছিল নিজের সবকিছু বাদ দিয়ে টাকা কামাই করে ওদেরকে পাঠাতে হবে। আপনার রাগের থেকেও বেশি প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। এবং এই কষ্টটা তো সত্যিই। এই রাগটাও সত্যি। আমরা এই দুঃখটা এবং রাগটাকে গ্রহণ করব। কিন্তু সেটাকে ধরে বসে থাকব না। এখনই নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমি কি করতে পারি সেটা ভাববো। কেমন? এখন আপনিই বলেন, ওদের কথা ভেবে কষ্ট আরও বাড়াবেন? নাকি এখন থেকে নিজেই দায়িত্ব নেবেন নিজের কষ্ট কমানোর? বহুদিন তো অন্যের দায়িত্ব নিলেন।”
ভদ্রলোক, ” আমি এখন কি করবো?”
আমি, ” আপনার মনটা কি চায়?”
ভদ্রলোক লাজুক হেসে, ” সংসার করতে।”
আমি, ” কে মানা করছে? মেয়ে দেখেছেন?”
ভদ্রলোক, ” যেসব প্রস্তাব আসে, সেটাতে নাকি ওদের মাথা কাটা যায়।”
আমি, ” আরে ধুর! বিয়ে করবেন আপনি। ওদের কি কাটা গেল না গেল না তাতে আপনার কি যায় আসে?”
ভদ্রলোক, ” আমি এই বয়সে, কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে পারবো না।”
আমি, ” বেশতো! আপনার সাথে মানানসই কাউকে দেখেননি?”
ভদ্রলোক, ” যেসব সম্বন্ধ আসে এদের বেশিরভাগই ৩০ এর কম। আমার সাথে বনবে না।”
আমি, “এমন কেউ নেই যাকে আপনার মনে ধরে?”
ভদ্রলোক, ” আমাদের প্রাইমারি স্কুলের অংক স্যারের মেয়ে। আমার ক্লাসে পড়তো। বাজা বলে স্বামী তালাক দিসে। ওরে পছন্দ করতাম।”
আমি, ” এখনো করেন?”
ভদ্রলোক আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
উনার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে গেলাম কি প্রচন্ড ভালোবাসা ভদ্রলোক লালন করে চলেছেন সেই ভদ্রমহিলার প্রতি।
আমি আস্তে আস্তে বললাম, ” মাঝে মাঝে আমরা দেরি করে ফেলি। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সুযোগ কি চলে যায়?”
আজ সকালে ঘুম ভাঙলো ভদ্রলোকের ফোনে। ওনার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে। পঞ্চাশোর্ধ দুটো মানুষ যখন ঝরনার মতন খলখল করে ভিডিও কলে বিয়ের দাওয়াত দেন সাতসকালের ঘুম ভাঙিয়ে, তখন মনে হয় এই কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর রোদ্দুরের গন্ধে ঝলমল করে উঠল।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।