#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
ভদ্রমহিলার বয়স ৫৫। আমার চেম্বারে মেয়েজামাই দুজনকে একসাথে নিয়ে ঢুকেই বললেন “এই যে দুইজনকে এনে দিলাম, কার কি কাউন্সেলিং লাগবে দেখুন। যার যত দিন লাগে কাউন্সেলিং চলুক আমার আপত্তি নেই। কিন্তু রোজকার এই অশান্তি বন্ধ হোক।”
পরিবারটির সবাই ডাক্তার। বাবা-মা দুজনই মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। হুলুস্থুল প্র্যাকটিস। মেয়ে জামাই দুজনেরই বিসিএস হয়ে এখন ট্রেনিং করছেন এফসিপিএস এর। ঝলমলে ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার।
আমি খুব অবাক হয়ে তিন জনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ” আমি কিন্তু কাপল কাউন্সেলিংএ প্রথমে প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা সেশনে কথা বলি পরে প্রয়োজন বোধ করলে একসাথে দুজনকে নিয়ে বসি।”
ভদ্রমহিলা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, ” আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট অলরেডি বলছে একথা, কিন্তু আপনি আগে আমার কাছ থেকে শুনেন।”
আমি বললাম, “সমস্যা আপনার মেয়ের দাম্পত্য কলহের তাইতো?”
ভদ্রমহিলা: ” হ্যাঁ, আমার মেয়ে জামাইয়ের।”
আমি: ” আমি দম্পতির সাথে কথা বলবো। আপনি তো এই দম্পতির স্বামী বা স্ত্রী নন। তাহলে আপনার কাছে কেন শুনবো?”
ভদ্রমহিলা ঝাঁঝালো কন্ঠে: ” কারন ওরা বুঝিয়ে বলতে পারবেনা।”
আমি: ” ওনাদের বয়স কত?”
ভদ্রমহিলা: ” আমার মেয়ের ৩৩, জামাইয়ের ৩৫।”
আমি: ” একজন ৩৩ ও ৩৫ বছরের মানুষ আরেকজন মানুষের ডেথ ডিক্লেয়ার করতে পারে, আর নিজেদের সমস্যা বুঝিয়ে বলতে পারবে না? তার জন্য আপনাকে উকিল ধরতে হবে?”
ভদ্রমহিলা তীব্র কন্ঠে, ” আপনি না শুনলে বুঝবেন কি করে?”
আমি, ” একদম ঠিক বলেছেন, কিন্তু সেই শোনাটা আমি স্বামী-স্ত্রী মুখ থেকে শুনতে চাই। কোন তৃতীয় পক্ষর না।”
ভদ্রমহিলা, ” আমি মা, ওদের সমস্ত সাপোর্ট আমি দেই। আমি কোন বাইরের মানুষ বা তৃতীয় পক্ষ নই। আমি অন্য মা’দের মতো না।”
আমি বললাম, ” প্রত্যেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একটা বাউন্ডারি থাকে। এই বাউন্ডারি যারাই ক্রস করে তারাই তৃতীয় পক্ষ।”
ভদ্রমহিলা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তার চোখে x-men টাইপ অস্ত্র থাকলে অবিলম্বে ভস্মীভূত হয়ে যেতাম।
আমি মধুর হেসে বললাম, “মেয়ে জামাই আপনারা দুজনে একটু বাইরে বসুন। আমি আপনাদের মায়ের সাথে কথা বলতে চাই একা।”
মেয়ে জামাই প্রথমে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। তারপর আমার দিকে। শাশুড়ি এখনো মুখ তোম্বা করে বসে আছেন। তার অ্যান্টেনায় ক্যাচ হয় নাই বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে। আমি ইশারা করলাম বের হয়ে যেতে। একটু হতভম্ব ভাবেই মেয়ে জামাই দুজনে বের হয়ে গেলেন।
আমি ভদ্রমহিলার দিকে ফিরে বললাম, ” আপনি বলছেন আপনি অন্য বাবা-মার থেকে অনেক বেশি সাপোর্ট করেন। কি কি করেন মেয়ে জামাইয়ের জন্য?”
ভদ্রমহিলা উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ” কি করি না বলেন, টাকা পয়সা লাগলে দেওয়া তো আছেই, এমন কি যে দুইজনের ঢাকার বাইরে বিসিএসের পোস্টিং প্রতিদিন সকালে কি রান্না করবে, কি খাবে, কখন বুয়া কাপড় শুকাতে দিল কখন তুলল সব আমাকে অপারেশনের ফাঁকে ফাঁকে বলতে হয়। এত বলি এভাবে করো, সেভাবে করো, কিছুতেই শুনে না দুইজন। আর কাহাতক বলা যায়। আমার নিজেরই এখন অসহ্য লাগে। নিজেকে সামলাতে পারে না, এখন আবার বাচ্চা নেওয়ার জন্য ঝামেলা শুরু করছে। আমি পারব না ওদের বাচ্চা সামলাতে।”
আমি বললাম, ” আপনার কোন চিন্তাটা, আপনাকে মেয়ের সংসারে ডিকটেট করতে বলে?”
ভদ্রমহিলা ফোঁস করে উঠলেন, “আমি ডিকটেট করি?”
আমি, ” জ্বী। দুটো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, রাষ্ট্র যাদেরকে বিয়ে করার মনোদৈহিক সনদ দিয়েছে, শিক্ষা যাদেরকে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার সনদ দিয়েছে, post-graduation এ পড়ছেন তারা আর যাই করুক বাড়িতে কি রান্না হবে, কখন কাপড় তুলতে হবে এটুকু করে নিতে পারবেন। কিন্তু কথা হল এটুকু করে নেওয়ার জন্য তাদেরকে সেই স্পেসটা দিতে হবে। আমি বুঝতে পারছি আপনি মা। আপনি আপনার সন্তানের জন্য বেস্টটাই চাইবেন এবং সব সময় দেয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু একবার ভাবুন তো ওদের কাজগুলো যদি ওদেরকে আপনি করতে না দেন তবে ওরা কিভাবে শিখবে? ছোটবেলায় আপনার মেয়েকে কতবার আপনি হ্যান্ড রাইটিং প্রাক্টিস শিখিয়েছিলেন। তখন কি মেয়েকে না দিয়ে নিজে নিজে লিখতেন?”
ভদ্রমহিলা চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, “তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন এত কষ্ট করে বড় করা আমার মেয়েকে আমি ছেড়ে দেবো? সারা জীবন ওর ভালো-মন্দ কি হবে আমি বুঝি এসেছি। সেভাবে ওর ভালোটাই হয়েছে। আপনার কথায় আমি আমার বাচ্চাকে ছাড়তে পারবো না। আর আপনিই বা কে এই কথা বলার?”
আমি, ” একদম ঠিক, আপনার বাচ্চাকে আপনার থেকে ভালো পৃথিবীতে কেউ বাসে না। আপনার থেকে বেশি কষ্ট, বেশি সেক্রিফাইস পৃথিবীর কোন মানুষ করেনি আপনার মেয়ের জন্য। আমি দেড় ঘন্টার সেশনে কোন সমাধান দিতে পারব না। ইনফ্যাক্ট সমাধান দেয়াটা কাউন্সিলিংয়ের কাজ ও নয়। আমাকে পছন্দ না করলে আপনি অন্য কাউন্সিলরের কাছে যাবেন। আমি শুধু আপনাকে একটু খেয়াল করতে বলবো, স্বামী-স্ত্রীর এই আন্তঃসম্পর্কের দ্বন্দ্বে আপনার কোন আচরণটা কনফ্লিক্ট তৈরিতে সাহায্য করছে?”
ভদ্রমহিলা থম মেরে গেলেন। চা আসলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমি চা খাচ্ছি। ভদ্রমহিলা সামনের চা ঠান্ডা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর আমি আস্তে আস্তে বললাম, ” আপনি অসম্ভব ইন্টেলেকচুয়াল একজন মানুষ। এত বড় একটা পদে কাজ করছেন। আপনার সেই ইন্টেলেকচুয়ালিটির জায়গাটিকে সম্মান দেখিয়ে নিরপেক্ষভাবে একটু ভাবুন তো, ছোট্ট একটা বীজ ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে মহীরুহ হয়। যত বেশি ঝড়ঝাপটা তত শিকড় মাটির বুকে আরো গভীরে ঢুকে যায়, তাই না? আপনার উদ্দেশ্য সন্তানের মঙ্গল। আজ বাদে কাল যখন আপনি পৃথিবীতে থাকবেন না আপনার সন্তান যদি এই কাজগুলো এখন যদি নিজে না করে তবে সে কিভাবে তখন করবে? কাজই ওদেরকে ওদের মতন ছেড়ে দিন। ওদেরকে ওদের মতো শিখতে দিন। ওদের পার্সোনাল লাইফে স্পেস দিন। একটা ৩৩ আর ৩৫ বছরের দম্পতিকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন, কখন তারা সন্তান নেবেন; কখন তাদের কাপড় শুকাতে দেবেন। আপনার সন্তানের দায়িত্ব যেমন আপনি নিচ্ছেন, তাদের সন্তানের দায়িত্ব তাদেরকে নিতে দিন। তাদেরকেও বুঝতে দিন, কত ধানে কত চাল। কিন্তু আপনার ভালোবাসার কারণে যখন আপনি একটা দম্পতির পার্সোনাল স্পেসের বাউন্ডারিটা ক্রস করবেন, তখন আপনার জন্যই আপনার অজান্তেই তাদের ঝগড়া লাগবে। আপনি কি জানেন আপনার এই খবরদারির জন্য আপনার মেয়েকে কখন, কিভাবে, কতটুকু এডজাস্ট করতে হচ্ছে? আপনার জামাইকে কতটুকু বিরক্ত হতে হয়? মেয়ের শাশুড়ি নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে কথা বলে না। আপনার ভালোবাসা আপনার মেয়ের জন্য সংসার জীবনটাকে আরো কষ্টকর করে তুলছে। সেটারই বহিঃপ্রকাশ আপনাদের এই আমার চেম্বারে আসা। আমি তো বলব আপনার মেয়ে জামাই দুজনেই অতিরিক্ত ভদ্র বিধায় আপনার সাথে আজকে আমার এখানে এসেছেন।”
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
প্রত্যেকটা দম্পতি একটি ইউনিট। এখানকার মেম্বার শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী। একটা পরিবার হলো এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটের সমন্বয়। বৃহত্তর পরিবারে বাবা, মা, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাই, বোন, গৃহকর্মী সবাই থাকেন। আমি শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ, জা, শালা, শালী, দুলাভাই, আত্মীয়, প্রতিবেশী যাই হই না কেন যেকোনো সময় নির্দিষ্ট একটি সম্পর্কের দাবি নিয়ে যেকোনো দম্পতির ব্যক্তিগত স্পেসে ঢুকে পড়াটা আমার অভদ্র আচরণ। তাদের ব্যক্তিগত প্রশ্ন, সেটা আদিরসাত্মক যৌন মিলন সংক্রান্তই হোক অথবা সন্তান কবে নেবে ইত্যাদি যেকোনো কিছু নিয়ে জিজ্ঞেস করাটাই চূড়ান্ত অভদ্রতা।
মনে রাখতে হবে, একটা নতুন দাম্পত্য সম্পর্ক যখন তৈরি হয়, তখন দুটো মানুষ অলরেডি নিজেরাই এডজাস্টমেন্ট ক্রাইসিসে ভোগেন। এমনকি যদি বিয়ের আগে তাদের প্রেমও থাকে, তারপরও দেখা যায় প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এক নয়। কাজেই মানুষদুটিকে নিজেদের সম্পর্কে থিতু হওয়ার সময় দিন। আপনার জ্ঞান এখানে ঝাড়বেন না। একটা দম্পতিকে কি বলবো, তার সাথে কেমন আচরণ করব আমি যতই কাছের মানুষ হোক না কেন তার একটা একটা বাউন্ডারি থাকতে হবে। সেটা তাদের রুমে নক করে ঢোকা থেকে শুরু করে অদৃশ্য ভাবে মানোসামাজিক ব্যক্তিগত স্পেস পর্যন্ত বিস্তৃত। আমি অনেক ভালবাসতে পারি দম্পতিকে। কিন্তু খেয়াল করা দরকার, বাবা/মা/ শাশুড়ি/শ্বশুর/ভাই/বোন/আত্মীয়/প্রতিবেশী হিসেবে আমার কোন আচরণ, দাম্পত্য কলহ তৈরিতে কন্ট্রিবিউট করছে। কারণ দেখা যায় দাম্পত্য কলহে পরিবারের ইনভলভমেন্ট ঝামেলা আরো বাড়ায় বই কমায় না। ছেলেপক্ষ ছেলের দিকে, মেয়ে পক্ষ মেয়ের দিকে ঝোল টেনে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক।
স্বামী ও স্ত্রী নিজের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করুন। প্রথমবার না হলে দ্বিতীয়বার অন্য অপশন দেখুন। নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করুন। কিন্তু নিজের বাপ মা ভাই বোনকে সমস্যার সমাধানে স্পেশালিস্ট হিসেবে আনার দরকার নেই। নিজেরা না পারলে কাউন্সেলিং এর সাহায্য নিন। কাউন্সিলর নিরপেক্ষ থাকবেন।
যেসব দম্পতি নিজেদের বাউন্ডারি নিজেরাই সসম্মানে মেইন্টেন করেন, নিজেরাই ঠিক করেন পারস্পরিক সহমর্মিতায় পূর্ণ সমঝোতার ভিত্তিতে উভয়ের পরিবারকে কতটুকু জানাবেন, কতটুকু জানাবেন না সেসব দম্পতির প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার