#চেম্বার কথন পর্ব ৩৬
ভদ্রমহিলা, ” আমার শাশুড়ি আমাকে অসম্ভব কষ্ট দিচ্ছেন! কথায় কথায় আমার দোষ ধরা, ননদের সাথে তুলনা, চেহারা নিয়ে খোটা সব। কিন্তু আমার হাজব্যান্ডের সামনে একদম অন্য চেহারা! মা ছাড়া কথাই বলেন না! মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। একদম ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড! সিনেমার কুচুটের মত! “
আমি, ” হাসব্যান্ডের সাথে বন্ধুত্ব আছে?”
ভদ্রমহিলা, ” অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। আমার বয়স ৩৭। আমার হাসব্যান্ড ২ বছরে বড়ো। মাত্র দেড় বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। ও খুবই কম কথা বলে। বুঝি সে চেষ্টা করে আমার যত্ন করতে। সুবিধা অসুবিধার দিকে চোখ রাখতে। কিন্তু মুশকিল হলো নিজেই বাসায় থাকে না। আমি অফিস শেষ করে বাসায় ফিরি সন্ধ্যায়। আমার শাশুড়ি, মুখে কিছু বলেন না। কিন্তু ঠেস মেরে কথা বলেন। প্রথম দিকে তো বুঝতামই না। এখন বুঝি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ওনার বোনদেরকে বলেন। এখনো রান্না করতে হয়! ঘরের কাজ করতে হয়! বাসায় কিন্তু দুটো হেলপিং হ্যান্ড। প্রথম প্রথম নিজেই এই কথা শুনে আমি রান্না করতে ট্রাই করি। তখন বলা শুরু করেন, অখাদ্য, কুখাদ্য জোর করে খাওয়াচ্ছি। রান্না ঘরের দখল নিচ্ছি। উনি বাতাসে কথা বানান। বিশ্বাস করেন! আমি বুঝতেই পারি না তিলকে কিভাবে তাল করেন। হাসব্যান্ডকে কিছু বলতে রুচিতে বাঁধে। আমি ও আমার হাসব্যান্ড দুজনেই আজীবন হোস্টেলে মানুষ। এসব পারিবারিক আবহাওয়া কম বুঝি। শাশুড়ি একদম চান না যে আমরা কোথাও একা যাই। আমাদের হানিমুনও হয় নাই। কারণ উনি চান নাই। আমাকে বলেছেন বিয়েতে অনেক খরচ হয়েছে। এখন সেভিংস দরকার। আমিও ভাবলাম তাই তো। কিন্তু নিজের মেয়ের বিয়ের পরে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নিজের মেয়েকে বলছে, ‘হানিমুনে অবশ্যই যাবি। লাগলে আমি টাকা দেবো। জীবন তো একটাই।’ আমি সেই প্রথম অনুভব করলাম উনি ডবল ফেস। এর পর পদে পদে খেয়াল করতে থাকলাম। আসলেই। আমি এখন কি করবো? আমার বাবা ঈদে কোন গরুটা দেবেন সেটাও উনি ঠিক করে দেন প্রথম বার। তখন অনলাইনে কোরবানির হাট বসেছে। এই বার যেমন বলেছেন ১০ মন আম পাঠাতে। আম কাঠাল খাওয়াবেন সবাইকে। অসহ্য হয়ে যাবার আগেই বিহিত করতে চাই। এমন না যে আমার বাবার সামর্থ্য নেই। প্রশ্ন হচ্ছে এত বাড়াবাড়ি কেন করবেন বাবা?”
আমি, ” এইগুলোতে আপনার হাজবেন্ডের সম্মতি আছে?
ভদ্রমহিলা, ” সে কিছুই জানে না। গরু দেখে তো অবাক। তখন আমার শাশুড়ির প্রচন্ড নাটক! কি দরকার ছিল এসব পাঠানোর? সেই গরুর মাথা ভুড়ি, মগজ, কলিজা, রানের মাংস সব আলাদা আলাদা করে প্যাকেটে প্যাকেটে ভরে উনি মেয়ের বাড়ি পাঠালেন।”
আমি, ” মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কি খুব জিনিষ পত্র চায়?”
ভদ্রমহিলা, ” মোটেই না। ওর শাশুড়ি নেই। শুধু শ্বশুর আছে। কানাডাতে থাকেন। আমার সাত মাস পরে বিয়ে হয়েছে। ফোনে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির মামা, খালা, ফুপু, চাচা সবাইকে বলছেন উনি গরু দিয়েছেন জামাইকে ঈদে। এরপর আমার বাবার দেওয়া গরুর মাংস মেয়ের মামা শ্বশুর, চাচা শ্বশুর, খালা শাশুড়ি, ফুপু শাশুড়ি, মোট ১২ টা বাসায় সবাইকে পাঠিয়েছেন প্যাকেট করে। অথচ আমি জানতাম না। বিকালে কি আনতে নিচে গেছি, দেখি উনি নিজে নিচে বসে বসে লিস্ট এ টিক দিচ্ছেন আর কথা বলছেন।”
আমি, ” নিচে মানে?”
ভদ্রমহিলা, ” আমাদের ৩ তলা নিয়ে থাকি । একদম নিচে হল, কিচেন, গেস্ট বেডরুম। দোতলায় ডাইনিং, লিভিং, গেস্ট রুম। আর আমরা ৩ তলায় থাকি, বেডরুমগুলি ওখানে।
আমি, ” কাউন্সেলিং এ কেন এসেছেন?”
ভদ্রমহিলা, ” আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। আমি কি করবো? বিশ্বাস করেন আমি কোনদিন অসম্মান করিনি। একটা শব্দও হাসবেন্ড এর কাছে উচ্চারণ করিনি। মনে হচ্ছে উনি যেন এতে আরো পেয়ে বসেছে। আমি এখন কি করবো? আমাকে আবার মনে করিয়ে দিতে বলেছেন বাবা কে এই ঈদে যেন ৭টা শাড়ি দেন। সব মামী শাশুড়ি, খালা শাশুড়ি, ফুপু শাশুড়িকে। উনি অনলাইনে সিলেক্ট করে দিয়েছেন। ৮০ কাউন্টের জামদানী।”
আমি, ” সোজা না’ বলবেন। ভদ্র গলায়, নিচু টোনে, চোখের চোখ রেখে। সিদ্ধান্তের জায়গা থেকে জানিয়ে দেবেন। তারপর দেখেন উনি কি করেন। যেহেতু আপনার হাজবেন্ডকে এতো দিন ইনভলভ করেন নাই, তাই এবারও নাই বা করলেন। না এর প্রত্যুত্তর কি ভাবে দেন সেটা আগে দেখুন। কারণ আমরা না বলতে ও না শুনতে মোটেও অভ্যস্ত নই।”
বাংলাদেশের দুটো ছেলেমেয়ের বিয়ে হয় না বিয়ে হয় দুটো পরিবারের। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটো প্রভাবই আছে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিছু কিছু অভিভাবক যখন শ্বশুর-শাশুড়ি হন, তখন অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্য অনেকেই পুরনো অভ্যস্থতা ছাড়তে পারেন না। মা মনে করেন সন্তান বিয়ের কি বোঝে? কাজেই সন্তান না চাইতেও অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা আগবাড়িয়ে উপদেশ দেন। এই উপদেশের পটভূমি হয় বাবা-মা নিজেরা তার জীবনে যেটা ফেইস করেছেন সেটা। কিন্তু সেই আমল এই আমল হতে আলাদা। হতেই পারে সেই আমলে আমার শাশুড়ি আমাকে জ্বালিয়েছেন। কিন্তু তার মানে যে বউ শাশুড়ির সম্পর্ক নেতিবাচক হতেই হবে এমন কথা নেই। কাজেই আমি যদি আমার পুরনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্তমানকে বিচার করতে চাই, সেই ক্ষেত্রে আমি আমার সন্তানের বর্তমান জীবনে অশান্তি টেনে আনব এই কথাটা বিনিতভাবে বলতে চাই। ইদানীং প্রায় খেয়াল করি কতো কম জানি। আর যেটুকুও বা জানি সেটাই বা আদতে কতটুকু বুঝি? মনে রাখতে হবে দরিদ্রতা সবসময় পকেটে থাকে না, মনেও থাকে।
এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার জেনারেশন গ্যাপ। যেটা বউ শাশুড়ি দুইজনকেই খেয়াল করতে হবে। আমি ২৫ বছর ধরে আমার সন্তানকে যা শিখিয়েছি, সেটা কি চট করে অন্য বাড়ির আরেকটা সন্তান একমাসের শিখে ফেলতে পারব? তার জন্য সময় প্রয়োজন। আমরা একটা নির্দিষ্ট বয়স হলেই সন্তানকে বিয়ে দেই। সন্তানের উপর সে আস্থাটা আমার রাখা দরকার যে তার সংসারটা সে তার মতন করে করতে পারবে। ভুল করবে। ভুল থেকে শিখবে। আমি যদি আগবাড়িয়ে শুধরাতে যাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখবো সুবিধা থেকে অসুবিধা বেশি হচ্ছে।
অনেক সময় দেখা যায় যৌথ পরিবারের না থেকেও কিছু হলেই পট করে একজন ফোন করে, বুদ্ধি নিতে থাকে মায়ের কাছে। আপনারা যদি এরকম করেন তবে আজকেই সেটা বন্ধ করুন। কারণ আপনার পরিবারের সিদ্ধান্ত আপনি , আপনার জীবনসঙ্গী নেবেন। আপনার বাবা-মা বা শ্বশুর-শাশুড়ির নয়।
শ্বশুর-শাশুড়ীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আপনারা যখন আপনার সন্তান জীবন সঙ্গী বেছে নেয় তখন খেয়াল রাখবেনআপনার নেতিবাচক অনুভূতিগুলো যেন কোনভাবেই তাদের সম্পর্কের মধ্যে না ঢুকে।
সম্পর্ক তৈরি করা কঠিন কিন্তু সম্পর্ক রক্ষা করা আরও কঠিন। তারপরও যদি দেখা যায় নিজেদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতবিরোধ হচ্ছে তবে পরিবারের হস্তক্ষেপ অবশ্যই নয়, প্রয়োজনে কাপল থেরাপি, সাইকোথেরাপি বা ফ্যামেলি থেরাপি নিতে পারেন অর্থাৎ পেশাদারের সাহায্য নেবেন।
(কথোপকথনের অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেনশিয়ালিটি বজায় রেখে প্রকাশ করা হলো!
পুনশ্চ: এখানে ভদ্রমহিলা কি সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা মুখ্য নয়। আমি নিরপেক্ষভাবে নিজের চোখে, নিজের আসল চেহারাটি দেখতে কতটুকু আয়না ধরতে পারি সেটাই মূখ্য!)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।