#চেম্বার কথন পর্ব ৩৫
৯ বছর বয়সী মেয়েটা বললো, “আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।”
আমি, “কেনো?”
মেয়েটি, ” বাবা মা বারবার ঝগড়ার সময় বলতো, আমার জন্য নাকি বিয়েতে আটকে আছে। ওরা তো আমাকে চায় না। আমি একটা বোঝা!”
আমি, ” বোঝা কে বলেছেন?”
মেয়েটি, ” মুখে কেউ বলে না, কিন্তু আমি তো বুঝি। আমাদের বাসায় যে বুয়া কাজ করে ওর বাবা-মা নাকি ওকে একা ফেলে রেখে আলাদা হয়ে গেছিল। তাই রাহেলা খালা আজ কামের বেটি! আমি কামের বেটি হতে পারবো না! বড় হয়ে গেছি তো এখন সব বুঝতে পারি।”
আমি, ” এটা কে বলেছে?”
মেয়েটি, ” রাহেলা খালা।”
আমি, ” এটা শুনে তুমি কেমন ফিল করলে?
মেয়েটি, ” খুব ভয় লাগলো, তাই ভাবলাম, আমি এতো কাজ করতে পারবো না। তাই ছাদ থেকে লাফ দেই।”
আমি, ” তারপর? “
মেয়েটি, ” দারোয়ান চাচা দেখে ফেলে। দৌড়ায় নামায় আনে!”
আমি, “তারপর?”
মেয়েটি, ” আব্বু আম্মু খুবই অবাক হয়! আব্বু আমাকে একটা থাপ্পর দেয়; ঠিক মা এর মত গুটিবাজ হয়েছি বলে। আম্মু আমাকে ধরে কাঁদছিল। তারপর উঠে আব্বুকে দুমদাম মারতে থাকে। ওরা সব সময় যেমন রেসলিং করে!”
আমি, ” তুমি কি করলে?”
মেয়েটি, ” রাহেলা খালা, নিনা আন্টিকে ফোন করে ডেকে আনে। নিনা আন্টি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে আসে।”
আমি, ” তোমার কি আসলেই মরে যেতে ইচ্ছা করে?নাকি প্রচন্ড ভয় হয় আব্বু আম্মু না থাকলে একা কিভাবে থাকবে? যাতে সেই কষ্টটা না হয় সেজন্য ভাবছো মরে গেলে কষ্ট কমে যাবে?”
মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। এই বয়সে বাচ্চারা সহজে কেঁদে ফেলে। মেয়েটা একবারও কাঁদলো না। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ” তুমি কিভাবে বুঝলে?”
আমি, ” কারণ আমিও তো বাচ্চা ছিলাম একদিন! তাই না? আমিও ভয় পেলে ভাবতাম পালিয়ে যাবো! মাঝে মাঝে এখনো তাই ভাবি!”
মেয়েটি, ” তাহলে পালাও না কেন? তুমি তো বড়! তোমার কথা মানুষ শুনবে।”
আমি, ” না রে মা! বড়রা খুব কমই কেউ কারো কথা শোনেন। যেটা শোনে সেটাও সাথে সাথে উত্তর দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। কিন্তু কথাটা শোনা আর সেই কথাটা অন্য মানুষটি কেন বললেন? এই জায়গাটা বুঝে উত্তর করা খুব কম বড়ো মানুষই করেন। উত্তর দিতে হবে তাই প্রশ্ন করার সাথে সাথে বেশিরভাগ বড়দের মুখে উত্তর রেডি থাকে। তুমি স্কুলের দুটো ইংরেজি শব্দ শিখছো না! Hearing আর listening? শুনেই পটপট করে উত্তর দেয়াটা হচ্ছে hearing! এটা শুধুই বলবার জন্য বলা। অনেকে আছে না শুধু মুখে মুখে বলে তোমাকে অনেক ভালোবাসি? “
মেয়েটি সাথে সাথে, ” হা বলেই তো! মামীতো বলে সবার সামনে আই লাভ ইউ! কিন্তু আমি শুনেছি মামাকে ঘরে ডেকে নিয়ে নানুর সামনে বলছে, তোমার বোনের ডিভোর্স হলে এই বাচ্চাকে কিন্তু রাখতে পারব না। আমার কথা ওরা শুনতেই চায় না।”
আমি, ” হুঁ! কিন্তু listening মানে শুনতে চাওয়া যে তোমার মনে কি কষ্ট হচ্ছে? তুমি কোথায় থাকতে চাও? তুমি আসলে কি চাও? তোমার কষ্টটাতে ওনার কেমন লাগছে সেটাও উনি বুঝতে চেষ্টা করতেন।”
মেয়েটি, ” কেউ আমার কথা শুনতে চায় না!”
আমি, ” তুমি কি মনে করো যে পৃথিবীতে তোমার মতন বাচ্চাদের কথা শোনার জন্য একটা মানুষ থাকা দরকার? যিনি তোমার কষ্টটা বুঝবেন?”
মেয়েটি সাথে সাথে উত্তর দিল, ” হা। কিন্তু কেউ নাই”
আমি, ” এক্সাক্টলি! কেউ নেই কিন্তু তুমি তো আছো। একটু আগেই তো বললে তুমি তো বেশ বড় হয়ে গেছো, ন বছর হয়ে গেল। সব বুঝতে পারো তাই না? তাহলে পড়াশুনা করে আর একটু বড় হয়ে কি সেই রকম একটা মানুষ তুমি হতে পারো না? যাতে তোমার মতন আর কোন বাচ্চা ভবিষ্যতে কষ্ট না পায়? এই বাচ্চাগুলোকে তুমি পারবে না হেল্প করতে?”
মেয়েটি হঠাৎ করে নড়েচড়ে বসল। তারপর বলল, “আমি কি একা আসলে পারব?”
আমি, ” একা একা কাজ করা মুশকিল। কিন্তু তুমি আর আমি একটা টিম যদি তৈরি করি, আমরা অবশ্যই পারবো। তুমি স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে হেল্প করবে। আর আমি তোমাকে হেল্প করব। কারণ দিনশেষে, we are not independent we are interdependent. তাই না? মরে যাওয়াটা সহজ, পালিয়ে যাওয়াটাও সহজ! কঠিন হলো মোকাবেলা করা। তুমি যেখানে এত চমৎকার বোঝো, মোকাবেলা না করে ছেড়ে দিবে? বাসার বাইরে হোস্টেল ও তো আছে। আমি নিজেই মেডিকেলে পড়ার সময় হস্টেলে ছিলাম। প্রথম দিকে একটু কষ্ট হয়। কিন্তু তারপর শিখে যাবে। এখন তুমি বলো, তুমি কি করবে?”
মেয়েটি: ” আমাদের ক্লাসে ফিওনারও একই সমস্যা।”
আমি, ” তাহলে আমি যেই কথাগুলো বললাম এগুলো কি তুমি ফিওনাকে বলতে পারবে? তারপর তোমরা দুইজন মিলে এরকম আর কয়টা বাচ্চা আছে খুঁজে বের করলে? কেমন হয়?”
মেয়েটি, ” খুব ভালো হয়।”
আমি, ” আমি কি আগামী সপ্তাহে তোমার সাথে আবার বসতে পারি? তুমি কেমন আছো? কিভাবে আছো? কি কি করতে পারো এসব আলাপ নিয়ে? শুধু একটাই শর্ত এরপর লাফ দেবার কথা মনে হলে আগে আমাকে ফোন করবে কেমন? প্রমিস করবে?”
মেয়েটি, ” প্রমিস!”
মেয়েটি আমার দিকে চোখে চোখে তাঁকিয়ে থাকলো। হঠাৎ করে আমার মনে হল যে মুখে ভাষা খুজে পাচ্ছি না। কারণ মেয়েটার দৃষ্টি ঝকঝকে তলোয়ারের মতো। সব বুঝতে পারছে। শিশু বলে ভোলানো কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইদানিং আমি কত কম বুঝি বার বার সেটা নিজেরই মনে হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ শিশু ভোলানাথ এর মধ্যে কত কিছু লিখেছেন। কিন্তু ইদানিং রিয়েলিটি শো’র নাচের অনুষ্ঠানে, যখন ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের যৌনগন্ধী নাচের মুদ্রায় তাকানো, হাত নাড়া, অঙ্গভঙ্গি করতে দেখি তখন মনে হয় এই মানুষগুলোর কি আসলেই যোগ্যতা আছে বাবা মা হওয়ার? যৌনতা উপলব্ধির বয়সের আগেই বাচ্চাকে এই আচরণগুলোর সাথে পরিচয় করানোর মধ্যে কি সিদ্ধিলাভ আছে?
আমি সব সময় একটা কথা বলি, আমরা যদি ৫০ বছর আগের হাঁস-মুরগি পালা নতুন করে শিখতে পারি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, তাহলে প্যারেন্টিং কেন নয়? এই কথা বলবার কোন অবকাশ নেই যে প্যারেন্টিং কি শিখতে হয় নাকি? আমার বাবা-মা আমাদেরকে পালেন নাই? তখন আমার মনে হয় বলি, আপনার বাবা মা যেভাবে হাঁস-মুরগি পেলেছেন, আপনি এখন মুরগির ফার্ম করলে কি সেভাবেই পালবেন? এমনি এমনি মানুষ বাচ্চা পালতে শিখে যায় না। এর জন্য পড়াশোনা করতে হয়। কারণ একেক বয়সের বাচ্চার একেক ধরনের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এখন অনেক গবেষণা হচ্ছে। নতুন নতুন তথ্য আসছে।
দম্পতিদের প্রবণতা থাকে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলে বাচ্চাকে অস্ত্র হিসেবে, একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর ভাবে ব্যবহার করা। এই অসুস্থ আচরণ বন্ধ করা খুব জরুরি। কারণ এটা বাচ্চার উপরে মানসিক নির্যাতন।
আমরা অনেক সময় হাসতে হাসতে বলি, “তুমি কাকে ভালোবাসো বাবাকে না মাকে?” এই প্রশ্ন করাটাও কিন্তু একদম অভদ্রতা এবং বাচ্চার জন্য অমর্যাদাকর।
বড়দের পৃথিবীটা বাচ্চাদের থেকে আলাদা। বড় হতে হতে আমরা ভুলে যাই আমার শৈশবের পৃথিবীকে। বাবা-মার বিচ্ছেদ হতেই পারে। রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ প্রত্যেকেই দম্পতিদের সেই অধিকার দিয়েছে।
কিন্তু তার মানে এটা নয় যে বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাহ্য করব। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের বিরুদ্ধে বাচ্চার কাছে বদনাম করবার কোন অধিকার নেই। কারণ মনে রাখবেন স্বামী-স্ত্রী যে কেউ চাইলে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ পুনরায় একাধিক বিবাহ করতে পারেন। কিন্তু এই বাচ্চাটির কাছে সারা জীবনের জন্য একটাই বাবা, একটাই মা।
( আমার চেম্বারে আসা মেয়েটি এবং তার নিনা খালার অনুমতি সাপেক্ষে মনোসামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে কথোপকথনের আলোচ্য অংশটি প্রকাশ করা হলো।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর সাইকোথেরাপি প্রক্টিশনার।