#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব ৫৫
#প্রথমাংশ
জমিদার বাড়ির আদলে গড়া দোতলা প্রাসাদোপম বাড়িটির সামনে রাতের নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা পাঞ্জাবি পরা বয়ষ্ক লোক। চারদিকের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। বাতাসে হাওর অঞ্চলের কাঁচা-পঁচা গন্ধ আর মাটির ভেজা সুবাস।
লোকটি স্থির নয়নে চেয়ে আছে বাড়িটার দিকে। যেন এক বিস্মৃত আত্মীয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই বাড়ি, এই বাজিতপুর, এই হাওর অঞ্চল সবকিছুই তার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। তার শিকড় এই মৃতপ্রায় ইমারতের গাঁথুনিতেই গাঁথা। বাড়িটির সামনের প্রাচীন নামফলকটা বহু আগেই পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ চেহারায়। বাইরের দেওয়াল জুড়ে কালচে সবুজ শ্যাওলা, বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে প্রতিটি ইটের গাঁথুনি। দরজাগুলো কাঁপা কাঁপা, গায়ে কাঠের ফাটল, কোথাও কোথাও লোহার কড়িকাঠে মরিচা ধরে রক্তচাপের মতো লালাভ দাগ। দোতলা ভবনের বিশাল বারান্দা আর পাকদণ্ডি ঘোর সিঁড়ি দেখেই বোঝায় কতটা রাজকীয় ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একসময়। দেয়ালের ক্যালেন্ডার হয়তো আজও আটকে আছে সেই দিনটাতে যেদিন সে শেষবার এই বাড়ির গন্ধ শুঁকে ফিরে গিয়েছিল দূরদেশে। দশ বছর পর আবার সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। ফিরে এসেছে পূর্বপুরুষের ভিটায়, যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি জানালা, প্রতিটি শূন্যতা তাকে চেনে। লোকটি এগিয়ে যায়। সদর গেট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সেই তালাবদ্ধ বাড়ি অথচ বাড়িভর্তি মানুষ গুলো আজ বিচ্ছিন্ন।
প্রথম তলায় বড়সড় বারান্দা। সেখান থেকে একজোড়া মোটা পিলার উঠে গেছে দোতলা পর্যন্ত। পিলারগুলো একসময় হয়তো সাদা রং করা ছিল, এখন কেবল ছোপ ছোপ ফাঙ্গাস আর ধুলোর আস্তরণ। জানালাগুলো লোহার গ্রিলে ঢাকা। কিছু ভেঙে গেছে, কিছু অর্ধেক খোলা পড়ে আছে। দোতলায় উঠার সিঁড়িটা বাইরের দিকে। পাকদণ্ডির মতো ঘুরে ঘুরে উঠেছে। ধাপে ধাপে জমে থাকা শেওলা আর ভেজা পাতার স্তূপে কেউ পা রাখলেই পা পিছলে যাবার ভয়। ছাদের কার্নিশ ভেঙে গেছে অনেকখানিই।
উপরের বারান্দায় উঠে সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ে দরজার সামনে। মোটা কাঠের দরজাটায় এখনো লেগে আছে একটি মরচে ধরা লোহার তালা বহু বছর কারো স্পর্শ পায়নি। সে পরে থাকা ইট দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করল। তালাটা প্রথমে একটু নড়ল। তারপর ধাতব একটা চিৎকারে ভেঙে পড়ে নিচে। দরজা খুলতেই ধূলির ঝাপটা নাকে মুখে এসে লাগল। লোকটির চোখের সামনে হারানো স্মৃতি, শৈশব ভেসে উঠল। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল জল। একটা নিশ্বাস নিয়ে সে বললেন, “অনেক হয়েছে এবার বাড়ির মালিক বাড়িতে ফিরবে। আর পালালে চলবে না। খুনের বদলা খুনের মাধ্যমেই নেওয়া হবে।” বলতে না বলতেই একটা কল আসে লোকটির ফোনে। ফোন তুললেই ওপাশ থেকে একটা পুরুষালী গম্ভীর গলা ভেসে আসল, “বাবা তুমি বাজিতপুর গিয়েছো?”
লোকটি চোখ না সরিয়েই উত্তর দেয়,
“হুম।”
“তোমাকে বলেছি না এখানে এখন আসার দরকার নেই? আমি আছি তো!”
সে ঠান্ডা গলায় বলে,”তোমাকে একজনকে আগলে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই দায়িত্ব না হয় পালন করো। বাড়ির মানুষ আমার বাড়িতে যেন সুস্থ ভাবে ফিরত আসে।”
“কিন্তু বাবা…”
“কোনো কিন্তু নয়। এবার আমরা খেলবো ওরা খেলনা হবে। আমার লাশ চাই, লাশ। এই ঝামেলা জলদি শেষ হলে তোমার বিয়ে হবে। এই বাড়িতেই। সেই মতো তৈরি রেখো।” বলেই লোকটি ফোন কেটে দিল। সরু চোখ নিয়ে অন্ধকার ঘরে আবারও কিছু ফেলে রাখা জটলা খোলার চেষ্টা করল আনমনে। ফোনের টর্চটা ইচ্ছে করছে বন্ধ করে দিতে। তবে করল না। ধ্যান ধরে চেয়ে রইল সেভাবেই।
–
নিশুতি রাত। বাতাসে ছড়িয়ে থাকা মাছ আর মাটির ঘ্রাণকে চাপা দিয়ে কালো নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে কুকুরের মতো একটা নির্বিকার নৈঃশব্দ্য।
লঞ্চ তখন চরের কিনারা ঘেঁষে যাচ্ছে। দূরের কুয়াশায় ঢাকা গাছপালার ফাঁক দিয়ে জোনাকিরা ভেসে বেড়াচ্ছে। কারন তাই হলো আঁধারের চেনা পাহারাদার। লঞ্চের নিচতলায় গুদামঘর। নিঃসাড়, বদ্ধ, ঘামে-তেল-মাছে গন্ধ মেশানো নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া জায়গা। ধাতব জং ধরা দরজার ওপারে কেরোসিনের আলো টিমটিম করছে। সেই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে দুটো নিথর দেহ। তাদোর কাপড়চোপড় রক্তে ভেজা। থমকে যাওয়া দুটো জীবন কংক্রিটের মেঝেতে পড়ে আছে।লাশ দু’টোর পেট কেটে নদীর কালো জলে ফেলে দেওয়া হবে। সোহানদের এখানে নতুন কিছু ছেলেপেলে নেওয়া হয়েছে। কাজগুলো তাদেরকেই করতে দেওয়া হয়েছে। সিফাত যদিও দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আছেই। মুইন নামক সেই ছেলেটিকে আজ বিশেষ ভাবে কাজ করতে বলা হয়েছে। সিফাতের মাঝে মাঝে এই মুইনকে দেখলে গা জ্বলে। ঠিক সহ্য হয় না। কারন আছে যদিও। এই যে মুইন নামক ছেলেটা এখানে আসার পর সোহান তাকে তেমন কোনো কাজও করায় নি। আসলে ওইযে শুনেছে মুইনের ছোট্ট একটা বোন আছে। ঠিক যেমন সোহানকে ওই বেঁধে মেয়ে ভাই বলে ডাকে ঠিক তেমন করেই তো ছোট্ট মেয়েটা মুইনকে ভাই বলে ডাকে। আর কোনো না কোনোভাবে সোহান নিজের একটা অসহায় প্রতিচ্ছবি হয়তো মুইনের ভেতর দেখতে পায়। তাই বোধ হয় অন্যদের থেকে মুইনের প্রতি তার এত কদর। মুইন এখনও শক্তপোক্ত হয় নি। রক্ত দেখলেই তার বমি আসে। তাই সোহান তাকে নিহান শেখের সঙ্গে জাহাজের কাজে পাঠিয়েছিল। তবে মাঝে মুইনের বাবার শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায় বিধায় ফিরতে হয় তাকে। সোহান তাকে ফিরে আসতে বলে। সিফাত দাঁড়িয়ে সিগারেটের ছাই ঝাড়ে। ঠোঁটে অম্লান বিদ্রুপ, “এইবারও পেট কাটতে পারবি না? তোরে ভাইজান হুদাই টাকা দেয়। তাও এত্তগুলা। তুই কোনো কামের না। খালি করোস ভুল। অপেক্ষায় আছি তোর গায়ে কাফন পড়ানোর। যেইহারে ভুল করতাছিসরে বেশি দিন আর বাঁচবি না।”
মুইন কিছু বলে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। কেরোসিন বাতির আলোয় তার মুখে ভয়ের ছাপ। হাতে কাঁপতে থাকা চেহারায় মানুষজনের জন্য বেঁচে থাকা একটা মানবিক লজ্জা। একজন মানুষের পেট কেটে ভেতরের নাড়িভুঁড়ি বের করে নদীতে ফেলা, এই কাজ তার মনোজগতে এখনও দুঃস্বপ্ন। তবু চাপাতিটা তুলে নেয়।
“কিরে শুরু কর।” সিফাত গম্ভীর গলায় বলে। সিফাতের কন্ঠ অনেকটা ভারী। হুট করে কেউ গলার শব্দ শুনলে মুগ্ধতায় ভুগবে। শ্যামবর্নের লম্বামতো পুরুষ। তার এলোমেলো চুলগুলো দুর্দমনীয়। তীক্ষ্ণ চোখে সামনের মানুষকে বিভ্রান্ত করার বিশেষ ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। চোয়ালের গঠন দৃঢ়। হাসলে গালের কোনায় মৃদু ভাঁজ পড়ে। বুকখোলা শার্টের মধ্যখানে ভেসে ওঠা বুকের লোমশ পশমগুলো বেশ আকর্ষিত। জিন্স প্যান্টের প্যাকেটে টাকার থেকেও সিগারেট আর লাইটার বেশি পাওয়া যায়।
মুইন একবার চোখ বন্ধ করে। বুক ঠেলেই ঢোক গিলে। চাপাতির হ্যান্ডেলে তার আঙুল শক্ত করে চেপে ধরে। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মারিয়ার শরীরের কাছাকাছি নিয়ে আসে ধারালো ধাতব সেই অস্ত্রটি। কিন্তু ঠিক তখনই সিফাতের ফোন বেজে ওঠে। সিফাত বিরক্ত মুখে ফোনটা কানে তোলে। ওপার থেকে কেউ কিছু একটা বলে, আর তার চোখের রঙ মুহূর্তে বদলে যায়। সিফাত এক লাফে বলে উঠে,
“থাম!”
মুইনের হাত ঝাঁকি খায়। চাপাতির ধার ঠিক মারিয়ার পেটের উপরে থেমে যায়। এক চুল নিচে নামেনি।সিফাত ঘেমে ওঠে। দেরি না করে গুদামঘর থেকে বেরিয়ে সোজা দৌড়ে ওঠে ওপরে, লঞ্চের ক্যাবিনের দিকে। তখন গভীর রাত। চারদিকে নীরবতা। নদীর ক্ষীণ ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া কিছু নেই। সোহান ক্যাবিনে। গায়ে গামছা মুছে লুঙ্গি পরে শুতে যাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছিল। দরজায় তীব্র ধাক্কা পড়ে। সে বিরক্ত হয়ে দরজা খোলে।
“তোরে কইছিলাম, আজ কেউ বিরক্ত করবি না। ভালো লাগতাছে না আমার, আজ ঘুম দিমু।”
সিফাত এক দমে বলে, “ভাই… খবর আছে। খুব জরুরি।”
সোহানের চোখ সরু হয়ে যায়। “কি?”
সিফাত দম আটকে আসা গলায় বলে, “মাহাদী আর মারিয়া… চিত্রার ভাই-ভাবী।”
“কিহ!”
–
রোশান আর ফারাজ পাশাপাশি বসে আছে। মাঝরাতে রাস্তার পাশের বটতলায়৷ একটা ছেলে এসে দুইকাপ চা এনে দিয়ে গিয়েছে। ফারাজ সিগারেট ধরিয়ে রোশানকে বলল, “দিবেন নাকি একটা টান?”
রোশান সিগারেটটা হাতে নিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়ল। ফারাজ একবার গাড়ির দিকে তাকালো। ফুলি সেথায় ঘুমিয়ে আছে। অনেক কান্না করছিল মেয়েটি। রোজ অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছে। যাক এই মেয়ে ভালো মা হতে পারবে হয়তো। তবে ফারাজের এখনও মনে আছে এই রোজ একবার সেই শিশু বয়সে ফারাজের গায়ে পটি করে দিয়েছিল। আসলে বিষয়টা এমন বললেও ভুল হবে। মেইড তখন রোজের ড্রায়পার বদলাবে। এরই মাঝে অভ্র এসে ছোট্ট রোজকে চিমটি মেরে দেয় এক দৌড়। রোজ কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল হয়ে উঠে। ফারাজের বড্ড মায়া হয়। তবে সেই মায়া হওয়াটাই কাল হয়েছিল জীবনের। কোলে নিতেই ওই ধবলরোগী কিনা ফারাজের গায়ে পটি করে দিলো। সেই দিনের কথা ভাবলেই গায়ে কাটা দেয়। তারপর থেকে ফারাজ রোজকে কেন? ইহো জগতের আর কোনো বাচ্চাকেই ড্রায়পার ছাড়া কোলে নেয় নি।
রোশান একটু গম্ভীর গলায়। চায়ের কাপের ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ফারাজকে জিজ্ঞেস করে, “ফারাজ তোর বউও যদি তোরে না ভালোবাইসা তার দেবররে ভালোবাসত? তাহলে তুই কি করতি?”
ফারাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তারপর ব্যঙ্গভরে হেসে বলে,”কাকে জোহান শালাকে? কি আর করতাম বলেন? জাস্ট ছবিতে গাদা ফুলের মালা চড়িয়ে দিতাম। তবে তাই বলে এই ভেবে আমার ছবিতে যেন আপনার মালা পড়ানোর শখ না জাগে। ওইসব কিন্তু ছোটলোকি কারবার ভাই।”
রোশান গলা নিচে নামিয়ে বলে,”মোহনা কেন আমারে ভালোবাসলো না?”
ফারাজ এক ঢোকে পুরোটা চা শেষ করে বলল,”কারন ওই মাতারির নজর আমার মতো আলাভোলা মানুষের দিকে ছিল। মহিলা মানুষ পুরুষ মানুষের দিকে এমন ভাবে নজর দেয় যেমন ভাবে নজর দিলে ডাইরিয়া, আমাশয়ও ফেইল।”
রোশান চোখ সরু করে। ঠোঁট চেপে ধরে বলে, “মজা নিস না। মেজাজ এমনিতেই ধাক্কা খেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে।”
“আপনি চাইলে আমি আরেক ধাক্কা দিয়ে মেজাজকে নিচে নামিয়ে আনতে পারি।”
রোশান জবাব দিল না। তার জীবনের প্রথম ভালো লাগা,প্রথম ভালোবাসা ছিল ওই মোহনা নামক মেয়েটি। তবে কে জানত সেই মোহনা রোশানকে জীবনের মোহনায় এসে ছুঁড়ে ফেলবে? ঘরের স্বামীকে রেখে আঁড়চোখে যখন ফারাজকে দেখত তখনই এই হৃদয় ভেঙেচুর মার হয়ে যেত। জীবনে কখনও কোনো মেয়ের সংস্পর্শে যায় নি রোশান। যাকে মনে ধরবে তাকে নিয়ে জীবন বেঁধে স্পর্শ করবে বলে। কিন্তু হায় নিয়তি! কতবার মোহনার কাছে ভিক্ষা চেয়েছে প্রেম। নিজেকে ছোট করেও ভালোবাসা পাওয়া হলো না রোশানের। তবুও বেহায়ার মতো সেই প্রেমের আশায় আজও সে পথ চেয়ে রয়েছে। একদিন মোহনা সব ভুলে তাকে ভালোবাসবে। তাকে বুঝবে,তার ভালোবাসা উপলব্ধি করবে। মরনের আগে হলেও একবার মোহনার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে চায় সে। ইশরে পৃথিবী কত নিষ্ঠুর। যেই ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে জীবন গুছাবে বলে কত স্বপ্ন বুকে লালন করবে করে রেখেছিল, সেই ভালোবাসাই তাকে পাপের দিকে ধাবিত করল। কই রোশানের মনে পরে না তো তার অতীতে সে কোনো পাপের সাথে জড়িয়ে ছিল। এলাহী বাড়িতে নেহাৎ ভদ্রলোকদের বসবাস নয়। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ এক একটি রহস্যের জট। বছরের পর বছর ধরে এই জট তৈরি হয়ে আসছে। এই বাড়িতে ভালো মানুষ এলেও হৃদয় পাপে ছেয়ে যায়। তবুও কেউ একজন জীবনে আসবে, তাকে ভালোরাখার জন্য হলেও জীবনে ভালো থাকতে হবে এই ভেবে কখনও রোশান কোনো পাপেই জড়ায়নি। রাজনের নারীদোষ সেই কম বয়স থেকেই। দশম শ্রেনীতে উঠেই মেয়ে মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তবে ইন্টারে ওঠার পর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। তারপর সবটা নেশায় বদলে যায়। খারাপের এই দুনিয়ায় রোশান ভালো ছিল কিন্তু ভালোবাসা তাকে ভালো থাকতে দিল না। যেই জীবনসঙ্গীর জন্য পাপে জড়ায়নি সেই জীবনসঙ্গীই তাকে বাধ্য করেছে পাপের দুনিয়ায় যাওয়ার জন্য। তবুও আজও রোশানের এই মন অন্য নারী আকর্ষিত করতে পারে নি। এই চোখের সামনে যদি বিশ্বের সবচেয়ে অপরূপা নারীটিও উলঙ্গ হয়ে বসে থাকে তবুও রোশানের চোখ তার দিকে যাবে না। কারন মন জুড়ে যে মোহনা বিচরণ করছে। কি অশেষ ক্ষমতা সেই মহারানীর। তাকে ভুলার জন্যই তো রোশান নরকে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলেছে তবুও মন থেকে মুছতে পারে নি। তবুও রোশান পাপী। ভয়ানক রকমের পাপী। মোহনার বাচ্চা অনেক পছন্দ। এক কথায় বাচ্চার প্রতি তার বিশেষ ভালোবাসা রয়েছে বলা চলে। তাই তো মোহনা যতবার গর্ভবতী হয়েছে রোশান নিজ থেকে সেই বাচ্চা নষ্ট করে দিয়েছে। যদি রোশানের থেকে মোহনা সেই বাচ্চাকে বেশি ভালোবাসে? দেখতে দেখতে এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে মোহনার কোনো ভালোলাগার জিনিস রোশান সহ্য করতে পারত না। সে যাকেই ভালোবাসত তাকেই রোশান তার জীবন থেকে কেড়ে নিত। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এইসব করে সে মোহনার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আরো বেশি অযোগ্য হয়ে উঠেছে। তবে মোহনা সবচেয়ে বেশি যেই মানুষটিকে ভালোবাসত রোশান তাকে মারতে পারেনি। রোশান জানে ফারাজ তাকে পছন্দ করে না আবার অপছন্দও করে না। শৈশব জিনিসটা আসলেই সুন্দর। জীবনটা শৈশবেই ভালো ছিল। তবে হুট করে সব এলোমেলো হয়ে গেল একটা ঝড়েই। হায়রে ফারহাদ এলাহী তোমার তৈরি করা খেলার থেকে আজও এলাহী বাড়ির কেউ বের হতে পারল না।
–
এই রাতের বেলা চিত্রা পরপর চারটি কল করল ফারাজকে। রিং হয়েছে কিন্তু রিসিভ হয়নি। এই লোকের এমন হুটহাট বাইরে চলে যাওয়া,তাও রাতের বেলা আজকাল কেমন জানি লাগছে। এমন নয় যে চিত্রা সন্দেহ করছে কিন্তু তবুও। চিত্রা চুলে খোঁপা করে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। খিদে পেয়েছে তার। ওইযে আয়েশাকে বলল ঘনঘন খিদে পায়। আগে তো কোনোদিন এমন হয়নি? একগাদা খেলেও মনে হয় কিচ্ছু খায়নি। নিচতলায় জুনায়েদ এলাহীর রুম। ইদানীং জুনায়েদ এলাহীকে কোথায় দেখা যায় না। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে তাকালেই কোণে তার রুমটা। চিত্রা পাত্তা না দিয়ে ফ্রিজের যত খাবার আছে সব বের করে। একবারে এসব রুমে কিছুতেই নিতে পারবে না। চিত্রার রুমে মিনি ফ্রিজ আছে। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ফারাজের এটা খেতে মন চায় ওটা খেতে মন চায়। তবে তার আর কি খাওয়া? বিদেশি বাবুর ঘাস-লতাপাতা খাওয়া। এখন চিত্রা তো আর মুখের ওপর বলে দিতে পারে না,”ওমন বিদেশে কাটানো ভ্যাদা মানুষগুলো যা খায় আমাদের দেশে সেইসব অবলা ছাগলছানারা খায়।” চিত্রা পেটের সঙ্গে বাজিয়ে যতটুকু জিনিসপত্র নেওয়া যায় একবারে সবটা নিয়ে নেয়। বের হতে যাবে হুট করে কিছু একটার শব্দে থমকে যায় তার পা। মাঝরাতে এত বড় বাড়িতে সাহস দেখিয়ে রাতের বেলায় রুম থেকে সে বের হয়েছে। ওইদিন জমেলা বুড়ি বলেছে এই বাড়িতে নাকি ভূত আছে। ভূতকে সে বাগানের দোলনায় দেখেছে। পুরুষ ভূত। সে আবার লুঙ্গি পরে। জমেলা করুণ চোখে চিত্রাকে বলে,
“জানো মাইয়া, এমনিতে তো আমি মেলা সুন্দর মানুষ। আম্মায় কইছে আমি যখন তার পেটে ছিলাম তখন নাকি এক বয়স্ক মহিলা আম্মার পেট দেইখাই বুঝছে আমি পরির লাহান ঢকের হমু। ওই বুড়ি তো আমি পেটে থাকতেই তার ব্যাটার বউ বানাইতে চাইছে আমারে। তারপর আর কী! হইলাম আমি। হওয়ার পর থেকেই বিয়ার প্রস্তাব আর বিয়ার প্রস্তাব। শেষে আম্মায় আমার মুখে রোজ আলকাতরা মাখাইয়া রাখতো। যাতে কেউ পছন্দ না করে,বিরক্তও না করে। কিন্তু শাক দিয়া কি মাছ ডাকোন যায়? মানুষরে না হয় বোকা বানান যায় কিন্তু জিনেগোরে? জানো জিনের সর্দার আমার ওপর ৩৪৪ ধারায় ফিদা হইয়া গেছিল। তাও সব ছাইড়া কালুর বাপরেই বিয়া করলাম। বুঝোনা ভেরি মাচ লাভিং করি। কিন্তু ওইদিন রাতে বাগানে গিয়া বুঝতে পারলামরে চিত্রা, ওই জিনের সর্দার আমার ওপর এখনও মরি মরি যায়। রাতে একা পাইয়া আমারে ইজ্জর হরণ করতে আইছিল। এক্কেরে লুঙ্গি পাইরা ফিটফাট হইয়া আইছিল। দিছি লুঙ্গি ধইরা টান। খালি ইজ্জত বাঁচাইয়া দৌড়ের ওপর পোলাইছে।” বলেই জমেলা মিটিমিটি করে হাসল শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে। চিত্রা মেকি হেসে বলল, “সেই আলকাতরা মনে হয় এখনও দেন তাই না? মুখ দেখলেই বোঝা যায় কতবড় সৌন্দর্য এখনও লুকিয়ে রেখেছেন।”
“মাইয়ার ইউর মাথায় মার্কামারা বুদ্ধি দেহি। যাই হোক আসলে নটি বয়েরা ডুস্টাব করে তো তাই মুই আমার আসল সৌন্দর্য লুকাইয়া চলি। ইউ কিন্তু আমারে ইউর মতো কালা ভাইব না। সময় কইরা আইসো দুধের লাহান ধলা হওয়ার হারবাল দিমু নি। বুজাই না ব্যাডা মানুষ আবার কড়া জিনিস পছন্দ করে। নইলে সংসার টিকোন মুশকিল।”
চিত্রা কোনোমতে হাসি চেপে সেদিন কেটে পড়েছিল। কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে সেই ভূতের বিষয় এক্কেবারে সত্যি। চিত্রার কানে একটা শব্দ আসছে। কেমন শব্দ সে ধরতে পারছে না। হুট করে একটা মেয়েলি গলার চিৎকার কানে এলো। কেবল একটাই। তারপর আর নয়। কিন্তু ওই মেয়েলি গলা জুনায়েদ এলাহীর ঘর থেকে কেন আসল? চিত্রা খাবার সঙ্গে নিয়েই জুনায়েদ এলাহীর রুমের দিকে এগোতে যাবে তার আগেই হুট করে এক পলকেই কেউ একজন তার স্টারশিপের ম্যাংগো জুস নিতেই চিত্রা হুট করে বলে উঠল, “কোন ম্যাংগোরভাই আমার জুসের হাত দেয় সে।”
পাশ থেকে মৃদু হাসিতে কেউ একজন বলল,”ওয়াও সুন্দরী ভাবির মুখের গালিও দোয়ার মতো শুনতে লাগে। তবে গালি এত ঘুরিয়ে দেওয়ার কি আছে? দেশের কোনো আইন আছে নাকি? যে সহজ গালিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে? স্বাধীন মানুষ স্বাধীন ভাবে গালি দিবেন। যাতে আপনার গালি ওরফে দোয়া গুলো শুনে মানুষ হাঁটতে হাঁটতে স্বর্গে চলে যেতে পারে।”
চিত্রা এবার ভালো করে তাকিয়ে বলল,”আরে জোহান ভাই! আপনি? আমি আরো ভাবলাম কে না কে?”
“কেন অন্য কাউকে আশা করেছিলেন নাকি? কারো আসার কথা ছিল বুঝি?
চিত্রা আরো একবার জুনায়েদ এলাহীর রুমের দরজায় তাকায়। তারপর না ভেবেই জোহানকে বলে, “আমি রুমে গেলাম ভাই।”
“চলুন ভাবী আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি জাহান্নামে” মনে মনে কথাটা বলেও জোহান মুচকি হেসে বলল, ” এত জিনিস! একা পারবেন না। মে আই হেল্প ইউ মাই ডিয়ার ভাবী?”
চলবে?
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৫৫
#বর্ধিতাংশ
সুলেমান এলাহীর এমন মৃত্যুর পর অনেকদিন বাড়ি থমথমে ছিল। জুনায়েদ এলাহী তো তিন দিনের মতো কামরা থেকেই বের হয়নি। রোশান,জোহান,রাজনও ঠিকমতো কাজে যায়নি। বাড়ি কেমন যেন নিষ্প্রাণ
হয়ে উঠেছিল। যেই রুমানা ঘটা করে শাড়ি পরত,সারা অঙ্গ সোনার গয়নায় চকচক করত সে একেবারে বোবা একগুঁয়ে হয়ে গিয়েছিল। চিত্রার এখন শোক পালন করা একটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে । সে নিজেও সুলেমানের মৃত্যুর পর কেমন যেন চুপচাপ হয়ে পড়েছে। কারণ শত হলেও সুলেমানকে বাবার জায়গায় স্থান দিয়েছিল সে। বাবা হারানোর যন্ত্রণা সে জানে। ফারাজ কালো শার্ট পড়ে ব্লেজার কাঁধে ঝুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। কী একটা ভেবে রুমানার ঘরের সামনে উঁকি দিতেই দেখতে পেলো রুমানা কোলে রোশান মাথা রেখে শুয়ে আছে। রাজন মায়ের পাশে বসে আছে। অসহায় মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ফারাজের ভেতরটা জমে উঠল বরফের মতো। চোখের সামনে ভেসে উঠল কিছু স্মৃতি আর ভয়ানক কিছু মুহুর্ত। তারও কী মায়ের কাছে গিয়ে কোলো মাথা রেখে শোক পালন করা দরকার ছিল? তাহলে সে কেনো করছে না। ফারাজ দেয়ালে মৃদু একটা ঘুষি দেয়। তারপর বলে,”মায়েরা কত স্বর্থপর হয়। তাদের মনে কোনো মায়া দয়া নেই। থাকলে বুঝি মা তাকে এত কষ্ট দিতে পারত?তার মা আসলেই একটা ছলনাময়ী নারী। সে গোটা দুনিয়ার সঙ্গে নয় কেবল ফারাজের সঙ্গেই ছলনা করেছে।”
ফারাজ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সুলেমানকে মাটি দেওয়া হলো এলাহীদের পারিবারিক কবরস্থানে। বাড়ির সাথে যেই মসজিদ আছে ওইটা এলাহী জামে মসজিদ। তার পাশেই এলাহী কবরস্থান। সরকারি কোনো কবরস্থান নয়। পারিবারিক। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো সুলেমান এলাহীকে। এই সুলেমান এলাহী সারাটা জীবন পার করেছে টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে। জমিদার বাড়ির সম্পত্তির পেছনে। এইযে তার চেয়ারম্যানের পদ তাও তো টাকার বিনিময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে পেয়েছিল। তার চেয়েও বড় কথা কত নারীর সর্বনাশ করেছে, কত মায়ের বুক খালি করেছে এই লোক তার হিসেব রেখেছে? বুড়ো বয়সে এসে খায়েশ পূরণ করেছে। রুমানা এসব নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায়নি। কারণ সে জানে সুলেমান পরনারীর স্পর্শে গেলেও তাদের মধ্য থেকে কাউকে বিয়ে করবে না। বউ তো কেবল রুমানাই থাকবে। স্বামীকে সে অনেক ভালোবাসে। শুধুমাত্র সেই কারনেই কী স্বামী চরিত্রহীন হওয়ার পরেও স্বামীকে কখনও সে বাধা দেয়নি? কেবলই কী স্বামীকে হারানোর ভয়ে সকল স্বাধীনতা দিয়েছিল? এটার উত্তর সেই মহিলাই ভালো জানে। তবে ভুল তো একটা তারও ছিল। সারাজীবন গহনা,অলংকারের পিছনে না ছুটে একটু স্বামীকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা একবার করে দেখলেও হতো।
সুলেমান এলাহীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ,অভ্র আর বজ্র। কবর যিয়ারত শেষে ফারাজ বেশকিছুক্ষণ সেই কবরের দিকে চেয়ে রইলেন। সুলেমানের মৃত্যুর আজকে পাঁচদিন কেটে গেলো। কিন্তু পুলিশও পারল না সেই মৃত্যুর রহস্যভেদ করতে। এদিকে সবাই হয়তো মনে মনে ফারাজকেই সন্দেহ করছে। কিন্তু কারণ তো নেই? তবুও হয়তো তাকেই করা হয়েছে। কারণ এক ফারাজ ছাড়া তো বাড়ির সবাই একদলের মানুষ। আচ্ছা চিত্রার কখনও মনে প্রশ্ন জাগেনি যেখানে বাড়ির সব মানুষেরা দিনে বাড়ি থাকে আর ফারাজ কাজ ছাড়া সবসময়ই কিন্তু কেন?কাজ তো তারা একটাই করে সকলে। চিত্রার কথা আপাতত বাদ দেওয়া যাক কারন ওই আগুন সুন্দরীর মাথার বুদ্ধি পোকারা বেশ চালু। তাই তার সব বুদ্ধি খেয়ে ফেলেছে। তার চেয়েও বড় কথা চিত্রা ফারাজকে ভালোবাসে,বিশ্বাস করে। সেই থেকেই হয়তো সন্দেহ করা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন একটা রয়েই গেলো সুলেমানকে খুন করল কে? তাও বাড়ির ভেতর থেকেই? এর আগেও বাড়িতে তিনটা খুন হয়েছে। এর আগেও খুন হয়েছে তবে ওইগুলো যারা করিয়েছে এখন তাদের লোক কিংবা তাদেরই খুন করা হচ্ছে। খুনি ভেতরের কেউ কিন্তু তার উদ্দেশ্য কী? নিরুরও কেনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এত খোঁজার পরও। সুলেমান এলাহীকে মারা হয়েছে ওইযে বাগানের দুইজন কর্মীকে যেমন ভাবে মারা হয়েছে ঠিক তেমন ভাবেই। তারপর একই ভাবে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এর থেকে তো বোঝায় যায় খুনির খুন করার নিজস্ব একটা প্রক্রিয়া আছে। এই যে যেমন ফারাজ খুন করে কলিজা ভুনা খায়,রোজ খুন করা ব্যক্তির রক্তে গোসল করে তেমনই ওই খুনিও হয়তো এভাবেই মারতে ভালোবাসে। কিন্তু খুনি একটাও ক্লু রেখে যায়নি এটা মানা যায়? ফারাজের কেন জানি খুনিকে খোঁজার ইচ্ছে না। এসব ফালতু কাজ করার সময় নেই তার। এই সময়টা যদি বউকে দেওয়া যায় ঠিক মতো তাহলে এলাহী বাড়ি একেবারে বাচ্চায় গদোগদো করবে। তবে আর যাই হোক ওই খুনি একটা মাস্টারমাইন্ড। বাড়ির মানুষদের টার্গেট করলে হয়তো ফারাজ নিজেও তার লিস্টে আছে। এখন শুধু মুখোমুখি হওয়ার পালা। সমস্যা নেই ফারাজ তাকে খুঁজবে না, খুনি নিজেই তার কাছে আসবে। ফারাজ চলে যাওয়ার আগে সুলেমান এলাহীর আগের করবটা দেখে। একদলা থুথু কবরটায় ফেলতে গিয়েও বিবেকের খাতিরে ফেলে। বুঝতে হবে ফারাজ বদলে যাচ্ছে। বদলানো ফারাজ এসব কাজ করে না। ফারাজ আরেকবার ফারহাদ এলাহীর কবরের দিকে তাকায়। বলে,”জানিস তো অভ্র এই হারামির নাম মনে এলেও মনে হয় মরাকে উঠিয়ে আরেকবার মারি। বমি আসে। মাঝে মাঝে মনে চায় নিজের নামটাও বদলে ফেলি। কারন নাম তো এই কুল্লুর সঙ্গেই মিল খায়। তবে নামের পেছনে আরেকটা মানুষ ছিল বলে চুপ থাকি। খোদা যদি আমাকে বলত,”তোমার একটা ইচ্ছে বলো।” আমি বলতাম,”আমি বার বার ফরহাদ এলাহীর মৃত্যু যন্ত্রণা দেখতে চাই।”
–
গাছের নিচে বসে বন্ধুমহল মিলে গানের আড্ডায় ব্যস্ত জোহানের জাদুকরী গলা। ওই নিরুটা তাকে খালি খালি ক্ষেপানোর জন্য গলা নিয়ে কত কী বলে! তবে গলা কিন্তু ফারাজেরও ভালো। ফারাজ ভাই যে কেনো গান ছেড়ে দিল? আসলে মানুষের জীবন এইরকম। প্রতিটি মানুষের একটা গোপনসত্তা থাকে। যা মানুষ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে,লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। জোহান কী সেইসবের বাহিরে?চ্যাক শার্ট পড়া শ্যামবর্নের একটা বখাটে পুরুষ সে। চুলগুলো তার এলোমেলো। কেমন যেন রুক্ষ। চ্যাক শার্ট আর জিনস প্যান্টে দারুণ লাগছে। শক্তপোক্ত শরীর তবে সুপ্ত পেশীবহুল। এখন যদিও মানুষ টুকরো টুকরো করতে করতে লম্বাচওড়া পেশী হচ্ছে। জোহানের বাহুগুলি দীঘল, কনুইয়ের কাছে হালকা কুঞ্চন। পিঠের রেখা সোজা, মেরুদণ্ডে দীপ্তি। তবে সবচেয়ে চমৎকার তার মুখের হাসি। একটা সানগ্লাস ঝড় হোক কিংবা বৃষ্টি সবসময়ই তার কাছে থাকে। জোহান সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেরে বন্ধু হৃদয়কে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল। তারপর প্রিয় গিটারটা কোলে তুলে টুংটাং বাজানো শুরু করল। গিটারের সুরের সঙ্গে সে তাল মিলিয়ে বলল,” সেই নারী কেবল জাদুকরী ছিল না বরং সে আমার মনও ছিল। আজ কতদিন হলো আমার মনটা আমার ভিতরে নেই। মায়াবতী লাবণ্যময় কোনো এক মেঘময়ূরী আমার মনকে দেহ থেকে ছিঁড়েখুড়ে বের করে হারিয়ে গিয়েছে নাম জানা পথের মোড়ে। তাকে এখন কী করে বোঝাই মন ছাড়া যে সত্যি বাঁচা যায় না?” জোহান এবার তাল মিলিয়ে গান ধরল,
~মন বলি তুই ফিরে চা
মন ছাড়া কি যায়রে বাঁচা?
তুই ছাড়া কে আর আছে এ জীবনে?
কি কারণ অকারণ
এত করিস জ্বালাতন?
ভাল লাগে না এ দোটানা
উচাটন সারাক্ষণ
বলনা, তুই বলনা, কেন এ ছলনা?
ও মন তুই বলনা ভালবাসি বলনা
বলনা, তুই বলনা, ভুলে গিয়ে ছলনা
একবার শুধু বলনা, ভালবাসি বলনা~
গান শেষে জোহান আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস ছাড়ল। কত কী মনে পড়ল। লাবণ্যের মৃত্যুর পর জোহান দুইটা বছর চিকিৎসায় ছিল। পাগলের থেকেও জঘন্য অবস্থা হয়েছিল তার। এই যে সবার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে,”জোহান বাছাই করে কেন চিত্রাকেই মারার বুদ্ধি করে সবসময়? আসলে চিত্রা নয় জোহান সেই সকল নারীকেই হত্যা করেছে যাদের সঙ্গে তাদের জীবন সঙ্গীর একটা দারুন সম্পর্ক ছিল। কারন এই বেশি ভালোবাসা নারীগুলোই হয় ছলনাময়ী একসময়। লাবণ্য নামক মেয়েটির সঙ্গে সেই ছোট্ট থেকে সম্পর্ক ছিল জোহানের। একসঙ্গে তারা বড় হয়েছে। প্রতিবেশীর মেয়ে ছিল। লাবণ্য সিগারেট খোর ছেলে পছন্দ করত না। জোহান সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। লাবণ্য পড়ুয়া ছেলে পছন্দ করত জোহান পড়ায় মন দিল। লাবণ্য বৃষ্টিবিলাস পছন্দ করত। জোহান সেই বৃষ্টিবিলাসের সঙ্গী হয়ে গেলো। তবুও কিছুই টিকল না। ভালোবাসার মোহে অন্ধ করে লাবণ্য অন্য কারো হাত ধরে অন্যের বাসরে লালটুকটুকে বউ সেজে বসল। এদিকে এত ভালোবাসার পরেও জোহান চোখের সামনে সব শেষ হতে দেখেছে।
লাবণ্য চলে যাওয়ার পর টানা বছর দুই জোহান পাগল বনে রয়। ড্রাগসের নেশায় পড়ে যায়। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরতে সময় লেগেছে। তবুও আজও পারে নি ওই ছলনাময়ী নারীকে ভুলতে। এখনও দুঃস্বপ্ন হয়ে সে বার বার জোহানের স্মৃতির কল্পলোকে আতঙ্ক হয়ে ফিরে আসে। কিছু খারাপ স্মৃতি কিছু খারাপ মানুষেরও থাকে। পৃথিবীর কেবল ভালো মানুষগুলোর কষ্ট দেখতে পায়,খারাপদের খারাপ হওয়ার নয়।
–
বজ্রকে আজ-কাল পাওয়া যায় না। কোনো মেয়ের চক্করে পরল নাকি? আবার ব্যস্ত থাকারই তো কথা। শত হলেও তো ডাক্তার মানুষ। জোর বেচারার কাটাছেঁড়া করে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে হয়। একটা বউ থাকলে ন হয় হাত-পাগুলো টিপে দিলো। চুলে হাত বুলিয়ে মাথাও মালিশ করে দিত। মানুষ কী এমনে এমনে বিয়ে করে নাকি? বিয়ের একটা বেনিফিট আছে না? এই যে বউ কিছু দেবে,বিপরীতে স্বামী কিছু দেবে। আবার সে দেবে, তারপর আবার বিপরীত পক্ষ। এই যে যারা বয়স হওয়ার পরেও বিয়ে করে না তাদেরকে পৃথিবী সবচেয়ে বেকার আর অকর্ম্য কীট হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। ওরা দুনিয়ায় থেকে অযথা অক্সিজেন নষ্ট করে কার্বডাইঅক্সাইডের সাপ্লাই দিচ্ছে। ওরা দেশের শত্রু,দশের শত্রু। মন তো চায় অবিবাহিত পোলাপান ধরেই তিন কবুলে বিয়ে পড়িয়ে দিতে। ছোটলোক গুলার জন্য পৃথিবীতে অক্সিজেন সংকট শুরু হচ্ছে। তারপর একদিন সব শেষ হয়ে গেলে কোথায় গিয়ে উঠবে? মঙ্গলগ্রহে? চিত্রা ফারাজের জন্য স্পেশাল লেমনেড নিয়ে স্টাডি রুমে হাজির হয়। ফারাজ গ্লাসের দিকে তাকিয়ে হালকা ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা কি তোমার সেই বিখ্যাত লেমনেড?”
“কেন দেখে কী ভিমের শরবত মনে হচ্ছে?”
“না মানে… আচ্ছা, দেখি কেমন বানিয়েছো।”
এই বলে ফারাজ এক ঢোঁকে পুরো গ্লাস খালি করে ফেলল। তারপর চশমা সামান্য নাকের ওপর টেনে তুলে বলল, “না টেস্ট আছে। তবে লেবু চিপে লবণ-চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে এত দামি ক্যাটাগরির নাম না দিলেও চলত।”
চিত্রা চোখ রাঙিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ফারাজ হেসে ওকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নেয়। তারপর আদুরে কণ্ঠে বলে, “বাপরে ভারী আছো তো দেখছি? এই বউ ওজন বাড়ছে দেখি তোমার। আগের থেকে সুন্দরও হয়ে গিয়েছো।”
চিত্রা একটু লাজুক হাসি দিয়ে ফারাজের কপালে চুমু দিতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ করেই সেই অপ্রতিরোধ্য জমেলা বুড়ি ঘরে ঢুকে পড়ে। বয়স্ক গলায় চিরাচরিত দেমাগে বলে ওঠে, “স্বামীর পানি গায়ে পড়লে মাইয়া হগ্গল সব চকচকা হইয়া যায়। মোটা হইয়া যায়। আমার বিয়ার পর তো আমি গন্ডারের মতো মোটা হইয়া গেছিলাম । একদিন তো কালুর বাপের ওপর পইড়া ব্যাডার পাছার হাড় ভাইঙ্গা ফেলছি। পরে কত ঝাড়ফুঁক কইরা, তেল মালিশ কইরা ঠিক করতে হইছে।”
বুড়ি কথা শেষ করার আগেই তীব্র প্রতিবাদী স্বরে ফারাজ বলল, “কেন স্বামী কী ওয়াসা নাকি? পানি সাপ্লায়ার ? পানি দেয়? জল-জ্যান্ত পুরুষ মানুষটাকে পানির টাঙ্কি বানিয়ে ফেলা? মশকরা করার জায়গা পাও না বুড়ি? তীব্র নিন্দা জানাই। অভিশাপ দিলাম তোমার বুড়োর টাঙ্কির তলানি ফুটো হয়ে যাক।”
ফারাজ তেড়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তবে তার আগেই চিত্রা জমেলাকে জলদি জীবন বাঁচাতে চাইলে রুম থেকে পালাতে বলে। এদিকে ফারাজের মুখটা আঙুল দিয়ে চেপে ধরে বলে, “থামেন তো। আসছে আমার টাঙ্কি উপদেষ্টা।”
জমেলা জলদি রুম থেকে বের হয়ে বুকে থু দিয়ে বলে,”এই ছ্যামড়ার লগে শয়তানের আছড় আছে। মুই সুন্দরী বইলা নিশ্চিত পটানোর জন্য এত কিছু কইছে। কারণ ব্যাডা মাইনষের ছ্যাচড়া কথার পশ্চাৎদেশেই ভালুপাছা লুকাইয়া থাহে।”
তবে জমেলার একটা পাল্টা প্রতিবাধ না করলেই নয়। ওই হেন্ডু কেজি ফেইল পোলারে কে বুঝাবে জামাইয়ের পানি হইল তার যত্ন,ভালোবাসা। ব্যাডা মানুষের যত্ন বউয়ের গায়ে পড়লে ভালোবাসা বাড়ে। মাইয়া মানুষ যত সুখী, তত সুন্দর। আর দেখো দেখি ওই ব্যাডা ইতর তার কালুর বাপের টাঙ্কির তলানিতে চইলা গেলো! দিচ ইচ ভেরি বিগ ইনচাল্ট।
জমেলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই জোহানের সামনে এসে দাঁড়াল। জোহান তখন অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ভাবছিল চিত্রার কথা। কী সুন্দর করে আবদার করেছিল সাহায্য করার। কিন্তু রাতে চিত্রা কি করল? দিলেই না তাকে সাহায্য করতে। ওই আল্লাহর বান্দি আরেক জাউরা। শয়তানের প্রাক্তন একটা। নাদানের মতো সবগুলো খাবার একা হাতে করেই রুমের দরজা লাগিয়ে দিল। একটু তো বলা উচিত ছিল, “জোহান ভাই আপনি খাবেন কিছু?” যাও জুসটা নিয়েছিল কেড়ে তাও নিয়ে গেল। ঢং করে কাঁদো কাঁদো করে বলল, “জোহান ভাই আমি ওই জুস ছাড়া কিচ্ছু খেতে পারি না।” যত্তসব ঢং। সকালে খেতো মরিচ পান্তা আর এখন হাতির পাঁচ পা দেখে বলে, “ওইসব পা দিয়ে মিষ্টিকুমড়ো চটকে বানানো জুস ছাড়া সে খেতে পারে না।” কত সস্তা নাটক আর দেখতে হবে। এই মেয়ের নাটক তো রাজুদার পকেট পরোটার থেকেও সস্তা। মন তো চেয়েছিল রাতেই ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ধুমধাড়াক্কা ঘাটে ফেলে দিতে। খালি ওর জামাইটা মুখের বদলে বন্দুক চালানো কলম্বিয়ার আস্ত খুনি লুইস গারাভিটো দেখে সময় নিচ্ছে। কিন্তু জোহান যাকে ধরে তার গায়ে একেবারে ঝোঁকের মতো লেগে যায়। এই ঝোঁক তিমির দুধ দিয়ে বানানো লবণ দিয়েও গা থেকে ছাড়ানো সম্ভব নয়।
জোহানকে দেখেই জমেলা তার দিকে এগিয়ে এসে কোমরের কাছ থেকে একটা স্মার্ট ফোন বের করল।
অনেক বলে কয়ে আয়েশার কাছ থেকে চেয়ে ফোনটা পেয়েছে। কিনে দিয়েছে লাল-কালা অভ্রনীল,দেখলে দিতে মন চায় পিরিতের কিল। তবে জমেলা ফোনের আগামাথা বুঝতে পারছে না। একটা ঝাকানাকা ডিলকানা গানে কোমর দুলিয়ে,শাড়ি উঁচুতে উঠিয়ে একটা ভিডিও বানাবে তা আর কই হচ্ছে? চিত্রার কাছে গিয়েছিল ফারাজ হেন্ডু বয় তো বেরই করে দিল। জোহানের থেকেই না হয় সাহায্য নেওয়া যাক। জমেলা এসে জোহানকে বলল,
“এই পোলা ইউর আব্বা হুয়ার ইজ গুয়িং?”
“আপনার নানির বাড়ি।”
“ইউর আব্বুার রুচি ইজ ডিচকাচটিং। এহন হুনো, আমার ফোনের ক্যামেরাডা দেহো দেখি কোনখানে। একটা গানও লাগাইয়া দিও। ওইযে আঁকিস বিড়ি খাইয়া বুড়া খু্ক্কুর খুক্কুর কাশে। আমায় রাইখা অন্য মেয়ে কেন ভালোবাসে? ওইগানটা লাগাইয়া দিও।”।
“আপনার নাতনি আর তার জামাইয়ের কাছে যান না?” মনে মনে জোহান কয়েকশোটা গালি দিয়ে বলল,”এই হচ্ছে আরেক ভ্যাড়াভাঙা আসমান ফুটো ঝোলার বুড়ি। বুদ্ধি খাঁটিয়ে কুল্লু রিচবাবার থেকে চিনি পড়া এনে অভ্রটাকে খাইয়ে নাতনির জামাই বানিয়েছে। ছিল চাকরানি হয়ে গেলো মহারানি।”
“আয়েশার কাছে গেছিলাম। ওরা তো লাজ শরমের আগামাথা মুলার শরবত বানাইয়া গিলছে। এই জমানার জর্ডান থেকে আসা মর্ডান পোলাপান। দিনের বেলাও দরজা লাগাইয়া রুমের মধ্যে বইসা থাকে। আমাগো আমলে তো আমরা সোয়ামির চোখের দিকও তাকাইতাম না লজ্জায়। কী লজ্জা কী লজ্জা।”
“ওহ আর ১৫-২০ টা বাচ্চা বুঝি ইরাশায় পয়দা করতেন?”
জমেলা বুড়ি অতি শরমে ক্ষেপে গিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললেন,” নু নিড ইউর হেলেপ। ননচেন্চ ইস্টুপিট বয়। ডেডবাই।”
–
সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ফারাজ চিত্রাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে ছিল। চিত্রার যে কত শান্তি শান্তি লাগছিল কী করে বুঝাবে সে কথা? তবে জরুরি কল আসতেই ফারাজকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হয়। চিত্রা যদিও এসব নিয়ে অভিমান করে না। তবে আজকাল তার অভিমানের পাল্লা একটু একটু করে ভরতে শুরু করেছে। এই হুটহাট বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টা কেমন যেন লাগছে। তার ওপর ইদানীং কার সঙ্গে যেন ফারাজ ফোনে তাড়াহুড়োয় কথা শেষ করে। তাড়াহুড়োটা চিত্রাকে দেখলেই বেঁধে যায়। মাথাটা কাজ করছে না। কিছু তো একটা জট বেঁধেছে। তবে কোথায় আর কে বেঁধেছে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।
আশ্রমে বৃদ্ধ মানুষের সমাগম। তাদের জন্য ফারাজ আজকে অনেক উপহার নিয়ে এসেছে। নতুন শাড়ি এনেছে সকলের জন্য। রোজ আর অভ্র ফারাজের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজ আশ্রমের ১১০ নাম্বার কক্ষের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। রোজ দরজা খুলতে গেলেই ফারাজ ইশারায় তাকে নিষেধ করে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। ভিতরে তার মণি আছে। মণি চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়েছিল। ফারাজ আসতেই সে টের পেল। হেসে বলল, “ফারাজ এলাহী তবে এলো।”
ফারাজ মণির পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, “না এসে উপায় কোথায় বড় বউ? শুনেছি খাওয়া-দাওয়া করো না ঠিক মতো?”
মণি হালকা হাসে। চোখে একরাশ অভিমান।”সোয়ামি দেখা করতে আসে না। বউ কেমন করে খাবে বলো?”
ফারাজ কপাল ভাঁজ করে।”মজা করছি না। ডাক্তার বলেছে তোমাকে এইসময় ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে।”
মণি একটু থেমে গলা নিচু করে বলল,”তোমার বউকে নিয়ে আসো। মরার আগে তো দেখে যাই।”
ফারাজের চোখ ছলছল করে ওঠে। কণ্ঠ কঠিন হয়। “কোনোদিন ওইসব ফালতু কথা বলবে না। কেন মরবে তুমি? তোমার অধিকার নেই সব বাঁধন ভুলে আমাকে একা করে চলে যাওয়ার।”
মণি হালকা মাথা নাড়ায়।”তোমার তো বউ আছে। ভালো মেয়ে। দেখবে তোমরা হবে রাজযোটক।”
ফারাজ মিনমিন করে বলে, “কিন্তু আমার যে আর মণিও নেই।”
এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা নামে। মণি জানালার দিকে তাকাল। তার সাদা-পাকা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। মণি সেথায় তাকিয়েই বলল,”চিত্রাকে তোমার অতীত শীগ্রই জানিয়ে দিও। আর কতকাল মিথ্যার বাঁধনে আঁটকে থাকবে? তবে ফারাজ ভালোবাসা অন্যায় নয় কিন্তু ভুল মানুষকে ভালোবাসা অন্যায়। নিজের রক্তের সঙ্গে, অতীতের সঙ্গে তুমি কী করছো ভেবে দেখো একবার। আর চিত্রাকে এভাবে ধোঁকা দিও না। আগে হলেও সে কষ্ট পাবে পরে হলেও পাবে। তাই আগের কষ্ট আগেই দিয়ে দাও না হয়, যন্ত্রণা বাড়ার আগে।”
ফারাজ চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মণির কপালে চুমু দিয়ে চিন্তার ভাবনায় আবারও ডুবে যায়। চিত্রাকে একদিন ফারাজ তার মণির সঙ্গে দেখা করাবে। তবে আগে চিত্রাকে সবকিছু খুলে বলতে হবে। ফারাজের অতীতের অংশ কী চিত্রা হতে পারবে? নার্সের সঙ্গে কথা বলে বাহিরে আসতেই রোজ ফারাজকে বলল, “বস আমার সঙ্গে আসুন।”
“শালী বস আমি না তুই?”
“একজন হলেই হলো। না আসলে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাবো। আমার অনেক শক্তি। জিম করি আমি।”
“বাল করো। সারাদিন ফাস্টফুড খেয়ে অন্ততপক্ষে জিম হয় না আমার মা। জিম শব্দটাকে নিজের সঙ্গে জরিয়ে আর ধর্ষন করিস না বেডি।”
রোজ পাত্তা দেয় না। ফারাজ তার সঙ্গে হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার সেই মুহূর্তে তারা উপস্থিত হয় আশ্রমের কবরস্থানে। ফারাজ এক মুহূর্তের জন্য কোনো প্রকার নাম-চিহ্ন ছাড়া কবরটার দিকে তাকিয়ে থমকে যায়।
রোজ বলে,
“বহুদিন তার সঙ্গে দেখা করেন না। মানুষটি আপনার সঙ্গে অভিমান করেছে।”
“আমার সঙ্গে? একুশ বছর আমাদের সাক্ষাৎ নেই, আর তুমি বলছো সে অভিমান করেছে? হাসি পাচ্ছে।”
“কবরে শুয়ে থাকা মানুষটি সুখে নেই, বস। তাকে সুখী করার জন্য এত কিছু করেছেন। শেষ কাজটা এবার তো করুন। আপনার অনেক ভালোবাসা হয়েছে। আপনি চিত্রাকে বলে দিন, তাকে মারতে আপনার বাংলাদেশে আসা। আপনি চিত্রাকে প্রথম দেখায় ভালোই বাসেননি। ওইটা খেলার শুরু ছিল। বলে দিন, বস। ওকে মেরে ফেলুন। রক্তের সঙ্গে সত্যি আপনি বেইমানি করছেন। কবরে শুয়ে থাকা মানুষটিকে এবার একটু সুখ দিন। চিত্রাকে মারলে এই প্রতিশোধ, এই গল্প এখানেই শেষ হয়ে যাবে।
প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। এটাই দুনিয়ার নীতি।”
ফারাজের এক মুহূর্তে অতীত তীব্র ভাবে ধাক্কা দিলো। আগুনে ঝলসে যাওয়া রাত। লাশের সামনে বসে কারো আর্তনাদ সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভেসে উঠল আরেকটি হারিয়ে যাওয়া মুখ। যার জন্য এত কিছু করা। আসলেই তো কী করছে ফারাজ? এই জীবনে যত না পাপ করেছে তার চেয়ে অধিক করেছে এলাহী বাড়ির ছেলে হয়ে তালুকদারের বদ রক্ত থেকে জন্ম নেওয়া সরুপা চিত্রার প্রেমে পড়া। ফারাজ চাইলেই প্রথম রাতেই চিত্রাকে মেরে ফেলতে পারত। বিয়েও করার কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু ওই যে দিয়ে কেড়ে নেওয়ার মজাই কিছুটা অন্যরকম। চিত্রাই তার জীবনের এমন মেয়ে ছিল যাকে দেখে ফারাজ চুম্বকের মতো আকর্ষিত হয়েছে। কাছে আসবে না বলেও চলে এসেছে। তবুও কতবার নিজের আবেগকে শান্ত করে চিত্রাকে খুন করার চেষ্টা করেছে ফারাজ তা কী সে জানে? সেই দিনের কথা কী চিত্রার মনে আছে? যেদিন প্রথম ফারাজ চিত্রাকে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল? ফুচকা খাওয়ার সময় চোখের সামনে ওই বাচ্চাটা মারা গেল? সেদিন হুট করে ওই গুলিটা না আসলে চিত্রাও জ্ঞান হারাত না আর ফারাজের প্ল্যানও সফল হতো। ফারাজ ওইদিন ওই লোককে খুঁজে শুধুমাত্র এই কারণেই তার কলিজা বের করে এনেছিল কারণ ওর জন্য ফারাজের সব সাজানো পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারপর ছাদ থেকে সেদিন চিত্রাকে ফেলে দিতে গিয়েও কেন জানি পারল না। বিষাক্ত ড্রাগস হাতে নিয়েও কেন জানি সামান্য একটুখানি স্লিপিং ড্রাগস দিয়েছিল রাতে চিত্রাকে সে। প্রায় রাতেই শুরুর দিকে ড্রাগস দেওয়া হয়েছিল চিত্রাকে। ভেবেছিল একটু একটু করে কাজ করবে। তারপর কী একটা ভেবে তাও বন্ধ করে দিল ফারাজ। কারণ ওই যে চিত্রার প্রতি ভালোবাসা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছিল। তবুও শেষবার চিত্রার জন্য ফারাজ যেই ডেজার্ট বানিয়ে ফ্রিজে রেখেছিল, ওইটাতেও বিষ মেশানো ছিল। আয়েশা সেদিন হুট করে ডেজার্ট ফেলে না দিলে কবেই সব শেষ হয়ে যেত। কিন্তু কিছুই হলো না। তবে ফারাজের ওইসব কথা কেন মনে পড়ছে এখন? কেন? ফারাজ ওইসব ভুলতে চায়। চিত্রা যদি এসব কখনও জানতে পারে তাহলে কী হবে? অন্তত এখন তো সে চিত্রাকে ভালোবাসে।
“বস, আপনি হারিয়ে যাচ্ছেন কোন খোয়াবে? জাগুন। জেগে উঠে আপনি এইবার সব শেষ করবেন, নয়তো আমি।”
রোজ ফারাজের হাতে পিস্তল তুলে দেয়। “যদি একুশ বছর আগের সেই প্রতিশোধ দিতে চান, তাহলে মেরে ফেলুন। বিশ্বাস করুন, একবার সে মরলে আপনার জীবন আগের মতো সুন্দর হয়ে যাবে। যার জন্য এত কিছু করা, সেও ওপারে সুখে রবে।”
ফারাজ একবার কবরের দিকে তাকায়। চোখের সামনে আবারও ভেসে ওঠে সেই অতীতের প্রতিটি মুহূর্ত। সে একটা ঢোক গিলে। তার কণ্ঠনলি উপর-নিচ ওঠানামা করে। সে রোজের হাত থেকে পিস্তল নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরোনো জিদে ফিরে যায়। সে এই জায়গায় এই জন্যই আসতে চায়নি। চিত্রাকে ভালোবাসার পর এই কবরের সামনে এই কারণেই আসতে চায়নি, কারণ এখানে আসলে সব গোলমেলে যাবে। হারানো চেতনা আগুনের মতো জ্বলে উঠবে।
ফারাজ কাঁপা চোখে একবার পিস্তলের দিকে তাকায় তারপর পুনরায় কবরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলে উঠল, “তোমার বুকে ট্রিগার প্রেস করতে আমার সবচেয়ে কষ্ট হবে, আগুন সুন্দরী।”
চলবে?