#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১০
“নারী পুরুষের অর্ধাঙ্গ,” মা বলতেন, “স্বামী যতই খারাপ হোক, কখনো অসম্মান করবে না। স্বামীই তোমার আসল অভিভাবক। মারলেও, কাটলেও, ভোগ করলেও সব মেনে নিতে হবে।”
নদী মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে। রাতবিরেতে স্বামী বাইরে থাকে, ভোর হলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে, সারাদিন ঘুমায়। মদ খায়, নারীদের দেখলে তার হুঁশ থাকে না। যখন ইচ্ছে গায়ে হাত তোলে, যখন ইচ্ছে তখন দখল নেয় তার শরীর। নদী সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে। কারণ মা বলেছিলেন, “এটাই তোমার নিয়তি।”এ বাড়িতে কষ্ট দেওয়ার মানুষের অভাব নেই।কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই। নদীর বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো। এই এক বছরে সে বুঝে গেছে, এলাহীদের প্রাসাদসম বাড়ির ভিতরে লুকনো গল্পগুলো কতখানি ভয়াবহ। যখন তার প্রস্তাব এসেছিল, নদীর মধ্যবিত্ত পরিবার তখন বিস্মিত হয়েছিল। তারা ভাবেনি যে, এত বড় ঘরের ছেলে তাদের দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করবে। নদীর বাবা দর্জি ছিলেন।সারা জীবন সুঁই-সুতোর মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন। গোটা পরিবারটাই কাপড় সেলাই করেই জীবন চালাত।পারিবারিক পেশা যাকে বলে।এসএসসির পর নদীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ সংসারের পেট চালানোর জন্য বইয়ের পাতা নয়, সুই-সুতা ধরাই ছিল জরুরি।তবে এখন নদী জানে, কেন এলাহীরা তাদের দরজায় এসেছিল। সে জানে, কেবল একজন বউ নয়, একজন নির্বাক দাসী চেয়েছিল তারা।বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটাই কষ্টের দাগ এঁকে দিয়েছিল নদীর মনে। লাল বেনারসিতে সজ্জিত হয়ে, গয়নায় সেজে অপেক্ষা করেছিল সে। স্বপ্ন দেখেছিল নতুন জীবনের। কিন্তু সে রাতেই সে বুঝে গিয়েছিল স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে বিস্তর ব্যবধান।রাজন সেই রাতে আসেনি। তার মুখ পর্যন্ত দেখা হয়নি নদীর।বিয়ের এক সপ্তাহ পার না হতেই সে জানতে পারল, রাজন বাসর রাতে তার পাশের ঘরেই ছিল। তবে তার পাশে নয়,অন্য কারো। বাড়ির একজন কাজের মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটিকে নদী একবার দেখেছিল।পরে আর কোনো খোঁজ পায় নি।এলাহীদের এই বাড়িতে কে কবে আসে, কে কবে হারিয়ে যায়, তার হিসাব কেউ রাখে না।রাজন দেখতে অসাধারণ। আল্লাহ যাকে দেয় তাকে সব দিক থেকেই দেয়।মেয়েরা রাজনের টাকা আর চেহারা দেখেই সঙ্গ দিতে রাজি হয়ে যায়।তবে সব মেয়েরা আবার এমন নয়।নদী এই বাড়ির বড় বউ হলেও বয়সে সে মোহনার থেকেও ছোট।রাজনের চার নম্বর স্ত্রী সে।তবে মোহনার মত সুন্দর নয় সে।সে মোহনার মতো শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে না।সাজতে পারে না।স্টাইলও করতে পারে না।তার কাছে ফ্যাশন মানে ওই একটা শাড়ি পড়া,হাতে মুঠো-মুঠো চুড়ি আর বড়োজোর হাত-পা দুটোকে আলতায় রাঙিয়ে চোখের নিচটা কাজলরেখায় মুড়িয়ে দেওয়া।রাজনের চার নম্বর স্ত্রী নদী।স্বামীকে কখনো জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি আগের তিনজনের সঙ্গে কি হয়েছিল?তারা কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।নদী যেই বাচ্চাটিকে একবছর ধরে পালছে তা নদীর তিন নম্বর সতিনের মেয়ে।ছোট্ট একটা পুতুল বলা চলে।নুড়ি নিজের মেয়ের মতো করেই একে পালন করছে।নুড়ি কাছে থাকলে দুঃখকেও সহনশীল মনে হয় নদীর।তবে মাঝে মাঝে খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।আজ একবছর হলো পরিবারের কারো সঙ্গে দেখা হয় নি তার।কথাও হয় নি।রাজন বিয়ের পরদিনই জানিয়ে দিয়েছিল, “যদি ওই বাড়ি যাও তাইলে এই বাড়িতে ভুলেও পা রাখবা না।”
বিয়ের দ্বিতীয় দিন স্বামীর বাড়ি থেকে পরিত্যাগ হলে সমাজ নদীকে কোন চোখে দেখত?তার বাবা-মায়ের অবস্থা কেমন হত?তবে রাজন এক বছর ধরে নদীর পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছে।নদীর ছোট বোনের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে।ভাইটাকেও বিয়ে করিয়েছিল রাজন।একটা চাকরির ব্যবস্থাও সেই করে দিয়েছিল।দেখা সাক্ষাৎ না হোক তবে নদী জানে তার পরিবার সুখে আছে।যেই সুখটা নদী তাদের দিতে পারে নি তা রাজন দিচ্ছে।তাই কখনো নদীর সাহস হয় নি রাজনের বিরুদ্ধে যাওয়ার।আঙ্গুল তুলে তর্ক করার।এই বাড়ির নারীদের নীরবতাই আসল অস্ত্র।
“ভাবী আসবো?” নদী ভালো করে শাড়ি দিয়ে শরীর ঢাকল।মাথায় একটা ঘোমটা দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আসো আসো।বাহিরে কেন দাঁড়াইয়া আছো?”চিত্রা রুমে ঢুকে চারপাশটা দেখল।রুমটা একেবারে সাধারণ ভাবে সাজানো।ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র কাঠের তৈরি।তাতে আবার ডিজাইন করা।জমিদারি একটা ভাব আছে।চিত্রা বিছানার ওপরে গিয়ে বসল।একবার ঘুমন্ত নুড়ির দিকে চেয়ে বলল,
” নুড়ি দেখতে একেবারে ভাইয়ার মত হয়েছে।মাশাল্লাহ একটা পরী।”
নদী মেকি হাসল।ব্যাথায় গা এখনো জ্বলছে।নদীর অস্তিত্ব লাগছে।
“ভাইয়া কোথায়?”
“উনি?উনিতো কামে গেছে।”
“রাতের বেলা?”
“হ।রাতেই তো তেনাগো সব কাম।রাইতে হাওরে জাল ফালাইবো জেলেরা।ভোরে সেই মাছ আড়তে যাইব।আবার সেইখান থাইকা কত খানে যাইব।তেনাগো সব ব্যবসা।তেনাগোর তো সেইখানে থাকোন লাগবো তাই না?”
চিত্রা জবাব দিল না।কিয়ৎক্ষণ থেমে বলল,
“অদ্ভুত কাজকর্ম।কিন্তু ফারাজ তো কাজে গেল না।বাড়িতেই তো আছে।”
নদী ভ্রু কুঁচকালো।প্রশ্ন করল,
“যায় নাই?ওহ।আসলে হেয় তো বিদেশের কারবার সামলায়।এইখানে তার কাজ না থাকতেও পারে।আমি ঠিক কইতে পারি না।”
“ফারাজ বিদেশে কিসের ব্যবসা করে?”
নদী থমকালো।নড়েচড়ে বসে বলল,
“এই ব্যবসাই তো।দেশের বাহিরে মাছের অনেক চাহিদা।বিভিন্ন দেশে দেশীয় মাছ রপ্তানি হয়।সেইসব বিষয় তদারকি করে ফারাজ।তবে তার নিজ….”
“বড় বউ।” রুমানা এলাহী এসেছেন।সচারাচর তিনি বউদের ঘরে আসেন না।জরুরী দরকার পড়লেই আগমন ঘটে তার।রুমানার শরীর ভর্তি স্বর্ণের গহনা।সারাদিন পান চিবোতে থাকেন।
“ওমা ছোট বউও দেখি এইখানে আছে।তো আমার দুই বউ কি গপ্প করতাছে?”
চিত্রা মাথায় ঠিক করে ঘোমটা টেনে দিয়ে জবাব দেয়,
‘কিছু না আম্মা।এই তো নুড়িকে দেখতে এসেছিলাম।আচ্ছা আপনারা থাকেন।কথা বলেন।আমার এমনিতেও ঘুম পাচ্ছে।”
চিত্রার কেন জানি মনে হচ্ছিলো তার শাশুড়ী নদী ভাবীর সঙ্গে জরুরি কোনো কথা বলতেই এ ঘরে এসেছেন।চেহারায় কেমন যেন একটা অস্থিরতা ছিল।তাই ইচ্ছে করেই দু’জনের মাঝ থেকে উঠে যায়।
ফারাজ বাড়ির গ্যারাজে গেছে।গাড়িতে কি একটা নাকি ভুল করে রেখে এসেছে সেটাই আনতে গিয়েছে।চিত্রা রুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখল।সোহাগ তাকে এতবড় ধোঁকা দিল কিন্তু চিত্রার কষ্ট হচ্ছে না কেন?চিত্রার মন এখন আর সোহাগের জন্য ব্যাকুল হচ্ছে না কেন?তবে কি একেই মানুষ ঘৃণা বলে?হয়তো সোহাগের প্রতি তৈরি হওয়া ঘৃণাই চোখের জল মাটিতে পড়তে দেয় নি।জীবনে একটা মানুষকে সে আপন ভেবেছিল।সেই লোকটাও তার সঙ্গে ছলনা করেছে।চিত্রার বাবা-মাও তো তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।নিজেকে ওপারে বসে তামাশা দেখার জন্য তাকে ফেলে রেখে গিয়েছে।না জানি মৃ*ত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে আর কি কি সহ্য করতে হয়।চিত্রার হুট করে ফারাজের কথা মনে পড়ল।আচ্ছা ফারাজ কি সত্যি তাকে ভালোবাসে?ভালোবাসে বলেই কি সেই রাতের সর্বনাশ হতে রক্ষা করেছে তাকে?আচ্ছা এক দেখায় আদৌও কি ভালোবাসা হয়?
চিত্রা গায়ের শাড়িটার দিকে তাকায়। এটাকে কি রং বলে?পিচ কালার?বিয়ের আগে কখনো শাড়ি পড়ে নি সে। শাড়ি সামলানো যুদ্ধ করার চেয়েও কঠিন। কখন কার সামনে খুলে যায়। ছি কি লজ্জা!চিত্রার গায়ের রং ফর্সা। আলাদা করে সাজসজ্জার প্রয়োজন নেই।সাজেও না সে। চিত্রার চুলে খোঁপা করা ছিল। কপালের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা চুলগুলোকে সে হাত দিয়ে ঠিক করে। হঠাৎ শীতল দু’টো হাত পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল।
“আগুন সুন্দরী…”
এলাচীর মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে আসছে চিত্রার।এই গন্ধ বোধহয় ১০০ হাত দূর থেকেও পাওয়া যাবে।অনেক স্ট্রোং একটা গন্ধ।ফারাজ পেছন থেকে কি একটা যেন চিত্রার গলায় পড়িয়ে দেয়।চিত্রা আয়নার দিকে তাকায়।একটা নেকলেস। চিকন একটা নেকলেসে ছোট্ট একটা হার্ট আকৃতির লকেট।
“তোমার গায়ের রংয়ের সঙ্গে স্বর্ণের রংটা মানানসই। দেখো চেয়ে সুন্দরী কি অপূর্ব লাগছে।তোমার গলায় যাওয়া মাত্রই স্বর্ণের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে।”
চিত্রা পেছনে ঘুরে ফারাজের দিকে তাকায়।ছেলেদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস কোনটা?ফারাজকে দেখল চিত্রা।লোটকার সব কিছুই তো আকর্ষণীয়।
“আমাকে কেনো দিলেন এটা?”
“আমার বউকে আমি দিয়েছি তাতে তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?”
“আপনার বউ কে?”
ফারাজ চিত্রাকে আয়নার দিকে ইশারা করল।চিত্রা আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখল।
“ওই যে আগুন সুন্দরীটাকে দেখছ না?ওটা আমার বউ?জানি দেখে অনেক হিংসা হচ্ছে।নজরও দিতে পারো।তবে সমস্যা নেই বউকে আমি নজর কাটার মন্ত্র পড়ে ফু দিয়ে দিয়েছি।”
“আপনার ভিতরে এত বেহায়াপনা কোথা থেকে আসে জানতে পারি?”
“আসে মানে?৩০ বছর ধরে সব যত্ন করে তুলে রেখেছি শুধুমাত্র বউকে উজার করে দিবো বলে।”
“ছাড়ুন তো।” চিত্রা বিছানার দিকে যেতে নিলে ফারাজ তাকে আবারো নিজের কাছে টেনে বলে,
“ধরেছি কি ছাড়ার জন্য? ধরেছি সারাজীবন আগলে রাখার জন। আমৃত্যু ভালোবাসার জন্য।”
” আচ্ছা আপনার লজ্জা নেই কেন বলুন তো?একটু লজ্জা করতে শিখুন।”
“লজ্জা? ওইটা আবার কি? হারপিক জাতীয় কিছু নাকি? ওইসব তো বাথরুমে থাকে। আমার মধ্যে কেন থাকবে? কোন দিক থেকে আমাকে বাথরুম মনে হয় ছোটলোক বউ?
“মজা করছেন?”
ফারাজ কামুক চোখে চেয়ে বলল,
“না। তবে তুমি চাইলে এখনি মজাটা শুরু করতে পারি?ডু ইউ ওয়ান্ট?”
“নো নিড।”
“বাট আই নিড ইউ।” ফারাজ এলাহী চিত্রার গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।কেঁপে উঠল চিত্রার ভেরতটা।এখনও তো সোহাগের ক্ষতই সে সামলে উঠতে পারে নি।না না ফারাজকে কিছুতেই নিজের কাছে আসতে দেওয়া যাবে না।
“কি করছেন?ছাড়ুন বলছি।” চিত্রা ফারাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
“তুমি শুধুই আমার চিত্রা।কখনো যদি আমার থেকে দূরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনো তবে খোদার কসম জবাই করবো তোমাকে।নিশ্চয়ই তুমি আমার হাতে জবাই হতে চাও না?”
চিত্রাকে পাঁজা কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়।তারপর শার্টের বোতামে হাত দিয়ে বেহায়ার মত হেসে বলে,
“আমাকে বেহায়া বলেছ না?চলো তোমাকে আজ বেহায়াপনার ডেমো দেখাই প্রিয়তমা।”
চলবে?
(আরো লেখার কথা ছিল।তবে চোখে যেই ঘুম।ঘুম নিয়েই খালি হাত চালাইছি।আজকে অনেক বানান ভুল থাকতে পারে।বানান গুলো ধরিয়ে দিয়েন কাল ঠিক করে দিবো।)