#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৯
❝জীবন যেমন রঙিন, তেমনি ধূসর। সবটুকু মিলিয়েই তো তার আসল সৌন্দর্য।❞
বিকেল তখন ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে। বাতাসে মিশে আছে স্নিগ্ধতার মৃদু স্পর্শ। প্রকৃতি নিজেই এক গভীর নিশ্বাস ফেলে শান্ত হচ্ছে। আকাশের নীল রংটা ক্রমে ফিকে হয়ে রক্তিম আভায় রঞ্জিত হচ্ছে। সূর্য অস্তাচলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিগন্তে মেঘের সঞ্চার। কোথাও সাদা, কোথাও কালো, কোথাও বা লালের আভা মিশে আছে। এই সময়টায় প্রকৃতি এক নতুন রূপে সজ্জিত হয়। পাখিরা নীড়ে ফেরে, তাদের কণ্ঠে ক্লান্তির সুর। গাছের পাতায় পড়ে শেষ আলো। মৃদু বাতাসে দুলে ওঠে তারা। মানুষের মুখেও তখন দিনের পরিশ্রমের ছাপ। কিন্তু বিকেলের এই মায়াবী আবহাওয়ায় সব ক্লান্তি একেবারে মুছে যায়। এই সময়টায় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক অদ্ভুত সঙ্গতি দেখা যায়। বিকেলের আলো-ছায়ার খেলায় জীবনের নানা রং মিশে থাকে যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি দিনের অন্তিম সৌন্দর্য ও প্রশান্তির কথা।
চিত্রা শাদা জর্জেটের শাড়ি ও সাদা কাজ করা ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া তালুকদার বাড়ির সামনে। বাড়িটির পাশেই পারিবারিক কবরস্থান। যেখানে দূর থেকে কবরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। ধর্মের রীতি অনুযায়ী, মেয়েদের সেখানে যাওয়া নিষেধ। তাই চিত্রা দূর থেকেই সেই কবরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই তিন হাত মাটির কবরই আমাদের আসল ঘর। তবুও, আমরা এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সাজসজ্জায় যতটা সময় ও গুরুত্ব দিই। তার এক ভাগও যদি সেই চিরস্থায়ী ঠিকানার জন্য ব্যয় করতাম তবে হয়তো পরকালের যন্ত্রণা কম হতো। মানুষ নকলের পেছনে বেশি দৌড়ায়। কবর ও পরলোক তারই উদাহরণ। ফারাজের গায়ে আকাশি রঙের শার্ট। গায়ে সাদা ব্লেজার। চোখে সানগ্লাস। চুলগুলো সেট করা। ফারাজ চিত্রার কাছে নিজের দু’জন লোক দাঁড় করিয়ে রেখে কবরটা ঘুরে ঘুরে দেখে। অভ্রর গায়ে কালো শার্ট। সঙ্গে কালো ব্লেজার। বারবারের মতোই সুদর্শন লাগছে। ফারাজ দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় চারপাশে। এক নিমেষেই গুনে ফেলে কবরগুলোর সংখ্যা। সাতাশটি কবর। একইসঙ্গে, একই পরিণতি। আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া সাতাশটি নামহীন অস্তিত্ব। এক সময় যারা শ্বাস নিয়েছিল, স্বপ্ন দেখেছিল, তারা এখন শুধুই ছাই আর মাটির স্তূপ। এক মুহূর্তের জন্য ফারাজ থামে। আড়চোখে তাকায় দূরে দাড়িয়ে থাকা চিত্রার দিকে। তার চাহনিতে এক অদ্ভুত রহস্য। অনির্বচনীয় কিছু। যেন সে এই নিঃসঙ্গ কবরস্থানকে ছাপিয়ে আরও দূরে, আরও গভীরে কিছু অনুভব করছে সে। আর অভ্র? সে স্থির, শান্ত, তবে তার দৃষ্টি অচল। সে শুধু তাকিয়ে আছে। কিসের জন্য, কার উদ্দেশ্যে, তা কেউ জানে না।
“ভাই।”
“হুম।”
“মানে এবার ফিরে চলেন না। আমার কিছুই ঠিক লাগছে না। ব্যবসা ফেলে এখানে আর কতদিন পড়ে থাকবেন? চলেন ডেনমার্ক ফিরে যাই।”
“তোর ভাবীকে রেখেই ফিরে যেতে বলছিস?”
“ভাবীকে সত্যি ভালোবাসেন ভাই?”
ফারাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।তারপর গভীর গলায় বলল,”হু চরম ভালোবাসি।”
“আপনার কথা শুনলে ভয় হয়। ভালোবাসার নীতি যে আপনার ক্ষেত্রে ভিন্ন। “
ফারাজ হেসে ফেলল, ঠোঁটের কোণে রহস্যময় বাঁক, “তোর ভাবী আস্তে ধীরে বুঝে যাবে আমার নীতি কি। তখন ঠিকই আমার জন্য মহিয়া হবে। একটা গাছের শুরুতেই ফুল ধরে না রে অভ্র। ফুলের জন্য গাছের যত্ন নিতে হয়। একটু একটু করে যত্ন নিলে গাছে কলি আসবে। একদিন ফুল ফুটবে। আচ্ছা নিজের হাতে বড় করা ফুল ছিড়তে কেমন লাগে রে অভ্র?”
অভ্র একটু ব্যঙ্গ মিশিয়ে হাসল, “আমি তো বালও ছিঁড়তে পারলাম না জীবনে। ফুল ছিঁড়লে কেমন লাগে কি করে বলব? ওইসব ভাই আপনার মতো মহৎ ব্যক্তিরা পারে।”
ফারাজ বিরক্ত নিয়ে চুইঙ্গামটা থু মেরে ফেলল। চোখ সরু করে বলল,
” মিজান চাচার সঙ্গে আজকে একটু সাক্ষাৎ করতে হবে। হিসেব তো এখনো বাকি আছে। বাঙ্গির নাতি তোর ভাবীর দিকে নজর দিছে। বুইড়ার ভিতরে কিরমি কত! আমার শিকারে নজর দেয়।”
অভ্রের গলা কেমন শুষ্ক হয়ে এল। সে ফিসফিসিয়ে বলল, “শিকার?”
” না ভালুপাসা কুদ্দুসের বাপ।”
–
সূর্য অস্তাচলের দিকে ধাবিত। আকাশের বুকে রঙের এক অবর্ণনীয় নাট্যমঞ্চ রচিত হয়েছে। সোনালি আভা ক্রমে রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। সবটাই তুলির আঁচড়ে আঁকা মহাকাব্য যেন। বাতাসে অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। নিস্তব্ধতার মাঝে গূঢ় সংগীত বেজে চলেছে। গাছপালার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। যেন প্রকৃতির বিশাল আঁচলের প্রান্তদেশ। পাখিরা কলরব থামিয়ে নীড়ে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দও শান্তিময়। দূরের নদী, দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যেতে যেতে তার স্নিগ্ধ জলে অস্তরাগের প্রতিচ্ছবি বহন করছে। দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতির নিজস্ব এক আয়না। সমস্ত সৃষ্টিজগত এক মোহময় আবরণের নিচে নিমজ্জিত। সময় থমকে দাঁড়িয়েছে সন্ধ্যার স্নিগ্ধ, গম্ভীর আবেশে। এই ক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্য এক অনির্বচনীয় মাধুর্য ধারণ করেছে। যার ব্যাখ্যা ভাষার সীমা ছাড়িয়ে অনন্তের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
সোহান সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামি পড়েছে। চুলগুলো আচরানো। গায়ে সে সবসময় সরিষার তেল মাখে। ক্রিম মাখলে তার মুখটা খসখস করে। সোহান ঘর থেকে বেরুনোর আগে মায়ের ঘরে একবার উঁকি দিয়ে আসে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সোহান মায়ের ঘরে গিয়ে খাটের ওপর মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মা পানদান সামনে নিয়ে বসে আছেন। আজান দেওয়ার পর পান মুখে দিবেন। ভাত না খেয়েও থাকতে পারবে সে কিন্তু পান ছাড়া এক মুহুর্তও নয়।
সোহান গলায় মমতার সুর টেনে বলল, ” শরীরটা কেমন আছে আম্মা।”
মা পানদানের ঢাকনায় হাত বোলাতে বোলাতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, “আমার কি হইবো? আমি ঠিক আছি বাজান। তুই বাহিরে যাইবি তাই না?”
“যামু তো। মাহবুবা কইল তুমি নাকি খাওন খাও না ঠিক কইরা? ঔষধও খাইতে চাও না। এমন করলে সুস্থ কেমন কইরা হইবো।”
মা এবার পানদানের ভেতর থেকে পান তুললেন, ধীর স্থির কণ্ঠে বললেন, “তুই একটা বিয়া কর বাজান। তোর বউ আসলেই আমি সুস্থ হইয়া উঠমু।”
সোহান হাসল,”আবার বিয়া?”
“বয়স কম হইছে?আমার কি নায় নাতকুরের মুখ দেখতে মন চায় না?”
সোহান মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল,” নায় নাতকুর আছে না?”
মা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন,”না তুই জলদি বিয়া কর। নইলে খাওয়া-দাওয়া ছাইড়া দিমু। মায় মরলে বিয়া করিস যা।”
“আম্মা তুমি মরার কথা কইবা না। আর দিলে যদি কাউরে না ধরে তাইলে কেমন কইরা বিয়া করুম?যেদিন দিলে কাউরে ধরবো সেদিন যে কইরাই হোক বউ ঘরে আনমুই আম্মা।” সোহান গম্ভীর গলায় বলল।মায়ের কপালে আলতো চুমো খেয়ে উঠে দাঁড়াল। বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে অপেক্ষায় ছিল সিফাত। কিন্তু দরজার চৌকাঠ পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই সোহানের মুখশ্রী বদলে গেল। কোমল, মায়াময় যে লোকটা এক মুহূর্ত আগে মায়ের পাশে বসেছিল সে মুহূর্তেই রূপ নিলো কঠিন হিংস্রতায়। সিফাত সামনে এগিয়ে এল। সোহান তার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কোনো খবর আছে?”
সিফাত কিঞ্চিৎ মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “ভাই, মিজানের যেই মাইয়ারে ওইদিন রাতে আমাগো হাতে তুইলা দেওয়ার কথা ছিল, সেই মাইয়াটা বাজিতপুর আইসে। সঙ্গে জামাইও আসছে।”
সোহান চোখ সংকীর্ণ করল। কণ্ঠে শীতলতা ঝরে পড়ল, “নাম কী মাইয়ার?”
“চিত্রাঙ্গনা।”
সোহান এক মুহূর্ত চুপ থেকে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি টানল। “ওহ! আর জামাই কেডা? সাহস তো কম দেখায় নাই! আমার সোনার ডিমে হাত দেওয়ার স্পর্ধা! তেনার কইলজাডা দেখার খুব শখ হইতাছে আমার।”
সিফাত মুখ নিচু করল। নামটি উচ্চারণ করতে গিয়েও দ্বিধায় পড়ল। তারপর গভীর শ্বাস ফেলে বলল, “এলাহী। ফারাজ এলাহী।”
–
নদী এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারছে কেন তাকে এই বাড়ির বউ করে আনা হয়েছে। শুধু গুণবতী বা মায়াবতী হলেই তো হয় না, মেয়েদের হতে হয় রূপবতীও। তবে স্বামীর চরিত্রে যদি দোষ থাকে, তাহলে অপ্সরাও এসে হাজির হলেও তার চোখ অন্যদিকে ঘুরবেই। এই বাড়ি নদীর সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। সে এখন কেবল মুক্তি চায়… মুক্তি। দু’বেলা না খেয়ে থাকলেও মেয়েদের কষ্ট লাগে না, কিন্তু কষ্ট তখনই অসহনীয় হয়ে ওঠে যখন স্বামীর চরিত্রে দোষ থাকে। নদী এখন বুঝতে পারছে, তাকে এই বাড়িতে আনার পেছনে কোনো সৌভাগ্যের গল্প নেই। ছিল সুপরিকল্পিত এক ফাঁদ। গরিব ঘরের মেয়েরা ক্ষমতার সঙ্গে পেরে উঠবে না। মুখ খোলার সাহসও নেই, প্রতিবাদ তো দূরের কথা! তাই এমন এক মেয়েকেই দরকার ছিল যে মুখ বুজে সবটা সহ্য করবে। তবে নদীর একটাই আফসোস এই বাড়ির নারীরা কেউই প্রতিবাদ করে না। শুধু নীরবে সহ্য করে। কিন্তু সে কি সারাজীবন এভাবেই সহ্য করবে? নাকি এই বন্দিত্বের শৃঙ্খল একদিন ভেঙে কেউ তাকে উদ্ধার করবে? রাজন তৈরি হচ্ছে। সন্ধ্যায় গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হচ্ছে সে। নদী নিঃশব্দে এগিয়ে এসে তার পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দেয়। রাজনের চোখে দম্ভের ঝলক। হঠাৎ, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই রাজন নদীকে শক্ত করে ধরে। নদীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। রাজনের ঠোঁট তার ওপর চেপে বসে নিষ্ঠুর, দখলদারিত্বের মতো। নদী কোনো প্রতিরোধ করতে পারে না। শুধু নিঃশব্দে নিজেকে সংবরণ করে রাখে। চুম্বন শেষ করেই রাজন মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলল, “রাতে তৈরি থাইকো। আমি জলদি বাড়ি ফিরমু।”
নদীর শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তার আর বুঝতে বাকি থাকে না এই রাতও হবে আরেকটি বিভীষিকাময় রাত, যেখানে ভালোবাসা নয়, থাকবে শুধুই পৈশাচিক নির্যাতন। নারীরা সাধারণত স্বামীর স্পর্শে প্রশান্তি খোঁজে। নদী খোঁজে মুক্তি। তার কাছে এই স্পর্শ ভালোবাসা নয়, বরং ভয়ঙ্কর অভিশাপ। রাজনের হাত তার গায়ে পড়লেই মনে হয় শীতল, কুৎসিত কোনো সরীসৃপ তাকে ক্রমশ গ্রাস করছে।
“নদী!”
কাঁপা গলায় নদী সাড়া দেয়, “হুম।”
রাজনের কণ্ঠে হুমকির সুর, “এবার যদি একটা পোলার জন্ম দিতে না পারো, তাইলে বিশ্বাস করো সতীনের লগে ভাত খাইতে হইবো। মনে কইরো না যে মাইরা ফেলমু। মারলে যন্ত্রণা ভোগ করবা কেমন কইরা? মারার চেয়ে আমি যন্ত্রণা দিতে ভালোবাসি।”
রাজন কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যায়। নদী নিঃশ্বাস ছাড়ে। বুকের পাঁজরগুলোও হালকা হয়ে আসছে। নদী ধীর পায়ে মেঝেতে বসে পড়ে। চোখ চলে যায় বিছানার ওপর খেলতে থাকা ছোট্ট মেয়েটার দিকে। অবুঝ, নিষ্পাপ নুড়ি কি জানে এই বাড়ির নারীদের জীবনের গল্প? সে কি একদিন বুঝবে, তার বাবার দুনিয়ায় নারীর অবস্থান কতটা করুণ? আচল দিয়ে মুখ চেপে নদী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এই কান্নার কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তার বুকের ভেতর একটা পাহাড় ধসে পড়ছে। প্রতিটি টুকরোতে র*ক্তা*ক্ত যাচ্ছে তার আত্মা।
–
চিত্রার সাদা শাড়ি ফিনফিনে বাতাসে উড়ছে। পূব আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। আবার বৃষ্টি নামবে। কবরগুলোও ভিজবে। পোড়া শরীরগুলো স্নিগ্ধ বৃষ্টির ছোঁয়ায় জ্বলে উঠবে নাকি শান্তি খুঁজে পাবে? চিত্রা তালুকদার বাড়িটা আরো একবার ঘুরে ঘুরে দেখল। আজ সে আর কান্না করেনি। পাথরের মতো চেয়ে সব দেখেছে।
ফারাজ পেছন থেকে বলল,”বৃষ্টি নামবে। চলো তোমার মাদার ইন লোয়ের বাড়ি যাই। নাকি শশুড় বাড়ি যাবে?”
চিত্রা ধীর স্বরে বলল, “রাতটা এখানেই থাকি?”
“এই ভূতের বাড়িতে? না গো বউ সাতাশজন মরা মানুষের সঙ্গে রাত কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
চিত্রার চোখে একরাশ শূন্যতা।”মামার বাড়ির কথা বলেছি।”
ফারাজ মাথা নেড়ে বলল,”ওহ ওইটা বলো।আচ্ছা তাহলে গাড়িতে গিয়ে বসো।”
আকাশ তখন সন্ধ্যার কালো চাদরে ঘেরা। মেঘের কালো আচ্ছাদনে অম্বর আজ কলুষিত। চিত্রা নির্বাক দৃষ্টিতে ফারাজের দিকে তাকায়। বাতাসের ঝাপটায় চিত্রার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের ওপর পড়ছে। তবুও খেয়াল নেই তার। কোন দুনিয়ায় চলে গেছে তা সে নিজেই ভালো জানে। চিত্রা ফারাজের দিকে দুইপা এগিয়ে আসে। ফারাজ অভ্রকে ইশারা করল। বলল,”এখন কোনো সিকিউরিটির দরকার নেই। চিত্রার সঙ্গে আমি একা থাকতে চাই।”
অভ্র তা বুঝে নেয়। লোক দুটোও নীরবে সরে যায়।ফারাজ নিজের জায়গায় স্থির। হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসে। তালুকদারদের পোড়া বাড়ির পাশেই ছোট্ট এক মাটির ঘর, যেখানে থাকে মুয়াজ্জল। সে লালনভক্ত, নিঃসন্তান, বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে থাকে ওই ঘরেই। তালুকদারদের জমি, পোড়া বাড়ি আর কবরগুলোর যত্ন নেয় সে। চিত্রাই তাকে এখানে থাকতে দিয়েছে। সেই মাটির ঘরের উঠোনে একটা হারিকেন ঝুলছে। যার টিমটিমে আলো বৃষ্টির ফোঁটায় কাঁপছে। বৃষ্টি শুরু হতেই কয়েকজন দৌড়ে আসে ছাতা নিয়ে। চিত্রা কোনো দিকে না তাকিয়ে শুধু ফারাজকে বলে, “আজকে ভিজতে চাই। বৃষ্টির ছোঁয়ায় দুঃখ ভুলতে চাই।”
ফারাজ লোকদের বিদায় করে দেয়। চারদিকে সন্ধ্যার স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। তার মাঝেই বৃষ্টিতে ভিজছে দু’জন। ভিজতে ভিজতে চিত্রা ধীরে ধীরে ফারাজের দিকে এগিয়ে আসে। ফারাজ তাকিয়ে আছে চিত্রার দিকে। আর চিত্রা তাকিয়ে আছে তার দিকে। হুট করে চিত্রা ফারাজকে জড়িয়ে ধরে। বুক ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমায় কেউ ভালোবাসেনি। আমায় একটু ভালোবাসা ভিক্ষা দিন। আমি ভালোবাসা চাই, ফারাজ। একটু ভালোবাসেন আমায়!”
ফারাজ নির্বাক। কী বলবে, বুঝতে পারছে না। শুধু অনুভব করছে, চিত্রার জমে থাকা কান্নারা আজ বাঁধ ভেঙেছে। সে শক্ত করে চিত্রাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। বৃষ্টি ঝরছে। সন্ধ্যা গভীর হচ্ছে। চারপাশের অন্ধকার আজ চিত্রাকে ভয় দেখাতে পারছে না। আজ সে শুধু ফারাজকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। আজ দুঃখ ভুলে যাওয়ার রাত। আজ ভয় পেলে চলবে না… কিছুতেই না।
–
ফারিয়া বারান্দায় বসে গুনগুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে। এক সুরে গেয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে তাল মেলাচ্ছে পা দুলিয়ে। তার বিয়ের বয়স খুব বেশি হয়নি। তার স্বামী—শেখ নিহান আহমেদ। শেখ বাড়ির উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ঘর জামাই হয়ে পড়ে আছে এখানে। বিষয়টা একেকজনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। কেউ কেউ করুণা করে, কেউ বা তাচ্ছিল্যভরে দেখে, কিন্তু নিহানের এসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। সে বরং নিজের জগতে মগ্ন।সমুদ্র, ট্রলার, আর তার অদ্ভুত ব্যবসায়িক পথচলা।
নিহানের বেশিরভাগ সময়ই কাটে সমুদ্রে। মাছের ট্রলারের সঙ্গে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘোরে। চিত্রার বিয়ের আগের দিন রাতেও সে রওনা দিয়েছিল মায়ানমারের উদ্দেশ্যে, অথচ এখনো ফেরেনি। সময় যত গড়াচ্ছে, ফারিয়ার দুশ্চিন্তাও তত বাড়ছে। তার সবচেয়ে বড় চিন্তা তার স্বামীটা এই বাড়ির জামাই সেই নিয়েই। কিন্তু কি করার? নিহান বাড়ির ইতিহাস জেনেই তো তাকে বিয়ে করেছে। এক কথাতে তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। শুধুই কি ফারিয়াকে কলঙ্কের হাত থেকে রক্ষা করতে? নাকি উদ্দেশ্য ভিন্ন?
“ফারু।”
সুর থেমে যায়। ফারিয়া কণ্ঠ চেনে। কিন্তু চট করে কিছু বলতে পারল না। ঘরটা প্রায় অন্ধকারে ডুবে আছে। কেউ একজন নিঃশব্দে দরজা খুলে প্রবেশ করেল ভিতরে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বারান্দার দরজার ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল। ফারিয়ার ঠোঁটের কোণে একচিলতে বাঁকা হাসি খেলে যায়।সে মৃদু স্বরে শুধায়, “নিহান তুমি?”
–
ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে অভ্র অনেকখানি চলে এসেছে। মানুষের রোমান্স দেখলে তার আবার কুরকুরানি উঠে। ভেতরটা জ্বলে। গুরুর আজকে চাঁদরাত। অন্যের চাঁদরাত দেখলে নাড়িভুড়ি ব্যাথা করে। অভ্র কানে এয়ারফোন গুঁজে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। এদিকে এত মশা আগে জানলে কয়েল খেয়ে আসত! অভ্রর বিচিত্র সব চিন্তা—তার মতে, মশা মারার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো কয়েল পানিতে চুবিয়ে খেয়ে ফেলা। একবার তা খেয়ে নিলে মশার আর সাধ্য নেই তার মতো সুদর্শন, একাকী তরুণের র*ক্ত খাওয়ার! অভ্র পথে চলতে চলতে গান ধরল,
“ঘটক বুঝি আমার বাড়ির রাস্তা চিনে না।
পান খাইয়া মুখ লাল করিয়া
কালো ছাতা মাথায় দিয়া
কত বিয়ার খবর আনে
আমার খবর আনে না।
ঘটক বুঝি আমার বাড়ির রাস্তা চিনে না……”
হুট করে ঝড়ের বেগে কিছু একটা তাকে পাশ কাটিয়ে ধাক্কা দেয়। সামনেই কাঁদাজল ছিল। এক ঝটকায় ছিটকে গিয়ে সপাৎ করে কাঁদাজলের মধ্যে পড়ল অভ্র। হাত-পা ছড়িয়ে বোয়াল মাছ ধরার ভঙ্গিতে বসে পড়তেই ফোনটা খসে কাদার ভেতরে ঢুকে গেল। সে একবার নিজের হাত দু’টোর দিকে চেয়ে দেখল। তারপর নাক কুঁচকে বলে উঠল,
“ওয়াট দ্য ফা*।”
কাঁদার মধ্যে হাত চালিয়ে ফোনটা খোঁজার ফাঁকে চোখ গেল পাশে। একটা মেয়েও পড়ে আছে। কাদায় মাখামাখি, তার চোখে স্পষ্টই একরাশ বিরক্তি। মেয়েটি গায়ের কাদা ঝেড়ে নিতে নিতে বলল, “রাস্তা ঘাটে কানার মতো হাঁটেন কেন?”
অভ্র বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। সে হতভম্ব! উল্টো দোষারোপ? সে রেগে গিয়ে বলল, “এই মেয়ে, আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন! কানা আপনি নাকি আমি?”
মেয়েটির গলায় কটাক্ষ ঝরে পড়ল, “আপনি।”
অভ্র দাঁত চেপে বলল,” আবার মুখে মুখে তর্ক করছেন? সুদর্শন ছেলে দেখলেই উত্ত্যক্ত করতে মন চায়?”
মেয়েটি একটুও বিচলিত হলো না। বরং বাঁকা হাসল, “তর্ক মুখে মুখে করবো না তো অন্য কোনো বিশেষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা করবো?”
অভ্র থতমত খেয়ে গেল, “অসভ্য মেয়ে।”
মেয়েটা কাঁদা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,”ওলে আমার সভ্য ছেলে।”
“দেখুন ফাইজলামি করবেন না। যত্তসব!”
“তাহলে নষ্টামি করবো?”
মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। কাঁদার মধ্যে দু’টো ডাব পড়ে আছে। সেগুলো তুলে হাতে নিয়ে অভ্রর দিকে চেয়ে বলল,
“লুলা নাকি? উঠতে পারেন না?”
“আপনি আগে আমার কাছে ক্ষমা চান। তারপর উঠছি।”
” সরি কানে শুনতে পারছি না।”
অভ্রর রাগ তখন তুঙ্গে। এমন একগুঁয়ে মেয়ে সে জীবনে দেখে নি! সে কাদার মধ্যে পড়ে থাকা দুটি ডাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই অন্ধকারে মানুষের বাড়ি থেকে ডাব চুরি করে পালাচ্ছিলেন? ছ্যাছড়া চুন্নী।”
মেয়েটি ঘুরে তাকাল, চোখে আগুন।”এই ছেলে ফালতু কথা বলবেন না। ভালো কথা আপনি কি করে জানলেন আমি যে সত্যি চুরি করেছি?”
“চেহারা দেখলেই চুন্নী চেনা যায়।”
মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অনেক সহ্য করেছি। আর নয়। আপনি উঠবেন নাকি এখানেই থাকবেন?”
সে হাত বাড়িয়ে দিল অভ্রর দিকে। অভ্র এক মুহূর্ত ভেবে মেয়েটার দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু তার আগেই সে শক্ত করে মেয়েটার কবজি চেপে ধরল। পরক্ষণেই এক ঝটকায় মেয়েটাকে টেনে নিয়ে আবার কাদার মধ্যে ফেলে দিল! কাদার ছিটায় অভ্রর চোখ-মুখ ঢেকে গেল। কিন্তু সে বোঝার আগেই মেয়েটা তার ওপর এসে পড়ল! অভ্র চেঁচিয়ে উঠল,
” আম্মা গো ভোটকি আমার কোমর ভাইঙ্গা ফেলল।”
মেয়েটা ধপ করে উঠে বসল, কাদা মুছতে মুছতে বলল, “শালা তোরে ভালো মনে করছিলাম। তুই জানোস আমি কে?”
অভ্র বিরক্ত গলায় বলল,”না শালী নাম কি তোর?”
“আয়েশা। আমার নাম আয়েশা।”
অভ্র নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “হ তুই গু খা ঠাইশা।”
চলবে?
( বানান রিচেক দিতে পারি নাই। ভুল হলে ধরিয়ে দিয়েন ঠিক করে নিবো। ধন্যবাদ)