মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে অষ্টাদশী চিত্রার গায়ে লাল বেনারসি মুড়িয়ে দেওয়া হয়।স্বামীর বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব।যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে তিনি চিত্রার পরিচিত। সহপাঠী রোখসানার পিতা।লোকের স্ত্রী মা*রা গেছেন আজ দুই সপ্তাহও হয় নি।চিত্রার অন্তরাত্মা ভয়ে কাঁপছে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দ তাকে নিমিষেই কাবু করছে।কি করবে সে এখন?সে তো সোহাগ ভাইকে ভালোবাসে।তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা চিত্রার পক্ষে অসম্ভব।হাতের কাছে ফোন নেই।মামি তাকে একটু আগেও একগাল কথা শুনিয়ে জলদি শাড়ি পড়তে বলে গেছেন।আচ্ছা সোহাগ ভাইয়ের রুমে গিয়ে তাকে জানিয়ে আসলে কি এই বিপদ হতে লোকটা তাকে রক্ষা করবে?হ্যাঁ! রক্ষা না করে কোথায় আবার যাবে?শত হলেও তারই তো প্রেমিক সোহাগ ভাই।ভাবতে না ভাবতেই মামি হুড়মুড়িয়ে আবার রুমে আসেন।সঙ্গে তার বড় ছেলের বউ মারিয়াও।
‘মুখপুড়ী তুই এখনো বইসা আছোত?তোর আম্মারা আইসা বুঝি তোরে তৈয়ার করবো?’মার্জিয়া বেগম গর্জে উঠলেন।
‘দয়া করে এমন করো না মামী।আমি ওই লোককে বিয়ে করতে পারবো না।আমি ওই লোককে বিয়ে করবো না।দয়া করো।ঘরের সব কাজ আমি আরো ভালো করে করবো।তাও রহম করো মামী।রহম করো।’চিত্রা মার্জিয়ার পা ধরে আর্তনাদ করে।তবে এহেন আর্তনাদ মার্জিয়ার হৃদয় ছুঁয়েছে বলে মনে হয় না।চিত্রাকে পাশ কাটিয়ে মারিয়া শাড়িটা ছুঁড়ে মারে তার মুখের ওপর।তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
‘নাটক কইরা লাভ হইবো না। আম্মা আপনে ওরে ধরেন।আমি শাড়ি পড়াই।’
‘ভাবী.. ভাবী আমি আপনার পায়ে পড়ি।আমার সঙ্গে এমন অন্যায় করবেন না।’
মারিয়া ধাক্কা মেরে নিজের পা সরিয়ে নেয়।আবারো বলে উঠল,
‘হে সব অন্যায় খালি আমরা করি আর তুমি তো দুধে ধুয়া তুলশী পাতা।এই বাড়ির কাঁধে বইসা আর কতকাল খাইবা?পরিবারটারে তো ধ্বংস কইরা ফেলাইছো।সেয়ানা মাইয়া হইয়া ঘর জুইড়া ধাপাইয়া বেড়াও।আমার জামাইটারে তো বশ করবার পারো নাই। তাই এখন সোহাগের পেছনে লেলাইয়াছ।তোমাগো মতো মাইয়া মানুষরে আমার খুব ভালা কইরা চেনা আছে।যার বাপ-মায়ের ঠিক ঠিকানা নাই তার আবার কিসের হেডাম?’
মারিয়ার নোংরা কথায় চিত্রার ভিতরটা জ্বলে পুড়ে উঠল।শত্রু আসলে জানে তার দুর্বল দিকটা কোথায় তাই তো বেছে বেছে সেখানেই বার বার আঘাত করে।সে আর কত বার দুনিয়াকে বুঝাবে তার বাবা-মা কোনো অপরাধী না।খারাপ না।মনে মনে সোহাগকে খুঁজছে চিত্রা। তার চিত্রা সওদা হয়ে যাচ্ছে।সে কি তাকে বাঁচাতে আসবে না?সে কি কিছুই জানে না?তাকে কি কেউ কিছু জানায় নি?একবার…শুধুমাত্র একবার সোহাগের কাছে যেতে চায় সে।ওই মানুষটা ছাড়া নিজের বৈধতা আর কাউকে দিতে পারবে না চিত্রা। এমন কিছু হওয়ার আগে মৃ*ত্যু শ্রেয়।
‘কি আম্মা হইছে?মিজান সাহেব তো বইসা আছে।ওরে তৈরি করছো?দরজার ওপাশ থেকে মার্জিয়ার বড় ছেলে মাহাদী হাঁক ছাড়ল।মার্জিয়া দরজা খানিকটা ফাঁক করে মাথা বের করে জবাব দিলেন,
‘এই তো আরেকটু। ওরে আমি নিয়া আসতাছি।তুই যা আব্বা।’
মাহাদী চলে গেলো।মার্জিয়া এবার চিত্রার চুলের মুঠি শক্ত করে মুঠোয় পুড়ে বললেন,
‘হারা*মির বাচ্চা ওঠ।ওঠ কইলাম।’
–
বসার ঘরে পাঁচ-ছয় জন পুরুষ মানুষ বসে আছে।
তার মধ্যে মাহাদী,মিজান সাহেব, কাজী সাহেব সহ আরো কয়েকজন লোক।মিজান সাহেব ঠিক বিয়ে করতে এসেছে নাকি মাঝরাতে চিত্রাকে মোটা টাকায় কিনে বর্ডার পাচার করতে এসেছেন।সেটা তিনি নিজেই ভালো জানেন।এলাকার সবাই জানে নারী পাচারের সঙ্গে তার কোনো না কোনো হাত আছে।তবে এখন অব্দি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।মিজানের লম্বা চওড়া শরীর।কালো কুতকুতে গায়ের রং।লালচে পান খাওয়া দাঁত। হাসি বিশ্রী।হাসতে গেলে মুখ থেকে পানের পিক ছিটকে আসে।
‘কই মাইয়া কই মাহাদী?’
‘আসতাছে একটু দাঁড়ান। ‘
‘এখানে কি দাঁড়াইতে আসছি?সময় নাই হাতে।এই মাইয়ার বদলে কিন্তু মোটা টাকা দিছি।সেইটা ভুইলা যাইও না।’
মাহাদী একটু বিরক্তি নিয়ে চিত্রার রুমের দিকে তাকায়।হুট করে রুমের দরজা খুলে যায়।ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে লাল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে।মাথায় ঘোমটা।মারিয়া শক্ত করে চিত্রার বাহু ধরে আছে।চিত্রার ফর্সা মুখখানা কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। এখনো চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।চিত্রা একবারটি চোখ তুলে দেখার চেষ্টা করল।তার সোহাগ কোথায়? কেনো সে এখানে নেই?বুক মুচড়ে আসছে তার।
চিত্রাকে বাসানো হলো সোফায়।মামা কোথায়?দুচোখ একটিবার মামাকে খোঁজার চেষ্টা করল।সে কি তার চিত্রাকে রক্ষা করবে না?কিন্তু কেমন করেই বা রক্ষা করবে?মামা যে নড়াচড়া থেকে শুরু করে কথা বলার শক্তি হারিয়ে বিছানায় পড়ে আছে।চিত্রার কষ্ট তার বাবার নজর হয়তো ঠিকই কারে।মাঝে মাঝে চিত্রার অসহায় মুখটির দিকে তাকিয়ে দু-চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে মনজুর কাদিরের।
‘হইছে এমনে তে অনেক দেরি হইয়া গেছে।কাজী সাব জলদি বিয়া পড়ান।বউ নিয়ে আমারে আবার আজকেই কুমিল্লা যাইতে হইবো।রাইতেই রওনা হইমু।’বলল মিজান।
মিজানের কাঁধে হাত থেকে পাশ থেকে আরেকজন লোক বাঁকা হেসে বলল,
‘কি মিয়া?বিয়া কইরাই কুমিল্লা কেন যাইবা?বাসর করবা না?নাকি আগের মতোন এখন আর জোর নাই?’হো হো করে লোকটি হেসে উঠেন।পাশে বসে থাকা বাকিরাও হাসেন।যেন একটু আগে খুব গর্ব হওয়ার মতো কথা হয়েছে এখানে।চিত্রার ঘৃণা লাগছে।বাবার বয়সে একটা লোকের সঙ্গে তার বিয়ে।তাও আবার হুট করে এমন মাঝ রাতে?লোকটাকে দেখেই মনে হচ্ছে আস্ত একটা লম্পট। শাড়ির ওপর দিয়েই চিত্রাকে কেমন করে চোখে গিলে খাচ্ছে।কাজী সাহেব নড়ে চড়ে বসেন বিয়ে পড়ানোর জন্য।মাহদী একবার আঁড়চোখে চিত্রার দিকে তাকান।একটু আগেও ঘর থেকে মেয়েটার আহাজারি শুনা যাচ্ছিলো।মুহুর্তেই কি এমন হলো যে এতটা নিশ্চুপ হয়ে গেছে?যাকগে ভালোই হয়েছে।ঝামেলা না করলেই তো হলো।
‘তো বিয়ে শুরু করা যাক?’কাজী জিজ্ঞেস করল।
‘হু শুরু করেন।’
কাজী সাহেব খুতবা পড়ে বললেন, মরহুম মুন্সি সাহবের বড় ছেলে মো:মিজান সাহেবের সঙ্গে…
কাজী সাহেব হঠাৎ থমকে গেলেন।সদর দরজাটা একেবারে ভেঙে ফেলার মতো শব্দ করে কারা যেন দরজায় আঘাত করছে।সবাই ভয় পেয়ে যায়।মাঝ রাতে কারা হলো?মারিয়া ভয়ে গুটিসুটি মেরে মার্জিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘আমি দেখতাছি।’মাহাদী উঠে গেলো।মার্জিয়া তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয় নি।দরজা খুলতেই বেশ কিছু লোক ঘরে ডুকে পড়ল।মাহাদী তাদের দেখে দু পা পিছিয়ে এলো।সকলের হাতে অস্ত্র। ডাকাত নাকি ওরা?এবার সকলের ভেতর ভয় যেন বাসা বেঁধে বসল। হঠাৎ ছেলেগুলোর পেছন থেকে সুঠাম এক সুপুরুষ এগিয়ে এলো।সুট-প্যান্ট পরিহিত।মিজান সাহেব লোকটাকে দেখে কেন জানি আঁতকে উঠল।সোফা থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল।চিত্রা এখনো বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে।তবে নতুন কোনো বিপদের যে উদয় হয়েছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।ছেলেগুলো সোফা থেকে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ভালো করে তা মুছে দিলো।লোকটা এসে সোফায় বসে পায়ে পা তুলল।ছেলেগুলোর মধ্যকার একজন এগিয়ে এসে লোকটির শরীর থেকে সুট খুলে হাতে নিলো।ফারাজের পাশেই দাঁড়ালো সে।
লোকটি ভাবলেশহীন ভাবে টেবিলের ওপর রাখা মিষ্টির প্লেট থেকে একটা মিষ্টি মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তো মিজান সাহেব জোয়ান মেয়েদেরকে যদি আপনার মতো চাচারাই বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যায় তবে আমাদের মতো ভাতিজাদের কি হবে?’
মিজান সাহেব ভয়ে কাঁপছেন। কারন তার সামনে যে স্বয়ং ফারাজ এলাহী বসে আছে।চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে।তবে সে দেশে ফিরল কখন?আর এখানে তার কি কাজ?
‘জবাব দিচ্ছেন না যে?’ফারাজের কন্ঠস্বর গম্ভীর।
‘আ..আপনি এখানে?’কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল মিজান।
‘আমাকে প্রশ্ন করছেন?’চোখ তুলল ফারাজ।
‘না মানে?’
‘কাজী সাহেব বিয়েটা চটজলদি পড়ান।বিয়েই তো খেতে এসেছে।’
মিজান সাহেবের মুখে খানিকটা হাসি ফুটল।
‘তবে মিজান সাহেবের বিয়ে নয়।আমরাটা।কাজী সাহেব দেনমোহরটা বেঁধে তাহলে বিয়ে পড়ানো শুরু করেন?’মিজান সাহেবের মুখটা ছোট হয়ে এলো।সব তার মাথার ওপর দিকে যাচ্ছে।বাড়ির বাকিদের অবস্থায় একই।তবে কারো সাহস হচ্ছে না লোকটার বিরুদ্ধে হুঙ্কার তুলতে।মাহাদী ইতিমধ্যে চিনতে পেরেছে কে এই ফারাজ এলাহী। তাই সে আগেই চুপ হয়ে গেছে।যেখানে মিজান সাহেবের মতো লোকের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে।সেখানে তারা কোন ক্ষেতের সবজি?ফারাজ সোফায় গা এলিয়ে বসে ভয়ার্ত চিত্রার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল।বলল,
‘জলদি করুন কাজী সাহেব।ভোর হওয়ার আগে তো আমার আবার বাসরটাও সারতে হবে।’
চলবে?
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১