#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব ৬
‘তোর মুখের লাগাম আর ঠিক হইবো না মনে হয় ফারাজ।’রোশন পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে সোফায় আরো ভাবে বসলো।তাদের তিনভাইয়ের বয়সে খুব একটা পার্থক্য নেই।রাজনের বয়স সাইত্রিশ। রোশনের চৌত্রিশ আর ফারাজের ত্রিশ।এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ অসম্ভব সুন্দর। দেখে মনে হয় আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠানোর সময় কোনোকিছু বাদ রাখেন নি।তবে ফারাজের গায়ের রংটা একটু বেশিই ফকফকা।রাগলে মুখ-কান একেবারে লাল হয়ে উঠে।ফারাজ প্যান্টের পকেটে হাত রেখে নদীর দিকে তাকায়।বাড়ির বউদের মধ্যে নদীর গায়ের রংটা একটু শ্যামলা।তবে উজ্জ্বল শ্যামলা।ফারাজ নদীরকে উপেক্ষা করে তার সামনে দিয়ে ভাইয়েদের পাশে গিয়ে বসল।নদী তখনো পাথরের মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।মোহনা ভোজনক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে হাত বুলিয়ে তামাশা দেখছে।বাড়ির অন্যদের এসবে আগ্রহ নেই।তারা যে যার মতো কাজ করছে।ফারাজের বাবা সুলেমান আর চাচা জুনায়েদ এলাহী বাহিরে এখনো। সুলেমান সকালের নাস্তা সেরেই জেলা পরিষদের গিয়েছেন। সঙ্গে তার ভাই জুনায়েদও গিয়েছেন।জেলা পরিষদে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং আছে।কিশোরগঞ্জের অবস্থায় ভালো না।আজকাল এখানে কিশোরগ্যাংয়ের পরিমানটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।এছাড়া অহরহ বাচ্চা হুটহাট নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে।শুধু বাচ্চা বললেও ভুল হবে নারীপুরুষও কম হাওয়া হচ্ছে না।বিশেষ করে নারী।এসব সমস্যা নিয়ে জলদি মিটিং এ না বসলে পড়ে দেখা যাবে দূর্ঘটনা নিজের ঘরের দুয়ারে এসে পড়েছে।
‘ভাবী..’ফারাজ লম্বা করে নদীকে ডাক দিলো।
‘হু।’নদীর কন্ঠে ভয়।
‘আমার ভালো মানুষ কেন জানি সহ্য হয় না।মনে হয় কলিজাটা ছিঁড়ে বের করে ভুনা করে খাই।আচ্ছা ভাবি আপনি এত ভালো কেন?’ফারাজ একেবারে স্বাভাবিক। সে নীল শার্টের দুটো বোতাম খুলে পা ছড়িয়ে বসল। টেবিলের ওপর রাখা আঙুরের বাতি থেকে একটা লাল আঙুর মুখে দিকে রাজনের দিকে চাইল,
‘এবার তোমাকে মনে হচ্ছে চার নাম্বার বিয়েটা করতেই হবে।আমার নতুন ভাবী চাই।এই ভাবী অনেক বেশি ভালো।দেখো না একটু আগেও আমার বউটাকে সবার সঙ্গে কেমন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো?ধূর ভাই এত ভালো মানুষ আমার পোষায় না।যতসব ছোটলোকি কারবার।’
‘আমার ভুল হয়ে গেছে ফারাজ।আমি খারাপ উদ্দেশ্যে কিছু করি নি।’নদীর কন্ঠে আকুতি।
‘ভুল?ওকে ফাইন।’
‘কিরে তুই হুট করে বিয়ে করলি এটা কি করে সম্ভব? চিত্রা মেয়েটা আসলে কে বলতো?আর তুই কি সত্যি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিস নাকি?’রোশান ফারাজের দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করল।
‘ভালোবাসা?সেটা কি জিনিস?আচ্ছা যা মনে করো।আমি আমার বউকে ভালোবাসি নাকি ঘৃণা করি সেটা আমার ব্যাপার।তবে ফারাজ এলাহীর পদ্ধতি ভিন্ন। আমি ভালোবাসা দেই সব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।এটা ভালোবাসা না,এটা বিষ বুঝলে তো।’
‘আমি রুমে যাবো।’
‘আরে বাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি দেখতে পাচ্ছেন না ভাবী?এত দিন পর বাড়িতে ফিরলাম তাও আপনাদের মহিলাদের জন্য শান্তি নেই।আর রাজন ভাই আপনি আপনার বউ ঠিক করেন।ঠিক করার দায়িত্ব যদি আমি হাতে তুলে নেই তাহলে কিন্তু এলাহী বাড়ি থেকে আরেকটা লা*শ বের হবে।’
রাজন কোনো জবাব দেয় না। শুধুই শীতল চোখে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। নদীর লজ্জা লাগছে। এখন তো নিজের অবস্থা দেখেও মনে হচ্ছে প্রদর্শনের পাত্র।হঠাৎ রান্নাঘর থেকে কাজের মেয়ে নিলুফা এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
‘ভাই খাওন খাইবেন না আপনারা?’
‘না তোকে খাবো?’জোহানের অদ্ভুত কথায় মেয়েটা ঘাবড়ে গেল।আজ এক সপ্তাহ হয় নি সে এ বাড়িতে কাজ শুরু করেছে।কাউকে ঠিক ভাবে এখন অব্দি চেনে পর্যন্ত না।নিলুফার গায়ের রং ছিমছাম। নাকে একটা ছোট্ট নোলক। আঁটসাঁট দেহের প্রতিটি ভাজে দুরন্ত যৌবন।গলায় একটা তাবিজ ঝুলছে।চুলগুলোকে সবসময় বিনুনি করে রাখে।নিলুট মা বহু বছর ধরে এখানে কাজ করছে।তবে নিলু কাজ শুরু করার আগে কখনো এই বাড়িতে আসে নি।ফারাজ এক মুহুর্তের জন্য কপাল কুঁচকে নিলুকে দেখল।পরক্ষণেই বিরক্তিতে তার কপাল আরো কুঁচকে এলো।সে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল,
‘কথার মাঝে বা হাত ঢুকিয়ে প্রশ্ন করল কেন এই মেয়ে?সে কি নতুন নাকি?কেউ ওকে বলো নি মেয়ে মানুষের এমন বাড়াবাড়ি আমার সহ্য হয় না?’
রান্না ঘর থেকে নিলুর মা জলদি ছুটে আসলেন।মেয়েকে একটা ধমক দিয়ে বললেন,
‘তোরে কইছিলাম আমি এইহানে আইতে?যা মুখপুড়ী সবার কাছে ক্ষমা চাইয়া এখান থেকে যায়।’
‘মাফ করবেন ।’
ফারাজ কিছু বলল না।আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। মেয়েটি আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ায় নি।তবে মেয়েটি চলে যাওয়ার পর রোশন তার পাশে বসে থাকা ফারাজকে হিসহিসিয়ে কিছু একটা বলল।ফারাজ তাতেও জবাব দিল না। রোশান উঠে গেল।মোহনাকে কাছে ঢেকে বলল,
‘আমার পেট ভরা।তুমি ওই নতুন কাজের মাইয়াটারে এক গ্লাস লেবুর শরবত বানাইয়া আমার রুমে নিয়া আসতে কও।’
মোহনা কোনো জবাব দিল না।তবে রান্না ঘরে যাওয়ার সময় পেছন থেকে জোহান ডাক দিয়ে তাকে বলল,
‘শরবতের সঙ্গে গ্লুকোজ দিতে ভুইলো ভাবী।ভাই সারাদিন ঘরে বাহিরে কত পরিশ্রম করে।’মোহনা তাতেও জবাব দিল না।সে রান্না ঘরে চলে গেল।রাজন এখনো নিশ্চুপ। সে কি একটা ভেবে নদীকে বলল,
‘ভাত নিয়া রুমে আসো।’রাজন কথা না বাড়িয়ে উঠে গেল।তবে নদীর ভয় হচ্ছে।কিছুতেই রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না।
–
মার্জিয়া হা-হুতাশ করছেন।সোহাগ যে তাকে এতবড় জাটকা দিবে তা সে বুঝে উঠে নি।সারা রাত ছেলে বাহিরে থেকে এখন বাড়ি ফিরেছে বউ নিয়ে।মেয়ের গায়ের রং শ্যামলা।নাম জান্নাত।মার্জিয়া রান্না রেখে কাটাকাটি করছেন।মারিয়া মাহদীকে ফোন করে সব জানিয়েছে।তবে মাহাদী এখন চাইলেও আসতে পারবে না।কাজে আছে সে।কাজের চাপ ইদানীং অনেক বেশি।সোহাগ জান্নাতকে নিজের রুমে বসিয়ে দিয়ে আসে।ফ্রেশ হতে বলে তাকে।সোহাগকে ক্লান্ত লাগছে।বাড়ির মানুষ তার মুখ থেকে জবাব শোনার অপেক্ষা করছে।তবে কাউকে কোনো কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছে করছে না তাঁর।কি বলবে সবাইকে?চিত্রাকে সে এতদিন ব্যবহার করেছে?এসব প্রেম ভালোবাসা কিছুই ছিল না?চিত্রাকে দেখলে শুধুই কামুকতা জাগত তার?ভালোবাসা নয় এসব বলবে?তবে জান্নাতের সামনে এসব নিয়ে ঝামেলা করতে এখন মন চাইছে না।সোহাগ মায়ের রুমে এসে বসল।তার মা আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্না করছেন।বাড়িতে বউ এসেছে তাতে তার কোনো আফসোস নেই।আফসোস শুধু ছেলে তাকে না বলে এমন সময় বিয়ে করেছে সেই নিয়ে?আর সবচেয়ে বড় কথা সোহাগ এখনো বেকার।সংসার চালাতে এমনিতেই তাদের কষ্ট হয়। তার ওপর ঘরে নতুন একজন এসে জুটেছে?এখন একে কি খাওয়াবে?
সোহাগ মায়ের পাশে বসে বলল,
‘জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন।জান্নাতের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েও চিন্তা তোমার মধ্যে।কিন্তু চিন্তা কইরো না।আমি সব ব্যবস্থা কইরাই বিয়ে করছি।’সোহাগ নিজের সঙ্গে আনা একটা ব্যাগ খুলে মায়ের হাতে দিয়ে বলল ,
‘খুইলা দেখ।’
মার্জিয়া চোখ মুছে ব্যাগ খুলে দেখল এক ব্যাগ টাকা।চোখ তার ছানাবড়া।
‘এত টাকা!!’
‘আস্তে আম্মা।এখন কোনো প্রশ্ন কইরো না।জলদি আমাগো দিন বদলাইবো।আমি সোহাগ দিন বদলাইয়া দিমু।’
‘তুই কোনো খারাপ কাজে জড়াইয়া যাস নাই তো বাপ?’
‘মাথা খারাপ হইছে তোমার?তবে ভেতরের কথা যেন ফাঁস না হয়।’
‘তুই না চিত্রারে ভালোবাসতি?’
‘বাসতাম তবে এখন বাসি না।আর সে এখন অন্যের বউ।অন্যের খাওয়া জিনিসে সোহাগের নজর নাই।’
মার্জিয়া থমকে গেলেন।সন্দিহান কন্ঠে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘চিত্রার যে বিয়া কইছে ওইটা তুই কেমনে জানোস?ওর বিয়ার সময় তো তুই নিখোঁজ ছিলি?’
–
ফারাজ রুমে এসে শার্ট খুলে এসি বারিয়ে দিল।ইদানীং যেই গরম পড়েছে।ফারাজের ঘরে অনেকগুলো ইংরেজি ম্যাগাজিন ছিল।চিত্রা সেখান থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে চোখ বুলাচ্ছে।ক্ষিধে পেয়েছে তার।তবে এমন লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে যে কিনা তাকে অনাহারে রাখিয়ে মারতে যায়।মানে লোকটা হাতে,ভাতে সব দিক দিয়েই তাকে মারার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।হঠাৎ কাজের মেয়ে রুমে এসে খাবার দিয়ে যায়।চিত্রা একবার আঁড়চোখে খাবারের দিকে তাকায়।খাবার দেখে ক্ষুধা আরো বেড়ে গেছে।তবে একটা প্লেট কেন?
‘বউ?এই বউ?খালি কি ম্যাগাজিন পড়ে পেট ভরবে?আসো একটু ভালোবেসে তোমার মনটাও ভরিয়ে দেই।’
চিত্রা আবার অবাক হলো।এটা কি মানুষ নাকি গিরগিটি?একটু আগে নিচে সকলের সঙ্গে কেমন আচরণ করল আর এখন পিরিত একেবারে গলে গলে পড়ছে।
‘আপনি এত বেহায়া কেন?আর সকলের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন কেনো?কয়টা রুপ আপনার?’
‘আমি শুধু তোমার জন্য বেহায়া বউ।তবে রুপ হাজারটা থাকলেও তোমার জন্য ভালোবাসার রুপটাই রেখেছি।আসো না একটু কাছে,মনটা আমার বড্ড ক্ষুধার্ত। ‘
ফারাজ গলা ফাটিয়ে গান গায়,
“আয় না করি ফষ্টিনষ্টি
দেখতে নোনতা খেতে মিষ্টি
টাং টাং টাং….”
চিত্রা চেঁচিয়ে উঠে,
‘নষ্টামি না করে গিয়ে ভাত খান?আমার মাথা কেনো খাচ্ছেন?খাবারের আকাল পড়েছে নাকি?’
‘খাবার তো দুনিয়াতে অনেক আছে?তবে আমার বউয়ের থেকে সুস্বাদু দু’টো নেই। আসো বউ আজ তোমাকে খেয়ে একটু টেস্ট করি। চিন্তা করো না আমি আবার ভালো রিভিউ দিতে পারি।’
ফারাজ চিত্রার ম্যাগাজিনটা হাত থেকে নিয়ে নিল। চিত্রা অবাক হয়ে তাকানোর সুযোগও পেল না।এরই মধ্যে ফারাজ তাকে নিজের কোলে টেনে নিলো।চিত্রার শ্বাস ভারী হয়ে এল। সে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই ফারাজ তার ঘাড়ে হাত রেখে মাথা নিজের দিকে টেনে নিলো। সময় যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছে।ফারাজ চিত্রার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।গভীর একটা চুমু এঁকে দিলো।চিত্রা শিউরে উঠল।হাত দুটো দিয়ে ফারাজের বুকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করল।কিন্তু ফারাজের শক্ত আলিঙ্গন হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল। চিত্রার হৃদস্পন্দন বেগ পায়। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে,বুকের ভেতর ঝড় বইছে।কয়েক মুহূর্ত পর ফারাজ ধীরে ধীরে তাকে ছেড়ে দিল। চিত্রা হাঁপিয়ে উঠছে।বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে।তার চোখেমুখে বিস্ময় আর বিভ্রান্তি।ফারাজ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। চিত্রার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন লাগলো বউ?’
চিত্রা রাগে কটমট করছে।ফারাজকে ধাক্কা মেরে নিজের কোল থেকে সরিয়ে দাঁত পিষে সে জবাব দিল,
‘এলাচের মত লেগেছে বুঝতে পেরেছেন মিস্টার এলাচী? অসভ্য লোক কোথাকার।ধ*র্ষন মামলা দিয়ে যদি আপনাকে হাজতে না পাঠাই তবে আমার নামও চিত্রাঙ্গনা নয়।’
চলবে?
(আজকে আপনাদের দিন কেমন কাটলো আমার তো অন্যের পিরিত দেখতে দেখতে কেটেছে)