#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#স্পেশাল পর্ব
#প্রথম_অংশ
রাস্তায় থেকেই ফারাজ চিত্রাকে একটা কল করল। তৈরি হতে বলল। আজকে তারা ঘুরবে, হুঁ, তার আগুন-সুন্দরী ঘুরবে। শেষবারের মতো ঘুরতে যাওয়া যাকে বলে, তাই না? মাথার একপাশ জ্বলছে কবরের সেই ব্যক্তি, তার যন্ত্রণা, তার অসংখ্য আর্তনাদ আর তার চিৎকারের শব্দে। অন্যপাশ জ্বলছে প্রতিশোধের স্পৃহায়। রোজ ঠিকই বলেছে, এসব ভালোবাসা আজ থাকলে কাল থাকে না। চিত্রা সরে গেলে ফারাজকে কষ্ট করে ভালো হতে হবে না। এত সত্য লুকিয়ে বাঁচতে হবে না। এত প্রশ্নের মুখোমুখিও হওয়া লাগবে না। মেয়েটার অপ্রয়োজনীয় মোহে জড়াচ্ছে। আচ্ছা, চিত্রাকে মারার সময় সে যদি জিজ্ঞেস করে, “সেদিন আমার যখন মিজান চাচার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল, তখন বিয়ে করে আমাকে না বাঁচিয়ে মাথায় একটা গুলি করে মেরে ফেললেই তো গল্প শেষ হয়ে যেত। গল্পকে উপন্যাস বানানোর কী খুব প্রয়োজন ছিল, ফারাজ এলাহী?”
তখন ফারাজ চিত্রাকে কী জবাব দেবে? যে আসলেই সেসব করাটা অনেক দরকার ছিল? সে প্রিয় শত্রুকে তিলে তিলে মারতে ভালোবাসে বলেই এত কিছু করা? চিত্রাকে উজাড় করে দিয়ে কেড়ে নেবে বলেই এত সময় নেওয়া। ঠিক যেমন ভাবে কবরের ব্যক্তিটির সব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই। তবে ফারাজ কী করে বলবে? ওইদিন সে চিত্রাকে মারেনি, বরং মিজান সাহেবের হাত থেকে বাঁচিয়েছে কেবল নিজের হাতে ধুঁকিয়ে মারার জন্য?
ফারাজ বাড়িতে এসে দেখে, চিত্রা নীল রঙের একটা মসৃণ শাড়ি পরেছে। তার ধবধবে ফর্সা পেট শাড়ির ফাঁক দিয়ে ফারাজের চোখ পুড়িয়ে দিচ্ছে। ফারাজ চিত্রার সেই উপচে পড়া সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। আজ কতদিন পর তার চিত্রা সেজেছে, হাসছে। কবিরা যদি তার চিত্রাকে দেখত, তাহলে তারা তাদের কাব্যে ফুলের এত সুন্দর বর্ণনা দিতে পারত না। ফারাজ চিত্রাকে নীল গোলাপের সঙ্গে তুলনা করতে চায়, অথবা সেই পৌরণিক কল্পলোকের বিরল ব্লু স্পাইডার লিলির সঙ্গে। যার নীল-বেগুনি সরু পাঁপড়িগুলোর গঠন, দেখতে পাওয়া চিত্রার মতোই দুর্লভ।
ফারাজ গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসে। গায়ে সে চিত্রার পছন্দ করা একেবারে হালকা বেবি স্কাই-ব্লু রঙের ফুলহাতা শার্ট আর সাদা রঙের একটা প্যান্ট পড়ে। বুকের দিকের দু’টো বোতাম বরাবরের মতো খোলা। ফারাজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেট করে। ফারাজের চুল নিয়ে অনেক মাথাব্যথা। শরীরের সকল কিছু থেকে চুল নিয়ে সে একটু বেশিই ভাবে। তার মতে মানুষের চুলই তার সৌন্দর্য বর্ধনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফারাজ শার্টের হাতার বোতাম লাগিয়ে ডান হাতে রোলেক্সের ঘড়ি বাম হাতে চেইন ব্রেসলেট পড়ে। ফারাজ ম্যাচিং ব্লু সানগ্লাস চোখে পড়েছে। আচ্ছা সে কী কোনো ফ্যাশন শো তে যাচ্ছে? এত সাজগোছ কেনো? তাও আবার বউকে খুন করতে?
চিত্রা পুরো তৈরি হয়ে ফারাজের সামনে দাঁড়াতেই ফারাজ বলল,”কিছু একটা মিসিং লাগছে।”
চিত্রা চিন্তায় পড়ে গেল। কী মিসিং লাগছে? ফারাজ টিপের বক্স থেকে একটা নীল রঙের টিপ বের করে চিত্রার কপালে টিপ পড়িয়ে বলল,”এবার পারফেক্ট।”
চিত্রা আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি হেসে বলল, “কী বলুন, লাগছে না আমাকে পারফেক্ট মিসেস ফারাজ এলাহী?”
ফারাজ মেকি হাসল। বলল,”হ্যাঁ।” দমটা বন্ধ হয়ে আসছে তার। কী করে মারবে? আবার মারতেও যে হবে। এই প্রথম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ফারাজের এত ভাবতে হচ্ছে।
প্রথমে দুজনে হাসপাতালে যাবে মার্জিয়াকে দেখতে। আজকে ১৯ আগস্ট। চিত্রার পরিবারের সকলে এই দিনেই মারা গিয়েছে। প্রতিবছর এই দিনে চিত্রা তালুকদার বাড়িতে যায়। হাসপাতাল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজকে ফারাজ নিজ থেকেই চিত্রাকে ফুচকা খাইয়েছে। বাহিরের সকল খাবার খেতে নিয়ে মন মতো। চিত্রা একটু অবাক বটে। তবে তার চেয়েও বেশি খুশী। চিত্রার জরজেটের শাড়ি সামলাতে একটু কষ্ট হয়। আবার ভালোও লাগে। সে ফুকচা খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। প্রতিবারের মতো ফারাজ সিটে বসেই চিত্রাকে বলে,” জানালার সঙ্গে হেলান দিয়ে পা দু’টো আমার উরুর ওপর রাখো। ওইসব না ছুঁলে গাড়ি চালানোর মুড আসে না।” চিত্রা একটু বাঁকা মুচকি হেসে পা দু’টো তুলে দেয়। তারপর হা করে ফারাজকে দেখতে থাকে। আয় আল্লাহ এই পুরুষ এত সুন্দর কেন? ফারাজ আজকে একটার পর একটা গল্প করছে। এমন ভাবে সে আগে কখনও এত কথা বলে নি। চিত্রা সেই কথা শোনার চেয়েও মনোযোগ দিয়ে দেখছে ফারাজের কণ্ঠনালি ওঠা-নামার দৃশ্য। চিত্রা আপ্লুত হয়। সে এগিয়ে এসে ফারাজের সেই কণ্ঠনালি ছুঁয়ে বলে,” আপনাকে হারালে চিত্রার সকল রঙ ফুরিয়ে যাবে। আপনাকে নিজের করে রাখার জন্য আপনার এই আগুন সুন্দরী আগুন হাতে নিয়েও খেলতে পারে।”
ফারাজ জবাব দেয় না। তবে খানিকবাদে বলে,”তুমি আমাদের বাড়ি আসার পর মোট চারটে খুন দেখেছে। ভয় লাগে না?”
“লাগে তো। তবে আপনি যখন রাতে পাশে থাকেন না তখন যেই ভয় লাগে তার থেকে কমই। জানেন ফারাজ সেদিন স্বপ্নে দেখলাম আমাকে মাথায় কেউ একজন গুলি করেছে। আপনি আমায় তখন বাঁচাতে আসেননি।”
“খুনির চেহেরা দেখেছিলে?”
“দেখার আগেই নিশ্বাস থমকে গিয়েছিল।”
চিত্রা পোড়া বাড়িতে অনেকক্ষণ সময় কাটায়। ফারাজ চিত্রাকে একা সময় কাটাতে দেয়। চিত্রা ভেতরে থাকাকালীন সে গাড়ির ভেতর থেকে পিস্তল বের করে হোলস্টারের রাখে। শার্টের কারনে পিস্তল ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ফারাজ সরাসরি চিত্রার কাছে চলে যায়। চিত্রা মোফাজ্জলের সঙ্গে কথা বলছিল। কী কথা ফারাজ জানে না। তবে এক মুহুর্তের জন্য ফারাজকে দেখে মোফাজ্জল চুপ করে যায়। তারপর বলে উঠে, “ফারাজ বাবারে নিয়া আইসো আইজকা?
ফারাজ ভ্রু কুঁচকায় তারপর বলে,” কেন আগে বুঝি অন্য কাউকে নিয়ে আসতো?”
লোকটি কিছু বলতে যাবে তার আগেই চিত্রা তার দিকে তাকায়। বলে,”আমরা একটু বাহিরে হাঁটাহাঁটি করি। আমার কোমর ব্যথা হয়ে গিয়েছে।”
বাহিরে এসে ফারাজ চিত্রাকে বলে,”চলো ঘোরাউত্রা নদীর ধারে যাই।”
চিত্রা একটু চমকে তাকায়,”বাসায় যাবো না?”
“ইচ্ছে তো করছে না। জানো বজ্রর বাড়িও বাজিতপুর। বাজিতপুরে ওদের পুরনো বাড়ি আছে। তবে কেউ সেখানে থাকে না। একেবারে জমিদার বাড়ির মতো।”
চিত্রা হালকা মাথা নাড়ে”হুম আমি জানি।”
“জানো মানে?”ফারাজ কৌতূহলী হয়ে তাকায়।
” মানে এখানে যে একটা জমিদার বাড়ি আছে তা জানি। অনেক আগে গিয়েছিলাম সেখানে। ওইটা কয়সার বাড়ি।”
“ওহ চিনো তাহলে?”ফারাজ অবাক হয়।
“হুম তবে আজকে জানলাম ওইটা বজ্র কায়সারের বাড়ি। সবাই ভূতের বাড়ি বলে চিনে। তাও আবার আমার নিজের এলাকায় ওই বাড়ি। চিনবো না মানে?”একটু চুপ থেকে চিত্রা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “চলেন, এখন বাসায় ফিরে যাই। আজকে কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না।”
ফারাজ চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর নিচু গলায় বলে,
“ভুলে যাও চিত্রা ওই বাড়ির কথা। আর কখনও… তোমার বাড়ি ফেরা হবে না।”
ফারাজ অন্ধকারের মাঝেই তালুকদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একটা বড়সড় নিশ্বাস ছেড়ে কোমরে গোঁজা পিস্তলের ওপর হাত রাখে। আজকের দিনে চিত্রার পরিবারের সবাই মারা গিয়েছে। চিত্রা কেন অন্য দিনে মরবে? এটা তো আনফেয়ার হয়ে যায়। আজকে দশ বছর পর তালুকদার বাড়ি আবার জ্বলবে। সেইদিন রাতে ফারাজের হাতেই তালুকদার বাড়ি জ্বলেছিল আজকে আবার জ্বলবে। চিত্রার মাধ্যমে তালুকদার বংশের ইতি ঘটবে। ফারাজ ভাবতে না ভাবতেই বৃষ্টি নেমে পড়ল। ফারাজ আকাশের দিকে চেয়ে একটু থতমত খেলো। হুট করে এমন বৃষ্টি? আকাশ তো পরিষ্কার ছিল? এখন আগুন লাগালেও তো জ্বলবে না। আর সময় পেল না। চিত্রা বৃষ্টি দেখে মহাখুশি। সে শাড়ি,গহনা কিছুর চিন্তা না করেই বৃষ্টিতে ভিজছে। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাজও ভিজে একাকার। এই তালুকদার বাড়ির সামনে এলে বৃষ্টি কেন বার বার তাদের ভিজিয়ে দেয়? বৃষ্টি কী কোনো শুভ লক্ষণ? তাদের জন্য পাঠানো খোদার কোনো রহমত!
ছাতা নিয়ে মোফাজ্জল এবং তার বৃদ্ধা স্ত্রী দৌড়ে এসে বলল,” আরে আপনারা এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাতবিরেতে বাড়ি যাইবেন কেমনে? আমাগো বাড়ি থাইকা যান। দক্ষিণের ঘরডা খালি আছে।”
চিত্রা নিষেধ করতে যাবে তার আগেই ফারাজ বলল,”আপনি সব ব্যবস্থা করুন। আমরা আসছি।”
“কিন্তু আমাদের বাসায় যেতে সময় লাগবে না। আর আপনি এই জায়গায় থাকতে পারবেন? ওয়াশরুম সেই কোন মাথায়। রাতে সমস্যা হবে না?”
“হবে না।”
চিত্রা কথা না বলে মোফাজ্জলের বউয়ের পিছু নেওয়ার চেষ্টা করতেই ফারাজ পেছন থেকে চিত্রার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে টেনে বলে,”আজকের রাতটা তোমার জীবনের আরেকটি স্পেশাল রাত হতে চলেছে।”
“এই দেখুন আমরা কিন্তু অন্যের বাড়িতে। আপনি কিন্তু এখানে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবেন না যেন।”
ফারাজ চিত্রাকে কাছে টেনে আনল। গলার কাছের গর্তমত জায়গাটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
” সারা নিশি ভিজবো দুজন
চাদের.. ঝরা জলে….
সারা নিশি ভিজবো দুজন
চাদের… ঝরা জলে……
সবুজ সুখে করবো কুজন
নীল আকাশের তলে…
পাঁজর দিয়ে আগলে রবো
তোমায় সারা জীবন
ফারাজের ঠোঁট তখনও চিত্রার শিকলে বন্দী। তবে হাত চিত্রার গাল বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে গলায়। ফারাজ মৃদু ভাবে চেপে ধরে গলাটা। আস্তে আস্তে হাতের চাপ বাড়তেই চিত্রার চোখে ব্যথায় পানি চলে আসে। বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি আড়াল হয়ে গেছে। ফারাজ কী আর সেই অশ্রু দেখেছে? চিত্রার এবার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার পথে। সে আঁতিপাঁতি করতে থাকা চিত্রার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে চোখের দিকে নেশালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বলে, ❝তোমার চোখ দুটো প্রেমের পোশাকে ছদ্মবেশী বিপর্যয়। যুদ্ধ না করেও আমি হেরে গেছি।❞
চলবে?
Your’s ইশুপাখি পেইজে এই পর্বের ২য় অংশ দেওয়া হয়েছে। একসঙ্গে এক দিনে দুইটা পর্ব দিয়েছি আর কী লাগে আপনাদের? তাও একটা চিত্ররাজময় পর্ব। আর নীল শাড়ি পড়া ছবিটা আমার তাই কেউ ব্যবহার করবেন না।)
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#স্পেশাল_পর্ব
#শেষ_অংশ
চিত্রার এবার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফারাজের এক পলকে হুঁশ ফিরে। সে হাত সরিয়ে চিত্রাকে কাছে টেনে গলায় এলোপাতাড়ি চুমু খায়। কিন্তু দিয়ে যাওয়া ব্যথা কী চুমুকে ঠিক করা যাবে। চিত্রা তাতেও কিছু বলে না। সে আজকে কেমন যেন চুপচাপ। বিষন্ন মন। ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষটি রোজ মৃত্যুর আতংক নিয়ে যেমন ভাবে বেঁচে থাকে ঠিক তেমন দেখাচ্ছে চিত্রাকে। ফারাজ চিত্রাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। ভেজা শরীর দিয়ে খাটের সামনে নামিয়ে নামিয়ে বলে,
❝তুমি আমি দুটো নক্ষত্র
আলোর মত কাছাকাছি,
তবু রই আলোকবর্ষ দূরে।❞
চিত্রা সেই কথার মানে বুঝল কিনা কে জানে? তবে চেয়ে রইল ফারাজের দিকে।
বিদ্যুৎ নেই। ঝড়-ঝঞ্ঝার দিনে এসব গ্রাম্য এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকাটাই স্বাভাবিক। মোফাজ্জলের বউ মুড়ির মোয়া,নাড়ু দিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে পানির জগ। হালকা কিছু খাওয়ার পর না হয় রাতে ভাত খাবে। সে সময় চেয়ে নেয়। হাঁস জবাই করবে। একটা দেশী মুগরিও সঙ্গে রান্না করবে নাকি? তড়িঘড়ি করে বৃদ্ধ মহিলা খাবার গুলো দিয়েই বেরিয়ে যায়। সে যেতেই ফারাজ চিত্রাকে বলে, “তুমি একটু থাকো। হারিকেনটা ঝুলাও। আমি মোফাজ্জলের সঙ্গে একটু কথা বলেই আসছি।” চিত্রা তাকিয়ে রইল। চিত্রার ছোটবেলার কথা বিশেষ মনে নেই। বাবা-মায়ের ছবি না থাকলে হয়তো চিত্রা তাদেরও ভুলে যেত। চিত্রার বাবার নাম তৌকির তালুকদার। মায়ের নাম চৈতী মজুমদার। তার মায়ের বাড়ি নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিল। জীবনে চিত্রার কপালে সুখ স্থায়ী হয়েছিল ওই আট বছর। তারপর বহুদিন চিত্রা সুখের মুখ দেখেনি। তবে এই বছরটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ক্যালেন্ডারের পাতায় লেখা থাকবে পঁচিশ মার্চের কথা। সেইরাতের কথা যখন ফারাজ আর চিত্রা বিবাহের পবিত্র আবদ্ধ হয়ে উঠেছিল চিত্ররাজ। ফারাজের জন্মদিন নিয়ে ভাবতে হবে। বিশ অক্টোবর ফারাজ এলাহী জীবনের ৩১ বছরে পা দিবে। চিত্রার জন্মদিন আসতে সেই কত দেরি। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ। এত দেরি করে কারো জন্মদিন আসে বুঝি? কেউ পরবে মানে একত্রিশে আর কারো জন্মদিন একত্রিশে।
একেতো জরজেটের শাড়ি তার ওপর ভিজে একাকার। এখন এই ভেজা পোশাক নিয়ে এই লোক নিজে কেমন করে এখানে থাকবে? আর চিত্রাই বা কেমন করে? শরীর ভেজা থাকলে গরমে কেমন জানি লাল লাল দাগ পড়ে যায়। জ্বালাপোড়া করে। চিত্রা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাজকে বলল,
“এই অবস্থায় রাত কাটাবো কী করে? আমি আর এক মুহূর্তও ভেজা কাপড়ে থাকতে পারব না।”
“থাকতে বলেছে কে? খুলে ফেলো।”
ফারাজ ফোনটা পকেট থেকে বের করে বিছানার ওপর রাখে। মাটির ঘর। কাঠের জানালা। সেই জানালা ফারাজ খুলে দিয়েছে৷ অফুরন্ত বাতাস আসছে। স্নিগ্ধ মন শীতল করে দেওয়ার মতো। ফারাজ ফোনের স্ক্রিনটা অন করেই চিত্রার দিকে তাকালো। সেই ফুলের মতো নরম ঠোঁট। ভেজা বক্ষ। চুলের পানি ছুঁইছুঁই করে আস্তে আস্তে গলা বেয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে কোনো এক স্পর্শকাতর জায়গা। ফারাজের নজর কাড়ে চিত্রার নীল পাতলা শাড়ি ভেদ করা সরুফর্সা পেটটা। ফারাজ এক মুহুর্তের জন্য চুপ করে রয়। সে এখানে কেন এসেছে তা বুঝি সে ভুলে যাচ্ছে। জাস্ট একটা প্রেস করলেই গুলি ছিটকে এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাবে। আর তারপর হয়তো ফারাজের শার্টটা রক্তিম হয়ে উঠবে। মুখ-গাল সবটা রক্তে মাখামাখি করবে। আচ্ছা আজ তো নিয়ম করে তাকে কলিজা ভুনা খেতে হবে। মোহনা ভাবিকে ফোন করে কলিজা ভুনা রান্না করতে বলা হয়নি যে!
নিশুতি রাত। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে মাটির ঘর নরম গদির মতো কাঁপছে। কাঠের জানালায় জমে থাকা জলের রেখায় অন্ধকারে প্রতিফলিত হচ্ছে হালকা হলদেটে আলো। ঘরের আবছা অন্ধকারে ফারাজ গা থেকে শার্টটা খুলে ফেলে দিল মেঝের কোণায়। তারপর এগিয়ে এসে চিত্রার বাহু দুটো শক্ত করে চেপে ধরল। আর কোনও দ্বিধা চায় না, শুধু এই মুহূর্তটাই এখন কেবল তার চাই। চিত্রা শ্বাস নিতেই ফারাজ তার নিঃশ্বাসে মিশে গেল। দুজনের গরম নিঃশ্বাস পরস্পরের গালে গলে গিয়ে, বুকের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিলো। মুহূর্তে তাপ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ফারাজ চিত্রাকে হালকা পেছনে ঘুরিয়ে ঘাড়ের ওপর থেকে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে কানের কাছে বলল, ❝অন্ধকার হতে দিওনা আমায়।
অন্ধকারের মধ্যিখানে আলো খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বিবিজান।❞
“আপনি যতবার অন্ধকার হবেন আমি ততবারই আলো হয়ে আপনাকে পথ দেখাবো।”
“আচ্ছা ভালোবেসে হেমলক পান করতে পারবে?”
“সে তো প্রথম দফায় আপনার ঠোঁটের স্পর্শেই আমি হেমলক পান করেছিলাম।”
“ভালোবাসার মানে কী জানো?”
“দগ্ধ হবে জেনেও আগুনকে জড়িয়ে ধরাই হচ্ছে ভালোবাসা”
“কতখানি বাসো?”
“আপনাকে বলতে না পারা কথাগুলোর সমান।”
ফারাজ চিত্রার পিঠে ঠোঁটের পরশ ছুঁয়ে দেয়। তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে বালিশের কাছে রেখে গান ছাড়ল। চিত্রা জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ফারাজ বলল, “বাহিরে থেকে কেউ ডাকলেও যেন কারো শব্দ না আসে তাই গান ছাড়লাম।” তবে হয়তো সেই ভালো জানে কেন গান ছেড়েছে। গান বেজে চলছে,
❝কার্নিশে আলতা মাখানো,
দিনেরা ঢলে পড়ে রাতে
তারপরে রাত্রি জাগানো
বাকি টা তোমার ই তো হাতে।।
জেগে জেগে আমি শুধু ঘুমিয়ে পড়তে চাই
থেকে থেকে সেই মেঘেতে যাই বেড়াতে যাই
তোমাকে পাই।।
চল বলে ফেলি
কত কথাকলি
জন্মেছে বলতে তোমায়
তোমাকে চাই।।❞
ফারাজ এক ঝটকায় চিত্রার পাতলা শরীরটিকে পাঁজা কোলে তুলে তাকে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। যেন সে কোনো মোমের পুতুলকে যত্ন করে তার জায়গায় রাখছে। ফারাজ হাত রাখে চিত্রার কাঁধে, ধীরে নিচে নামিয়ে নেয় আঙুলের স্পর্শ। চিত্রার দেহে হালকা কাঁপন ওঠে, চোখের কোণে বৃষ্টির মতো জলের রেখা। কে জানে আবেগ, না কি ভালোবাসার চিহ্ন সেই চোখের কোণের জল।
রাত ঘন হয়ে আসে। বৃষ্টির শব্দ তীব্রতর হয়। গান থেমে যায়, কিন্তু ঘরের ভেতর তখনও বাজছে দেহের আকাঙ্ক্ষার, এবং ভালোবাসার অবর্ণনীয় প্রেমধ্বনি।
সময় গড়ায়। চিত্রা জানালার দিকে তাকিয়ে রাতের ঝলসানো রূপ থেকে গভীর চিন্তায় হারিয়ে যায়। চিত্রা বাঁ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ফারাজও চিত্রার পেছনে ঠিক বাঁ পাশ ফিরেই শুয়ে আছে। সে চিত্রার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জানালার দিকে তাকায়। একুশ বছর আগেই সেই রাতেও এমন বৃষ্টি ছিল। ফারাজের বৃষ্টি দেখলেই সেইসব মনে পড়ে। শরীরের রক্ত টগবগ করে ওঠে। কী লোমহর্ষক এক-একটি মুহূর্ত ছিল। অনেক হয়েছে। মারবে মারবে করেও ভেতরটা এত ছটফট করছে কেন ফারাজ জানে না। এসেছিল মারতে, কিন্তু…..
ফারাজ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। চিত্রার পিঠে শেষ চুমু দিয়ে কাঁপা হাতে বিছানার নিচ থেকে পিস্তলটা বের করলো। তখন অন্ধকারে বিছানার কোণে রেখেছিল। পিস্তলের স্লাইড টানা ছিল। শুধুমাত্র ট্রিগারে প্রেস করলেই যথেষ্ট। এই মুহুর্তে ২টা গুলি আছে ম্যাগাজিনে। কিন্তু চিত্রাকে মারার জন্য একটিই যথেষ্ট। ফারাজ মনকে শক্ত প্রথমে নিচের কপালের ডান দিক বরাবর পিস্তলের নলটা আলতো করে ঠেকায়৷ চিত্রা ক্লান্ত শরীর নিয়ে সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ফারাজের বাম হাতের ওপরে। ফারাজের হাত অনবরত কাঁপছে। সে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছ? নিজের ওপর গুলি চালালে কিছুটা সময় তো বাঁচবে। সেইসময়টায় একই জায়গায় না হয় চিত্রার ওপরও গুলি চালাবে।
একটা সেকেন্ডেই নিজেদের ধ্বংস করবে বলে এত আয়োজন করেছে? নিজের মৃত্যু নিয়ে তার দাবি নেই। তবে…. এই ফারাজই না বলেছিল মৃত্যুটা যেন তার চিত্রার আগেই হয়?স্ত্রীর খাটিয়া বহন করার সক্ষমতা নেই তার? সেইসব দেওয়া কথাগুলো কেমন করে ভুলবে? না ভুলতে পারবে সে কবরের মানুষটিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আর না সামনের মানুষটিকে। ফারাজের চোখ দিয়ে গড়িয়ে জল পড়ছে। সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে জল মোছার চেষ্টা করে। কিন্তু এই জল তো বড্ড অবাধ্য। তার নিষেধ শুনছেই না। ফারাজের চোখের সামনে তার এতদিনের বৈবাহিক মুহুর্তগুলো ভেসে উঠছে। ফারাজ ভালোবাসে। অফুরন্ত সেই ভালোবাসা। তবে কথার মূল্য তার জীবনে অনেক। কবরের সেই ব্যক্তির সঙ্গেও তো ফারাজ বেইমানি করতে পারবে না আর ফারাজ চিত্রার সঙ্গেও যে বেইমানি করতে পারবে না। ফারাজ আর চিত্রা মুক্তি পাবে এই দুনিয়ার সকল পাপ থেকে। দু’জনেই ওপারে সুখী হবে। এই নষ্ট জীবন তাদের থেকে আগেই সব ছিনিয়ে নিয়েছে। যেই দুনিয়ায় চিত্রা থাকবে না সেখানে ফারাজও থাকতে চায় না। দুনিয়া যাক জাহান্নামে। অর্থ-সম্পদের পরোয়া ফারাজ এলাহী করে না। পিস্তলের একটা গুলি সে নিজের জন্যেও রেখেছে। আগে সে নিজের ওপরে গুলি চালাবে। তারপর চিত্রার ওপর। তবুও তো বিবিজানকে দেওয়া কথা রাখতে হবে না? তার থেকে ফারাজ একটা নিঃশ্বাস হলেও কম নিতে চায়। ফারাজ চোখ বন্ধ করে ট্রিগারে হাত রাখে। মুহুর্তেই একটা বিকট শব্দে কেঁপে উঠে চারপাশ। ঘুমন্ত চিত্রার হুঁশ ফিরে, সে কেবল গুঙিয়ে ফারাজকে ঝাপটে ধরে বলে উঠল, “ফারাজ!”
চলবে?