#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব ৫৪
#প্রথমাংশ
অবচেতন চিত্রাকে বাহুতে তুলে নিজের কক্ষে নিয়ে এল বজ্র। বিছানায় শুইয়ে দেয় সে নিথর দেহটাকে। কিছুই বলছে না চিত্রা। জ্ঞান নেই, নীলাভ ঠোঁটে জ্বরের তীব্রতা ঝলসে উঠছে। বজ্র বুঝল, আর কিছুক্ষণ দেরি হলেই অনর্থ ঘটে যেত। এ মুহূর্তে যাকে সে স্যালাইন দিয়ে শুয়িয়ে রেখেছে সেই চিত্রার অবস্থা সত্যি খারাপ। আয়েশা যদি না বুঝত, যদি সময়মতো গিয়ে না জানাত বজ্রকে, চিত্রাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে হয়ত আজকের রাতটা দুঃস্বপ্নে রূপ নিত। বজ্রের কাছে ফারাজ যে দায়িত্বটি দিয়ে রেখেছে সেই দায়িত্ব ছিল চিত্রা। তবে বজ্র পালন করতে পারল না সেই দায়িত্ব। ব্যর্থ সে। চিত্রার এমন শোচনীয় অবস্থায় যদি ফারাজ এসে পড়ে… তবে হয়ত বিস্ফোরণ ঘটত। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, চিত্রা কিভাবে চোখে ধুলো দিয়ে পৌঁছে গেল ওই সরাইখানায়? কীভাবে গেল, কেন গেল? সবকিছুই এখনও অস্পষ্ট বজ্রের কাছে। তবুও শুধুমাত্র প্রবল এক ধারণার টানে ছুটে গিয়েছিল সে সেই অখ্যাত সরাইখানায়। সেখানে পৌঁছেই যা ঘটাল বজ্র, তা সে নিজেও ভাবেনি। পিস্তলটা মাথায় ঠেকাতেই কেঁপে উঠল মালকিন। দম্ভে ফেটে পড়া সেই নারী মুহূর্তেই চুপসে গেল নিউরোসার্জন বজ্র কায়সারের চোখের হুঙ্কারে ও অস্ত্রের নির্মম বাস্তবতায়। বজ্র কখনও হুট করে অস্ত্র ছোঁড়ে না, ওর ধমনীতে এখনও নীতির রক্ত বইছে। কিন্তু আজ, আজ যদি সে পিস্তল না তুলত, তবে চিত্রাকে হয়ত আর ফিরে পাওয়া যেত না। ওই মহিলা, এই মালকিন সে কী করে ভাবল একজন অজানা মেয়েকে বন্দি করে সে কাস্টমারের কাছে পাঠাবে? সাহস তো কম নয় তার। তবে বজ্র তাকে ছেড়ে দিবে না। সে তাকে বুঝিয়ে দেবে কার শরীর স্পর্শ করার স্পর্ধা করেছে সে।
সন্ধ্যার ম্লান আলো গা ছুঁয়ে যখন ফারাজ বাড়িতে ফিরে আসে তখনই কানে আসে অস্বাভাবিক এক নৈঃশব্দ্যেতা। রুমের দরজায় পা রাখতেই তার দৃষ্টিতে পড়ে ভিড়। মোহনা, নদী, ফারিহা, আয়েশা সবাই একত্র। ঘিরে আছে কারো নিঃস্পন্দ দেহকে। মুহূর্তেই ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া বইয়ে যায় রক্তে।
ফারাজের হাতে সদ্য কেনা নতুন ফোন। ফারাজ আসার সময় যমুনা থেকে নতুন ফোন নিয়েছে। কিছুদিন গেইম খেলবে তারপর এটাও না হয় ফেলে দিবে। তার ফোন ভাঙ্গলে কেমন জানি শান্তি শান্তি লাগে।
ক্রোধের ঝাঁজে ভাঙা ফোনের সংখ্যা যদি গোনা হয়, তবে তা দিয়ে বেশ বড় একটি ফোনের শোরুম দাঁড় করানো যেত। মার্কেট থেকে ফেরার পথে এক দোকানের কাচঘেরা পুতুলে চোখ পড়ে তার। টকটকে রক্তের মতো লাল শাড়ি। নিটোল বুনন, মাতাল করে দেওয়ার মতো রঙ। সেই শাড়ি দেখেই ফারাজের মনে হয়, যদি তার চিত্রা এই শাড়ি পরত, তবে নারী-সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটাই নতুন করে রচিত হতো।
কিন্তু সেই সৌন্দর্য আজ ধুলিসাৎ। ফারাজ রুমে পা রাখতেই মুহূর্তে জমে ওঠে ভারি নিস্তব্ধতা। কেউ কিছু বলে না। না, এই নীরবতা চিত্রার অসুস্থতা নিয়ে নয় বরং সেই অনাগত ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় যা ফারাজ নামক মানুষের ভেতর জন্ম নিচ্ছে ধ্বংসাত্মকভাবে। কেউ তাকে ফোন করে কিছু জানায়নি, চিত্রা যে কী ভয়াবহ অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছে তা আজ নিজ চোখে দেখে বুঝতে পারছে সে। রুমে থাকা সকলেই অজান্তে একপাশে সরে যায়। হয়তো ফারাজের শরীর থেকে নিঃসৃত ক্রোধের তাপমাত্রা অনুভব করা তাদের কাম্য নয়। বজ্র তখন চিত্রার পালস ধরেছে। ঠিক ভাবে পালস নড়ছে না। স্যালাইনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে খুব ধীরে। চিত্রার দিকে তাকাতেই ফারাজের চোখ স্থির হয়ে যায়। কপালে আঘাতের দাগ, ঠোঁট ফুলে আছে ব্যথায়, নির্যাতনে। ফারাজের শরীরজুড়ে একটা প্রচণ্ড স্নায়ুচাপ জমা হয়। মুষ্টিবদ্ধ হয় হাত, দৃঢ় হয়ে ওঠে শিরা। কপালের রেখায় ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট হয়। ঘাড় বেয়ে নামা শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠেছে মুহুর্তের মধ্যে। সে গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই পেছনের দরজা দিয়ে অভ্র আর রোজ রুমে প্রবেশ করে। চিত্রার অবস্থা দেখে অভ্র থমকে দাঁড়ায়। এ নীরবতা ঝড়ের পূর্বাভাস। অভ্র তা জানে, ফারাজের নীরবতা যত দীর্ঘ হয়, তত বেশি ভয়ংকর হয় তার প্রতিঘাত। চিত্রার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা ফারাজ ধীরে, অত্যন্ত নিচু কণ্ঠে বজ্রকে প্রশ্ন করে,
“কারা করেছে?”
“দেখ, আমি পরে সব ব্যাখ্যা করে বলব তোকে।”
“আমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি বজ্র।” দাঁতে দাঁত পিষে বলল।
বজ্র নিরুত্তরে বলল, “তুই আগে ওর পাশে বস।”
“যেই হাত আমার জানের ওপর আঘাত করছে সেই হাত আমি উপড়ে না ফেলা অব্ধি চিত্রার পাশে বসা তো দূরের কথা ওর চোখেও চোখ রাখব না খোদার কসম। যে আমার কলিজায় আঘাত করছে, তার কলিজা আমার চাই।” ফারাজ থামল। নিথর চিত্রার দিকে তাকিয়ে পুনরায় অভ্রকে বলল, “স্থানীয় কুকুর ফার্মের মালিককে খবর দিয়ে বল ফারাজ এলাহী আজকে পুরো এলাকার সকল কুকুরকে নিজ দায়িত্ব পেট ভরাবে।”
ঘরের সবাই সেই বলা কথায় ছটফট করে উঠল। আল্লাহ জানে কার মরন আজকে হবে? বজ্র ফারাজের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “বারান্দায় আয় বলছি।”
–
রাত তখন নয়টা না কি দশটা বাজে।
রাস্তার পাশে ফারাজের গাড়ি দাঁড়িয়ে। অভ্র আর বজ্র গাড়ির সামনে। দোকানের সামনে বসে থাকা একটা কুকুর ক্ষুধার তাড়নায় ঘুমোতে পারছে না। ফারাজ নেমে এসে কুকুরটির সামনে বসল। বরফ দেওয়া বাক্স থেকে একটা কলিজা বের করে শিস বাজিয়ে ডাকল। কুকুরটা ছুটে আসল। গপগপ করে চিবিয়ে খাওয়া শুরু করল সেই কলিজাটা। ফারাজের হাতে আবারও রক্ত লেগে আছে। সে কিছু বলার আগেই অভ্র জলদি গাড়ি থেকে মদের বোতল বের করে এনে হাত ধুয়ে দিল তার। ফারাজ উঠে দাঁড়ায়। সে অনেক বেশিই ক্লান্ত। বলেছিল চিত্রার সঙ্গে যারা এমন করেছে তাদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত বউকে ছোঁয়া তো দূরের কথা উল্টো দেখবেও না। তবে অনেক হয়েছে। ফারাজ তার কথা রেখেছে এবার প্রানভরে চিত্রাকে দেখার পালা। তাকে স্পর্শ করার পালা। তার যন্ত্রণাগুলোকে নিজের ভেতর শুষে নেওয়ার পালা। ওই পতিতা ভবনের মালিকের নাম লতা। সেই লতা এখন মাটির নিচেও যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে নি। করবে কেমন করে? দেহ তো হিংস্র প্রানীরা খুবলে খেয়েছে। তবে এত সহজ মৃত্যু ফারাজ তো অন্তত সেই ব্যক্তিকে দিতে পারে না যে কিনা ফারাজের স্ত্রীকে তীব্র যন্ত্রণা দিয়েছে ক্ষনে ক্ষনে। চিত্রার গায়ে যারা হাত দিয়েছে তাদের সেই সকল জায়গা থেকে মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে যেখানে তারা তার স্ত্রীকে আঘাত করেছিল। ফারাজ নারীদের গায়ে হাত তুলে না। তাই এই কাজগুলো রোজ করেছে। তবে প্রতিটি নির্দেশনা ছিল ফারাজেরই। কোনো জীবন্ত মানুষকে জোর করে অ্যাসিড খাইয়ে দিলে কি পরিমাণ যন্ত্রণা হয় যদি বাকিরাও তা দেখতে পেত। ফারাজের চোখের সামনে গলে গলে গলার মাংস খসে পড়ছিল। ফারাজ কেবল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেই দৃশ্যের দিকে। ওদের ভাগ্য ভালো ওরা নারী হয়ে জন্মেছে। নারী হয়ে ফারাজের হাতে মৃত্যুর স্বাদ নেওয়া থেকে বেঁচে দিয়েছে তবে মৃত্যুর হাত থেকে তো আর নয়? গলে পড়তে থাকা অংশে রোজ বিষ প্রয়োগ করে। এই বিষে কেবল জ্বালা বাড়াবে এবং অতিমাত্রায় চুলকাবে ওই জায়গা। কারো কিছু করা লাগবে না। চুলকানির দাপটে ওরা নিজেরাই ওদের মাংস টেনে টেনে ছিঁড়বে। অতি ভয়ানক সেই দৃশ্য। তার থেকেও ভয়ানক ছিল বজ্রর করা সেই কাজ। জ্যান্ত অবস্থায় তাদের শরীর থেকে কলিজা বের করা হয়েছিল। যখন পেট কাটা অবস্থায় নাড়িভুঁড়ি দলা পেকে চোখের সামনে বেড়িয়ে আসছিল। নিজের এই হাল যখন নিজেরাই এক নজর দেখেছিল তখন আসল শান্তি লেগেছিল ফারাজের। এই সরাইখানা আজ থেকে বন্ধ। এখানে যে সকল মেয়েকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে তাদেরকেও মুক্তি করে দেয় ফারাজ। যার যার বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আর যারা মাটির চাটুকারিতা করছিল তাদের মৃত্যুও ওই একই ভাবে হয়েছে যেমন বাকিদের। আজ থেকে এই ভবন পাপ মুক্ত হবে। এখানে কোনো নারী আর চিত্রার মতো লাঞ্ছনার শিকার হবে না।
ফারাজ উঠে দাঁড়ায়। অভ্রকে বলে,”তোর ভাবী অপেক্ষা করছে। বাড়ি ফিরতে হবে।”
“জ্বী ভাই। আপনি গাড়িতে গিয়ে বসেন।”
ফারাজ বাড়ি ফিরে চিত্রার পাশে এসে বসে। রুম থেকে সবাইকে বের করে দেয়। চিত্রা তখনও নিথর হয়ে পড়ে আছে। ফারাজ চিত্রার ঠোঁটের সেই আঘাতে আঙুল ছোঁয়াতে গিয়েও ছোঁয়ায় না। যদি সে ব্যাথা পায়? ফারাজ হাত ধরে চিত্রার। সে এসবের জন্য চিত্রাকে দোষারোপ করে না একবারও। সব দোষ নিয়ে নেয় নিজের কাঁধে। যদি সে ঢাকা না যেত তাহলে কখনই এমন হতো না। তার চিত্রার এত যন্ত্রণা এত আঘাত সহ্য করতে হতো না। সব দোষ তার। ফারাজের চোখের কোণে জল! অবিশ্বাস্য। তার মতো পশু কাঁদছে? পশুদের কি অনুভূতি বলতে কিছু থাকে? ফারাজের মতে খারাপ মানুষের ডাকে সৃষ্টিকর্তা সারা দেয় না। তবুও ফারাজ আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চায়। তাকে বলতে চায়, ❝তুমি তার সকল ব্যথা বিলিয়ে দাও আমায়,
যে আমায় ভালোবেসে আমার সকল দুঃখ জড়িয়ে ঘুমায়।❞
–
সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সাতদিন ধরে মাহাদী ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মারিয়াকে বন্দি করে রেখেছে সোহান। শুধুই কি বন্দিত্ব? প্রতিদিন সূক্ষ্ম ও নিপুণ নির্যাতনে বিদীর্ণ হচ্ছে তাদের শরীর, ধসে পড়ছে তাদের মন। অথচ মারার হুমকি দিলেও সোহান এখন পর্যন্ত মারা মতো সময় পাচ্ছে না। গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলেছে সব। ছাই হয়ে গেছে কোটি টাকার মালামাল। চারদিকে শোরগোল উঠেছে। সবই নাকি দুর্ঘটনা! সবাই বলছে, ভুলক্রমে আগুন লেগেছে। নিয়তির নির্মম খেলা সব। কিন্তু সোহানের মনে সংশয় দানা বেঁধেছে। এত বছর ধরে এমন দুর্ঘটনার মুখোমুখি তো কখনও হয়নি। না, এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়। এর পেছনে হয়তো কোনো চতুর কৌশল অবলম্বন কারী লুকিয়ে আছে বলেই তার দৃঢ় ধারণা। লোকসানের অঙ্ক মাথার ভেতর ক্রমাগত বিদ্ধ হয়ে চলেছে। লক্ষ, কোটি, কোটি কোটি টাকা। যা ক্ষতি পূরণযোগ্য নয়। এই ক্ষতির রোষে পুড়ে যাচ্ছে সোহান। সেই ক্রোধের নিঃশেষ ঘটছে মাহাদী ও তার স্ত্রীর গায়ে প্রতিদিনের আঘাতে। কেন সে এমন করছে তা সে নিজেও জানে না। হয়তো ব্যথা দেওয়ার মধ্যেই আজ শান্তি খুঁজে নিচ্ছে তার অসুস্থ মন। সোহানের সেই রাতের কথা মনে পড়ে যায়।
সেদিন অঝোর ধারায় ঝরছিল বৃষ্টি। প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে সিফাত ছাতা হাতে নৌকা থেকে নেমে গেল জঙ্গলের গা ঘেঁষে। কাজ শেষ করেই যখন ফিরে আসবে, ঠিক তখনই অন্ধকার চিরে আচমকা একটা যুবক তার সঙ্গে ধাক্কা খেল। ছেলেটির চোখে-মুখে আতঙ্ক ছিটিয়ে একাকার। কণ্ঠে অসহায় আবেদন, “একজন লোক আমাকে খুন করার জন্য ধাওয়া করতেছে। দয়া করে সাহায্য করেন!”
সিফাত হতবাক। এমন গভীর রাতে, জঙ্গলের নির্জনে কেউ কারও পেছনে ছুটছে মৃত্যুর উদ্দেশ্যে?অদ্ভুত! সে নাম জানতে চায়। ছেলেটি বলে “মাহাদী! মাহাদী নামক একজন লোক আমাকে মারার জন্য পেছনে লেগেছে।”
নামটি শোনামাত্রই সিফাতের অন্তরে বজ্রপাত হয়। সে বুঝে ফেলে আসল ঘটনা। ভয়ানক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ ভাবে। তখনই ছেলেটি থানায় ফোন করে। ঘটনা লম্বা হোক তা সিফাত চায় না। তাই কোনোমতে বুঝিয়ে ছেলেটিকে নৌকায় নিয়ে আসে। সোহান সব ঘটনা শুনে পুলিশকে অন্যত্র না পাঠিয়ে সরাসরি তাদের কাছে আসতে বলল। পুলিশের সঙ্গে সোহানের সম্পর্ক ভালো। টাকার কৃপার প্রলেপে সব কিছু ধুয়ে-মুছে ফেলে সে। এসবের কোনো দরকার পড়ত না। যদি না মাহাদী সেদিন ভুল করত। রাতে সোহান লোক পাঠায় মাহাদীকে ধরে আনার জন্য। ভাগ্য ভালো জঙ্গলেই খুঁজে পায় ওই তাকে। কাজ আরও সহজ হয়ে যায়। মাহাদী তখন হুশে ছিল না। নেতিয়ে পড়েছিল। সেই রাতে সোহানের আদেশে পৃথিবীকে খুন করে সিফাত। মাহাদীকে পাশেই ফেলে রাখে কিন্তু হুশ ফিরতে ফিরতে সকাল হয়। তারপর আর কি?
সোহান মাথা নিচু করে কাগজপত্র ঘেঁটে চলেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে প্রতিটি লাইন, প্রতিটি হিসাব। এমন সময়ে রাজন চুপচাপ এসে তার পাশের চেয়ারে বসে। মাথায় হাত রেখে হঠাৎ বলে ওঠে,”চলো চিত্রাকে মেরে ফেলি।”
এক মুহূর্তেই সোহানের স্নায়ুতে রগরগে আগুন ছুটে যায়। চোখের লাল শিরাগুলো স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠে। এই রাজন কি সত্যিই তার সঙ্গে এসব কথা বলছে? ওর কি মাথা ঠিক আছে? সোহান দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমার চিত্রার বিষয়ে যেন আর কোনোদিন এসব কথা মুখ থ্যাইকা না বের হয় রাজন।”
রাজন ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়, “মিয়া রাখো ওই মাইয়া আমাগোরে ধ্বংস করব দেইখো।”
সোহানের কণ্ঠ কঠিন হয়ে ওঠে,
“কি হইছে, খোলাসা কইরা বলো।”
রাজন একটু ঝুঁকে আসে। মুখটা সোহানের কান ঘেঁষে নিয়ে বলে,”ওইদিন নাকি সরাইখানায় গেছিল।”
“কিহ!”সোহান স্তব্ধ হয়ে যায়।
“আরে হ। ওই মাইয়া দুনিয়ার চালাক। আমি ফোনে সরাইখানায় যাওয়ার কথা বলছিলাম ওইটা শুইনা ফেলছে। তার চেয়েও বড় কথা আমি যেই সরাইখানায় গেছি ওই সরাইখানাতেই কেমনে সে গেলো?”
সোহানের চোখ সংকুচিত হয়ে আসে।”দেইখা ফেলছে?”
“না। ওই সরাইখানার মালিক লতার থেকে আমি মোনালিসারে কিন্না ফেলছিলাম। ওইদিন আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করা ছিল। খালি মোনালিসারে সরাইখানা থেকে বের কইরা গাড়িতে বসাইছি। ওর জন্য নতুন বাড়ি কিনছি। ওখানে গেছিলাম গা। আমি যাওয়ার পর দিয়াই সম্ভবত চিত্রা ওইখানে গেছে।”
সোহান অবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত বড় বিষয় ঘটে গেছে। চিত্রা এমন জায়গায় গিয়ে ঘুরে এসেছে আর সে বিন্দুবিসর্গও জানে না? সে কিছু বলবে তার আগেই রাজন পুনরায় বলে উঠল,
“চিত্রা সবাইরে সন্দেহ করতাছে। আর ওর সন্দেহ আমাগো মরণ ডাইকা আনব। ভাইবা দেখছো সরাইখানায় যদি সত্যি ওইদিন আমি থাকতাম তাইলে ফারাজ নিজ হাতে আমারে খাইয়া ফেলত? ভাই হেয় মানুষ না। চিত্রার প্রেমে কানা হয়ে গেছে। এই চিত্রা কোনদিন আমাগো সব গুলারে মারব। ওর ব্যবস্থা করো জলদি। তুমি না করলে কিন্তু আমি নিজেই করতে বাধ্য হমু।”
–
সুস্থতার পর চিত্রা তার ভুলের সবচেয়ে বড় যেই শাস্তি পেলো তা ছিল ফারাজের সঙ্গে তার মন-দেহের দূরত্বতা। সে কেবল তার স্পর্শ থেকে নয় বরং তার শব্দ থেকেও নির্বাসিত হয়েছিল। ফারাজ তাকে এত বড় শাস্তি না দিয়ে যদি গালে দু’টো শক্ত চড় বসাতো। মেরে হাড় গুঁড়োকরে দিত তবুও যদি খানিকটা কথা বলত! জীবনের এই পর্যায়ে এসে চিত্রার মনে হচ্ছে কিছু শাস্তি না দিয়েও দেওয়া যায়। কিছু অভিমান প্রকাশ করা লাগে না৷ তারা গোপনে বেদনা ছড়ায়,দুঃখ দিয়ে ভেতর ক্ষয় করে ফেলে। মানুষ ভাবে শাস্তি মানে দাহ। তবে তারা কি জানে কিছু শাস্তি শব্দেরও ঊর্ধ্বে। কিছু দহন চোখে পড়ে না। তবুও তারা স্তব্ধতায় আগুন জ্বালে, একফোঁটা রক্ত না ঝরিয়েও গর্ভে চূর্ণবিচূর্ণতা তৈরি করে। এই যন্ত্রণার কথা না কাউকে বলা যায়,তা কাউকে এর জন্য দোষারোপ করা যায়। ❝প্রিয়জনের আচরণের পরিবর্তন মানুষকে খুন না করেও হত্যার ক্ষমতা রাখে।❞ এটি নীলাভ নৈঃশব্দ্যতা। যেখানে মানুষ প্রলাপ করে না। শুধু সংলাপের গতি থেমে যায়, দৃষ্টিতে জমে ওঠে অপাঠ্যতা। কেউ কাউকে আর ছোঁয় না, কেউ কাউকে আর নাম ধরে ডাকে না। কথাগুলো বরফ হয়ে জমে যায় ঠোঁটের কোণে। আর হৃদয়ের ভেতর জন্ম নেয় অনাদৃত শূন্যতার মহাফসিল। ব্যাস এইটুকুই যথেষ্ট একটি প্রেমকে রক্তাক্ত ছাই করে মাটির নিচে চাপা দেওয়ার জন্য। একটি হৃদয়কে জীবন্ত কবর বানিয়ে তার কালো গোলাপের বাগান করার জন্য।
এই যে বিগত সাতরাতে চিত্রা অনুভব করেছে রাত জেগে কেউ তার পাশে বসে আছে। কেউ মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। কেউ ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দিয়ে পোশাক বদলে দিচ্ছে। কারো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল হুট করে চিত্রার গালে এসে পড়েছে। কেবল অনুভবই করতে পেরেছে সে। চোখ মেলার মতো অবস্থাও তার ছিল না। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল সে। সব অনুভব করতে পারছে ঠিকই তবে চোখ মেলে, শরীর নাড়িয়ে দেখার, বলার সাধ্য নেই। যেন সজ্ঞানে অচেতন, চেতনাতেও শিকলবন্দি।অসুস্থতার শেষ পর্যায়ে যখন চিত্রা প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছিল সেই থেকে ফারাজকে চোখের সামনে দেখে নি। অথচ চিত্রা যে মানুষটি রাতের আঁধারে তার নিঃশ্বাস গুনেছে, শরীরের তাপ মেপেছে,অসুস্থতার রাত্রিরে তাকে সুস্থ করার রোগে নিজেই অসুস্থ রোগীর ন্যায় ছটফট করেছে সেই ছায়াসম লোকটি কেবলই তার স্বামী।
চিত্রা মলিন মুখে অভ্রর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়েশা তাকে দেখে জলদি উঠে এসে বলে, “আপা আমাকে একটা কল করতা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসছো কেন?”
“অভ্র নেই?”
“আছে।”
চিত্রা রুমে গিয়ে বসে। অভ্র তাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়ায়। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোনো দরকার ছিল ভাবী?”
“আপনার ভাই কোথায়?”
অভ্র দ্বিধায় পরে যায়। “আসলে ভাবী ভাই তো কাজে।”
“সেই ঢাকায় যাওয়ার আগে শেষবার তাকে মন ভরে দেখেছিলাম ভাই। মাঝে দুই-চার হুট করে চোখে চোখ পরলেও কি সব কাজের অজুহাত দিয়ে চলে যায়। তারপর দু’দিন ধরে যে নিখোঁজ হয়েছে এখনও বাড়ি ফিরে নি। আপনি তো তার কাছের লোক। আপনি তো জানেন সে কোথায় আছে? দয়াকরে বলুন ভাই। আমি আর এই দূরত্ব মানতে পারছি না।” চিত্রা ছোট্ট বাচ্চার মতো কান্নায় ছটফট করে। আয়েশা তা সহ্য করতে পারে না। কাছে বসে চিত্রার চোখ মুছিয়ে দিতেই আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে চিত্রা। ডুকরে উঠে তার বুক। হাহাকার মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,” আয়েশারে আমি আর পারছি না। আমার ফারাজকে ফিরে আসতে বল। তার চিত্রা মরে যাচ্ছে তার শূন্যতায়। তার কাছে নিয়া চল আমায়।”
অভ্র শ্বাস নেয়। কষ্ট তারও হচ্ছে। ওদিকে ওই মানুষটা তার নিজের দোষ ভেবে নিজেকে সবচেয়ে বড় শাস্তি দিচ্ছে। সেই শাস্তি হচ্ছে তার চিত্রার থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। আর এদিকে এই মানুষটা সেই দূরত্বকে নিজের শাস্তি ভেবে ডুকরে উঠছে। চিত্ররাজ নিজেদের থেকে দূরে সরে নিজেদের প্রেমদহনেই পুড়ে মরছে। অনেক হয়েছে এবার অভ্র চিত্ররাজের মিলন চায়। আর দূরত্ব নয়। ফারাজকে সে নিজেই আজকে বাড়ি ফিরিয়ে আনবে৷ আনবেই। সে তার ভাইকে এভাবে আর ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখতে পাবে না। অনেক দিয়েছে সে নিজেকে শাস্তি আর নয়।
–
চিত্রা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তবুও সেই ঘটনার পর চিত্রা কখনও হাসে নি সে । ফারাজ পাসপোর্ট তৈরি করতে দিয়েছে। জলদি ডেনমার্ক ফিরবে। চিত্রাও সঙ্গে যাচ্ছে। তারপর কবে ফিরবে জানা নেই। সেই ঘটনার পর থেকে ফারাজ চিত্রার কাছে এখনও আসে নি। এই যে কতদিন হলো চিত্রা সুস্থ হয়েছে তবুও ফারাজ সেই অসভ্য কথাবার্তা মুখ থেকে বের করে নি। রাত হলে এখনও কাজের অজুহাতে রুমে আসে না। কাজের কথা বলে স্টাডি রুমেই থাকে। চিত্রা জানে ভুল তারই। এই ভুলের ক্ষমা হয় না। ওইদিন রাজন ভাইকে সে সরাইখানায় পায় নি। নিশ্চয়ই আবারও ভুল বুঝেছিল? ভুল বুঝাবুঝি কত্ত খারাপ জিনিস তা এখন সে হারে হারে টের পাচ্ছে চিত্রা। সে নিজেকে নিজে কথা দিয়েছে। আর কখনও কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না সে। ভালো শিক্ষা হয়েছে। তবে শুনেছে ফারাজ নাকি পুলিশকে খবর করে ওই মহিলাকে ধরিয়ে দিয়েছে আর মেয়েগুলোও মুক্তি পেয়েছে। তার স্বামী আসলেই একজন নম্র-ভদ্র মানুষ। রাত হয়েছে। চিত্রা তাকের বইগুলো গুচ্ছাছিল। এমন সময় রুমে বজ্র আসে। চিত্রা তাকে দেখে বসতে বলে। বজ্র দাঁড়িয়েই চিত্রাকে জিজ্ঞেস করে, “শরীর কেমন লাগছে?”
চিত্রা শান্ত গলায় বলল,”ভালো।” চিত্রা খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, “ফারাজ কি আজকে রাতেও আসবে না?”
বজ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,”ওকে একটু সময় দাও। আসলে তোমার সেদিন না বলে ওইখানে যাওয়া উচিত হয় নি। এক মুহুর্ত দেরি হলে কি হতো ভেবে দেখেছো? ভাগ্যিস আমি বাঁচাতে গিয়েছিলাম। যদি আমার বদলে সত্যি সত্যি অন্য কোনো নোংরা পুরুষ নোংরা ভাবে তোমায় স্পর্শ করত?”
চিত্রা হঠাৎ ঠোঁট চেপে বলল,”থামুন ভাই। আমি ওইসব থেকে এবার বাহিরে আসতে চাই। আর মনে করিয়ে মনকে মারতে চাই না।”
বজ্র একটু বিব্রত হয়ে মাথা নিচু করল। তারপর ধীরে বলল,” আচ্ছা,বেশ তবে। চলুন অন্য কিছু বলা যাক। জানেন আমাদের কায়সার বংশের মানুষকে জনগণ এখনও ভয় পায়। কারন একটাই কায়সাররা আগে ডাকাতি করত। ডাকাতি কিন্তু অনেকভাবেই করা যায়। তবে অন্য সব জায়গায় যেমন ছেলে মেয়েকে আলাদা চোখে দেখা হয় আমাদের বংশে তেমনটা হয় না। এই বংশের মেয়েদের মুখের আগে হাতের ছুড়ি চলে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় তারা একবার সেখানে চোখ ফেলে তা নিজের করে তবেই ছাড়ে। উদ্দেশ্য পূরণে তাদের জুড়ি নেই। “
চিত্রা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,”খুনী বংশ নাকি?”
বজ্র হেসে ফেলল,” আরে উঁহু উদাহরণ দিলাম মাত্র।”
“আপনি কি বুঝাতে চাইছেন?”চিত্রা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
“কিছুই না। তবে বলছিলাম কি আমিও তো ওই বংশেরই ছেলে। আর…”
চিত্রা সোজা তাকিয়ে বলল,”আর কিছুই না। এসব আমাকে শুনাচ্ছেন কেনো?
বজ্র নরম গলায় বলল,”মন চাইলো তাই। আচ্ছা আপনি তো নিজেকে বাঁচাতে পারতেনই ওইদিন। ওই মহিলাদের সামনে নিজেকে হারিয়ে দিলেন কেন?
চিত্রা হাসল। বলল,”হেরে যদি উদ্দেশ্য পূরণ হয় তাহলে জিতে লাভ কী বলুন বজ্র কায়সার?”
–
ফারাজ অন্ধকার রুমের মধ্যে কারো কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মেয়েলি একটা হাত তাঁর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ সেই হাতের মালিক নরম গলায় বলল,
“রাত হয়েছে? বাড়ি ফিরবে না?”
ফারাজ চোখ না খুলেই জবাব দিল,”তোমার কাছে থাকলে তোমার অসুবিধা হবে বুঝি?”
“তা বলেছে কি?” তোমার বউ বাড়িতে অপেক্ষা করছে আর তুমি কিনা আমার কাছে পরে আছো।”
ফারাজ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “বউতো আমায় বোঝেনা। তুমি তো বোঝো। আজকে রাতটা তোমার কাছে থাকতে দাও মণি।”
মণি আদুরে দৃষ্টিতে ফারাজের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, “আমার থেকেও বেশি ভালোবাসো বউকে?”
ফারাজ চোখ মেলে তাকায় না, শুধু বলে,”বাসিতো। কেনো তোমার হিংসে হয়?”
মণি চোখ মুচড়ে হাসে,”খুব হয়।”
“যাও তোমাকে একটু বেশি ভালোবাসা দিব। তুমি বদলে আমার দুঃখ ভুলিয়ে দাও।”
“দুঃখ পেলেই তো আমার কথা মনে পরে তোমার। আমার কাছে আসো। তাছাড়া তোমার জীবনে মণির অস্তিত্ব আর কই?এখন তো আবার সতীন এনেছো আমার। শুনো ফারাজ সতীন হিসেবে কিন্তু আমি বেশ ঝগড়ুটে। তোমার বউ পারবে তো আমার সঙ্গে?”
“আরে বড় বউ তোমার সেবাযত্নের জন্যই তো বিয়ে করলাম। এত ঝগড়ুটে হতে নেই বড় বউদের।”
ফারাজ মণির কোলে মাথা রেখেই ছোট্ট বাচ্চাটির মতো চোখ বুজল। মণি মৃদু হাসল। বলল, “একটা গল্প শুনবে?”
ফারাজ মৃদু কন্ঠে হু বলল কেবল। সে শুনতে চায়। রাত গাঢ় হচ্ছে। আচ্ছা ফারাজকে ছাড়া আরেকটা রাত কাটাতে কি তার চিত্রার অনেক কষ্ট হবে? সে কি একটা ভেবে মণিকে বলল, “গল্পটা জলদি শুনাও। বাড়ি ফিরতে হবে। বউকে অনেক মনে পরছে। তাকে জড়িয়ে ধরে রাতটা ফুরিয়ে দিতে চাই।”
চলবে?
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৫৪
#শেষাংশ
রাতে পাশ ফিরতেই অনুভব করল চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে কেউ একজন ঘুমিয়ে আছে। ওই এলাচের সুবাসযুক্ত পারফিউমের প্রয়োজন নেই চিত্রা ফারাজের নিশ্বাসের শব্দ শুনেই অনুভব করতে পারে তার পাশে কে শুয়ে আছে। চিত্রা শান্তিতে চোখ বন্ধ করার আগেই পুরুষালি গম্ভীর গলা তার কর্ণকুহুরে ধাক্কা খায়, “বিবিজান।”
চিত্রা ধীরে জবাব দেয়,”হুম।”
“আমায় ছাড়া ছিলে কেমন?”
চিত্রা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,❝পুড়ে যাওয়া চিঠির ভেতর অপ্রকাশিত ভালোবাসা যেমন। আর আপনি কেমন?❞
ফারাজ বিষণ্নতা ঝরা গম্ভীর গলায় জবাব দেয়, ❝আলোর খোঁজে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো শিশুর চোখ যেমন। ঝরে যাওয়া ফুলের গায়ে মরচে ধরা বসন্ত যেমন। বৃষ্টির আশায় ফেটে চিরে যাওয়া মাটির বুক যেমন। শিকলবাঁধা স্বপ্নের চোখে ঘুমহীন রাত যেমন। ছিলাম ঠিক তেমন।❞
কথাগুলো চিত্রার বুকের ভেতর গজিয়ে ওঠা সব যন্ত্রণার কুঁড়িকে ফাটিয়ে দেয়। হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। দু’হাতে ফারাজকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভেতর জমে থাকা কান্নাগুলো কোনো শব্দ ছাড়াই বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে ফারাজের উন্মুক্ত বুকজুড়ে।
ফারাজও চিত্রাকে আরও শক্ত করে বুকে টেনে নেয়।
যেন হাতটা একটুও আলগা হলেই এই মেয়েটা আবার হারিয়ে যাবে, এই স্পর্শটুকু আবার দূরের হয়ে যাবে…তাদের মাঝখানে শুধু থেকে যাবে ভাঙা ভাঙা নিশ্বাস আর অপূর্ণতায় গুমরে মরা কিছু বাক্য।
“কথা দিন মেরে ফেলবেন কিন্তু আর কখনও দূরত্ব দিবেন না।”
” আমাদের মাঝে আর কখনই দূরত্ব আসবে না। কথা দিলাম।”
“কিন্তু দূরত্বের অপর নাম কিন্তু ভালোবাসা ফারাজ। এখন মনে হচ্ছে আপনার থেকে আলাদা হয়ে আপনার জন্য আরো বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছি।”
❝দূরত্বের নাম যদি ভালোবাসা হয়,
তবে শিরোনামে লিখে দিও আমার
পরাজয়।
যে ভালোবাসায় দূরত্বই সই,
সেখানে আর ভালোবাসা রইল কই?
সেই ভালোবাসা আমার চাইনা,
যেখানে তোমায় ছোঁয়া যায়না।
তিন অক্ষরের দূরত্ব,
সম্পর্কে বাড়ায় গুরুত্ব?
ওসব আমি মানি না,
বুঝলে তো বউ চিত্রাঙ্গনা?❞
ফারাজ যতটা সম্ভব আগলে রাখে চিত্রাকে। আর দূরত্ব নয়। এবার ভালোবাসার গল্প শুরু। তবে এখানকার পরিস্থিতি ভালো না। সবাই এখন শত্রু। জলদি চিত্রাকে নিয়ে বাইরে চলে যেতে হবে। অন্তত চিত্রার একটা সুস্থ জীবনের জন্য। ফারাজ সব ছেড়ে দিবে। সব পাপ সে ছেড়ে দেবে। কেবল তার চিত্রাকেই চাই। চিত্রাকেই লাগবে তার।
–
সারাদিন ঘরে বসে কাটিয়েছে চিত্রা। ফারাজ এসে পাশে বসতেই চিত্রা তাকে বলল, “পাসপোর্ট হয়েছে?”
ফারাজ ল্যাপটপে চোখ রাখতেই উত্তর দেয়,”কাজ চলছে।”তার কোল জুড়ে তখনও ল্যাপটপ। চিত্রার দৃষ্টি সেই যন্ত্রটির ওপর স্থির। ফারাজ সেটা বুঝেই চোখ তুলে হাসে, “চেয়ে চেয়ে কী দেখছো?”
“দেখছি ল্যাপটপটা কী সুন্দর করে আমার স্বামীর কোল দখল করে বসে আছে। হিংসা হচ্ছে গো স্বামী।”
ফারাজ ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানার ওপর ছুঁড়ে মেরে চিত্রাকে কাছে টেনে কোলে বসায়। চুল সরিয়ে ঘাড়ে একটা চুমু দিয়ে বলে, “সারাদিনে চুলগুলো আঁচড়াওনি?আসো একটা বেণী করে দেই।”
চিত্রা অবাক হয়ে বলে,”আপনি বেণী করতে জানেন?”
“না তবে তুমি বলে বলে দাও আমি ঠিক পারব।”
চিত্রা মেঝেতে বসে পড়ে। ফারাজ আস্তে করে চুলগুলো আঁচড়ে এবড়োখেবড়ো একটা বেণী গেঁথে দেয়। ব্যালকনির ফুলের টব থেকে সাদা সন্ধ্যা মালতী ফুল ছিঁড়ে চিত্রার বেণীর ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেয়। কী সুন্দর দেখাচ্ছিল ওই চুল। চিত্রা আবার হেসে ফারাজের এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা শিমুলের তুলোর মতো মসৃণ চুলগুলোতে ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেয়। ফারাজ বাধা দেয় না। বউ তার যা ইচ্ছে করুক। তবুও খুশি থাকুক। হাসুক।
–
সন্ধ্যার পর চিত্রা ছাদে যায়। বহুক্ষণ নিঃস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে সে, চেয়ে থাকে দূরের আকাশে, যেখানে গোধূলির আলো-আঁধারিতে হারিয়ে যাচ্ছে দিনের শেষ আলো। সুখ ছাড়া আর কিছু চায় না চিত্রা। কিন্তু এই দুঃখ যে তার পেছনেই ছাড়ছে না। জীবনটা সুন্দর হয়েও খুব জলদি আবার অসুন্দরে ছেয়ে যাচ্ছে। আর কালকে বজ্র কী বলল?চিত্রা কি করে লড়তো ওদের সঙ্গে? ইচ্ছে করে কি কেউ মৃত্যুর দুয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ে? বজ্রকে ওমন ত্যাড়া জবাব দিয়ে শান্তিই লাগছে। যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর। লাগুক এখন তার, যা মনে করার করুক। আর ভালো লাগে না। ধ্যাৎ! চিত্রা ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে নিচে নামতে যাবে হুট করে সোহাগের সম্মুখীন হয় সে। চিত্রার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সোহাগ থমকে দাঁড়ায়। চিত্রা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে সোহাগ আকুল গলায় অনুরোধ করে,”কিছুক্ষণ থেকে যাও।”
চিত্রা স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,”ছাদের শেষ কোণে যাও। আসছি আমি।”
চিত্রার অগোছালো চুলের খোঁপা খুলে গেছে। মাথার ওড়নাটা পিছলে পড়েছে। সে পুনরায় মাথায় কাপড় দিয়ে পুকুরপাড়ের পশ্চিম পাশের সেই জায়গায় তাকায়। এক সপ্তাহে ঘাস উঠেছে সেই জায়গায়। এখন ঠিকভাবে ঠাহর করাও যাচ্ছে কোথায় চাপা পড়ে আছে সেই বস্তা এবং তার ভেতরের রহস্য। সোহাগ শেষবেলায় বাড়ি ফেরা টিয়াপাখি ঝাঁকের দিকে তাকায়৷ তারপর বলে, “যদি কোনোদিন আমাদের দেখা না হতো?”
“তাহলে তোমার জীবন সুখ খুঁজে পেত।”
সোহাগ আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “আমায় কেন ভালোবাসলে না চিত্রাঙ্গনা?”
“মনে ধরে নি তাই।”শান্ত স্বরে উত্তর চিত্রার।
“তবে তাকে যে ধরলো?”
চিত্রা মৃদু হেসে বলে,”সে ধরার মতোই তো ছিল।”
সোহাগ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ভাগ্যের একতরফা পরিহাসে হারিয়ে দিলে আমায়।”
চিত্রা ঠান্ডা স্বরে জানায়,”তোমার চার আঙ্গুলের কপালে ছিলাম না আমি। আর কি বলে বুঝাবো তোমায়?”
“তবুও চাইব আমার হয়ে যাও।”
চিত্রার ঠোঁটে তিক্ত হাসি,”হাসালে সোহাগ। সময় আছে এখনও আমায় ভুলে যাও।”
“বড্ড ভালোবাসি যে।”
“এসব শুনলে রাগ করবে সে।”
“তাকে খুব ভালোবাসো তাই না? তার প্রতি তোমার ভালোবাসা কতখানি?”
“পৃথিবীর সকল ভালোবাসা যতখানি।”
সোহাগ থেমে যায়। তার ভুল একটাই তা হলো ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় সে বিশ্বাসী সে ভালোবাসা বাস্তব জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদি মুখে বলা কিছু মিথ্যা কথা,মিথ্যা পরিচয়, ছলনায় গড়া সম্পর্ক বাস্তবে রূপ নিত। যাক গে চিত্রা কখনই তার ছিল আর না হবেও না। কিছু সত্য সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাবে। কিছু ফুল ঝরে পড়বে অকালে তবে তার সুবাস রয়ে যাবে সোহাগের ভাঙা হৃদয়ে আমরণ। বাকি জীবনটুকু নাহয় এই তীব্র সুবাসকে কেন্দ্র করেই বাঁচার আশা করবে। যেদিন বাতাসের সঙ্গে হারিয়ে যাবে সুবাস সেদিন হয়তো হারাবে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় জীবন। চিত্রা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সোহাগও দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের শূন্য দৃষ্টি শূন্যে ভাসছে। সূর্য তখন ডুবতে বসেছে।
ফারাজ চিত্রার জন্য ডায়মন্ডের একটা নাকফুল কিনেছিল। অনেকদিন ধরে দিবে দিবে বলে দেওয়া হয় নি। সারাবাড়ি চিত্রাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে না পেয়ে যখন বিচলিত তখন আয়েশার কাছ থেকে খবর পায় চিত্রা ছাদে। ছাদে অনেক আশা দিয়ে এসে ফারাজ নিরাশায় ডুব দেয়। নিজের স্ত্রীকে তার প্রাক্তনের সঙ্গে দেখে বুকটা চিলিক পেরে ওঠে। তবে তারা ফারাজের অস্তিত্ব অনুভব করার আগেই ফারাজ নিজেকে আড়াল করে নিচে নেমে যায়। চাইলেই সে চিত্রাকে সেখান থেকে কেড়ে নিয়ে আসতে পারত,শোনাতে পারত তোকে বেশ কিছু কথা। কিন্তু কেনো জানি মন চাইল আজ। ওই সোহাগ নামক মানুষটাকে কষ্ট দিতে আর ইচ্ছে করল না। কারন মানুষটা নিজেই এখন আস্ত একটা কষ্ট। ফারাজের চিত্রার ওপর বিশ্বাস আছে। কিছু সময় ভালোবাসার মানুষকেও মুক্ত করে দিতে হয়,ভালোবাসাকে মুক্তি করতে হয়। কারন খাঁচায় বন্দী পাখি যেমন ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যায় তেমনি খাঁচায় বন্দী ভালোবাসাও বেশিদিন বাঁচে না। কিন্তু ভেতর ভেতর কেমন জানি জ্বলজ্বল করছে। ফারাজের কি ঈর্ষা হচ্ছে? সে জেলাস? কিন্তু জেলাস তো ছোটলোকরা হয় তার তো জেলাসি হয় না ডাইরেক্ট কলিজাটা বের করে ভুনা করতে মন চায়।
ফারাজ নাকফুলের বাক্সটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। নিচে নামার জন্য পেছনে ফিরতেই দণ্ডায়মান অভ্রকে দেখতে পেলো সে। এই কুদ্দুসের বাপ কি তাকে অনুসরণ করছে? অভ্র ফারাজকে ডিঙিয়ে ছাদে একবার উঁকি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করে। নামতে নামতে গান ধরে, “পরাণ যায় জ্বলিয়ারেহহহহহহ পরাণ যায় জ্বলিয়ারেহহহহ।”
ফারাজ ক্ষেপে গিয়ে পা থেকে জুতা খুলে অভ্রর দিকে নিশানা করে বলে, “শালার ভাই তোমারে খাইছি আজ।”
ফারাজ বলতে দেরি অভ্র খিঁচে দৌড় দেয়। আর ফারাজ তার পিছনে ছুটে।
–
ইদানীং দিন-রাতের তফাৎ যেন ভুলে গেছে ফারাজ। শুধু কাজের কথা বলে হুটহাট বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চিত্রার ঘরে থাকা বইগুলো প্রায় সবই পড়ে ফেলেছে সে। মোহনার ঘরে আছে অনেক ভালো বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস। বেশ কিছুদিন ধরে দূরবীন বইটা পড়বে পড়বে করে আর পড়া হচ্ছে না। বইটা মোহনার কাছেই আছে।
চিত্রা পাশে বসে থাকা আয়েশার দিকে তাকায়। তারপর বলে, “কিরে বাবা তুই নতুন লিপস্টিক কিনেছিস? রঙটা সুন্দর।”
আয়েশা নাক সিঁটকে জবাব দেয়,”কিনিনি। ওই কাটাওয়ালীর রোজ অভ্রর সামনে ঘষে ঘষে এই লিপস্টিক লাগাচ্ছিল। এখন খাম মেরেছি শালী বিদেশি প্রতিবন্ধী দেখি কেমন করে ঘষামাজা করে। ও আমাকে চিনে না। আমার সরকার ভাই সুন্দর দেখে নজর দেওয়া? ওই মেয়ের ঠোঁট কেটে আমি পেছনে লাগিয়ে দেব।”
চিত্রা হেসে বলে,”বাপরে বাপ। বেশ কথা শিখেছিস বিয়ের পর।”
“আপা।”
“হুম।”
“আপনি কথা দেন আর কখনও নিজেকে বিপদে ফেলে কোনো কাজ করতে যাবেন না। একবার ভেবে দেখেছেন ওইদিন আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কি জবাবদিহি করতাম?”
চিত্রা একটু চুপ থেকে বলে,”চুপ করো। মরি নি তো? বেঁচে আছি।”তারপর একটু হেসে আবার বলে,” ভালো কথা ইদানীং না কেমন যেন খালি
ক্ষুধা লাগে রে। খেতে ইচ্ছে করে,খেলে আবার বমি হয় আবার না খেলেও বমি লাগে।”
আয়েশা চিন্তিত গলায় বলে,”ভাত এনে দেই। ভাত খাননি এখনও।”
“না না ভাত খেতে ইচ্ছে করে। মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা আমার রুমের মিনি ফ্রিজটা খুল তো। চকোলেট লাভা কেক আছে। ফারাজের নিজ হাতে বানানো। চল ওইটা খেয়ে শেষ করি।”
আয়েশা চোখ গোল করে বলে,”আরে ভাবী লক্ষণ কিন্তু মোটেও ভালো না। আপনার আগে কিন্তু কুদ্দুসকে দুনিয়ায় আনব আমি। আপনার আগে গেডা এনে আপনার গেডিকে জ্বালাতে হবে না?”
চিত্রা হেসে জিজ্ঞেস করে,”কেমনে বুঝলি তো যে গেডাই হবে?”
“চৌদ্দ সেন্স ব্যবহার করে।”
” বাহ বিলুপ্তপ্রায় প্রানীর মতো মূল্যবান দেখছি তুই।”
হাসির রেশ রেখে চিত্রা বলে,”আচ্ছা চল মোহনা ভাবীর রুমে গিয়ে টাঙ্কি মারি।”
আয়েশা আবার বলে,”আপা ওইটা তো ফারাজ আব্বার সঙ্গে মারবেন। আর মশারী ভাবির সঙ্গে মারবেন আড্ডা।”
বাড়ির পুরুষরা এই সময় বাড়িতে থাকে না। যদিও ফারাজ বাদে। কিন্তু আজকে তো সেও নেই। মোহনা ফুলির চুলে তেল লাগিয়ে উঁকুন এনে দিচ্ছে। এই মেয়ে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে,মাথা ঘেমে একাকার হয়ে যায়। সেই আঠালো চুল অযত্নে পড়ে মাথায় উঁকুন হয়ে গিয়েছে। চুল আচড়ে বেণী করে দিতে দিতে মোহনা কপট রাগে বলল, “আর দৌড়াদৌড়ি করবি না। কি অবস্থা করেছিস দেখ নিজের? রোদের তাপে মুখের ওপর কালচে ভাব পড়ে গেছে।”
ফুলি লাজুক গলায় বলল,”আচ্ছা আর করুম না।”
“এখন বিছানায় গিয়ে একটা ঘুম দে তো।”
ফুলির ভয় ভয় করছে। সেই মুখশ্রী দেখে মোহনা বলে, ” চিন্তা নেই রোশান ফিরবে কাল ভোরে।”
ফুলি নিরুত্তর। ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
মোহনা তার পাশে এসে শোয়, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমপাড়ানির গান গুনগুনিয়ে গায়। তবে ফুলি চোখটা বন্ধ করার আগেই কেউ দরজায় খটখট শব্দ করে। মোহনা উঠে গিয়ে দরজা খুলে কিছুটা অবাক হয়। তার চোখ বিস্ফারিত। বেশ অবাক হয়েছে। সঙ্গে মনের ভয় উপচে উঠছে। রোশান এই সময়? রুমে এসে রোশান ফুলিকে দেখতেই এক মুহূর্তের জন্য স্থির থাকতে পারে নি। যেই নারীকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে সেই নারী যখন তাকে সে দুনিয়ার সবাইকে এত ভালোবাসা বিলিয়ে দেয় তখন যেই দুঃখ হয় তা বলে বোঝানো দায়। মোহনা যাকে ভালোবাসবে রোশান তাকেই কেড়ে দিবে। মোহনার কোনো ক্ষতি করবে না তবে তাকে ব্যথা না দিয়েও সবচেয়ে বড় ব্যথা দিবে রোশান। রোশান এগিয়ে এসে লুঙ্গির গিঁট বাঁধে। তারপর একটানে ঘুমন্ত ফুলিকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে মেঝেতে ফেলে।ফুলি কিছু বুঝে ওঠার আগেই শরীরটা ঠাণ্ডা ঘামের মতো জমে যায়। সে বুঝতেও পারে নি তার সঙ্গে কি থেকে কি হয়ে গেল। মোহনা তড়াক করে উঠে রোশানের পায়ে পড়ে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে, কাকুতি-মিনতির করে বলে, ” ওকে ছেড়ে দাও। ওর কোনো দোষ নেই। ওর সঙ্গে খারাপ কিছু করো না।”
“সামনে থেকে সর মোহনা।” বলেই পা ছাড়িয়ে নেয় রোশান। চিত্রা আর আয়েশা মোহনার ঘরের দিকেই আসছিল। চেঁচাচেচির শব্দ শুনে তারা দৌড়ে আসে। রোশান ফুলির বাহু ধরে তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বাহিরে নিয়ে যাওয়ার আগেই চিত্রা সেখানে উপস্থিত হয়। মোহনা চিত্রাকে দেখে সাহস পায়। দৌড়ে এসে তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে,,”বোন বাঁচাও আমার ফুলকে। ওরা জানোয়ার। মেয়েটাকে ধ্বংস করে ছাড়বে।”
চিত্রার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কি করবে বুঝতে পারছে না। এখানে হচ্ছে টা কি? রোশান ধমকে বলে,
“চিত্রা, সামনে থেকে সরে যাও।” চিত্রা নিজেকে শক্ত করে। বুক টান করে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। কাঁপা গলায় বলে উঠে, “ফুলি কে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ভাই?”
“দেখো চিত্রা সেটা তোমার জানার দরকার নাই। সামনে থেকে সরো কইলাম।”
মোহনা উঠে এসে ফুলিকে ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করলে রোশান বাধ্য হয় তাকে ধাক্কা দিতে। মোহনা মাথায় আঘাত পায়। পড়ে যায় মেঝেতে। তাও কান্না আর আকুপাকু দূর হয় না। চিত্রার ইশারায় আয়েশা চটজলদি মোহনার কাছে দৌড়ে যায়৷
রোশান দাঁত চেপে বলে,”দেখো চিত্রা সামনে থেকে না সরলে ধাক্কা দিতে বাধ্য হমু।”
চিত্রা স্থির গলায় বলে,”তো দেন দেখি ধাক্কা। তবুও আপনি ফুলিকে নিয়ে কোথাও যেতে পারবেন না।”
রোশান চিত্রার সাহস দেখে অবাক হচ্ছে। সেইদিনের ওই তালুকদার বাড়ির মেয়ের শিরায় এত গরম? ফারাজের মাথা নষ্ট হয়েছে এই মেয়ের রূপ দেখে। খুনের বদলে রুপের পূজারী হয়েছে। যেদিন এই মেয়ে ওকে সহ বাড়ির সবার পেছনে ছুরি চালাবে সেদিন পাবে আসল শিক্ষা। চিত্রার খুব ভয় করছে কিন্তু পাশ থেকে মোহনার সেই আর্তনাদ তার পা জমিনের সঙ্গে আঁটকে রেখেছে। বিবেক তাকে নড়তে দিচ্ছে না।
“আপনি বলুন ফুলিকে আপনি জোর করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছেন? ওর অপরাধ কি? আর মোহনা ভাবী কোন ধ্বংসের কথা বলছে?”
রোশানের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আবার ফুলিটাও সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। রোশান ফুলির মুখ চেপে ধরে গর্জে ওঠে,” এই বান্দির বাচ্চা চুপ যাহ। হইলে কইলাম গলা কাইটা মাটিত গাড়ুম।” ফুলি ভয়ে চপসে যায়। কান্নায় ভেতর শুকিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে কাঁদতে বেজায় ভয় পাচ্ছে।
চিত্রা টেনে ফুলিকে ছিনিয়ে নেওয়ার আগেই পেছন থেকে রুমানা এসে চিত্রাকে ঝাঁপটে ধরে, “বউ তুমি পাগল হইছো?”
“আম্মা দেখুন ভাই ফুলীকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে।”
“কই আর নিয়ে যাবে? ওর চাচার কাছেই পাঠিয়ে দিবে। তুমি জায়গা দেও ওরে।” বলেই রুমানা চিত্রার হাত ধরে টেনে দরজার সামনে থেকে তাকে সরায়। রোশান টেনে হিঁচড়ে ফুলিকে নিয়ে যায়। ফুলির ক্ষীণ শরীর যেন মাটিতে ছেঁড়া কোনো পুতুল। হ্যাঁচড়ে হ্যাঁচড়ে যাচ্ছে। কি হিংস্রতা রোশান ভাইয়ের সেই চেহারায়। এই টুকু মেয়ের সঙ্গে এত ধস্তাধস্তি? এত জুলুম তার ওপর? মোহনা দৌড়ে উঠতে নিয়েই রুমানা একটা ধমক দেয়। মোহনা নিঃস্ব কণ্ঠে বিলাপ করে। অসহায়ের মতো মাটিতে গড়িয়ে নিজের কপালকে নিজেই দোষারোপ করা শুরু করে। চিত্রার চোখে জল। তবে এই জল কষ্টের না বরং জিদের। সে দৌড়ে বাঁচানোর চেষ্টা করে কিন্তু রুমানা বাধা দেয়। যেতে দেয় না তাকে চোখ গরম করে বলে, ” মহিলা মানুষ মহিলা মানুষের মতোই থাকো। পুরুষ হইবার চেষ্টা কইরো না কইলাম বউ। এত তুরতুর করা ভালা না। তোমার কাম আমার পোলার সেবা করা৷ সংসার সামলানো। এই বংশরে বংশধর দেওয়া।”
চিত্রা জিদের বশে কেবল চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরায়। কি এক আফসোস ফুলিকে ওরা চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে গেল অথচ চিত্রা চেয়ে দেখা ছাড়া কিচ্ছুটি করতে পারল না।
ফারাজ বাড়ি ফিরতেই চিত্রা তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ফুলিকে এনে দেওয়ার জন্য ছটফট করে উঠল। ফারাজের তখন মেজাজ ঠিক ছিল না। ওদিকে চিত্রার যে মোহনা ভাবীর জন্য হলেও ফুলিকে ফিরত চাই। সে হাহাকার করেই গেল ফারাজের সামনে। ফারাজ কেবল একটা কথাই বলল, “তুমি কি চাও আমি আবারও তোমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই? না চাইলে যার যার বিষয় তাকে সামলাতে দাও। অনেক হয়েছে। কয়দিন পর বিদেশ যেতে হবে প্রস্তুতি নাও।”
চিত্রার ভেতরটা সেই কথায় কেমন যেন ভেঙে পড়ল। যতটা না কষ্ট তার ফুলিকে বাঁচাতে পারে নি বলে হচ্ছিল তার চেয়েও অধিক হচ্ছে ফারাজের কথা শুনে। এই বাড়ির মানুষ গুলোকে এখনও কেন চিত্রা বুঝে উঠতে পারছে না? রোশান ভাইয়ের ওমন ব্যবহার আর মোহনা ভাবীর চোখের ভয়ের মধ্যে কি লুকিয়ে ছিল? একটু চিন্তা থেকে বের হতে চাইলে পরক্ষণে চিন্তার পাহাড় এসে তার ঘাড়ে ধ্বসে পড়ে। সারারাত ফারাজ স্টাডি রুমে ছিল। সবার প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছিল ওই রুমে। চিত্রা ঘরের এক কোণে কেবল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মাথায় একটাই চিন্তা এই বাড়ির আসল রহস্য কী?ফুলিকে কোথাও নিয়ে গেল?আম্মার হুট করে এমন ব্যবহার বদলে যাওয়া?আর মোহনা ভাবীর ওই কথার ইঙ্গিত কী?
“ভাই আপনি ড্রাগস নিবেন কেন? নিয়েন না ভাই ড্রাগস।” বলল অভ্র।
পাশ থেকে রোজও সমান তালে বলে উঠল, “ওইসব নিয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানে কী?
” যা বলেছি তা কর।”
রোজ না চাইলেও মাদকদ্রব্যগুলো ফারাজের সামনে এনে রাখল। ফারাজ ড্রাগস নিলে তার সকল ব্যাথা, সকল যন্ত্রণা কমে যাবে। মন খুলে চিন্তা করতে পারবে। সে সামনের সাদা প্যাকেট থেকে কিছু একটা বের করে হাতের উপরপাশে ঢেলে নিলো। শুঁকতে নিবে তার আগেই চিত্রার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সে নেশা পানি পছন্দ করে না। ফারাজ নেশা করলে সে কষ্ট পাবে না? হুট করে মাথা আরো বিগড়ে যায়। সামনের টেবিলটাই উল্টে ফেলে দেয় সে। কপালে হাত দিয়ে ধমকে উঠে সবাইকে বলে,
“লিভ মি এলোন।”
ফারাজের দুনিয়া এদিক-ওদিক হয়ে যাচ্ছে। চিত্রাকে লাগবে তার। একটা ভারি বিষাক্ত নিশ্বাস পতনের জন্য হলেও চিত্রাকে লাগবে। এই দেশে আর একমুহূর্ত না। ফারাজ যতই কষ্ট পাক,যতই হাহাকার করুক চিত্রা ঠিকই বার বার ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে। ভালো ব্যবহার অনেক হয়েছে। বউকে নিরাপদ রাখতে যদি খারাপ হতে হয়, হিংস্র হতে হয় তবে ফারাজ এলাহী এবার থেকে তাই হবে। জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছে ফারাজ। ফারাজের ফেলা আসা অতীত সব কেড়ে নিয়েছে তার। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে ওই অতীতে হারিয়েই আজকের এই পাপিষ্ঠ পুরুষের সৃষ্টি। আর নয়,ফারাজ আর হারাতে চায় না। অতীতকে তো বদলাতে পারবে না ফারাজ। যা হারিয়েছে তাও ফিরে পাবে না। কিন্তু যে আছে তাকে তো আগলে রাখা সম্ভব। তাকে আর হারানো যাবে না। কারন না পেয়ে হারানোর থেকে পেয়ে হারানোর দুঃখ বেশি।
–
রাজন রুমের বাতি বন্ধ করে দিল। দিয়ে শুয়ে পড়ল মোনালিসার পাশে। এখন যদিও মোনালিসা বললে ভুল হবে। সে এখন রাবসা। পাশাপাশি রাজনের স্ত্রী। মিসের রাজন এলাহী সে। রাজনের রাবসা। রাবসার চুলে হাত বুলিয়ে রাজন কাঁধ ছুঁয়ে বলল, “শরীর এখন কেমন লাগতাছে ময়না?”
“আগের থেকে ভালো।” নরম গলায় শুধালো রাবসা। কন্ঠে জোর নেই।
রাজন তার কপালে আলতো চুমু খেয়ে আশ্বাস দেয়,, “দেখবা তোমার কিচ্ছু হইব না ময়না। তুমি জলদি সুস্থ হইয়া উঠবা।”
“সান্ত্বনা দিচ্ছো?”
“নাগো সত্য বলছি।”
একটু থেমে রাবসা বলে,”রাজন দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে পতিতার নষ্টা নারীর প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করলে কেন?”
রাজন রুঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,”আর একবারও যেন এসব ফালতু কথা জবান থ্যাইকা না বাইর হয়। তুমি আমার বউ। আমার সব তুমি।”
“তোমার মেয়ে আছে,বউ আছে তবুও আমি তোমাকে বিয়ে করে ওদের জীবন নষ্ট করেছি। আমি তো এমনিতেও পাপী। এখন আবার পাপ।”
রাজন তাকে থামিয়ে দেয়। বলল,”নদীরে আমি ভালোবাসি না। আর মাইয়া? নুড়ির মায়ের যখন আলট্রা করাইছি তখন শারীর ডাক্তারে কইছে পোলা হইব। হইছে তো বাল মাইয়া। আগে যদি জানতাম ওইটা মাইয়া তাহলে পেটে থাকতেই মাইরা ফেলতাম।”
রাবসা স্তব্ধ হয়ে যায়।”মেয়ে মানুষ এত অপছন্দ কেন?”
“মেয়ে মানুষ দিয়া কি করুম? আমি মরলে ওই বালগুলা আমার অভাব পূরণ কইরা ব্যবসা সামলাইতে পারব?”
“আমিও তো মেয়ে মানুষ। আমায় ভালোবাসলে কেন?”
“তুমি আর ওরা এক হইল নাকি ময়না? তুমি ভিন্ন।”
“নদীর বাচ্চা হয় নি?”
রাজন চুপ যায়। রাবসা রাজনের গালে হাত রেখে বলে, “আমাকে ভালোবাসো তো? অন্তত মিথ্যা বলবে না আমার সঙ্গে।”
রাজনের রাবসার সেই আকুল আবেদনে হৃদয় কেঁপে উঠে। সে রাবসাকে নিজের বুকে আগলে বলে, “নদী মা হইছিল। পর পর দুবার। দু’বারই বাচ্চা নষ্ট করি আমি। কারন ঘুইরা ফিইরা মেয়ের জন্ম ছাড়া কিছুই দিতে পারে নি সে। নদীর কখনও সিঁড়ি থ্যাইকা পইরা বাচ্চা নষ্ট হয় নাই। ওর এসবে কোনো দোষও ছিল না। নষ্ট করছি আমি। তবে দোষ সে চাইলেই দিতে পারত আমার ওপর। দেয় নাই। নডির মহৎ সাজতে হইব না?”
“সে তোমাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে। তাই হয়তো তুমি সবার সামনে খারাপ হও কখনও চাই নি।”
“আমাদের মাঝে কেবল আমরা থাকমু ময়না। তুমি ওই শালীর আলাপ পাইরো না। ওর গায়ের ময়লা রং দেইখাই তো ওর সঙ্গে আমার শুইতে ঘৃণা লাগে। খালি গরিব ঘরের মাইয়া,ওরে বিয়া করলে কোনো ঝামেলা হইব না,সব সহ্য করে নিতে পারবো তাই বিয়া করা। না হইলে ওর মতো মেয়ে রাজনের বিছানায় যাওয়ারও যোগ্য নয়।”
রাবসা আর একটা কথাও বলে না। রাজনকে সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। রাজনের যে কোনো সরাইখানায় বেশ আনাগোনা ছিল। সেবারের কথা। রাবসা তার চাচার বাড়িতে থাকত। ছোট থেকেই রাবসা তার চাচাকে দেখতে পারত না। চাচা সবসময় ছোট্ট রাবসার গায়ে বাজে ভাবে স্পর্শ করত। বয়স বাড়ার সঙ্গে এই স্পর্শ ভয়ে পরিনত হয়। রাবসা যেখানে পড়ালেখা করত তার সঙ্গেই চাচার বাড়ি ছিল বিধায় বাবা-মায়ের জোরজবরদস্তিতে চাচার বাসায় থাকার জন্য পাঠায় থাকে। চাচিরও আপত্তি ছিল না৷ বিনা পয়সায় ঝি তো পাবে। কতবার মাকে সব খুলে বলেছে উল্টো মা তাকেই গালাগাল করত। কখনও বিশ্বাসই করে নি। চাচিকে সব বলার পর চাচির হাতের কড়া একটা চড় গিয়ে বসল রাবসার গালে। তার পবিত্র স্বামীর নামে নাকি রাবসা ইচ্ছে করেই অপবাদ দিচ্ছে। দোষ নাকি রাবসার নিজের চরিত্রেই মিশে আছে। তারপর আর কি? একদিন চাচি সত্যি বুঝতে পারে রাবসার কথা মিথ্যা ছিল না। তখন বুঝল যখন তার আপন বোনের মেয়ের সঙ্গেও তার স্বামী একই কাজ করেছে। আফসোসের বিষয় সেইবারও চাচি সংসার বাঁচানোর জন্য রাবসার ওপরই দোষ দিল। স্বামী- স্ত্রী মিলেই রাবসাকে লতার পতিতায় বেঁচে দিয়ে নাম দিল নষ্টা রাবসা পালিয়ে গিয়েছে। লতার কাছে বিক্রি হওয়ার পর রুমে সবার প্রথম যেই ভিআইপি কাস্টমার এসে ভয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাবসাকে ছোঁয়ার অধিকার লাভ করল সে ছিল রাজন এলাহী। কিন্তু সেই সতী রাবসাকে রাজন স্পর্শ করল না। প্রথম দেখায় বিমোহিত হলো। তার এতোই ভালো লেগে গেল যে অন্যকারো সঙ্গে সে রাবসাকে ভাগ করতে চাইল না। সেই থেকে রাবসাকে রাজন ছাড়া আর কেউ দেখারও সুযোগ পেলো না। রাজন রোজ আসত। রাবসার কোলে মাথা রেখে গল্প করে রাত কাটিয়ে দিত। তারা রাত জেগে দাবা খেলত,তাস খেলত। গান গাইত। সেই রাবসাও রাজনের ভালোবাসায় একসময় পড়েই গেল। তারপর আর কি? মুসলমান হলো। মোনালিসা থেকে রাজনের রাবসা হলো। তারপর বউ । তাদের সংসারও হলো। তবে অসুস্থ সংসার। রাবসার ছোট থেকেই ফুসফুসের ছিদ্র ছিল। সেই রোগ ধীরে ধীরে মরণব্যাধিতে পরিনত হয়। সব জেনেও রাজন রাবসাকে বিয়ে করল। আসলে পুরুষ যতই খারাপ হোক না কেন প্রিয় নারীর জন্য তারা সব করতে পারে। রাজনও তেমনই। রাজন জানে তার রাবসার হাতে সময় নেই। তবুও কত পাগল এই লোক তার জন্য। হায়রে এই দুঃখিনীর জীবনে সে ক্ষনিকের সুখ হয়ে না এলোও পারত। সব জেনেও সে এই বিশ্বাসে নিশ্বাস নিচ্ছে যে তার রাবসা একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে। আহা মানুষ!
রাবসা চোখ বন্ধ করে। সে কারো সংসার কখনই ভাঙতে চায় নি। ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে। তবে নদীর সঙ্গে গল্প করার তার খুব শখ। তার দুঃখের গল্পের ভাগিদার রাবসা হতে চায়। রাবসা চায় রাজন তাকে যেই পরিমাণে ভালোবাসে নদীকেও বাসুক। আজ বাসুক,নয়তো কাল তবুও বাসুক। তারা সুখী হোক। নুড়ি দুঃখ চেনার বয়স হওয়ার আগেই যেন রাজন তার দুঃখ ভুলিয়ে ভালো পিতা হয়ে উঠুক। রাবসা সেইসবই চায়।
নদীর চোখে ঘুম নেই। নুড়িটাও আজকে ঘুমাচ্ছে না। সেই কখন থেকে বাবা বাবা বলে কান্না করছে। মেয়ে মানুষ বাবার পাগল কেন যে হয়? যেই বাবারা মেয়েদের দেখতে পারে না ওমন বাবাদের জন্য খোদা মেয়েদের মনে একটু কম ভালোবাসা দিলেও তো পারে। নদীর নিজের মেয়ে দুনিয়ায় আসতে পারে নি তো কি হয়েছে। ওই বাচ্চাগুলোর মধ্যে সে ছোট্ট নুড়িকে খুঁজে পায়। একদিন সব শেষ হয়ে যাবে তবুও নুড়িকে আগলে রাখবে নদী। দুঃখের পর একদিন তার ঠিকই সুখ ফিরে আসবে। নদী রাজনকে কল করে। কয়েকবার কল করে। নম্বার ব্যস্ত। ব্লক করেছে তাকে তা বুঝতে বাকি রইল না নদীর। সে নদীকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে খোদাকে স্মরণ করে বলে, “আমার তাহাজ্জুদের নামাজ তুমি বিফলে যাইতে দিও না খোদা। আমার স্বামীরে তুমি আমার বুকে ফিরাইয়া দাও। তার হৃদয়ে আমার জন্য একটু হইলেও টান দাও। আমারে তার ভালোবাসা লাগব না সে শুধু আমারে একটা বার বুকে জড়াইয়া আমার নদী বইলা ডাক দেখ। আমি নদী সেই মুহুর্ত আঁকড়ে ধইরা মাটির নিচে যাওয়ার দিন গুনমু।”
–
সোহানের মাথা ধরে আছে। মাথা পুরোই খারাপ। তার মা অসুস্থ। বিয়ের কথা বলছে বার বার। মাকে কি করে বলবে চিত্রাকেই বিয়ে করতে চায় সে? চিত্রাই তার সকল মন্দের একমাত্র ভালো? চিত্রাকে পেলে দুনিয়া সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিবে। হারামকে নিষিদ্ধ করবে নিজের জন্য। তবে মায়ের জন্য মনটা ভালো নেই। মা অসুস্থ থাকলে তার দুনিয়া আন্ধার লাগে। মাথা কাজ করে না। শরীর জ্বলে-পুড়ে ওঠে। সোহানের পাশে এসে সিফাত দাঁড়ায়। এসেই বলে, “ভাই মাহাদী আর ওর বউয়ের ঝামেলাটা শেষ করবেন কবে? এই আর্তনাদ,হাহাকার শুনতে ভালো লাগে না।”
লঞ্চ এগিয়ে চলছে রাতের আঁধারে বুড়িগঙ্গার সদরঘাটের দিকে। সকালে বরিশাল এসেছিল একটা কাজে। সেখান থেকে সন্ধ্যারাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চে করে ঢাকায় ফিরা। এই লঞ্চের গুদামঘরেই মাহাদী-মারিয়াকে তুলে এনে বন্দী করে রাখার ব্যবস্থা করেছে সোহান। গুদামঘরে গিয়ে সোহান পায়ের ওপর তুলে চালের বস্তার ওপর বলে।
“কিরে সিফাইততা? চাউলের খোঁচা পাছায় লাগে কেন?”
“দাঁড়ান ভাই চেয়ার দিতাছি।”
“না থাক মাঝে মধ্যে খোঁচা খাইতে মজাই লাগে। চুলকানি কমে। এই যে এখন একটু নড়চড় করলেই চাউলের খোঁচায় পাছার চুলকানি কমব।”
মাহাদীকে হিঁচড়ে সোহানের সামনে টেনে আনে দু’জন লোক। মারতে মারতে অবস্থা নাজেহাল করেছে। মুখে চাউল গুঁজে শরীরে লোহা গরম করে ছ্যাঁকা লাগিয়ে দিয়েছে। পায়ের তলার ছাল উঠিয়ে ফেলেছে। এই এক সাপ্তাহ সামান্য জল ছাড়া কিছুই পেটে পরে নি মাহাদীর। খিদার তাড়নায় বস্তা ছিঁড়ে আটা খেয়েছে। চাউল খেয়ে পেট ভরিয়েছে। তবুও আক্ষেপ নেই তার। আক্ষেপ একটাই তা হলো মারিয়াকে না দেখতে পাওয়া। মারিয়াকে একটা বারের জন্য দেখা করাইনি সোহান,সোহানের লোকগুলো। মাহাদীর চেয়ে তাকানোর মতোও শরীরে আর শক্তি নেই। তবুও সোহান চায় মাহাদী তার দিকে তাকাক। মাহাদীও চায় তাকিয়ে সোহানের কাছে আর্তনাদ করতে। নিজের জন্য নয়। নিজের বাচ্চার জন্য। নিজের স্ত্রীর জন্য।
সোহান সিফাতকে ইশারা করতেই সে মাহাদীকে সোজা করে বসায়। হাত পা বেঁধে দেয়। তারপর মাহাদীর সামনে পেশ করা হয় মারিয়াকে। মারিয়ার ছাপা সাদার শাড়ির ওপর নীল ছোট ছোট ফুল করা শাড়িটি রক্তে জর্জরিত। লাশের মতো পড়ে আছে সে। নড়ছে না চড়ছে না। মাহাদী চোখ মেলার চেষ্টা করে। কষ্ট হচ্ছে চোখটাও মেলতে তার। তবে কানটা সজাগ। সোহান মারিয়ার পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“কয়বার?”
সিফাত জবাব দেয়,”জানি না ভাই। ছেলেদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম ওরা জানে। মানুষ তো অনেক। ধারণা করেন।”
সোহান শাড়ির রক্তমাখা ভাঁজগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”এত রক্ত কিসের?”
“বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে।”
সোহান হালকা হাঁ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।”ইশশ….দুঃখের বিষয়।” পরক্ষণেই এক চিলতে হেসে জবাব দেয়,” তবে আমার দুঃখ লাগতাছে না কেন?”
মাহাদীর দম বন্ধ হয়ে আসে। সে এবার উঠে নড়চড় করে উঠে। চোখ বেয়ে কান্না ঢলে পরে। তার মারিয়া….মারিয়ার কি হয়েছে? মারিয়া কথা বলছে না কেন? সোহান ফের বলে উঠল,
“সিফাইততা মাইয়া বেঁচে আছে?”
সিফাত দু’দিকে মাথা নাড়ায়। সোহান মুখটা কালো করে মাহাদীকে বলে, “ভাই তোর বউয়ের মরণ কিন্তু সেই লেভেলের আগে হইছে। বাচ্চাটা দেখবি? বাচ্চাটা নষ্ট হয়েছে তবে পরবর্তীতে ওইটা টেনে জায়গা থেকে বের করে আনা হইছেরে। আরেকটা খবর মৃত্যু যন্ত্রণায় তোর বউটাকে আরেকটু ছটফট করতে করতে জানটা বের করে আনা হইছে। জানোস কি করা হইছে? তারে তোর হিংস্রতা,অন্ধলোভ, স্মৃতি নামক সেই গর্ভবতী মাইয়া সহ যাদের জীবন টাকার লোভে তুই ব্রিক্রি করছোত তাগো সবার গল্প শুনানো হইছে। তুই তো আর কইবি না তাই আমিই জানাইয়া দিলাম। তবে বিশ্বাস কর জীবনে কোনো মানুষরে ধরার আগেই জান বাইর হইয়া গেল। তোর বউয়ের এটা জান নাকি আর কিছু? সিফাত মাহাদীর বাঁধন খুলে দেয়। মাহাদী হাহাকার করতে করতে মারিয়ার দিকে হাতরে যায়। তার মারিয়া তাকে ফেলে কোথাও যেতে পারে না। সে মারিয়ার কাছে গিয়ে তাকে টেনে বুকে জড়িয়ে আহাজারি করে, ” এই বউ। মারিয়া উঠো বউ। আমাগো বাচ্চার জন্য হলেও উঠো। উঠো বউ। আমারে ক্ষমা কইরা দাও। আর অভিমান কইরো না। আমি সব খারাপ কাম ছাইড়া দিমু মারিয়া। তাকাও।”
মারিয়া উঠে না। মারিয়ার শাড়ি তাজা রক্তে ভেজা। সিফাত পলিথিন এনে সামনে রাখে। সেই পলিথিনের ওপর চারমাসের একটা ভ্রুণ। ছোট্ট নিষ্পাপ জীবন। মাহাদী সেই ভ্রুণ বুকে আগলে আমার বাচ্চা আমার বাচ্চা বলে চিৎকার করে। তার চিৎকার বাকিদের কাছে কেবলই বিরক্ত। মাহাদীর চোখে বার বার স্মৃতি নামক মেয়েটির সেই রাতের আহাজারি ভেসে উঠে। সেই রাতে মেয়েটির চিৎকার আজ তার চিৎকার হয়ে উঠেছে।
“বাচ্চাটা যখন বের করা হয় তখন কিন্তু তোর বউ বাঁইচা ছিল। স্মৃতির মতোই পায়ে পড়ছি। পেটে লাথি খাইছে।”
মাহাদী চোখের সামনে সব শেষ হয়ে যেতে দেখে। সব শেষ তার। তার লোভ তার সব শেষ করে দিল। যে যেমন অন্যকে ধ্বংস করেছে খোদা একই ভাবে তাকে করেছে। সব শেষ। মাহাদী স্ত্রীর লাশ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জড়িয়ে রাখে। সোহানের সেই দৃশ্য সহ্য হচ্ছিলো না। সে সিফাতকে নির্দেশ দেয়,
“মাইয়ার লাশের পেট কাইটা জলে ভাসাইয়া দে। ন্যাড়করামি দেখতে পারি না।”
সিফাত মাহাদীর থেকে মারিয়াকে ছিনিয়ে নিতে আসলেই মাহাদী শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে মারিয়াকে আগলে ধরে। ” কেউ ধরবি না আমার মারিয়ারে। দেখোস না সে ঘুমাইতাছে। ওরে বিরক্ত করবি না। ও আর আমার বাচ্চা এখন ঘুমাইতাছে।”
সিফাত মাহাদীর মুখে একটা লাথি মেরে বলে, “শালা পাগল হইছো?”
সবাই জোরজবরদস্তির করে মাহাদীর থেকে তার মারিয়াকে ছিনিয়ে নেয়। ওই দেখাই ছিল শেষ দেখা। আর কখনই তাদের দেখা হবে না। মাহাদীর চোখের সামনে তার বউকে নিয়ে যাচ্ছে। ওই ঘুমন্ত মানুষটার গায়ে ওরা ছুরি চালাবে বলছে। ওদের কি দয়ামায়া নেই? আকাশ চৌচির হয়ে বিরহের গান ভেসে আসে বাসাতে। মাহাদী শেষ বারের মতো বলে,”তোরা আমার মারিয়ারে নিস না। আমারে মার। ওরে ছাইড়া দে।”
মাহাদীর শোকে প্রকৃতির বুক চিরে ভেসে আসছে,❝তোমার সঙ্গে আর হলোনা দেখা, দেখা রে। বুকে আমার বির্সজনের ব্যথা।❞
মাহাদী নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তবে শেষবারের মতো বউকে মন ভরে দেখার আগেই পরপর ঠিক তার বুকের ওপর টিগ্রার প্রেস হয়। চোখের সামনে ঘোলা হয় সবটা। ঘোলা হয় স্ত্রীর বিদায় বেলার মুখখানা। কেবল স্পষ্ট হয় কিছু না হওয়ার স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। মাহাদীর আর মারিয়া হাঁটছে একসঙ্গে। হাসছে দু’জনে। দুজনের হাত ধরে আছে আরেকটি ছোট্ট হাত। তারা সুখী। কোনো কষ্ট নেই তাদের। মাহাদীর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তার রচিত গল্পের অধ্যায়ের ইতি হয়। দুনিয়া হয়তো কোনো না কোনোদিন মাহাদীর পাপের গল্প জানতে পারবে, জানতে পারবে না অভাবের তাড়নায় খারাপ হওয়ার গল্প। স্ত্রীকে বাঁচাতে না পারার যন্ত্রনা। সন্তানের ভ্রুন হাতে নিয়ে ডুকরে উঠার গল্প। এটাই জগতের অটল নিয়মাবলী। পাপের পরিণতি সর্বত্র সমান, এপার-ওপার দুনিয়ার কোণে কোণে তার শাস্তি গোঁড়া। কিন্তু এ পরিণতির মাঝে কি রয়েছে লাভ? বরং পাওয়ার চাইতে না পাওয়ার গল্পই অধিক ব্যপ্ত। কথায় আছে, অতিমাত্রায় লোভে তাঁতির সূতা ছিন্ন হয়, আর সেই লোভের জালেই জীবন পরিপূর্ণ হয় দুঃখ-বেদনায়। লোভের সঙ্গেই মৃত্যুর তীর ছুঁয়ে যায় প্রাণকেন্দ্র। মাহাদীর অধ্যায় আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিল অতিরিক্ত পাওয়ার নেশা ভয়ংকর রকমের খারাপ। এই নেশা কেড়েও নেয় জীবন থেকে অতিরিক্তই। যা ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
চলবে?
( তো কি শিক্ষা নিলেন? আপনার পাপ কেবল আপনাকে নয় আপনার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাকিদের কেউ ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। তাই সময় থাকতেই ভুল শুধরে নেওয়া উচিত। শেষ সময়ে নয়।)
গ