#ইশরাত_জাহান_জেরিন
পর্ব ৫৩
অভ্র রুমে এসে আয়েশাকে শুইয়ে দেয়। মেয়ে দেখি মাল খেয়ে টাল হয়ে গেছে। তার ওপর দেখো, শাড়ির ওপর দিয়ে লুঙ্গি পড়ে, চোখে চশমা লাগিয়ে রান্নাঘরে ডিসকো ডান্স করছিল! গা থেকেও মদের গন্ধ আসছে। তার ওপর পরিচিত একটা মদের গন্ধ। হ্যাঁ, রোজের পছন্দের ব্র্যান্ডের, পছন্দের মদ। ওই নাগিন আয়েশাকে না জানি কয় প্যাক খাইয়েছে! আয়েশা হুঁশে নেই। আবোল-তাবোল বকছে। অভ্র তার গা থেকে লুঙ্গি খুলে ফেলে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমু এঁকে লকার খোলে। তাতে নানারকম বিদেশি হুইস্কি রাখা। তার এসব মদ-হুইস্কিতে গলা জ্বলে। ছোটবেলা থেকেই কেন জানি, তেতো ভাব একদমই পছন্দ না অভ্রের।
তবে ফারাজ এলাহীর বিষয় আলাদা। সে একসঙ্গে এমন অনেকগুলো বোতল শেষ করলেও একদমই হুঁশ হারায় না। বরং এসব না গিললে তার কাজে মন বসে না। ফারাজ এলাহীর অবৈধ জিনিসের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক, তবে নারীর ক্ষেত্রে বিষয় ভিন্ন। পুরুষ মানুষ যতই খারাপ হোক, সকল খারাপকে ভালোয় পরিণত করতে শুধুমাত্র চরিত্রটা শুদ্ধ থাকাই যথেষ্ট। চরিত্র ভালো থাকলে অন্য নারীর দিকে বাজে নজর যাবে না, আর দেখা যাবে সেই নারীর প্রতি ভালোবাসাই তাকে আলোকিত পথে ধাবিত করবে।
দুই দিনের জন্য কিশোরগঞ্জের বাইরে যেতে হবে ফারাজ ভাই আর রোজের সঙ্গে। পরশু যাবে। আগে সিঙ্গেল মানুষ ছিল বলে এত গায়ে লাগত না। তবে ইদানীং বউকে ছাড়া শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর। বউ তো বউ নয়, এ যেন অক্সিজেন। সে বিনা শ্বাস নেওয়া দায়।
অভ্র মদের বোতল খুলেও কেন জানি রেখে দিল। ভালো লাগছে না। ফ্রেশ হয়ে ঘুমন্ত আয়েশার পাশে শুয়ে পড়ে। আবার একটু পর আয়েশার দিকে ঘুরে, গালে একটা চুমু বসিয়ে বউকে বুকে আঁকড়ে চোখ বন্ধ করে। শেষ রাত। যতটুকু ঘুমানো যায়। অভ্র মনে মনে বাঁকা হেসে বলে, “একদিন উভয়ে উভয়ের সম্মুখীন হবো আসল রূপ নিয়ে। সেই দিনের অপেক্ষায়, ঘরনী।”
–
চেঁচামেচির কোলাহলে ঘুম ভাঙে চিত্রার। রাতভর চোখে ঘুম ছিল না একবিন্দু। ভোরের আগ মুহূর্তে ক্লান্ত দেহটা যখন একটু ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, তখনই চারপাশে হট্টগোল শুরু। বাড়িতে নতুন কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে। ওদের মধ্যে কেউ এখানেই থাকে, কেউ বা নিজের বাড়িতে। শায়লা নামক মেয়েটা চিত্রার রুমে টোকা দেয়। বেশ কয়েকবার দেওয়ার পর ঘুম ভাঙে চিত্রার। ফারাজ তখনও উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
বিদেশে থাকলে এতক্ষণ এই ঘুম ভাঙানোর অপরাধে এই মেয়েকেই চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়াতে, ফারাজ একটুও দ্বিধাবোধ করত না। এখানেও চাইলে করতে পারে, কিন্তু এখানে তার ভালোবাসার মানুষ থাকে। পাপ তো অনেক করা হয়েছে জীবনে এবার মনে হয় কিছুটা হলেও যদি ভুল শুধরে ভালো থাকার চেষ্টায় লাগা যায়।
ফারাজ কোলবালিশের নিচে মুখ গুঁজে আবারও ঘুমের দুনিয়ায় হারিয়ে যায়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিত্রা চোখ মেলে। হাই তুলে, মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুলে শায়লাকে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”
শায়লা খানিক উদবিগ্ন স্বরে জানায়, “একজন আসছে। আপনারে আর ছোট সাহেবরে খুজতাছে।”
“এত সকাল সকাল কে?”
“কইল তো আপনার নাকি মামী হয়।”
“মার্জিয়া মামী এত সকাল সকাল এইবাড়িতে?” ভাবতে না ভাবতেই অন্দরমহল থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। চিত্রা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ধ্বক করে বুকটা। হিম হয়ে আসে শরীর। আবার কোনো অনিষ্ট ঘটে নি তো?
অন্দরমহলে বসে আছে ফারাজ। পায়ের ওপর পা তুলে, কপালে আঙুল ঠেকিয়ে। মারিয়া বড় বিপদে পড়ে কোনো উপায় না পেয়ে ছুটে এসেছে তার দুয়ারে। কারা যেন কাল রাতে মারিয়াকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মাহাদীকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চিত্রা চুপটি করে কেবল ফারাজের পাশে দম বন্ধ করে বসে থাকে। মাথায় কাজ করছে না। প্রথমে জান্নাতও একইভাবে নিখোঁজ হলো। তারপর মাহাদী, এখন মারিয়া। একই বাড়ির তিনজন মানুষ। কেমন যেন একটা লাগছে চিত্রার। সবই কি তাহলে একই সূত্রে গাঁথা?
মার্জিয়াকে আর সোহাগকে আপাতত এই বাড়িতেই ফারাজ থাকার অনুরোধ করে। কিছুদিন যাক। বিষয়টা আগে সে বুঝে উঠুক, তারপর না হয় ওনারা বাড়ি ফিরবেন। তবে ফারাজের সন্দেহ একেবারে জায়গামতো গিয়ে লেগেছে। কেন জানি মনে হচ্ছে নারী পাচারের একটা হাত আছে এখানে। যদিও ওইসব ভুঁইয়ারা করে, তবে তাদেরকে তো ওই মেয়েলোক সংগ্রহ করে দেয় রাজন, সোহানরা। কিন্তু পরপর একই বাড়ির মানুষ গায়েব হয়েছে, তাও সতীসাবিত্রী কোনো নারী নয়। দু’জনেই বিবাহিত। তার ওপর একজন পুরুষও এখানে নিখোঁজ। ঘটনা অন্য কিছুই মনে হচ্ছে। সোহাগের অবস্থা ভালো না। চোখের নিচে দাগ পড়ে গিয়েছে। আজকাল কিচ্ছু খেতে পারে না। সব কেমন যেন গন্ধ গন্ধ লাগে। জন্ডিস হয়েছে কিনা, তাও ধরা যাচ্ছে না। সোহাগের কেমন যেন অস্তিত্ববোধ হচ্ছিল এই বাড়িতে থাকতে। প্রথমে রাজি হয়নি। পরে চিত্রা নিজে যখন বোঝায়, তখন কেমন যেন বাধ্য হয়ে আসে তার ভিতরটা। এ কেমন জীবন? নিয়তির নির্মম পরিহাস চিত্রাকে আজ কোন চূড়ান্ত অস্থিরতার প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে? তার অন্তঃস্থলে আষাঢ়ের উন্মত্ত ঝড় বইছে, অথচ বাইরের দৃশ্যে একফোঁটাও ভেজা নেই। সে কিছুই প্রকাশ করতে পারছে না। না অভিমানের রেখা, না ক্ষতের কান্না। মারিয়া সেদিনই জানতে পেরেছিল, সে মা হতে চলেছে। এই মুহূর্তেই কেনো এই অলক্ষুণে ঘোষণা আসতে হলো? একটু দেরি হলে কী এমন ক্ষতি হতো? ভাগ্য কেন ইচ্ছাকৃতভাবেই চিত্রার সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা খেলছে? এই হারানোর যন্ত্রণা কি কখনও শেষ হবে না? চিত্রা তো কম হারায়নি। প্রতিবারই অদৃশ্য রক্তক্ষরণে ধুকে ধুকে মরেছে সে। খানিক সুখ দিলে খোদা এক আকাশসমান দুঃখ কেন তাকে দেয়? কোন পাপের শাস্তি এসব?
–
সন্ধ্যাবেলায় চিত্রা ছোট্ট নুড়িকে নিজের কক্ষে নিয়ে আসে। ছোট্ট নুড়ি বড় হচ্ছে। ফারাজ বাইরে গিয়েছে। একটুপর আসবে। এই নুড়ি ফারাজকে কাছে পেলেই হয়েছে। আর কোল থেকে নামতে চায় না। আর ফারাজটাও না। বাচ্চা দেখলে মাথা নষ্ট হয়ে যায় তার। বাচ্চাদের হাসিতে সে মোহাচ্ছন্ন। অদ্ভুত শিশু প্রেমে আক্রান্ত এক পুরুষ। এমন শিশুস্নেহপরায়ণ পুরুষের হৃদয় যে নির্মল ও সংবেদনশীল, তা বুঝতে চিত্রার বাকি থাকে না। এই অভ্যাসটি চিত্রাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে, আবিষ্ট করে তার অস্তিত্বকে।
না জানি নিজের সন্তান হলে এই লোক কি করবে? কত ভাগ্যবান হবে সেই বাচ্চা যে কিনা ফারাজ এলাহীর মতো বাবা পাবে। যদিও চিত্রা নিজেও ভাগ্যবান তা না হলে ফারাজ এলাহীর মতো এমন যত্নশীল পুরুষ কি কখনও সে পেত? সৃষ্টিকর্তা কিছু কেড়ে নেয় কিছু দেওয়ার জন্যই।
নুড়ির জন্য ক্লে আনা হয়েছে। সে এসবের মানে বোঝে না, কিন্তু বিনষ্ট করতে ভীষণ ভালোবাসে। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ ক্লেই সে নষ্ট করে ফেলেছে, বাকি রয়েছে একটুখানি গোলাপি রঙের ক্লে। হঠাৎ চিত্রার মনে কেমন এক দুরন্ত ভাবনার উদয় হয়। জগতের সমস্ত দুঃখ যেন হার মানে সেই ভাবনায়। দুষ্টু এক চঞ্চলতা চেপে ধরে তাকে। সে নিঃশব্দে নুড়ির কাছ থেকে গোলাপি ক্লেটুকু সরিয়ে ফেলে আবার শিশুটির সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে ওঠে। ভুলে যায় সবকিছু, উদ্দাম উড়িয়ে দেয় সকল কথাবার্তা। নুড়ি তো এসবের কিছুই বোঝে না। সে জানেই না দুঃখ কাকে বলে, জানে না যে তার মা আর নেই। হয়তো বোঝেও না, কেননা বয়সটা এখনও ছোট্ট, হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যাওয়ার মতো ব্যথার ভার সে বইতে শেখেনি। চিত্রাও যদি পারত নুড়ির মতো হয়ে যেতে। শৈশবের সহজ-সরল, নিঃশঙ্ক জগতে আশ্রয় নিতে। যেখানে দুঃখ ধাক্কা দিলেও ব্যথা হয় না, যন্ত্রণায় হৃদপিন্ড খাঁ খাঁ করে না। যেখানে হারিয়ে যাওয়া মানেই নয় শোক, আর হাহাকার মানেই নয় অস্তিত্বের ভাঙন।
ফারাজ এলাহী রাতেই ঢাকা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। অভ্র আর রোজও সঙ্গে যাবে। চিত্রার মন ভালো না। এই রাতের বেলায় বিবাহিত নারীদের স্বামী ছাড়া ঘুমানো কী যে কষ্টের সেটা যদি তার ধানচুরি করা ঘুঘু পাখিটা বুঝত!
ফারাজ গোসল করে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়। চিত্রা রোজ ফারাজের টাই বেঁধে দেয়। আজ চুপ করে বসে আছে। কোনো কিছু এগিয়েও দিচ্ছে না। ফারাজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,”তুমি চাইলে কিন্তু আমার কাজগুলো করানোর জন্য মেইড থাকতে পারি। তুমি টাই পড়াবে নাকি মেইড ডাকব?”
চিত্রা জলদি উঠে ফারাজের টাইটা বাঁধতে বাঁধতে বলল, “ভয় দেখাবেন না এলাহী। চিত্রা ভয় দেখে মানুষ হয়েছে তাই ভয়কে আর সে ভয় মনে করেনা।”
ফারাজ হেসে বলে,”হুম খালি ওই একটু রক্ত দেখলে কিডনি খুলে হাতে চলে আসে। এর থেকে বেশি আর কিছুই না?ঠিক বললাম না?”
চিত্রা মুখ ভেংচি কাটল। তারপর হুট করে পুনরায় হেসে বলে উঠল,”তোমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।”
ফারাজ চোখ গেড়ো করে,”সরি আমি আর লুঙ্গি-ফুঙ্গি পড়তে পারব না। এসব সারপ্রাইজ দিয়ে আসলে আগেই দূরে যাও।”
“আরে আগে শুনবেন তো? আগেই কেন এত অ্যাগগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছেন?”
ফারাজ চিত্রার দিকে সরু চোখে তাকায়। মাথা নিচু করে চিত্রার দিকে ঝুঁকে বলে, “অ্যাগ্রেসিভের স্পেলিং বলো তো আগে।”
“ফারাজ!”
“আচ্ছা আচ্ছা সরি। তো দেখাও কি সারপ্রাইজ এনেছো। এবার বুঝি শাড়ি পরে চাম্মাক চাল্লো গানে ডান্স দিতে বলবে?”
চিত্রা ফারাজকে পাত্তা না দিয়ে ড্রয়ার খুলে কি যেন একটা বের করে। তারপর হুট করে হাত সামনে করতেই ফারাজ তার হাতের তালুর ওপর নড়েচড়ে প্রতিবন্দীর মতো দেখতে ক্লে দিয়ে বানানো একটা অদ্ভুত প্রজাতির পুতুল দেখতে পায়। ফারাজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই চিত্রা গর্বভরে বলে, “দেখুন আমি আপনাকে বানিয়েছি। সুন্দর হয়েছে না?”
ফারাজ বিস্মিত চোখে চিত্রার দিকে তাকায়।”এটা আমি?”
“হুম পিংক কালারের পুকি ফারাজ।”
“ওহ আচ্ছা তুমি না বললে সত্যি জানতামই না।” ফারাজ একটা ঢোক গিলে তারপর পুনরায় বলে, “ওর নাক নেই কেন? নিশ্বাস না নিয়ে বেঁচে আছে কেমন করে?”
“কালো ক্লে আর ছিল না। তাই পুকি ফারাজের পশ্চাৎদেশ থেকে একটু পিংক কালার ক্লে নিয়ে নাকের জায়গায় লাগিয়ে দিয়েছি। ভালো করে দেখুন নাক আছে। সারপ্রাইজ পছন্দ হয়েছে?”
“হ্যাঁ এতই পছন্দ হয়েছে যে হারপিকের বোতলে চড়ে খুশির ঠেলায় পৃথিবী ত্যাগ করে সূর্যমামার কাছে গিয়ে টান্ডুরি ফারাজ ফ্রাই হওয়ার উপক্রম।”
–
নিশুতি রাতে হাইওয়ে পেরিয়ে সামান্য এগোলেই দৃষ্টিগোচর হয় একটি পুরনো ব্রিজ, যার গম্ভীর ছায়া বিস্তার করে নিচের বিস্তীর্ণ বিলে। এ ঋতুতে বিল উপচে পড়া জলে পূর্ণ, জলরাশির বুকে দোল খায় বুনো সোনালি ধানের পাঁজা। বিলঘেঁষা পথের ধারে ছড়ানো কয়েকটি চায়ের টং দোকান। প্রতিটি দোকানে ঝুলছে ঝিমধরা সোডিয়াম বাতি। সেই আলোতে চারপাশের গাঢ় অন্ধকারে এক ধরনের মোহময় আভা ছড়িয়ে পড়েছে। একটানা নিঃশব্দতা ছেদ করে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে টিনের কাপ ঘষাঘষির ক্ষীণ ধ্বনি। দোকানের কাঠের বেঞ্চের নিচে ঘুমিয়ে আছে ন্যাড়ি, শীর্ণ কুকুরেরা। তাদের কঙ্কালসার দেহ জড়ানো নির্ভার ঘুমের পরত। এক কোণে, এক মাদী কুকুর তার সদ্যোজাত বাচ্চাদের নিবিড় করে জড়িয়ে রেখেছে। মাতৃত্বের আদিম তীব্রতায়, তীব্র অন্ধকারের মধ্যেও তা এক উজ্জ্বল দৃশ্য। এই নিস্তব্ধ প্রকৃতি বহন করে দ্বৈত বোধ। একদিকে এক অচঞ্চল শান্তি, অন্যদিকে এক অমোঘ অস্বস্তি। এই নিঃশব্দ রাতের আবরণে ঢাকা পড়ে আছে কোনো অব্যক্ত গূঢ়তা, কোনো এক অন্তর্লীন অস্থিরতা।
রাতের সমস্ত বিভীষিকা, সকল আত্মরক্ষার বোধ উপেক্ষা করে প্রাণপণে ছুটছে চিত্রা। কলাপাতা রঙের নরম শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে ঘষটে-ঘষটে পিছলে পড়ছে। যেন সেই আঁচলও চিত্রার সঙ্গে প্রাণপণে পালাতে চাইছে। কপাল বেয়ে নামছে উষ্ণ ঘামের সরু ধারা। সেই ঘাম গিয়ে মিশছে চিবুকের কাছে যেখানে কাঁপন এক মুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। হৃদপিণ্ডের গতি এতটাই দ্রুত যে, মনে হচ্ছে পরের ধাপেই থেমে যাবে সবকিছু। পেছনে ছুটে আসছে ধাবমান চারজন পুরুষ। চিত্রার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠেছে, তার দেহ হাঁপিয়ে উঠেছে, কিন্তু তার মন? সে এখনো খুঁজছে একমাত্র ফারাজকে। সে কোথায়? কেন সে আসছে না? কেন এই ভয়াবহ রাতের মধ্যে চিত্রার পাশে সে নেই? চিন্তার অতল গহ্বরে যখন ডুবে যাচ্ছে চিত্রা তখনই ঘটে বিপর্যয়। শাড়ির আঁচলে পা জড়িয়ে হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সে। পিচঢালা কংক্রিটের পথ মুহূর্তেই রক্তে রঞ্জিত করে চিত্রার হাঁটু, কনুই আর তালুর ছাল। ক্ষতের ভিতর থেকে ফুটে ওঠা রক্ত তার ভয়কেই রক্তাক্ত করে তুলে। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে চিত্রা। ভয় তার চেতনার গলা চেপে ধরেছে। সে পিছনে তাকায়, তারা আসছে। পাষাণ পায়ে, নির্মম অভিপ্রায়ে, দিগ্বিদিক অন্ধ করে এগিয়ে আসছে তার মৃত্যুর দূতেরা। চিত্রা উঠে দাঁড়ালো চেষ্টা করতেই অন্ধকার ফুঁড়ে কেউ একজন ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ায়।চিত্রার এলোমেলো চুলের মুঠি এক ঝটকায় টেনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় অপরিচিত সেই ছায়ামূর্তি। শরীরে কোনো ভারসাম্য নেই, তবু এক অদৃশ্য শক্তি তাকে শূন্য থেকে তুলে আনে। সে এখনো অন্ধকার ছেঁকে সেই মুখটি দেখার চেষ্টা করছে। কার মুখ? চেনা কেউ? না কি অন্য কেউ? প্রশ্নগুলোর জবাব আসার আগেই গর্জে ওঠে ট্রিগার। এক ভয়াবহ হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়া ধাতব শব্দ।
প্রথম গুলির সঙ্গে সঙ্গেই কেঁপে ওঠে চারপাশ। দ্বিতীয় গুলির কম্পনে স্থবির হয়ে যায় সমগ্র জগৎ।
চিত্রার করোটির এক প্রান্ত ভেদ করে বুলেট ছুটে যায় অজানার দিকে। আর অন্য প্রান্ত থেকে বিস্ফোরিত হয়ে ঝরে পড়ে উষ্ণ রক্তধারা। জলের ঢেউয়ের মতো কপাল ভেদ করে গড়িয়ে পড়ে নিচে। মুহূর্তের মধ্যেই চিত্রার পৃথিবী নিঃশেষ হয়ে যায়। সব রঙ, সব শব্দ, সব ভয় এক ঘন, নিগূঢ় ধূসরতায় ডুবে যায়। চুলের মুঠি থেকে হাতটি যখন সরে আসে, তখনই শরীরটাও নিথর হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। করোটির একটি অংশ ছিটকে এসে পড়েছে সম্ভবত সেই অন্ধকার ঘেরা মানুষটার গায়ে। যিনি গুলি চালিয়েছিলেন। তার মুখাবয়বে রক্তের বিন্দু জমে থেকেও কোনো অনুশোচনার রেখা তৈরি করে নি। চিত্রা লুটিয়ে পড়ে। তবে শেষবারের মতো সে তাকাতে চেয়েছিল।চেয়েছিল বুকের সরু গলিতে জমে থাকা গলে যাওয়া প্রশ্নগুলো উগরে ফেলার জন্য। চিত্রার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। চোখের সম্মুখে সবটা ঘোলাটে হতেই আচমকা ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল চিত্রা।
ভয়ে হঠাৎ করেই হাহাকার করে কেঁদে ওঠে চিত্রা। অস্থির হাতে পাশ হাতড়ে দেখে ফারাজ নেই। বুকের গভীর থেকে উঠে আসে শীতল আতঙ্ক। সারা শরীর কাঁপছে কম্পনে। এ কেমন দুঃস্বপ্ন? এতটা বিভীষিকাময় স্বপ্নও কি সম্ভব? দমবন্ধ করা ঘরে বসে ঢকঢক করে পানি পান করে সে। জল কিছুটা ভার হালকা করেছে। দীর্ঘ এক নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করার বৃথা চেষ্টা করে চিত্রা। মন ছটফট করছে ফারাজকে কল করতে। কিন্তু আঙুল থেমে থাকে স্ক্রিনের ওপর। করবে কি, করবে না এই দ্বিধার দোলাচলে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়। চোখে আর ঘুম নেই। ঘুমের আড়ালে থেকে গেছে দুঃস্বপ্নের বিষাক্ত পদচারণ।
চিত্রা ধীরে উঠে বারান্দায় আসে। রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। চারপাশে নিস্তব্ধ এক রাত। তবু সেই নীরবতার বুক চিরে আসে অস্পষ্ট একটি শব্দ কর্ণকুহরে। কেউ মাটি খুঁড়ছে। অনভিপ্রেত সেই শব্দ তাকে সজাগ করে তোলে। সতর্ক দৃষ্টিতে নিচে তাকায় সে। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে আবছা আলোয় দেখা যায় তিনজন লোককে। একজন টর্চ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আরেকজন নিরবচ্ছিন্ন হাতে মাটি খুঁড়ছে। হঠাৎ, টর্চধারী ব্যক্তি আলো নাড়িয়ে দেয়, আর তাতেই দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখ সম্পূর্ণভাবে আলোকিত হয়ে ওঠে। সেই মুখ দেখে হঠাৎই বুকের রক্ত জমাট বাঁধে চিত্রার। এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি থমকে যায়, নিশ্বাস আটকে আসে। কারণ সেই ব্যক্তি আর কেউ নয়, স্বয়ং জুনায়েদ এলাহী। পরম শান্ত কণ্ঠে সে বলে ওঠে, “সুলেমান ভাই, আপনি ভালা কইরা টর্চ ধরেন… আমি এগুলা মাটির নিচে ভরি।”
ব্যাস! আর কোনো কথা না, শুধু কাজ। গম্ভীর ও নির্দেশনামূলক কণ্ঠে কথাটি বলেই দু’জন পুরুষ মিলে বস্তাটি সদ্য খুঁড়ে তোলা মাটির গহ্বরে চেপে দিল। কষে মাটি চাপা দিল। এরপর তারা একে অপরের দিকে ঝুঁকে কিছু ফিসফিস করে বলল বটে, তবে সেই কণ্ঠস্বর চিত্রার শ্রবণে পৌঁছায়নি। চলার আগে তারা ঘুরেফিরে আশপাশটুকু সতর্ক চোখে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর দ্রুত পায়ে তারা মিলিয়ে গেল অন্ধকারের অতলে যেন কেউ কোনোদিন সেখানে আসেইনি। চিত্রার মস্তিষ্ক তখন আর কাজ করছে না। সমস্ত চিন্তাবোধ এক বিভ্রান্তির ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে আছে। হাজারো প্রশ্নের ভিড় জমে ওঠে মনে। এত রাতে ওনারা কী চাপা দিলেন? আর সেই বস্তার ভেতর কি ছিল? কী এমন থাকতে পারে সেখানে? আর সেই ব্যক্তি, যে নিরলসভাবে মাটি খুঁড়ছিল সে কে? কেন তার মুখ একবারও আলোর রেখায় ধরা পড়ল না? বাকি দু’জনকে চিত্রা চিনেছে। একজন সুলেমান এলাহী অন্যজন জুনায়েদ এলাহী।
চিত্রার বুকের মধ্যে ফারাজের কথা গুমরে ওঠে। সবটা তাকে বলা উচিত হবে কি? না কি চুপ করে যাওয়াই শ্রেয়? যদি রাগ করে? যদি সন্দেহ করে?
কিন্তু আবার সেই কথাও মাথায় আসে। না জেনে, না বুঝে কিছু ভাবা উচিত নয়। তবুও… কেন যেন মনে হচ্ছে এই বাড়িতে কিছু তো একটা আছেই। চিত্রা তার গন্ধ পাচ্ছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না উৎস। চিত্রার মাথায় কিছু ধরছে না। বারান্দার রেলিং আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রা তখনো বোঝার চেষ্টা করছে। সে কি এখনো ঘুমের মধ্যেই আছে, নাকি সত্যিই কোনও দুঃস্বপ্ন তাকে টেনে নিয়ে গেছে বাস্তবের ভয়ংকর প্রান্তে। একটি প্রশ্নই রক্তমাখা ছুরির মতো বিদ্ধ করছে তাকে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে আসবে না তো?
–
পুরান ঢাকার এক অভিজাত প্রান্তে রাত্রির বুকে আয়োজিত হয়েছে বিশাল ও জমকালো অনুষ্ঠান। আলোর ঝলকে, ব্যান্ডের উদ্দাম বাজনায় আর আপ্যায়নের রাজকীয় আড়ম্বরে মুখরিত চারদিক। তবে এই বাহ্যিক জৌলুশের আড়ালে জড়িয়ে আছে গোপন অভিসন্ধান। সেখানে অতিথি হিসেবে আগমন করেছেন ফারাজ এলাহী। ফারাজ এলাহী এখানে এসেছেন, নিছক সৌজন্য সাক্ষাতে নয় বরং তার আগমনের অন্তরালে রয়েছে আরও কিছু। এমন কিছু যা এই মধ্যরাত্রির ঢাকাকে ঢেকে রেখেছে কুয়াশাচ্ছন্ন এক সখ্যতার আবরণে। এই আয়োজনকে ‘সস্তা’ বলাটা অবিচার হবে বটে তবে ফারাজের মতো ব্যক্তি, যে অপরাধবিশ্বে এক অলিখিত কিংবদন্তি, তার তুলনায় এ আয়োজন নিছক ফিকে। সে এর চেয়েও রক্তগন্ধময়, আরও ভয়াবহ মঞ্চে বিচরণ করে প্রতিনিয়ত। তার উপস্থিতিতে ভালোই আলোড়ন চলছে। বড় বড় ডিলার, অস্ত্রব্যবসায়ী, মানবপাচারের মাস্টারমাইন্ড, এমনকি রাজনৈতিক ছায়ায় লুকিয়ে থাকা কুশীলবেরা পর্যন্ত ফারাজ এলাহীর নজরে পড়ার আশায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তবুও কেউ তার নাগালে পৌঁছাতে পারছে না। কারণ, এখানে ভিআইপিদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে এক অলঙ্ঘ্য প্রটোকলের দেয়াল। বুলেটপ্রুফ গ্লাস ঘেরা লাউঞ্জ, রুদ্ধ গেট, বহুসংখ্যক দেহরক্ষী, এবং সর্বোচ্চ শ্রেণির নিরাপত্তা। ফারাজ এলাহীর চারপাশ যে কোনো দুর্গ, যেখানে প্রবেশের অধিকার কেবলমাত্র নির্বাচিতদের। তাকে দেখতে হলে অন্তত দশ থেকে পনেরো স্তর পেরিয়ে আসতে হবে। সবকিছু অতিক্রম করেও ক’জনই বা পারে ফারাজের সামনাসামনি দাঁড়াতে? এমনকি কেউ কেউ বলে, একঝলক দেখা পাওয়ার সৌভাগ্যও আজ পর্যন্ত কেবল কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই যেমন, ঢাকার কুখ্যাত ‘ভুঁইয়া’ পরিবার যাদের নামেই রক্তপাতের ইতিহাস। আজ তারা এখানে উপস্থিত, অথচ তাদের মুখ কারও চেনা নয়। তাদের মতোই অস্পষ্ট ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় অন্য সব ভিআইপিরা। এই ভিআইপিদের মধ্যে ফারাজ এলাহীও একজন। যাকে বাহিরে থেকে মানুষ একভাবে আর ভেতর থেকে মানুষ চিনে অন্যভাবে।
তবে ফারাজ এসবে অনন্ত সম্মিলন, গোপন আঁতাত আর অপরাধী অভিজাত্যের প্রতি নিতান্ত উদাসীন। তাঁর চোখে এই আয়োজন শুধুই একটি দৃশ্যপট,কোনো কেন্দ্রবিন্দু নয়। তার ডানপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অভ্র। কালো স্যুট-প্যান্টে দেহ ঢেকে রাখা দায়িত্বশীল চোখের মানুষ। চোখে কালো সানগ্লাস, পকেটে হাত গুঁজে আছে। ফারাজ ঘড়ির দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ ছুড়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে অভ্রকে জিজ্ঞেস করল, “গ্যাংস্টার অ্যালেপো কখন পৌঁছাবে?”
“এখনই তো পৌঁছানোর কথা। আমি খোঁজ নিচ্ছি।” অভ্র শান্ত কণ্ঠে বলল।
ফারাজ এলাহী চোখ নামাল ঘড়ির ডায়ালের দিকে। ধৈর্যের প্রাচীর ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে।”আমি জার্মান গেলেই তো ওর সঙ্গে ডিল ফাইনাল করতে পারতাম? এখানেই যে কেন আসতে হলো?”
“সে অপেক্ষা করতে পারছিল না, সম্ভবত সে কারণেই,” অভ্র জবাব দেয় সংক্ষিপ্ত স্বরে।
“বিনিয়ন ডলারের হিসেব যেহেতু, তাই সব হাই কোয়ালিটির মালই কিন্তু তাদের কাছে যাবে।”
“চুক্তির সঙ্গে কি হাফ পেমেন্ট নিয়ে নিব?”
“নো। পুরোটা।”
ডিল চূড়ান্ত হয়েছে সবে। তবে অ্যাপোলো ফারাজকে অনেক বেশি পছন্দ করে। ফারাজকে বিনোদন দেওয়ার জন্য মিশোর থেকে নারী আনা হয়েছে। সব কিছু সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। নারীরা নৃত্যে মত্ত। ফারাজের মাথা ধরছে এসব দেখে। তার এসবে আগ্রহ নেই। সময় হয়ে এসেছে। এখানে সে ভিন্ন আরেকটি কাজ করতে এসেছে তাকে এখন গিয়ে সেটা সারতে হবে। অ্যাপোলো ফারাজের জন্য বিশেষ একটা উপহার এনেছে। আজকাল উপহারের নাম শুনলেই চিত্রার উদ্ভট সব সারপ্রাইজের কথা মাথায় আসে।
“অ্যাপোলো একটু জলদি। আমার যেতে হবে।” ফারাজ বলল।
অ্যাপোলো মিশর থেকে সেই উপহার ফারাজের সামনে উপস্থাপন করতেই ফারাজের মাথা গরম হয়। তবে সে শান্ত থাকার চেষ্টা করে। উপহার হিসেবে ফারাজকে সে মিশরের সবচেয়ে সুন্দরী এক নারীকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। মেয়েটি ফারাজের কাছে আসতেই ফারাজ বলে উঠল, “সরি এই উপহার আমি তোমাকেই রিটার্ন উপহার হিসেবে দিয়ে দিলাম অ্যাপোলো। কারণ আমার ঘরে বউ আছে।”
অ্যাপোলো অবাক। এই প্রথম কেউ তার দেওয়া উপহার ফিরিয়ে তাকে নিচু করল। বিষয়টি একেবারে পছন্দ হয় নি অ্যাপোলোর। তবুও সে মুখে হাসি রেখে ফারাজকে বলল, “সামান্য বউয়ের সঙ্গে সুন্দরী মিশরীয় দেবীর তুলনা?”
ফারাজ এলাহী হাসল। বলল, “আমার স্ত্রী চিত্রাঙ্গনা এমনই সুন্দর যে সুন্দর শব্দটাও তাকে হিংসা করে। তাই সেখানে তুলনা শব্দটা তার সঙ্গে যায় না। বড্ড বেমানান লাগে। খুশী হবো যদি তোমার নাড়ি কাঁচানো মিশরীয় দেবী মিশরেই চলে যায়। কারন দেবী দেশ ছাড়া হলে ওই দেশের ভক্ত কুলকে সে সেবাদান করবে কেমন করে?”
এলিজাবেথ অবাক হয়। কারন পুরো দুনিয়া যেখানে একবার তাকে দেখার জন্য মরিয়া, সেখানে এই ফারাজ এলাহী তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না? এত অপমান! কিন্তু সে হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। মেয়েটা ফারাজের দিকে এগিয়ে এসে তার ঘাড়ে মৃদু স্পর্শ করে বলল,”আমি তো তোমার বউয়ের থেকেও সুন্দর। ওকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো না।”
ফারাজ শান্তভাবে ঘাড় থেকে মেয়েটির হাত সরিয়ে নিল। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে মুছতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,”আমি ফারাজ এলাহী সমুদ্র দেখেই আন্দাজ করতে পারি তাতে কত-শত জাহাজ বিচারণ করেছে। সমুদ্র যত বড় গভীরতা তত বেশি। লাখো জাহাজ চলা সমুদ্রের প্রতি ফারাজ এলাহী নট ইন্টারেস্টেড।” বলেই ফারাজ পকেট থেকে লাইটার বের করে আগুন ধরিয়ে দিল রুমটায়। আগুনে জ্বলজ্বল করতে থাকা রুমালটা মেয়েটির মুখের সামনে ধরে আচমকা মাটিতে ফেলে দিয়ে পায়ে পিষে উল্টো দিকে হাঁটা ধরল। যাওয়ার পেছন না ফিরেই হাত নাড়িয়ে বলে উঠল, “গুডবাই ফরএভার।”
যাওয়ার আগে সে অ্যাপোলোর সঙ্গে করা ডিলও ক্যান্সেল করে দেয়। যে ফারাজ এলাহীর সহধর্মিণীর সঙ্গে নোংরা নারীদের তুলনা দেয় তাকে ফারাজ পায়ের নিচে স্থান দিতেও ঘৃণাবোধ করে। হোক সে জার্মানের সবচেয়ে বড় গ্যাংস্টার। তাতে এলাহীর কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, ফারাজ এলাহীর দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চিত্রাঙ্গনা। আর কেউ যদি সেই কেন্দ্রের দিকে হাত বাড়ায় তবে ফারাজ তাকে এই দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতেও একটুও দ্বিধা করবে না।
রোজের মুখ ভার। হৃদয়ের অনুভূতিকে যেন খেলনার মতো উলটপালট করছে তার বস। একটি নারীর জন্য কি কেউ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি বাতিল করে দিতে পারে? অ্যাপোলো যে কেবল পুরনো ক্লায়েন্ট নয়, বরং এই অন্ধকার জগতের অঙ্গনে অনেকের স্বপ্নের সিঁড়ি। তার সঙ্গে করা ডিল এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফারাজ যেন ইচ্ছেমতো ছুরি চালিয়ে শত্রুদের তালিকায় নতুন নাম জুড়ে নিল। রোজের মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। যতক্ষণ না সেই নারী ফারাজের জীবন থেকে একেবারে মুছে যাচ্ছে
ততক্ষণ সে তার আসল বসকে কিছুতেই ফিরিয়ে আনতে পারবে না। রোজ জানে, এই মানুষটা কখনও প্রেমগাঁথার নায়ক হতে পারে না। সে জন্মেছে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। অথচ এখন? ভালোবাসা নামক তুচ্ছ এক অনুভূতির মোহে পড়ে সে নিজের জাত-চরিত্রই ভুলতে বসেছে। এই পেশা, এই পথ কোনো খেলা নয় যে ইচ্ছেমতো শুরু করে সমাপ্তি টানলাম। মুখে বললেই কি এসব ছেড়ে দেওয়া যায়?
অভ্র এখনও বিস্ময়ের ঘোরে। ছাব্বিশ বছরের জীবনে এই প্রথমবার দেখছে ফারাজের এমন অবিন্যস্ত সিদ্ধান্ত। কালো দুনিয়ার যে শাসক, সে কি আদৌ এমন আবেগতাড়িত হতে পারে? কোনো নারী তাকে এতখানি বশ করতে পারে? তবুও, অভ্রের বুকের কোথাও যেন হালকা একটা টান পড়ে। কষ্ট? না, ঠিক কষ্ট নয়। একধরনের অনুচ্চারিত বোঝাপড়া। প্রেমের পরশে তার অন্তর্গত মরিচাপড়া বাগানে ইদানীং অদ্ভুতভাবে কুঁড়ি ফোটছে। সেই ফুলগুলো এখনও ঠিক ভাবে ফুটেনি কিন্তু তারা জানান দিচ্ছে জীবনটা আর একার নয়। এখন প্রতিটি সিদ্ধান্তে জড়িয়ে আছে আরেক নারীর নিঃশ্বাস, আরেক হৃদয়ের স্পন্দন।
ফারাজ নির্বিকারভাবে গাড়ি থেকে নামে। রোজ আর অভ্রর দিকে চোখ ছুঁড়ে দেয়। জিজ্ঞেস করে, “সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে তো?”
“জ্বী।”
” আমি ভেতরে যাব। বাহিরেটা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের।”
“আচ্ছা।”
ফারাজ গোডাউনের ভেতর ঢুকে পড়ল। গোডাউনে এইসময় মানুষ নেই বললেই চলে। মাল ডেলিভারি হবে কালকে। সব কাজ শেষ তাই কিছু মানুষ ছাড়া যে যার কাজে। রোজ গোডাউনের পেছন দিক থেকে কেরাসিন ঢালা শুরু করে। পেছন থেকে এসে একেবারে সামনের দিক পর্যন্ত চলে যাবে। অন্যপাশে অভ্র কাজ করছে। হুট করে পেছন থেকে কেউ একজন রোজের মুখ চেপে ধরে। রোজ চাইতেই ঘনবর্ণ এক কুৎসিতদর্শন লোককে দেখতে পায়। সে বলে উঠে, ” এত সুন্দরী মাইয়া এত রাইতে এইখানে? বাঘের আস্তানায় হরিণ ভালোই তো।”
লোকটা রোজের বুকে বাজে ভাবে স্পর্শ করার আগেই রোজ হাতের মুঠিতে রাখা ছোট্ট চাকুটি একেবারে লোকটির গলার মধ্যে থাকা রগের ভেতর ঢুকিয়ে মুহুর্তেই টেনে হিঁচরে রগ ছিঁড়ে বের করে আনে। লোকটা মুহুর্তেই ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পরে। ব্যথায় নিজের গলা নিজেই চেপে ধরল। রোজের সেই জবাই করা পশুর ন্যায় ছটফট করতে থাকা লোকটাকে দেখে হাসি পায়। সে বলে, ” সুন্দরী বললে অথচ সৌন্দর্যের রহস্য না শুনেই চলে যাচ্ছো? যাওয়ার আগে একটা সিক্রেট শুনে যাও।” রোজ হিসহিসিয়ে উঠে। হেসে বলে, “মানুষ খুনের পর ওদের উষ্ণ রক্ত আমি জলের সঙ্গে মিশিয়ে স্নান করি। সেই রক্তস্নানই তো আমার সৌন্দর্যের রহস্য। তবে দুর্ভাগ্য, আজ তোমার রক্তে আর আমার স্নান হবে না।”
অভ্রের সামনে বেশকিছু লাশ পড়ে আছে। হ্যাঁ এদেরকে সেই উপরে পাঠিয়েছে। ঠান্ডা মাথায়, কোনরকম দয়ামায়া ছাড়াই। মানুষকে মৃত্যুর ঘরে পাঠানো এখন তার কাছে একটি দৈনিক রুটিন প্রক্রিয়া। অভ্রর সেইদিনের কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন রাতে আয়েশাকে সেই দু’টো ছেলে রাস্তায় বিরক্ত করার চেষ্টা করেছিল কুৎসিত অভিপ্রায়ে। সেই রাতেই অভ্র তাদের শরীরের স্পর্শেন্দ্রিয়, তাদের পুরুষালি অহংকার গলে দিয়েছিল অ্যাসিড ঢেলে।
কিন্তু… এতটুকুই কি যথেষ্ট ছিল? এত সহজ মৃত্যু কি প্রাপ্য ছিল তাদের? না। তা তো নয়। তারপর যা হয়েছিল, তা ছিল সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া ন্যায়বিচারের এক উন্মাদ রূপ। সেই আধমরা দেহগুলোকে ফুটন্ত জলে সিদ্ধ করে সে ছুঁড়ে দিয়েছিল রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরদের সামনে। যারা একরাশ ক্ষুধা নিয়ে সেই পঁচা মাংসে দাঁত বসিয়ে সেদিন রাতের আহার সেরেছিল।
অভ্র এসব করেছিল কেবল আয়েশার জন্য নয়। সে করেছিল পুরুষ হিসেবে। এক দায়ভারগ্রস্ত পুরুষত্বের দায়ে। যারা পথের মেয়ে দেখলেই পশুত্বে নেমে পড়ে তাদের মৃত্যুর পথ রক্তমাখা হওয়াই তো বিধান। নিজেকে দমন করা সেই কাপুরুষদের জন্য অনুচিত। কারণ পাপ করে যে আর পাপকে মেনে নেয়, এই দুই-ই সমান অপরাধী। ভাবনার জট কেটে ওঠার আগেই তার ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ফারাজের নাম। তারমানে ভেতরের কাজ ভাই সেরে ফেলেছে। এবার একটু ধামাকার পালা।
গোডাউনের ভেতর রক্তের স্তুপ জমে গিয়েছে। দুই-চারজন মানুষ ছিল। সবাই এখন মৃত। কেবল একজন এখনও জীবিত আছে। প্রাণের ভিক্ষা চাইছে। তার তো পালিয়ে যাওয়া উচিত কিন্তু পালানোর পথ কোথায়? ফারাজ যে তার দুই পা কেটে ফেলে রেখেছে তারই সামনে। হাঁটার মতো অবস্থা নেই। তবুও সে মিনতি করছে। জীবন ভিক্ষা চাইছে ফারাজের কাছে। ফারাজের সেদিকে খেয়াল নেই। ফারাজের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মনোযোগ দিয়ে সাবওয়ে সার্ফারস্ খেলছে। এক হাতে ফোন। চোখ স্ক্রিনে। মুখে নিঃস্পৃহ অভিব্যক্তি। ডাঙায় ফেঁসে যাওয়া ইলিশের মত জান নিয়ে লোকটি আবারও ফারাজেকে বলল,” আমারে বাঁচান। আমি কাউরে কিছু কমু না।”
ফারাজ হঠাৎ থেমে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়, মুখে বিরক্তির ছাপ।
“ধ্যাত নেউরা! তোর কথার ঠেলায় জাস্ট মনোযোগ নষ্ট হয়ে হেরে গেলাম।
নিরীহ ছেলেটা ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে অক্কা পেয়েছে। পারলাম না রে, আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। আইডিয়া আছে তোর, একটা গেমে জিততে কত কষ্ট হয়? মন তো চাইছে তোকেও অক্কায় পাঠাই। জানিস, কত কষ্টে এত পয়েন্ট জমিয়েছিলাম?”
ফারাজ হুট করে আচরে হাতের ফোনটা ভেঙে ফেলে। অভ্র আর রোজ সেখানে উপস্থিত হয়। রোজ ফারাজকে স্থির গলায় জিজ্ঞেস করে, “একে মারেন নি কেনো বস?”
ফারাজ একটু হেসে বলে, “মরাকে আর কি মারব?”তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,” যাহ ভাই তোকে ছেড়ে দিলাম। আজকে আর মারতে ইচ্ছে করছে না। এই অভ্র বড্ড ঘুম ধরেছে। এখন আর কিশোরগঞ্জ যাওয়ার মতো এনার্জি নেই। তুই জলদি হোটেল বুক দে।”
অভ্র মাথা নেড়ে বলে,”আচ্ছা ভাই।”
নিঃশব্দে একবার গোডাউনের দিকে তাকাল ফারাজ। এই ভাঙাচোরা, ধুলোপড়া খুপরিতে যে মৃত্যুর মহামারী জমা আছে, তা ক’জন জানে? ক্যামিকেলের অভাব নেই, আর আছে মানুষের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। শরীরের ভেতরের সবচেয়ে সংবেদনশীল, দামি বস্তুগুলো। এই সমস্ত অঙ্গ ক্যামিকেল দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে একরকম সতেজ রাখার হয়। হিসাব করলে কোটি কোটি টাকার মাল আছে এখানে। অথচ গোডাউনটা এমনভাবে সাজানো যেন এর চেয়ে অপ্রাসঙ্গিক, অবহেলিত জায়গা আর দুনিয়ায় দু’টো নেই। ঠিক এটাই মূল পরিকল্পনার কৌশল। চোখের সামনে রেখে আড়াল করে রাখা কারসাজি। কিন্তু বোকার দল কি জানে না, এখানে একবার আগুন লাগলেই সব কিছু ছাই হয়ে যাবে? এই গোডাউনের মালিক সোহান। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি অলি-গলির মাঝে অবস্থিত এই কারখানাই আন্তর্জাতিক অঙ্গ পাচার চক্রের এক গোপন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার নৌপথ ধরে এসব ‘মাল’ চলে যায় বিদেশে। আর সেদিন? সেদিন যে হামলা হয়েছিল ফারাজ আর অভ্রর ওপরে তার কুশীলবও ওই সোহান। কিন্তু এত সহজে ফারাজ কাউকে ছেড়ে দেয় না। সে তার শত্রুকে তাত্ক্ষণিক হত্যা করে না। সে ভালোবাসে ক্ষনে ক্ষনে মারে। ধৈর্যের সাথে শত্রুর সব কিছু কেড়ে নেয়। তারপর একেকটি শ্বাস রুদ্ধ করে পিষে ফেলে। সোহানের সেই দিন আজ থেকে শুরু হয়েছে। সে যেহেতু নিজেই নিউক্লিয়ার বোমার মুখোমুখি হতে এসেছে তবে তো করার কিছু নেই। কিন্তু হাধারাম তো জানে না এই বোমা বিস্ফোরণ হলে সবচেয়ে আগে মৃত্যু তারই হবে। ফারাজের হাতে এখনো রক্তের ছোপ লেগে আছে। ফারাজ অভ্রর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
“হাতে নোনতা কেচাপ লেগে গেছে কুদ্দুসের বাপ।হাত কি তোমার নানা এসে ধুয়ে দেবে?”
অভ্র চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কী করা যায়। হঠাৎ তার চোখ পড়ে টেবিলের উপর রাখা মদের বোতলে। সে দৌড়ে গিয়ে দ্রুত সেই মদ ঢেলে ফারাজের রক্তাক্ত হাত ধুইয়ে দেয়। ফারাজ ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায়। গোডাউনের কোণায় পড়ে থাকা অসহায় লোকটার দিকে একবার তাকিয়ে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যায়। তারপর এক টান দিয়ে সিগারেট ধরায়। অভ্র বাইরে থেকে গোডাউনের তালা মেরে দেয়। ভেতর থেকে ধ্বনিত হয় চাপা আর্তনাদ, হাহাকার। লোকটার কান্না রোজের কানে আসতেই সে বিরক্ত হয়। ফারাজকে বলে,
“বস, দয়া করে কাজটা শেষ করুন… জলদি।”
“তুমি ধবলরোগী চুপ করো।”
“আপনি নিজেও তো ফর্সা।”
“চুপ কর আম্মা ।”
রোজ চুপ করে যায়। ফারাজ ধীরে সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে সেটি ছুঁড়ে ফেলে দেয় গোডাউনের একপাশে। যেখানে আগেই কেরোসিন ঢেলে রাখা হয়েছিল। অন্ধকারে সেই আগুনপ্রবণ স্থানটায় সিগারেটের জ্বলন্ত ছাইটা পড়তেই একটা হালকা ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে। পরক্ষণেই সে লাইটারটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর শীতল অভিপ্রায়ে আগুন জ্বালিয়ে লাইটারটিও ছুঁড়ে দেয় ঠিক সেই জায়গাতেই।
ধোঁয়া-জ্বলে ওঠা মুহূর্তের মধ্যে গোডাউনের ভেতরকার রক্তমাখা নরক জ্বলে উঠে। ধাউ ধাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আর্তনাদ, রক্ত আর পোড়া চামড়ার গন্ধ মিলেমিশে তৈরি হয় বিভীষিকাময় দগ্ধ সত্য। ততক্ষণে ফারাজ আর অভ্র গাড়িতে উঠে বসেছে। আজকের কাজ শেষ।
ফারাজ ব্যাকসিটে হেলে পড়েছে। শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে।
“কাল সারাদিন ঘুমাবো।” নিজেই নিজেকে বলে ওঠে ফারাজ। এই শরীর আর টান নিতে পারছে না। ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে অভ্র। তার চোখ সামনের রাস্তায়। তবে মনে অন্য কিছু চলছে। সে একটু দ্বিধাভরে জিজ্ঞেস করল,
“ভাই গোডাউনে এত কম লোক কেন ছিল? সব কই গিয়েছিল?”
ফারাজ তখন চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত হেসে ওঠে।
“এই প্রশ্নটা যে আসবেই তা তো আমি জানতাম।”
শালারা সবাই কাজ ফেলে গিয়ে পুরান ঢাকার সেই অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিল।”
“কিন্তু ভাই, ওদের তো পাসকোর্ড নেই ? গেলেও কি?”
ফারাজ চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, “ওদের পাসকোর্ড আমি দিয়েছি। মানে, ওরা জানে এলাহী দিয়েছে। কিন্তু কোন এলাহী তা জানে না। ভেবেছে রাজন কিংবা রোশান দিয়েছে।”
অভ্রের মুখে সন্দেহ জাগে, “তাহলে তো ভাই… ওরা যদি ফিরে এসে দেখে গোডাউনে আগুন লেগেছে, তখন তো বুঝে যাবে সব ফারাজ-এলাহীর কারসাজি!”
ফারাজ এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারল না।
“ফেরার উপায় নেই। ওরা আর ফিরে আসবে না। আমার লোকেরা ইতোমধ্যেই ওদেরকে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
অভ্র তাকিয়ে বলে, “ভাই, আপনার মাথার ভেতর কি আসলেই মস্তিষ্ক আছে, নাকি কোনো গ্রেনেড ঢুকানো?”
ফারাজ আবারও হেসে উঠে বলে,” যা মনে হয়। তো বাচ্চারা, মোর্যাল অফ দ্য স্টোরি কি ছিল?”
অভ্রও এবার খিলখিলিয়ে হেসে উত্তর দেয়,”বসকে না জিজ্ঞেস করে, না যাচাই করে ফূর্তি করতে গেলে যে পেছন মারা খেতে হয় তাই ছিল।”
–
রাতে ঘুম ভাঙার পর আর ঘুম আসে না চিত্রার। কেমন যেন অস্বস্তিকর একটা রাত ছিল। কেটে গিয়ে ভোর হয়েছে তবুও যেন বিষাক্ত রাতের ছোঁয়া চারপাশে লেগে রয়েছে। সুলেমান এলাহীকে চিত্রা বড্ড ভালোবাসে। সুলেমান এলাহীর মধ্যে বাবা বাবা গন্ধ পায় চিত্রা। কী সুন্দর করে ‘আম্মাজান’ বলে ডাকে। অন্তর জুড়িয়ে যায়। সকাল থেকে নদী বিছানায় পড়ে আছে। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। রাজন খেয়ে বেরোবে। ঘুম থেকে উঠেছে কেবল। নদী বিছানা থেকে উঠতে গিয়েছিল তবে মোহনাকে নদীর পাশে বসিয়ে দেখে রাজনকে চিত্রা খাবার দিতে আসে। রাজন আর আজ নদীর কথা জিজ্ঞেস করে নি। কেনো নদী নিচে এলো না তা নিয়েও আজ রাগ করল না। বার বার কল আসছে তার। ধরছে না। খাওয়ায় মনোযোগী সে। গপ-গপ করে গিলছে। এক একটা নলা কি বিশাল! মনে হচ্ছে হাজার বছর ধরে না খাওয়া কোনো দানব বহুদিন পর আয়েশ করে খাচ্ছে। তবে এই লোক দেখতে মাশাল্লাহ। পূর্ব পুরুষের কেউ কি পাকিস্তানি ছিল নাকি? চিত্রা রান্না ঘরে যায়। মুহুর্তে রাজনের আরেকটা কল আসে। আশপাশে রাজন তাকায়। চিত্রা নেই। কলটা সেই সুযোগে রিসিভ করল রাজন।
“কিরে কী হইছে? কী? জ্বর আইছে? ওগোরে না কইছি ওর খেয়াল রাখতে? রাখোস নাই কেন? ওর জ্বর কেমনে আসে? অপেক্ষা কর। আমি আসতাছি। আর সরাইখানায় ডাক্তার পাঠাইতাছি।”
ফোন রেখে পাশে তাকাতেই দেখে চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। রাজন খানিকটা ঘাবড়ে যায়। চিত্রা হেসে জবাব দেয়,”আর কিছু লাগবে ভাই?”
“না। খাওয়া শেষ।” রাজন উঠে যায়। চিত্রা জিজ্ঞেস করে না। তার জিজ্ঞেস করার দরকারও নেই। রাজন হাত ধুয়ে, মুছে সরাসরি বাহিরে চলে যায়। তবে চিত্রা জানে সরাইখানায় যাচ্ছে রাজন। কার জ্বর এসেছে? কে এমন অসুস্থ যে খালি পেটে ঘরের বউকে রেখে একেবারে সরাইখানায় চলে গেল? বজ্রকে একবার রুমে গিয়ে খবরটা বলবে কি? উঁহু যদি ফারাজকে জানিয়ে দেয়? চিত্রা কিছুক্ষণ রুমে গিয়ে পায়চারি করল। আজ-কাল তার সন্দেহ কেমন তরতর করে বেগ পাচ্ছে। সে অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল মনকে এত পীড়া দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। যে করেই হোক তাকে সত্য মিথ্যা যাচাই করে বিবেকের ফয়সালা করতে হবে। ভেতরে দ্বিধাদ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে মরছে সে। যা ভাবা, তাই কাজ। ফারাজ নেই। বাড়িতে অভ্রও নেই। আয়েশা ঘুমাচ্ছে। এমনিতে চিত্রাকে রুমে এসে কেউ বিরক্ত করে না। তাই সে নিখোঁজ হলেও কেউ টের পাবে না। চিত্রা ফোনটা নেবে কি নেবে না করতে করতে সঙ্গে নিয়ে নেয়। তারপর বোরকা পড়ে মুখ আড়াল করে সরাসরি চলে যায় সরাইখানায়।
এটাকে মানুষ সরাইখানা বলে ডাকে কেন? নোংরা অশালীন জায়গায় বললে কি লজ্জা লাগে? মোটেও সরাইখানা নয়। এগুলো নোংরা ব্যক্তিদের আস্তানা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে পতিতা পল্লী বলা চলে। চিত্রা যখন পা রাখল এই জীর্ণ, বীভৎস ভবনের ভেতর, ঠিক তখনই একটা হিমেল স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে গেল। চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে অব্যক্ত কষ্ট আর গোপন লালসা। সিঁড়িঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো অর্ধনগ্ন মেয়েদের ছবি। কোথাও গাঢ় লিপস্টিকের ছাপ, কোথাও বা দেয়ালে লেখা নোংরা বুলি। এই ভবনটা দুই তলা। নিচতলায় বিশৃঙ্খলারই মেলা বসেছে। রঙচঙে জামা-কাপড় পরা মেয়ে আর তাদের চারপাশে লালসাপূর্ণ চোখে ঘোরাঘুরি করছে দলে দলে পুরুষ। কিছু ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে চাপা শ্বাসপ্রশ্বাস শোনা যায়। আবার কোথাও কোথাও মেয়েরা দাঁড়িয়ে, চটকদার হাসি ঠোঁটে মেখে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণের আশায়। এদের ভিড়ে চিত্রা যেন একটা ভুল মানুষ। মাথায় কালো বোরখা, মুখে নিকাব। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেমন অদ্ভুত সেই চাহনি। তারা অবাক হয়ে দেখছে না কি হাসছে! কে জানে? হয়তো কেউ মনে করছে সে নতুন এসেছে, কারও আবার মনে হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় জিনিস। চিত্রা জানে না রাজন কোন রুমে। সে শুধু জানে, এই ভবনের সামনেই সেদিন তাকে দেখেছিল। এবার সে আরেকটু এগিয়ে যাবে, ঠিক তখনই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজোড়া হাত রাখে তার কাঁধে। ভয়ার্ত চোখে ঘুরে তাকায় চিত্রা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মধ্যবয়স্ক নারী। চেহারায় অদ্ভুত দৃঢ়তা। সাজগোজও অদ্ভুত। কপালে বড়সড় লাল টিপ, চোখের নিচে মোটা করে টানা কাজল, ঠোঁটে রক্তলাল লিপস্টিকের খোঁচা।
“বোরকা পইড়া পালানোর চেষ্টা করোস? কত বড় সাহস!” মহিলার কন্ঠ কাঁঠালের ছিবড়ার মতো খসখসে।
চিত্রা সেই কথার মানে বুঝতে পারল না। তবে এতটুকু বুঝতে দেরি হলো না এখানে একটা ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে।
“আপনি ভুল বুঝছেন। আমি এখানকার কেউ নই। একজনকে খুঁজতে এসেছিলাম?”
“মুখপুড়ী নাটক মারাও?” বলেই চিত্রাকে টেনে হিঁচরে মহিলা সকলের সামনে দিয়ে নিয়ে যায়। জলদি আরো কিছু মেয়ে দৌড়ে আসে। তারাও চিত্রার সঙ্গে জোরজবরদস্তি করে। টেনে হিঁচড়ে সকলে চিত্রার হিজাব খুলে ফেলে। মুখের নিকাবটা কোথায় টেনে ফেলেছে খবর নেই। চিত্রা বার বার আর্তনাদ করছে। বলছে,”সে তার ভাসুসের কাছে এসেছে। এখানকার কেউ নয় সে।” মহিলা প্রথমে তাকে ছেড়েই দিত কিন্তু ওই সুন্দর চেহেরা দেখে তার দৃষ্টি লোভাতুর হয়। এই মেয়ে আগুনের মতো সুন্দর, কাঁচমুক্তার মতো চকচকে। একে ব্যবসায় লাগানো লেগে খদ্দেরের অভাব পড়বে না। মহিলা হুকুম দিতেই মেয়েগুলো চিত্রাকে হেঁচড়ে রুমে নিয়ে যায়। একে তৈরি করতে বলেছে। “ছাড়েন! আমি কিছু করিনি…!” কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। কান্নায় তার বুক কেঁপে ওঠে। গলা শুকিয়ে খটখটে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফারাজের ছায়ামূর্তি। চিত্রা হাত জোর করে মিনতি করতেই একটা মেয়ে এগিয়ে আসে। গালে একটা চড় বসাতেই চিত্রার ফর্সা চাড়মা মুহুর্তেই রক্তজবার ন্যায় রক্তিম হয়ে উঠল। আঘাত এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে দাঁতের সঙ্গে লেগে ঠোঁটের চামড়া কেটে যায় চিত্রার। বেশ ভালো পরিমানে। তবে সেদিকে কারো খেয়াল নেই। পাশ থেকে আরেকটা মেয়ে বলে উঠল, “আরে শালী মুখের আঘাত করছিস কেন? ম্যাডাম শুনলে রাগ করব। এই মেয়ের কাছে কাস্টমার আসলে তো ঠোঁট কাটা দেইখাই চইলা যাইব। মেয়েটি জবাব দেয় না। কেবল বলে, ” ওরে তুল। তৈরি করতে হইব।”
বেশসময় লাগে। ধকল শেষে মেয়েগুলো রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। তারা চিত্রাকে তৈরি করে এসেছে। তবে এত ধস্তাধস্তি তাদের আগে কখনও করতে হয় নি। চিত্রার গালে, ঠোঁটে শরীরে আঘাতের চিহ্ন। মেয়েদের নখের আঁচর লেগেছে। তার ওপর বেশ মেরেছেও তাকে। রুমের এক কোণে ভয়ে কুঁকড়ে আছে চিত্রা। তার ফোনটা ওই মেয়েরা নিয়ে গিয়েছে। চিত্রা চোখের সামনে মরণ ছাড়া কিছুই দেখছে না। কেনো সে এখানে আসতে গেল? ফারাজকে কি আর কখনও দেখা হবে না? শরীর তপ্ত হচ্ছে। গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। চিত্রা এই তো এখনই মাটিতে লুটিয়ে পরবে হয়ত। ঠিক সেই মুহুর্তে রুমের দরজা খুলে যায়। ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে চিত্রার। ভয়ে সে ঝট করে পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। কানে আসে ভারি জুতার শব্দ। ওরা নিশ্চয়ই কোনো খদ্দের পাঠিয়েছে… কোনো পুরুষ। চিত্রা নিঃশ্বাস আটকে রাখে, নিজের অস্তিত্বটুকু গোপন করার মরিয়া চেষ্টায় কুঁকড়ে ওঠে। রুহু আঁতকে ওঠে, শরীরে আতঙ্ক স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ে। জুতার শব্দটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। চিত্রা চোখ বন্ধ করে রাখে। দেখতে চায় না। শুনতে চায় না। হঠাৎ সেই শব্দ থেমে যায়। তার শরীরটা এক ঝটকায় স্তব্ধ হয়ে পড়ে। লোকটা চলে গেল? নাকি সামনেই দাঁড়িয়ে আছে?
সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে আসে। লোকটা একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে।
চিত্রা দেওয়াল ভেদ করে পালাতে চায় । শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে ভয় জমে উঠেছে তার। মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠে। সে একবার দম নিয়ে করুন দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। তারপর হুট করেই চারদিক ঘোলাটে হয়ে আসে। মুখ খুলে কিছু বলতে চায় কিন্তু অদৃশ্য এক চাপ তার কণ্ঠনালী চেপে ধরে। চোখ দুটো বুঁজে আসছে। নিথর হয়ে পড়ছে তার শরীর। হয়তো এটাই শেষ চোখ বন্ধ করা। হয়তো কেউ বুঝবে না তার এই অবস্থা। কেউ দয়া দেখাবে না। ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর, পৈশাচিক ভোগের জন্য। খুব করে খোদাকে বলতে ইচ্ছে করছে, “খোদা, তুমি আমার অর্ধাঙ্গের হৃদয় ছুঁয়ে তাকে জানিয়ে দিও, তার অর্ধাঙ্গিনী তাকে বড্ড ভালোবাসে। আমার খাটিয়া বহন করার সময় তার হৃদয়ে পাথর গেঁড়ে দিও, দিও স্ত্রীর লাশ বহনের সক্ষমতা। তাকে বলে দিও এই চিত্রা তাকে শেষ বেলায় এক নজর দেখার জন্য তৃষিত মরুভূমির তৃষ্ণার্ত মৃত্যুপথযাত্রীর ন্যায় কাতরিয়েছে। তুমি বলে দিও, জানিয়ে দিও তাকে তার বিবিজানের বিদায় বেলার গল্প।”
চিত্রা আর ভাবতে পারল না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘোলাটে চোখে পুরুষসদৃশ এক ছায়ামূর্তি দুলতে দুলতে ভেসে ওঠে। মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে আবার। শরীরটা অবশ হয়ে আসে। তারপর… চারপাশ অন্ধকারে ডুবে যায়। বুঁজে যায় তার হাজারো স্বপ্ন দেখা নিষ্পাপ চোখ জোড়া। ক্লান্ত, নির্মম অত্যাচারে বিদ্ধ কাঁপতে থাকা ছোট্ট দেহটা থেমে যায় এক চিলতে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার আশা নিয়ে।
চলবে?
(রিচেক দিয়ে পুনরায় ঠিক করতে গিয়ে ৬ হাজার শব্দের হয়ে গেল আমার লেখা এত বছরের সবচেয়ে বড়ই পর্ব হবে হয়তো এইটা। গল্পের সকল আপডেট আর স্পয়লার অগ্রিম পেতে জয়েন হয়ে যায়ন গ্রুপে:https://facebook.com/groups/849474313646905/)