#চেম্বার কথন পর্ব ২২
মেয়েটি, ” আপনি কি জানেন, আমাদের হিন্দুদের মধ্যে ফার্স্ট কাজিনের বিয়ে হয় না?”
আমি, ” জ্বী!”
মেয়েটি, ” আমার খালাতো ভাই আমার থেকে ২ বছরে বড়। আমরা আলাদা ভার্সিটিতে পড়ি। সমস্যাটা ওকে নিয়েই। ওরা বেশ অনেকদিন দেশের বাইরে ছিল। ফিরেছে গত বছরের শেষের দিকে। তারপর থেকে জীবনটা হেল করে দিয়েছে আমার আর আমার খালাতো বোনদের। আমার মা’রা ৭ বোন, ভাই নেই। আমার পুরা নানির গুষ্টিতে এই একমাত্র ছেলে। এ নাকি শিবরাত্রির সলতে। আমার নানী, মা-খালারা সম্পূর্ণ এর প্রতি বায়াসড। সাতখুন মাপ। এখন তো অনলাইন ক্লাস। আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। নানা বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে আমাকে থাকতে হয়। নানা অসুস্থ তাই। অন্য খালারাও আসেন। বিভিন্ন সময় একা পেলেই হলো। আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করে। শুধু যে আমি তা নয়! আমার অন্য খালাতো বোনেদেরও। আমিই বড়। আমরা বোনরা খুবই কানেক্টেড!”
আমি, ” মা-খালা, নানী এনাদেরকে জানাচ্ছো না কেন?”
মেয়েটি, ” প্রশ্নই ওঠে না! আমার নানী, মা, খালাকে বলাই যাবে না। তাঁরা প্রথমত এটা বিশ্বাসই করবে না। দ্বিতীয়ত বলবে আমার দোষ। আমি প্রভোক করেছি। এমনই প্রায়ই বলে সোনার চামচ বাঁকা ভালো। মেয়ে মানে তো বান্দি!”
আমি, ” সাতজনই?”
মেয়েটি, ” আপনার কোন ধারনাই নেই! এরা সাতজন একই ক্ষুরে মাথা কামানো! ছেলে হলে সব মাপ। যাদের ছেলে নাই তাদের তো অনন্ত নরকবাস।”
আমি, ” তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?”
মেয়েটি, ” এর আগে খেয়াল করেছি আমি ঘুমালে, আমাকে একা পেলেই আমার পা চাটে। ভয়ে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে যে এইবার আবার নানা বাড়ী গেলে কি হবে? আমি এখন কি করবো?”
আমি, ” কি করতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছো?”
মেয়েটি, ” আবার যদি চেপে ধরে বা পা চাটে?”
আমি, ” পা চাটাটা সম্ভবত ফেটিশ! যৌন বিকৃতি, প্যারাফিলিয়ার ভিতরে পড়ে। পা ফেটিশিজম যৌন অনুশীলন। পা ফেটিশিস্ট প্রায়ই পুরুষ। এটি তার যৌনতার আচরণের মধ্যে পড়ে। পা দেখা, আদর করা, ঘ্রাণ নেওয়া বা চাটা। কিন্তু যেহেতু ছেলেটি নিজে বলছে না, এই আচরণ কেন করছে; কাজেই এই ট্যাগলাইন তার নামে, না জেনে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তুমি এতো মেধাবী হয়েও প্রতিবাদ করতে পারো না?”
মেয়েটি, ” কিভাবে করব? সবাই আনকন্ডিশনালি ওর দলে। নালিশ করে লাভ নেই।”
আমি, ” নালিশ করা বাদে তুমি নিজে কি করতে পারো ভাবো তো? নালিশ করে বালিশ পাবি ইলিশ দিয়ে পোলাও খাবি, শুনেছ?”
মেয়েটি মাথা নেড়ে না বলে খুব অসহায় ভাবে বললো, ” আমি কি করবো? কিছু করবার নেই আমাদের বোনদের সহ্য করা ছাড়া?”
আমি, ” এতদিন মা খালার উপর নির্ভর করেছ। এবার চিন্তা করে কি একটু দেখবে যে নিজে কি করতে পারো? সনাতন ধর্মে নারীকে আদিশক্তি বলে না?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। বুঝলাম ভাবতে চেষ্টা করছে। মানুষ ১২ ধরনের অবচেতন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ছোটবেলা থেকে বড় হয়। এদেরকে ইনজংশন বলে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, অসম্ভব মেধাবী এই মেয়েটির মধ্যে ডোন্ট থিঙ্ক ইঞ্জাংশন প্রবল। পড়াশুনায় দুর্দান্ত কিন্তু যখনই পারিবারিক বিষয়টি চলে আসছে তখনই সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
কতশত অসম্ভব মেধাবী মেয়েরা পারিবারিক যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে আমরা খোঁজও রাখি না। লক্ষী মেয়ে হও বলে আমরা যতবার মুখে ফেনা তুলি (কন্ডিশন করে বিলিভ সিস্টেমে খোদাই করে দেই), তার সিকিভাগও কি শেখাই নিজের মর্যাদা কিভাবে রাখতে হয়? নাকি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেয়েকে আমরা সহজে গ্রহণ করি?
আত্মমর্যাদা আর অহংকার যে এক জিনিস নয় সেটা কি সমাজ এখনও বোঝে? এই সমাজেরই প্রবচন, ‘নারী রাগলে বেশ্যা পুরুষ রাখলে বাদশা।’ অথচ কখনো কখনো রাগ একটি সুস্থ অনুভূতি। যেটা নিজের অধিকার রক্ষা করতে আমাদেরকে সাহায্য করে।
আমি, ” তোমার পায়ে ব্যথা?”
মেয়েটি অবাক হয়ে, ” না তো!”
আমি, ” ধরো কেউ যদি পা চাটতে আসে, তাহলে অন্য পা দিয়ে কষে একটা লাথি মারলে কেমন হয়?”
তারপর বাকিটা ইতিহাস। মেয়েটির মা আকুল হয়ে এই রাত্তির তিনপ্রহরে ফোন করে আমার ঘুম ভাঙালেন।
কেন?
কারন খুব বিপদে পড়েছেন। ঢাকা শহরের কোথায় ইমারজেন্সিতে এমবিবিএস এবং বিডিএস ডাক্তার একসাথে রোগী দেখেন জানতে চান।
আমি খুবই অবাক হয়ে আধো ঘুমে প্রশ্ন করলাম, “কেন?”
মেয়ের মা, ” কি বলবো বলুন, ছেলের চোয়াল ভেঙে গেছে, ২টো দাঁত পড়ে গেছে!”
আমি আরো অবাক হয়ে, ” কিভাবে?”
মেয়ের মা, ” কথা বলতে পারছে না তো! মনে হচ্ছে পড়ে গেছে।”
আমি কি জানি ধরি ধরি করে ঘুম ভাঙ্গা মাথায় হিসাব মেলাতে ধরতে পারছিনা।
জানতে চাইলাম, “কোথায় পড়লো?”
মা, ” আমার মেয়ে যেই ঘরে ঘুমাচ্ছিল, ওই ঘরের মেঝেতে! ওই তো সবাইকে ডাকলো! দাদার দাঁত কুড়িয়ে গুছিয়ে রাখলো। মেয়েই বললো আপনাকে ফোন করতে!”
( আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে কথোপকথনের এই অংশটুকু কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে প্রকাশ করা হলো! )
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রক্টিশনার
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ।