#চেম্বার কথন
পর্ব ৪২
ভদ্রমহিলা, ” আমার হাসব্যান্ড আমার বান্ধবীর সাথে…..”
ভদ্রমহিলা ধীর লয়ে থেমে গেলেন। কণ্ঠার হাড়ের নড়াচড়ায় স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওনার গলার কাছে কান্নাটা দলা পাকিয়ে উঠছে। আর উনি গিলে ফেলছেন। যেন পণ করেছেন চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে দেবেন না। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে শতরঞ্জি খুঁটছেন।
আমি চুপ করে থাকলাম। ভদ্রমহিলাও নিশ্চুপ। বেশ বুঝতে পারছি নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য এই সময়টুকু তাঁর দরকার।
বেশ কিছুক্ষন পরে নিজেই শুরু করলেন, “আমরা রেমাক্রী গিয়েছিলাম। প্ল্যান ছিল ওখানে ড্রিংক করবো। মজা করবো। আমরা স্বামী স্ত্রী আর আমার বান্ধবী ওর স্বামী। এই দুই কাপল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড অফিস থেকে ছুটি না পাওয়ায় আমরা তিনজনই যাই।”
আবার দীর্ঘমেয়াদী নীরবতা। চুপ করে রইলাম। বাইরে কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে। সেখানকার একঘেয়ে আওয়াজ পাক খাচ্ছে। পোষা বিড়াল দুটো সমানতালে নখে শান দেবার খসখসানি ছাড়া আর কিছু নেই।
ভদ্রমহিলা একটু পানি খেলেন। তারপর বলা শুরু করলেন, ” আমরা যেই রাতে রেমাক্রীতে থাকলাম ওইদিন সবাই প্রচুর ড্রিঙ্ক করি। আমি বমি করব বলে, আমার হাজব্যান্ড আমাকে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়। ওকে বলি বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে করতে। প্রায় মিনিট বিশেক পরে দরজা খুলতে গিয়ে দেখি দরজা বাইরে থেকে লক। তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে ও ফিরে এসে আমাকে বাথরুম থেকে বের করে। সময়গুলো আসলে আমার ঠিকমতো খেয়াল নেই। কারণ আমি নেশায় টোলছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই কোন ছন্দপতন ছাড়া ট্যুর শেষ হয়। এরপর আমরা ঢাকায় ফেরত আসি। আমাদের দুজনের পোস্টিং ২ খানে। দুজনেই হাসিখুশি পোস্টিং এর ওখানে চলে যাই। ঠিক ৩ দিন পরে আমার বান্ধবী আমাকে ফোন করে বলে, রেমাক্রির সেই রাতে, ও যখন ড্রাংক, আমি বাথরুমে তখন ও অনুভব করে ওর শরীরের উপর কোন পুরুষের স্পর্শ। এবং সে নিশ্চিন্ত যে সেটা আমার হাজবেন্ড ছাড়া আর কেউ না। কিন্তু মেয়েটি নিজেই এত বেশি নেশার ঝোঁকে সে ছিল পুরোটা মনে করতে না পারলেও এটুকু মনে করতে পারে যে আমি যখন বাথরুমে গেছি তখন এই ঘটনা ঘটে। সে ২ দিন ধরে ক্রমাগত ভেবেছে এটা আমাকে জানাবে কিনা। এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা আমাকে বলবে। কারণ ওর বিবেচনায় আমার জানা উচিৎ।”
আবার নিরবতা। সময়ের গতি হঠাৎ করে যেন দীর্ঘ গেল। দুজনেই চুপচাপ বসে আছি। কখনো কখনো সুতীব্র আর্তনাদ শব্দহীন হয়ে ইথারে ভাসে। ১৯৬০ এর দশকে এক গবেষণায় ডক্টর মেহরাবিয়ান দেখান ৭০% থেকে ৯৩% যোগাযোগ মানুষ ভাষাহীন (নন ভার্বাল) ভাবে করে।
ভদ্রমহিলার দুচোখে সর্বহারার দৃষ্টি। তারপরও প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দাঁতে চেপে রাখা ঠোটের কোনা নিঃশব্দে সব বলে দিচ্ছে। কখনো কখনো কেঁদে ফেললে কষ্টটা কম হয়। তিনি সেটাও পারছেন না।
আমার মনে পড়লো রবি ঠাকুরের লাইন,
” ভাষাহারা মম বিজন রোদনা…
প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা….”
ভদ্রমহিলা কান্না চেপে বললেন, ” আমার হাসব্যান্ড প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে ক্ষমা চায়। এখন আমি কি করবো? ওর সাথে আর বান্ধবীর সাথে একদম যোগাযোগ রাখি নাই। আমি অসম্ভব প্রতারিত বোধ করছি। বুঝতে পারছি না আমি এখন কি করবো?”
ইদানিং এত কম জানি, এই কথাটা বার বার স্পষ্ট করে নিজের চোখের সামনে ধরা পরে। স্বয়ং নিউটন যেখানে বলেছেন তিনি জ্ঞানসমুদ্রের নুরী কুড়িয়েছেন। বিশাল জ্ঞানসমুদ্র নাকি তার কাছে অনাবিষ্কৃত। সেখানে আমি কোন ছার! আমি জানি আমি অকৃতি অধম। কিন্তু সামনে যিনি বসেছিলেন তিনি তো আর সেটা জানেন না। আমি খুব অসহায় বোধ করি ধরনের পরিস্থিতিগুলোতে।
Cheating is a choice. এই আপ্ত বাক্য যেমন সত্য। তেমনি সত্যরে লও সহজে, এটাও সঠিক। কিন্তু বইয়ের ভাষায় কি জীবন চলে? জীবনের ব্যাকরণ বইয়ের ব্যাকরণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আমি শুধু বুঝি এভাবে ঘুরতে যেয়ে মদ খেয়ে মাতলামির বেসামাল পর্বটা না থাকলে এই জীবনগুলি এভাবে খাদের ধারের এসে দাঁড়াতো না।
ভদ্রমহিলা পুড়ছেন, হয়তো বান্ধবীটি এবং স্বামীটিও পুড়ছেন, সেটা আমরা জানি না। কারণ সীমালঙ্ঘনের পেনাল্টি সবাইকে দিতে হয়। সবার হিসাব ঠিকঠাকমতো ফেরত নেয় মহাকাল। সীমা লঙ্ঘন ধর্মীয়, মানবিক এবং নৈতিকভাবে অন্যায়।
এর সাথে ছোট্ট করে বলতে চাই, পাহাড়ে কতিপয় অসভ্য ট্যুরিস্টদের যে কুরুচিপূর্ন বেলেল্লাপনা আমি নিজের চোখে দেখেছি তাতে লজ্জায় নিজেরই মাথা কাটা গেছে। দয়া করে সাজেক যাওয়ার পথে বাচ্চাদেরকে পয়সা/ চকলেট ছুঁড়ে দেবেন না। ওরা ভিখিরি বা চিড়িয়াখানার বাদর না। সমতলের সভ্যতার বিষ নাই বা ঢুকালেন পাহাড়ে।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” কি করব?”
আমি চুপ করে ভাবলাম কি বলবো? কাউন্সেলিং মানে উপদেশ দেয়া নয়। কাউন্সেলিং মানে সমালোচনা নয়। কাউন্সেলিং মানে ঠিক ভুল হিসাব বের করা নয়। কাউনসিলিং মানে ভদ্রমহিলার ভেতরে যেই শক্তিকে আছে, যেটিকে তিনি ব্যবহার করছেন না, সেটির সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়া। ব্যাস তারপর ওনার ঘটনা ওনার থেকে ভালো আর কে সামাল দিতে পারবে? তাই না?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি বললাম, ” ঘটনাটা ঘটার এখনো মাস পুরেনি, তাই আপনি একটু সময় নেন। তীব্র রাগ, দুঃখ, জ্বালা দিয়ে এখনো আপনার মনটা ঘোলা পানি হয়ে আছে। তাই এর নিচে কি অনুভূতি আছে আছে, কি ভাবনা আছে সেটা নিজেই এখন দেখতে পারছেন না। পাহাড়ি নদীর যেমন ঘোলাজল থাকলে তার তলে বালি না পাথর আছে সেটা বোঝা যায় না, ঠিক সেরকম মনের এই ঘোলা সময়টিকে কোন ভাবনা ছাড়াই পার করেন। নিজেই নিজের এই অশান্ত অনুভূতিগুলোকে একটু থিতাতে সময় দেন। তারপর সিধান্ত নেন। মনটা শান্ত হলে নিজেই বুঝবেন কি চান। এখন শুধু নিজের যত্ন নিন। জীবনের পথে ঋতু বদলায়। জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে কখনো স্রোত, কখনো ঘোলা জল, কখনো দুকুল উপচানো প্লাবন। শুধু একটাই কথা, বেহিসেবী হুজুগে বয়ে যাওয়া যাবে না। সময়ই বলে দেবে কখন কি করতে হয়। সময়ের সেই ভাষা বুঝতে চেষ্টা করাই জীবনের ধর্ম।”
(কথোপকথনের আলোচ্য অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা ভদ্রমহিলার অনুমতি সাপেক্ষে কনফিডেনশিয়ালিটি বজায় রেখে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হলো।
* ভদ্রমহিলাকে এই লেখায় উপদেশ দেবেন না কারণ তিনি উপদেশ চাননি। আর কে না জানে গায়ে পড়ে বেহুদা উপদেশ বিরক্তিকর।
* ভদ্রমহিলাকে জাজমেন্টাল মন্তব্য করবেন না। কারণ সমালোচনা ওনার বেদনার ভারকে আরো বাড়াবে।
*ওনার দোষ ধরবার আপনি/আমি কে? কেউ কি আমাদেরকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে? *অযাচিত উপদেশ এবং জাজ করবার প্রবণতা অস্বস্থিকর।
*এই লেখার মূল উদ্দেশ্যটা বাউন্ডারি সেট।
*নিজের চোখে আয়না ধরা যে আমি কিভাবে আমার সীমারেখা অতিক্রম করি?
*জীবনকে সহজ করবার জন্য বাউন্ডারি সেট সব সময় জরুরি। কিভাবে করবো? সেটা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। সীমালংঘনকারী নিজেই শাস্তি পায়।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রক্টিশনার।