#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#প্রথমাংশ
‘নাহিয়ান মানে?’
নাহিয়ান চিত্রার পাশে চেয়ার টেনে বসল। কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে একটা জায়গা। নাহিয়ান বলল, ‘ভাবী আমি আসলেই কোনো নিহান শেখ নই। আমি স্পেশাল ফোর্সের ইন্টেলিজেন্স অফিসার নাহিয়ান খান। খান বংশের ছেলে।’
চিত্রার কাছে সব কিছু ধোঁয়াশা লাগছে। নিহান ভাই কি পাগল হয়ে গেল নাকি? চিত্রা এবার এক ঘন্টার মতো নাহিয়ানের বলা প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল। নাহিয়ান খান বাড়ির ছেলে। সেই বাড়ির বড় ছেলে মাহিয়ান খান। বাবা মনিরুল খান। দুইভাই যখন ছোট ছিল তখন বাবার ব্যবসা ধ্বসে পড়ে। অনেক ঋণ জমা হচ্ছিল। উপায় না পেয়ে এলাহীর সবচেয়ে বড় পাপী,নোংরা, আর জঘন্য মানুষটির কাছ থেকে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে টাকা সুদ হিসেবে নেয়। দিনকাল ভালোই চলছিল তবে মাঝে বাবাকে অনেক চিন্তিত দেখাতো। একদিন লোকজন নিয়ে ফরহাদ এলাহী বাড়িতে হাজির হন। মেয়াদ শেষ হবার পরও বাবা তাকে টাকা পরিশোধ করতে পারছিলেন না। আসলে যারা একবার ঋণগ্রস্ত হয় তাঁদের মাথা থেকে ঋণ আর সহজে নামে না। দিনকে দিন তা বেড়েই চলে। সেইরাতে বাবাকে চোখের সামনে হত্যা করা হয়। মাকে চোখের সামনে ধর্ষণ হতে দেখে দু’ভাই। কিন্তু ঘটনাক্রমে খান বাড়ির কাজের লোক নজরুল কাকা নিজের জীবন বাজি লাগিয়ে দুই ভাইকে বাঁচায়। তাদেরকে তাদের মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মামারা সপরিবারে আমেরিকায় থাকতেন। অনেকটা কষ্টেই বেড়ে ওঠা দুই ভাইয়ের। এমন না যে মামা-মামী তাদেরকে ভালোবাসতেন না। তাদেরককে অত্যাচার করতেন। অভাব তাদের। খুব ভালো পরিবেশেই বেড়ে ওঠে। তবে ওই যে চোখের সামনে একটা বড় রকমের ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার রেশ কখনো কাটেনি। নাহিয়ান বাবা-মায়ের বিষয়ে কখনো কথা বলেনি। তবে মাহিয়ান সবসময় বলত সে বড় হয়ে দেশে ফিরে প্রতিশোধ নিবে। তবে দেশে ফেরার পর জানতে পারল ফরহাদ এলাহী নাকি মারা গিয়েছে। কে মেরেছে জানা নেই। তবে নিজের ছেলের হাতেই খুন হয়েছে। সেই ঘটনা জানার পর আস্তে আস্তে মাহিয়ান কেমন যেন হয়ে যায়। আসলে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরই তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। আবোল-তাবোল কথা বলত সারাক্ষণ। রাতে ঘুমের মধ্যে কথা বলত, কেঁদে উঠত। ফরহাদ এলাহীর কাছ থেকে বাবা-মায়ের প্রতিশোধ নিতে পারবে না এই ভেবে আরোও ভেঙে পড়ে। এক পর্যায়ে মানসিক চাপে পাগল হয়ে ঘরবন্দী হয়। মাহিয়ান আজও বেঁচে আছে। তবে এটাকে বেঁচে থাকা বলে না। নাহিয়ান সেই ক্ষোভেই আরও মন দিয়ে পড়াশোনা করে। ইন্টেলিজেন্স অফিসার হয়। দেশে আসে কেবল এই বাড়িতে ঢুকে সকলের জীবন জাহান্নাম বানাতে। তবে মাঝে ওইযে ভালোবাসা? ওই ভালোবাসার ফাঁদে পড়েই তো কিছুই করা হয়নি। নাহিয়ানের কাছে এখন সবার সবকিছুর প্রমাণ আছে। চাইলেই সবাইকে ধরিয়ে দিতে পারে। তবে এখন আর প্রয়োজন নেই। কারণ সকলে নিজ নিজ হাতে তাদের ধ্বংস লিখেছে। এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল এখন তাদের মৃত্যুর প্রহর গুনছে। নিজস্ব প্রতিশোধ নিতে এসেছিল অবশ্য নাহিয়ান ,তার ক্ষমতাও ছিল সবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। নিজের জানের পরোয়া করে না সে। তবে তার কিছু হয়ে গেলে ফারিয়ার কি হবে? এই জাহান্নামে ফারিয়াকে ফেলে তো মরতে পারে না। কেবল ফারিয়া চায় বলেই নাহিয়ান জলদি তাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে। মেয়েটাকে আর অসুস্থ জীবনে রাখতে পারবে না সে। কোনো মারামারি নেই,ঝামেলা নেই এমন একটা জায়গায় তাদের সংসার হবে। তবে বাকিরা নাহিয়ান খানকে না চিনলেও ফারিয়া চেনে। তাইতো প্রতি মুহূর্তে তার নাহিয়ানকে নিয়ে ভয় হয়। যদি ভাইয়েরা সব জেনে যায়? তখন তো তারা নাহিয়ানকে মেরে ফেলবে। কেবল এই একটা ভয়ে সে রোজ পুড়ছে, মরছে আবার জন্মাচ্ছে। চিত্রা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘সুলেমান এলাহীকে কে হত্যা করেছে জানেন?’
নাহিয়ান চিত্রার দিকে ভালো করে তাকায়। একটু মুচকি হেসে বলে, ‘জানব না কেন? আপনি শুনতে চান ভাবী? মজার বিষয় বলি? এলাহী বাড়িতে আগেও অনেক খুন হয়েছে। একটা সময় পর সব কমে এসেছে। তবে আপনি আসার পর আবার খুন শুরু হয়েছে। রহস্যময় নয় কি?’
চিত্রা একটা ঢোক গিলল। নাহিয়ান পুনরায় বলল,’ভাবী আপনি আর আমি এক জলের মাছ। তবে সাবধান। আমাদের ধরার জন্য কিন্তু অনেক জাল ফেলা হয়েছে। জাল থেকে বাঁচতে না পারলে শিকারির শিকার হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
চিত্রা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরল। তার শরীর এখনো থরথর করে কাঁপছে। কিসব শুনেছে সে? আসলেই কি সব সত্য? এলাহী বাড়ির মানুষগুলো আসলেই এত জঘন্য? এখন সব কেমন যেন লাগছে। এত খুন,রাত করে মাটি খুঁড়া, নোংরা পট্টিতে বাড়ির পুরুষদের আনাগোনা সবই তবে সত্য ছিল? চোখের দেখা সেইসব মিথ্যা নয়? তাহলে ফারাজ? রাত করে তার বাড়ির বাইরে যাওয়া। ভোরে ফেরা সেইসবও কি এমনি এমনি ছিল না? আচ্ছা ফারাজও কি তবে নারীদের এত জঘন্য ভাবে নিপীড়ন করে? তাদের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়? পাপের টাকায় জীবন চালায়? মিথ্যার পাহাড় জমিয়ে চিত্রার সঙ্গে সংসার করছে? এটা কি সংসার? মাথা কাজ করছে না চিত্রার। ফারাজ পাপিষ্ঠ হলে তো চিত্রাকে কখনোই এত ভালোবাসত না। আচ্ছা সব কিছু কোনো নাটক ছিল না তো? নাটক হলে চিত্রাকে বিয়ে করেছে কেন ফারাজ? চিত্রা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। বুঝতে পারছে না কি করবে। তবে মনে মনে এতটুকুই চাওয়া ফারাজ যেন এসবে না জড়ায়। চিত্রা ফারাজের জন্য সব করতে পারবে,কিন্তু ফারাজের ছলনা সহ্য করতে পারবে না। যদি পাপ করেও থাকে সে যেন খোদার কাছে ক্ষমা চেয়ে সব কিছু থেকে ফিরে আসে। চিত্রা ফারাজকে হারাতে চায় না। তারা বিদেশ চলে যাবে কিংবা অনেক দূরে কোথাও। তবুও…. তবুও যেন ফারাজ সব ছেড়ে দেয়। চিত্রার নিহানের কথা মনে পড়ল। উঁহুঁ নিহান বললেও ভুল হবে। নাহিয়ান খান। তার গোটা নাম থেকে শুরু করে বংশের পদবীও অদলবদল। এই এলাহী বাড়িতে তার প্রবেশ করা সবই ছিল পরিকল্পিত। তবে নাহিয়ান খান বাড়ির সকলের কথা বললেও ফারাজ এলাহীর কথা কিছুই বলেনি। আর না ওই ফরহাদ এলাহীর কথা। সময় হলে নাকি সেইসব চিত্রা নিজেই জানতে পারবে। তবে এবার চিত্রার ভয় হচ্ছে। বাড়ির মানুষগুলো খারাপ সেই জন্য নয়। বরং নাহিয়ান ইন্টেলিজেন্স অফিসার সেই ভেবে। এর মানে সে আরও অনেকের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে।
ফারাজ বাসায় এসে সরাসরি গোসলে যায়। চিত্রা ফারাজের ফোনের সামনে বসে আছে। ফোনটা খুলে ভেতরে কি আছে দেখা হয়নি কখনো। তবে আজ ইচ্ছে করছে। ফারাজ রুমে আসতেই চিত্রাকে বলল,’তোমার পাসপোর্ট কিন্তু চলে আসবে। বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?’
চিত্রা ফারাজের দিকে তাকায়। সরু চোখে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কে বলুন তো?’
‘এমন প্রশ্ন কেন?’
‘না আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তো তাই চিনতে পারছি না।’
‘মানে কি? আগে বুঝি অসুন্দর ছিলাম? দেখো চিত্রা আমার জন্মের দিন পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে গিয়েছিল আমার রূপের ঝলকে। বাপরে বাপ নিজের প্রশংসা নিজে করতে আমি একটুও পছন্দ করি না। শুধু তুমি বললে দেখে একটু বললাম।’
ফারাজ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চিত্রা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কালো পুকুরটির দিকে তাকাতেই চোখের সামনে মিতালি, নিলুফা, মাহাদী, মরিয়ম আর মারিয়ার মুখটা ভেসে উঠে। সে একটা শ্বাস ছাড়ল। ফারাজ আয়নার সামনে দাঁড়াতেই অভ্রর ফোন এলো। অভ্র জানায় আয়েশা আর চিত্রার পাসপোর্টে কিছু সমস্যা হয়েছে। অনেক কিছুই মিলছে না। ফারাজ বিষয়টি পরে দেখবে বলে ফোন রেখে দেয়। তারপর বারান্দায় গিয়ে চিত্রাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘এবার বলোতো বউ তুমি কে?’
চলবে?
(আপনারা গল্প গল্প করে পাগল করে ফেলতাছেন আর এদিকে আমি রাইটিং ব্লকে পড়ছি। একটা অক্ষর লিখতে পারতাছি না। একজন রাইটার কেবল জানে রাইটিং ব্লক কাকে বলে। জোর করে লেখালেখি করা যায় না অন্তত। এটা মনের শান্তির জন্য করি। কিন্তু যেখানে মনই ঠিক নেই সেখানে লেখালেখি কিসের? এত দিন লাগিয়ে কেবল এই টুকুই লিখছি। তাহলে বুঝেন কি অবস্থা।)
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৫৭
#বর্ধিতাংশ
বজ্র আজও এসেছে সেই বাড়িতে। মাঝেমধ্যে তার আসা হয়। এখন বলতে গেলে আত্মিক একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার এই বাড়ির সঙ্গে। এখানে যে মেয়েটি থাকে, যাকে নিরাপত্তা দেওয়া বজ্রের দায়িত্ব ছিল। তবে অজান্তেই এখন সেই মেয়ের সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। এখন তার মনের ভিতরেও একটা টান অনুভব হয়।
বজ্র প্রতিবারের মতো রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল মেয়েটি জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো বাড়িটা কাঠের তৈরি। চারপাশে বাগান, মাঝখানে বাড়ি। দোতলা এই কাঠের বাড়িতে মেয়েটি এখন মাসের পর মাস অনায়াসে থাকছে। এখন তাকে দুনিয়ার কোনো কিছু ভাবায় না। সেও এই চার দেয়ালের মধ্যেই কারো জন্য অপেক্ষা করে। নীরবে কেবল তাকে খুঁজে এই মন।
বজ্র রুমে ঢুকতেই মেয়েটি মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এসেছো?”
আপনি থেকে কখন যে এই তুমি নামক শব্দে দুজনে চলে এসেছে। আসলে কিছু জিনিস এত ভেবে চিন্তে হয়না। হুট করে হয়ে যাওয়া থেকেই ভালো কিছুর জন্ম হয়।
বজ্র এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এত সুন্দর করে বিছানাটা গুছিয়ে রাখো… দেখলেই ইচ্ছে করে ঘুমিয়ে যাই।”
“বারণ তো করিনি,” মেয়েটি মুচকি হেসে জবাব দিল।
“করলেও বুঝি আমি শুনতাম ?”
মেয়েটি হাসল। বলল, “আমি এখনো অনেক কিছু চিন্তা করি জানো? তুমি আমায় সাহায্য না করলে আমার কি হতো?”
“সাহায্য তো আমি করিনি। কে করেছে, তুমি না জানো। আমি তো কেবল তার আদেশ পালন করেছি।”
“অনেকদিন ধরে তাকে দেখি না। একবার আসতে বলবে?”
“বলে দেখতে পারি বুঝলে। তবে তার তো অশুভ দিন সামনে ঘনিয়ে আসছে। আসার আর সময় কই?”
মেয়েটি বজ্রের পাশে বসতেই বজ্র হঠাৎ বলে উঠল,
“গত সপ্তাহে অনেকদিন পর জানো, মর্গে গিয়েছিলাম। মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের ছেলে-মেয়েদের পোস্টমর্টেম ক্লাস ছিল। একটা কম বয়সী মেয়ের লাশ দেখলাম। মৃত্যুর আগে মেয়েটিকে ছয়জন পুরুষ মিলে ধর্ষণ করেছিল।”
একটু থেমে সে আবার বলল, “ময়নাতদন্তে আরও ভয়াবহ তথ্য জানা গেল। মৃত্যুর পরেও মেয়েটির ওপর একই কাজ করেছে তারা। লোকগুলোর নাকি নেক্রোফিলিয়া ছিল। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, মেয়েটির হত্যার কোনো বিচার হয়নি। বাবা-মা কবরের পাশে বসে কাঁদছে, থানায় হোঁচট খাচ্ছে। শুনেছি মেয়েটি কলেজ স্টুডেন্ট ছিল। সিনিয়ররা অনেকদিন ধরেই র্যাগিং করছিল। কেমন একটা দেশ—যেখানে ধর্ষকের বিচার হওয়ার আগেই ধর্ষিতা মারা যায়। আসলে মেয়েদের জীবন সহজ না, বুঝলে। ওই মেয়ে যদি প্রথম দিনই মুখ বুঝে না সয়ে জবাব দিত…”
মেয়েটি চুপচাপ শুনছিল। এবার ধীরে বলল,”তোমার কি মনে হয়, জবাব দিলেও বাঁচতে পারত?”
বজ্র আর কিছু বলল না। কেবল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবদারে বলল, “নিরুপমা… মাথাটা অনেক ধরেছে। চুলগুলো একটু টেনে দেবে?”
–
সুলেমান এলাহীর মৃত্যুর পর এলাহী বাড়ি আরো নীরব, নিঃশব্দ হয়ে উঠেছে। মরা বাড়ি যাকে বলে আর কি। রোশানের সাথে মোহনার সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ হলেও বিপরীতে জোহান, রাজনের সঙ্গে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। উঠতে বসতে ঝগড়া। কারো সাথে কারো কথা হয়না। আজ-কাল নদীকে অস্বাভাবিক লাগে। লাগারই কথা। স্বামী নেশাখোর, নোংরা পল্লীর মহারাজা সে। নিজের মেয়েকে তো দেখতেই পারেনা। উল্টো নদীকে দেখো বিয়ের পর বাপের বাড়ি কখনো তার যাওয়া হয়নি। বাবার মৃত্যুতেও রাজন তাকে বাড়ি যেতে দেয়নি। একটা মেয়ের জন্য এরচেয়ে কষ্টের কি আছে? মেয়ের বড়লোক পরিবার থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল যেদিন, সেই খবরে নদীর বাবা তো সারাদিন খুশিতে কেঁদেছেন। বাকিটা জীবন মেয়ের সুখ দেখে শান্তিতে হাসবেন বলে। অথচ বিয়ের পর রাজন তাদের এই বাড়ির এক গ্লাস জলও কথা না শুনিয়ে পান করতে দেননি। তারা প্রথমদিকে একবার এসেছিল। মেয়ের শশুর বাড়ির জন্য গ্রামের দেশী হাস থেকে শুরু করে ফলমূল কতকি সঙ্গে নিয়ে। তবে রুমানা তাদের একগাল অপমান করেছিলেন। দুপুরে আগেরদিনের পান্তা ভাত খেতে দিয়েছিলেন। সময় তো চলে গেছে। তবে সে-সব কথা আজও বুকে সূঁচালো তীরের মতো গিয়ে বিঁধে। নদী কেবল সেদিন বাবা-মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,’ভালো আছি আমি। অনেক সুখে আছি। তিনি আমারে খুব ভালোবাসে। চিন্তা নাই তোমাগো।’ তবে বাবা-মা বুঝতে পেরেছিলেন কি ভুলটাই না তারা করেছেন। আজও সেই ভুলের জন্য হয়তো নিজেদের দোষারোপ করছে। তবে ইচ্ছে আছে একদিন নদীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার। বাবা তো আর নেই। কোনো এক বর্ষায় সবাইকে কাঁদিয়ে সে চলে গেছেন। তবে নদী যেদিন আসলেই সুখী হবে,সেই সুখের গল্প শোনাতে সে পরিবারের কাছে যাবে।
সকালে কালো বোরকা পরে বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে নদী কোথায় একটা যায়। ফিরতে ফিরতে ভালোই সময় লাগে। বাড়ির ভেতরে যখন প্রবেশ করে তখনই দেখা হয় ফারিয়ার স্বামীর সঙ্গে। নদী এক মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে গিয়ে পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে বলে,
‘আরে নিহান তুমি?’
‘এই দুপুর বেলা কোথ থেকে এলেন?’
নদী থতমত খেয়ে বলল, ‘নুড়িটার জ্বর। ঔষধ কিনতে গেছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা। তাহলে রুমে যান। যেই গরম পরেছে।’
নদী অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। নাহিয়ান খানের বড্ড হাসি পায়। পাবে না কেন? বাড়ির কার ভেতরে কি আছে সব তার জানা। তবুও যখন মানুষ চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলে তখন কি আর না হেসে পারা যায়? ওরা ভাবে ওরাই চালাক বাকিদের তো নাক টিপলে দুধ পরে।
–
চিত্রার কলেজে অভিভাবক মিটিং ছিল। সঙ্গে আয়েশা অভ্রও এসেছে। ওরা চিত্রার সঙ্গে মিটিং এ এসেছে নাকি নিজেদের ডেটিং তা তেনারাই ভালো জানেন। আয়েশা কিছু জিনিস অর্ডার দিয়েছিল। ডেলিভারি ম্যানকে গুরুদয়াল কলেজের সামনে আসতে বলেছিল। লোকটি এসে পার্সেল দিয়ে যায়। সেই লোকের সঙ্গেও অভ্র মারপিটে লাগে। কলার চেপে ধরে বলে,’এই ব্যাটা ছ্যাড়রা আমার বউয়ের থেকে নম্বর চাও কেন? মেরে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে হালুয়া তৈরি করে ছেড়ে দিব।’
এই সরকার ভাইকে কে বুঝাবে ওইটা ওটিপি ছিল। পার্সেল ডেলিভারির সময় এমন ওটিপি কখনো কখনো চায় তারা। এক মহিলা আয়েশার দিকে তাকিয়েছিল বলে তার সঙ্গেও দৌড়ে গিয়ে ঝগড়া করেছে অভ্র। বলেছে মেয়ে হোক আর ছেলে, তার ঘরনীকে দেখার অধিকার সে ছাড়া আর কারোর নেই। আগে আয়েশা দেখত ফারাজ আব্বা, চিত্রা আপার জন্য এসব করত। এখন তার এসিস্ট্যান্টটাও পুরো কার্বনকপি হয়ে উঠেছে তার। আয়েশা অভ্রকে বলল, ‘সরকার ভাই তোমাকে একটু দরকার?’
‘কিগো? কি দরকার ঘরনী?’
‘গাড়ির ডিকি খুলে দেন। জিনিস গুলো রাখি।’
অভ্র ডিকি খুলতেই হুট করে কেউ গর্জে উঠল, ‘চালপেরাজ।’
ভয়ে অভ্র চেঁচিয়ে আয়েশার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে বলল, ‘তোমার এই দাদি কি আমার পেছন জীবনে ছাড়বে না ঘরনী? কই পরিকল্পনা করেছি বাচ্চাকাচা হলে একে পালতে দিয়ে আমরা কালা পিরিত করব, কিন্তু এই বুড়ির জন্য তো কালা পিরিত দূরে থাক পুকি পিরিতও কপালের জুটছে না। একটু বাইরে এলাম ওমা সেখানেও চলে এলো।’
আয়েশার হাসি পায়। সে তার দাদিকে ধরে গাড়ির থেকে বের করে। তা দেখে অভ্র পকেট থেকে টিস্যু বের করে জমেলার হাত ঘষে মুছিয়ে দিয়ে বলে,’বুড়ি আমার ঘরনীর স্পর্শ আমি ছাড়া কারো গায়ে লাগতে দিব না। আমার ঘরনীর ছোঁয়া লেগেছে তোমার গায়ে। ভালো করে ঘষে ঘষে মুছে সেই ছোঁয়া আমি উঠাবো আজ।’
জমেলার তাতে মন্দ লাগেনি। কালুর বাপ তার হাত মুছে দিয়েছে। সেই অনুভূতিতে তার শাড়ি তুলে মির্কি নাচ দিতে ইচ্ছে করছে। কত কষ্ট করে ডিকিতে উঠেছিল সে। গরমের মধ্যে বসে ছিল। আজ সে সুন্দর ভাবে তিব্বত ঘামাচি পাউডার দিয়ে কোরিয়ান মেকআপ লুক ইউটিউব দেখে ট্রাই করেছে। চোখে একটা কালা রোদ চশমা লাগিয়েছে। পাহাড়ের মতো উঁচু জুতা পরেছে। তার তো উঁচু জুতা নেই। তাই বার্মিজ জুতার নিচে বাঁশের চোকা খুঁটি লাগিয়ে জুতা বানিয়েছে। এখন পুরো হিল জুতা ফেইল। হাতে একটা ব্যাগও নিয়েছে। যা লাগছে না তাকে। পুরো কড়া জিনিস! পৃথিবীর সব ছেলেকে অজ্ঞান করার জন্য যথেষ্ট। আর কোরিয়ান মেয়েরা তো জমেলার এই লুক দেখলে হিংসে করবে। ওই দেশে কতছেলে আছেনা? একেবারে দুধের সরের মতো গায়ের রং। ওরা তো জমেলাকে দেখলে মরেই যেত। এত ছেলেকে এখন জমেলা একা যুবতী হয়ে কি করে বিয়ে করবে? কি করে বলবে? কালুর বাপের প্রতি সে লয়াল। মন সে কাউকে দিতে পারবে না। তবে দেহের বিষয় হলে অন্য কথা।
ফারাজের তো কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পর গুরুদয়ালের আঙ্গিনায় আর পা রাখা হয়নি। এখন বউয়ের জন্য যাওয়া-আসা হয় আরকি। কলেজ থেকে বের হওয়ার পর আজকে চিত্রা জিদ ধরেছে মুক্তমঞ্চে বসবে। কলেজের সামনের এই জায়গাটা এত স্নিগ্ধ। ফারাজ চিত্রার জন্য বিভিন্ন প্রকার ভাজা কিনতে যায়। গল্প করবে আর ভাজা খাবে। চিত্রা আজকাল খুব কম কথা বলে। যতটুকু বলা দরকার কেবল ততটুকু। ফারাজ তাকে বলেছে সে নাকি গুরুদয়াল থেকে এইচএসসি দিয়েছে। আসলেই কি তাই? আচ্ছা ফারাজের চেহারাটা এমন বিদেশিদের মতো দেখতে কেন? আর তার বাকি ভাইদের সাথে কোনো প্রকার মিল নেই কেন? কিছু তো একটা আছে কিন্তু কি? ফারাজ বলেছে চিত্রার পাসপোর্টে নাকি কি সব ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলাটা এখন হওয়া কি খুব দরকার ছিল? কি সুন্দর বিদেশ চলে যেত। সব সমস্যা শেষ। তবে চিত্রা জানে সামনের দিনে আরও অনেক কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে। সব যেন সে সামাল দিতে পারে। এত দূর পর্যন্ত এসেছে হেরে যাওয়ার জন্য নয়। যার জন্য মৃত্যুকে এতবার কাছ থেকে দেখা তাকে তো চিত্রা এত সহজে হাতছাড়া করবে না। ফারাজ চিত্রাকে ডাকতেই সে তার কাছে যায়। মুক্তমঞ্চে গিয়ে বসতেই চিত্রা ফারাজকে বলল, ‘আপনি এত বার ডাকেন কেন?’
‘কারণ আমি ঝিঁঝি পোকা। ঝিঁঝি পোকা কেন ডাকে জানো?’
‘জানি না। কেন ডাকে?’
‘এই কারণেই তো ছোটলোক বউ বলি। দেখো, ঝিঁঝি পোকা কেন ডাকে আমি বলতে পারব না। আমি পুরুষ বলে আমার বুঝি শরমের লজ্জা নেই? যাও গিয়ে গুগুল করে নাও।’
‘শরমের লজ্জা? বাহ ইউনিক লজ্জা দেখি আপনার।’
‘হ্যাঁ। ছোটলোরা লজ্জাশরম পায়। আর আমার মতো বড়লোকরা শরমের লজ্জা পায়।’
দূরে পাঁচ-ছয় জন ছেলের মাঝে একটা মেয়ে। তাদের আবার কি হাতাহাতি। চিত্রা একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। ফারাজ তাকে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। সে কেবল টুপ করে মুখে দিচ্ছে। ফারাজখোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, ‘মেয়ে মানুষ হচ্ছে ঠিক এই বাদামের মতো। খোসা ছাড়ানো থাকলে যে কেউ অনায়াসে খেয়ে ফেলে। খোসা সহ একে খাওয়া যায় না। খোসা লাইক একটা পর্দার মতো। আবরণে ঢাকা জিনিস বরাবরের মতোই সুন্দর।’
‘জানি। নিজেকে সবার সামনে খোলামেলা ভাবে উপস্থিত করলে খোসা ছাড়া বাদামই হয়ে যায় মেয়ে মানুষ। শুনছেন?’
‘বলো বউ।’
‘জুস খাবো।’
ফারাজ উঠে যায়। সামনের দোকান থেকে চিত্রার জন্য জুস আনতে হবে। তার ফোনটা চিত্রার ব্যাগের ওপরই ছিল। সেটা আর সঙ্গে নিতে মনে নেই। ফারাজ যাওয়ার পর চিত্রা চারপাশের পরিবেশ উপভোগ করে। হুট করে ফারাজের ফোনে একটা কল এলো। নম্বর সেভ করা নেই। চিত্রা কলটি ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে কেন জানি আজ ধরেই ফেলল। আজকাল তো আর কিছুই স্বাভাবিক নেই। হ্যাঁ নিজেকে সে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করছে কিন্তু মনের অবস্থা কেবল সে জানে। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি গলা ভেসে এলো, ‘স্যার আপনার মণি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। একটু যদি আসতেন? হ্যালো স্যার! আপনি শুনতে পাচ্ছেন?’
চিত্রার হাত কাঁপা শুরু হয়। সে কোনো মতে ফোনটা কেটে দেয়। আতঙ্কে চোখের কোণে জল চলে আসে।
‘মণি? এই মণি কে?’
চলবে?
(আর কয়েকটা পর্বের পরেই চিত্রাঙ্গনার প্রথম পরিচ্ছদ শেষ। তারপর জমিদার রিলেটেড গল্প #শকুন_দৃষ্টি আসবে। আচ্ছা একটু বলেন তো এই নামে কি কোনো গল্প ফেসবুক বা কোথাও আছে নাকি? অনেক কষ্ট করে প্লটের সাথে মিল রেখে নামটা রেখেছি। আর শকুন দৃষ্টির মেইবি প্রথম পরিচ্ছদ শেষ করার পর চিত্রাঙ্গনার ২য় পরিচ্ছদ আসবে।)