#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৫
‘লা*শ কি করমু ভাই?’
‘আগে লা*শের পেট ফুটা করবি।তারপর আট মণ ইট বানবি লা*শের গায়ে।দড়ি যেন প্লাস্টিকের হয়।ইটের গায়ে ফুটা করা আছে না?’
‘জে আছে ভাই।’
‘ইটের ফুটা দিয়া ভালো মতো ধরি ডুকাইবি।যাতে ইট সহজে ছুইটা না যায়।কাজটা মনোযোগ দিয়া করবি কইলাম।যদি কোনো ভুল হয় তাইলে তোর পেট কাইটা মেঘনা নদীতে ভাসাইয়া দিমু।কথাডা মগজে ভালো কইরা ঢুকাইয়া রাখ।’
লোকটা ফোন কাটতে যেয়েও কাটল না।আবার বলল,
‘নারায়ণগঞ্জে নিয়া ফেলবি।আজকে রাতের মধ্যেই।লা*শ যেন পচে না।লা*শের পচন পছন্দ না আমার।দরকার হইলে লা*শে আপাতত বরফ দিয়া রাখ।আর যা করবি সাবধানে।’লোকটি ফোন রাখল।
মুইন একটা ফাঁকা ঢোক গিলল।সে এখানে নতুন এসেছে।এখনো কাজের অনেক কিছু তার শেখার বাকি।পাপ কাজের সঙ্গে জড়ানো সহজ তবে জড়িয়ে গেলে এসব ছেড়ে বেড়িয়ে আসা কঠিন।মুইন সব যেনেও এখানে এসেছে।তার আব্বা সদর হাসপাতালে ভর্তি।চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন।আব্বার জন্য মুইন সব করতে পারে।জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে এখানে এসেছে। এভাবেই তো আর সে মরে যেতে পারে না।তাদের কর্তা,তাদের নেতা এখন ট্রলারে নেই।সে রাতের বেলা আসেন। ভোরে আবার চলে যান।গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া আসেনও না।তবে মাঝে মাঝে আবার হুট করে তার আগমন ঘটে।মুইন ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে লুঙ্গি গিট ঠিক করে।এখন তার কাজ নেই।কাজ সব রাতে।এখন সে সোজা হাসপাতালে যাবে।তার বাবাকে দেখতে।সঙ্গে ছোট বোনটাকেউ দেখে আসবে।মা মারা যাওয়ার পর ছোট বোনটা সব একা হাতে সামলেছে।কখনো কোনো আবদার করে নি।যাওয়ার সময় হাতে করে কিছু নিয়ে যাবে আজ সে।
–
চিত্রার সঙ্গে অনেকক্ষণ যাবৎ খুটিনাটি কথা বলছে মোহনা।বাড়িতে এত সব কাজের মানুষ থাকলে বাড়ির বউদের হয়তো এভাবেই শুয়ে বসে সময় কাটাতে হয়।তবে চিত্রার শরীর ম্যাচম্যাচ করছে।ছোট থেকেই তার কাজ করার অভ্যাস।এমন কোনো কাজ নেই যা চিত্রা পারে না।এখানে আসার পর ঘরের মধ্যে বসেই থাকতে হয়েছে চিত্রাকে।তার শাশুড়ী রান্নাঘরে।নদীও রান্না ঘরে তবে চিত্রাকে উনুনের সামনে আসতে নিষেধ করেছেন রুমানা। গালে হাত বুলিয়ে বলেছেন,
‘তুমি আমার ফারাজের বউ।আমার ছোট পোলার বউ।তাই তুমি আমার চোখে আমার ছোট মাইয়ার সমান।আমার মাইয়া ফারিয়াও কোনো কাম করে না এই বাড়িতে।তাই তুমিও করবা না।যাও যাও এখান থেকে যাও।তোমার সুন্দর চেহারা তৈরি হইছে স্বামীর যত্ন নেওয়ার লইগা।আমার পোলার সেবা যত্ন করাই তোমার ধর্ম।’
নিরুও রুমানার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।আর রুহী ব্যস্ত নদীর মেয়ে নুড়িকে সামলাতে।বাড়িতে কি শুধুমাত্র এরাই থাকে?তবে সুলেমান এলাহী যখন বাহিরে যাচ্ছিলেন তখন তার সঙ্গে আরেকজন লোককে দেখেছে চিত্রা।বয়সে সুলেমান এলাহীর থেকে হয়তো কিছুটা ছোট হবেন।তবে চিত্রার সঙ্গে তার পরিচয় হয় নি।লোকটিকে কিছু একটা নিয়ে অনেক চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
‘নিরু তোমার সঙ্গে কথা বলে নি বুঝি?’মোহনা জিজ্ঞেস করল। চিত্রার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটল।সে বলল,
‘না তো।’
‘করবেই বা কেমন করে?তার চাঁদে বসত ঘরেছো তুমি।’
‘মানে?’
‘মজা করলাম।আমি আবার রসিক মানুষ বোন।তুমি কিছু মনে করো না।চা খাবে?’
‘এই দুপুরে চা?’
‘কেন খাও না?আমি খাই তো।যখন দুপুরে বাড়িতে কেউ থাকে না।তখন আমি ওই যে কালো পুকুরটা দেখছো ওটা দেখতে দেখতে চা খাই।’মোহনা হাসল।হঠাৎ হিসহিসিয়ে বলল,
‘ ইদানীং স্বপ্নে শুধু র*ক্ত দেখছি।র*ক্তে কেমন যেন নতুনত্ব ছিল।’মোহানা অদ্ভুত ভাবে চিত্রার দিকে তাকায়।চিত্রা তার চোখে চোখ রাখল না।সে মোহনার দৈনিক সাজসজ্জা লক্ষ করছে।এই বাড়িতে এখন অব্দি সে শুধুমাত্র যাদের সঙ্গে কথা বলেছে তাদের মধ্যে শুদ্ধ বাঙালি ভাষায় শুধুমাত্র ফারাজ এবং মোহনাকেই কথা বলতে দেখেছে।ফারাজ এলাহী কে যেমন চিত্রা বুঝে উঠতে পারছে না তেমনি মোহনা কেউ বুঝতে পারছে না সে।
‘তোমাদের বিয়ে কেমন করে হলো?মানে রাতে সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম আর সকালে উঠে জানতে পারলাম ফারাজ এলাহী নাকি বিয়ে করেছে।ভাবা যায়?ফারাজ এলাহী বিয়ে করেছে?’
চিত্রা কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না।না জানি ফারাজ বাড়ির মানুষদের কি বলেছে।এখন যদি চিত্রা সত্য বলে দেয় তখন তো সমস্যা হতে পারে।
‘বলবে না?স্বামীর বারণ আছে তাই না।থাক বাদ দাও।’
‘ভাবী!ভাই এসেছে।আপনাকে ডাকছে।’দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাক ছাড়লো নিরু।তবে চিত্রার সঙ্গে কোনো কথা বলল না।চিত্রাও তেমন কোনো আগ্রহ দেখালো না। চাঁদ শব্দটা নিয়ে এখনো সে ভাবছে।বিষয়টি তার মাথায় ধরছে না।
‘চলো চিত্রা নিচে চলো।এখন বাড়িতে এক এক করে সবগুলো বিড়..মানে এখন বাড়ির পুরুষরা বাড়িতে ফিরবে।তোমার স্বামীও বাড়ি আসবে।সকাল বেলা তোমাকে নিজের ভাগের পরোটা দিলো এখন তো তোমারো উচিত স্বামীকে কিছু একটা দেওয়া।কি আছে তোমার কাছে?’
চিত্রা ভাবলো।তার কাছে কি আছে?কিছুই তো নেই।সে তো নিঃস্ব।
‘কিছুই নেই নাকি?’মোহনা পুনরায় জিজ্ঞেস করল।
‘না।’চিত্রার সোজাসাপ্টা জবাব।
‘একটা জিনিস আছে তো।’
চিত্রা জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে মোহনার দিকে তাকালো।
‘তোমার জীবন।পুরুষ মানুষ কিছু নেওয়ার জন্যই কিছু দেয়।তবে যা দেয় তার চেয়ে বেশী কেড়ে নেয়।’
কথাটা মোহনা খুব যেয়ে খারাপ বলেছে তাও নয়।চিত্রা মোহানার পেছন পেছন দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।বসার ঘরে চোখ যেতেই একসঙ্গে তিনজন পুরুষকে দেখে মাথার ঘোমটা আরো বড় করে টেনে দিলো সে।পুরুষগুলো একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল।চিত্রার দিকে চোখ পড়তেই তাদের কথার প্রসঙ্গ বদলে যায়।
‘এই যে এরা দুজন তোমার বড় ভাসুর।উনি হইলো রাজন। আমার স্বামী। আর উনি রোশান।মোহানার স্বামী। আর উনি…উনি হইলো গিয়া তোমার দেবর জোহান এলাহী।তোমার চাচা শশুরের বড় পোলা।’বলল নদী।
চিত্রা এক মুহুর্তের জন্য চেয়ে একটা করে সালাম দিয়ে চোখ নিচে নামিয়ে ফেলল।
‘আর আমি হচ্ছি মিসেস চিত্রা এলাহীর আপন স্বামী যার অনুমতি ছাড়া আপনি আমার স্ত্রীকে দর্শকের সামনে প্রদর্শন করছেন।কাজটা কি ঠিক হচ্ছে ভাবী?
ফারাজের হাসিমাখা কন্ঠেও কেন জানি সবাই থমকে গেলো।তবে তার ভাইয়েরা কিচ্ছুটি বলল না।
‘না মানে ফারাজ তুমি ভুল ভাবতাছো।’
‘চিত্রা তুমি রুমে যাও।’
চিত্রা অবাক হলো।সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কেউ এভাবে বলে?
‘কিন্তু ফারাজ।’
‘আমি তোমাকে যেতে বলেছি না?’ধমকে উঠল ফারাজ।একমুহূর্তেই বাড়ির পরিবেশ বদলে গেল।চিত্রা দেরি না করে রুমের দিকে পা বাড়াল।রাজন,রোশানের মুখে ক্ষীণ হাসি।যেন দুনিয়া উল্টে গেলেও তাদের কিচ্ছু আসে যায় না।তবে জোহান চিত্রার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল।তার চোখের পলক পড়ল না।চিত্রা রুমে গিয়ে ধপ করে দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল।
‘এবার চোখটা নামা।’ফরাজ দাঁত পিষে বলল।
জোহান তখনও শান্ত।যেন কিছুই হয় নি।কিংবা কিছুই হওয়ার নেই।সে বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বলল,
‘ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।মনে আছে তো?’
–
রান্না ঘরে মার্জিয়া আর মারিয়া রান্নার জোগাড় করছে।পুঁইশাক ভাজি করছে মারিয়া।
‘হেরে মারিয়া আমার সোহাগটার লইগা তো বুক পুড়তাছে।বাপ আমার এহনো বাড়ি আইলো না।’
‘আরে আম্মা চিন্তা কইরেন না।হয়তো কোনো জরুরি কামে গেছে।আপনে জানেন না সোহাগ অনেকদিন ধইরাই এমন উথাল-পাতাল শুরু করছে?’
‘আইচ্ছা ওই যে চিত্রারে যে তুইলা নিয়া গেল ওই পোলা, হেয় আমার সোহাগরে কোনো ক্ষতি করবো না তো আবার?’
‘হেয়ডা আমি কেমনে কইমু?আপনার পোলার লগে যে ওই মাইয়ার ফষ্টিনষ্টি আছে ওইডা মনে হয় ওই এলাহী সাহেব জানেন না।জানলে কি আর এই ছ্যামড়িরে বিয়া করত।আইচ্ছা আম্মা হেরা কি বহুত বড়লোক? না মানে ওই মাইয়া এত সুখ করতাছে বড় বাড়ির বউ ইইয়া?’
‘হ মনে হয়।এলাচী বাড়ির বউ হইয়া গেলো মাঝখান দিয়া। সবই কপাল।’
‘আম্মা এলাচী না এলাহী।’
‘ওই হইলো।’
বাড়ির বেল বাজতেই বাড়ি মারিয়া কাজ রেখে দরজা খুলতে যায়। তবে দরজা খুলতেই মারিয়া স্তব্ধ, নির্বাক।চিৎকার করে উঠল সে,
‘আম্মু!!!!!!!!!!!’
(আজকে ভাবতেও পারি নি গল্প দিতে পারবো।দিতে পারছি এটাই অনেক।বইকেন না আমাকে কেউ)
চলবে?