#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৪ (প্রথমাংশ)
( সতর্কবার্তা: সহিংসতা আছে।)
বৃষ্টির পানি আজ রক্তা*ক্ত। আকাশ নিজেই আজ শোকগ্রস্ত হয়ে ঝরছে। বিদীর্ণ ধরনীর বুকে লালচে জল জমে আছে। রাস্তায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু চিত্রা কিছুই টের পাচ্ছে না। তার শরীর নিথর, চোখের পাতা ভারী। র*ক্তের স্রোতে সবকিছুই যেন ধোঁয়াশা।গুলিটা তাকে ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে পারেনি। বরং তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটার মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। মস্তিষ্কের ছিটকে পড়া টুকরোগুলো চিত্রার শরীরে এখনো লেগে আছে। ভয় আর ধাক্কায় তার হাত থেকে ফুচকার প্লেট পড়ে গেছে কাঁদাজলে। হৃদপিণ্ডের গতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সমস্ত শরীর নিস্তেজ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে নেয় চিত্রা। তবে ফারাজ পড়ার আগেই তাকে সামলে দেয়। কয়েকটা মুহুর্তে কি থেকে কি হয়ে গেল? ফারাজের চোখে মুখে আতঙ্ক তবে র*ক্ত কিংবা গুলির শব্দে নয় বরং চিত্রার নেতিয়ে পড়া দেখে। কেমন যেন একটা অনুভব হচ্ছে তার। ওইযে গলায় মাছের কাটা বিঁধলে কিংবা শরীরের প্রতিটি অংশ ফালি ফালি করলে যেমন যন্ত্রণা হয় ঠিক তার চেয়েও বেশি । এক লহমার জন্য ফারাজ নিজেও থমকে যায়। একবার তাকায় বাচ্চা ছেলেটার লুটিয়ে পড়া র*ক্তাক্ত দেহের দিকে অন্যবার তার বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা নিষ্পাপ প্রিয়তমার দিকে। গুলির শব্দে অভ্র দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে আসে। চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তবুও মানুষ অবিরাম ছুটছে। মানুষের তো বাঁচতে হলে ছুটতেই হবে। কিশোরগঞ্জে ইদানীং ছিনতাইকারী, সন্ত্রাস, ডাকাতি ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। এর মূল কারণ কি এখানকার কাউন্সিলর জাতীয়তাবাদী বলে? ইশরে সামান্য ক্ষমতা পেতেই পালোয়ান সাহেবরা অরাজকতা শুরু করেছে? যদিও তাদের দিয়ে এসবই আশা করা যায়। দলের দোষ দিয়ে লাভ নেই।
ফারাজ ভিজছে। চিত্রাকে সঙ্গে নিয়েই ভিজছে। রাগে তার কপালের শিরা অব্দি নীল হয়ে এসেছে।চোখে জমেছে দপদপে আগুন। অভ্র ছুটে আসে। সঙ্গে ফারাজের বাকি লোকজনও। সবাই তাকে ঘিরে রাখে, যে-কোনো মুহূর্তে আবারও গুলি চালাতে পারে সন্ত্রাসীরা।
“ভাই, জলদি উঠেন!ভাবীরে নিয়ে গাড়িতে যান ভাই! এখানকার পরিস্থিতি ভালো না। কালকে জেল থেকে সাবেক বিএনপি নেতা নাশিদ পালোয়ান পালিয়েছে। দেশের অবস্থা খুব খারাপ। ভাই, দেরি করবেন না!”
ফারাজ দাঁতে দাঁত চেপে একটা ঢোক গিলল। চোখের শিরাগুলো রক্তিম হয়ে উঠেছে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে সে চিত্রাকে শক্ত করে কোলে তুলে নিলো।
“চিত্রাকে নিয়ে তুই হাসপাতালে যা।”
অভ্র দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “ভাই!”
“আমি যা বলছি, তাই কর।”
“কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আপনি কোথায় যাবেন? কাকে ধরবেন? আগে ভাবীকে সুস্থ হতে দিন, ভাই!”
“মেজাজ গরম করাস না।”ফারাজ অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,”আমি জানি এসব কার কাজ। খুব ভালো করেই জানি। তুই চিত্রাকে নিয়ে হাসপাতালে যা। চিত্রা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আগেই আমি আমার কাজ সারবো। আমার কলিজার ওপর হাত দেওয়া? শালাদের কলিজা ছিঁড়ে এনে যদি কুত্তাকে না খাওয়াই তাহলে আমার আব্বা দুইটা।”
অভ্র একটা শুষ্ক ঢোক গিলে। এসব ঝামেলায় না গেলে কি হয় না? যেই কাজের জন্য দেশে আসা সেইটা শেষ করে চলে গেলেই তো হয়?শুধু শুধু শত্রু বাড়ানোর কি দরকার? ফারাজ অভ্রকে পাশ কাটিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তার লোকগুলো মাথার ওপর ছাতা ধরতে গেলে, ফারাজ হুংকার ছাড়ে,
” আরে বা*ল ছাতা সরাবি? নাকি ছাতা তোদের পেছ….ছাতা সরাহ।”
লোকগুলোর সাহস হয় না আর এগোনোর। ফারাজ চিত্রাকে গাড়িতে শুইয়ে দেয়। কালো বোরকা পড়া মেয়েটার মুখে এখনো নিকাব। ফারাজ হাত বাড়িয়ে নিকাব সরিয়ে দিয়ে অভ্রকে নির্দেশ দেয়,
“ফারিয়াকে একটা কল করে হাসপাতালে আসতে বল। আর শুন এসব খবর যেন বাড়ির কেউ এখনি না জানতে পারে।”
ফারাজ আরেকবার চিত্রার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“ও আমার আমানত। আমি ফেরার আগ অব্দি ওকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তোর। যদি কোনো ভুল হয় রে তাহলে রাম দা দিয়ে তোর কল্লা কেটে স্পেশাল মুড়িঘন্ট বানাবো।”
অভ্র জবাব দেয় না। গাড়ি ছেড়ে দেয়। তবে যাওয়ার আগে মেয়েলী গলার একটা কান্নার শব্দ তার কানে ভেসে আসে। ওই বাচ্চাটার মা এসেছে বুঝি? লা*শের সামনে পড়ে হাহাকার করছে? সাহায্যের জন্য আকুতি করছে? আচ্ছা সন্তান হারানোর বেদনা সত্যিই খুব পিঁড়া দেয়?
–
চারটে লাশ পরপর সাজানো। নিথর, বিকৃত, নিঃশেষ। চারজনই সোহানের লোক। সোহান ধীরে ধীরে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আর গভীর দৃষ্টিতে লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। খু*নের ধরন দেখে বোঝাই যাচ্ছে, একেবারে পেশাদার কাজ। ছেলেগুলো একটা মাদ্রাসা ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধ*র্ষণ করেছিল। তারপর ভোরে হ*ত্যা করে জঙ্গলে লা*শ ফেলে দিয়ে যায়। কিন্তু আফসোস তাদের কর্কম গুলো মানুষের চক্ষুনজরে পড়ে যায়। বলদগুলো একটা কাজও যদি ঠিক করতে পারত! প্রতিটি লাশের হাতের আঙুল কাটা, নখ তোলা, কান ছেঁড়া। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, ওদের “মূল্যবান” জিনিসটাও কেটে ফেলা হয়েছে। সোহান ধীরে ধীরে লুঙ্গির ভাঁজ ঠিক করল। মুখে তেতো হাসি ফুটল।
“চ্যাহ! শালাগুলারে একেবারে হিজড়া বানাইয়া উপরে পাঠাইলো! কামডা কি ভালা হইলো?”
সিফাত পাশেই দাঁড়িয়ে, চুপচাপ। তার মুখ গম্ভীর। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ভাই, সবাই জেনে গেছে যে ওরা আমাগো দলের লোক ছিল। তার ওপর ধ*র্ষণ আর খু*নের ব্যাপারটা হাইপ্রোফাইল। কেমনে হ্যান্ডেল করুম?”
সোহান গোঁফে আঙুল বুলিয়ে এক পা তুলে বসল। তার কালো চামড়ায় ঘামের চিকচিকে আভা। চোখে অদ্ভুত এক ঝলক। সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে ভারী মেঘ। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু পেছন থেকে নদীর ঢেউয়ের শব্দ আসছে।
“জনগণ নাকি গণধোলাই দিছে?”
সিফাত মাথা নাড়ল, “হ ভাই, মেয়েগুলাও মারছে। জুতার বারি দিছে।”
“তাইলে হাতের আঙুল আর কান আর ওইডা কাটল কে? তাও আবার এমন কইরা?”সোহান লা*শগুলোর দিকে তাকিয়ে একবার ঠোঁট ভেজাল। এইভাবে শাস্তি দেওয়ার মতো ক্ষমতা ওই মাদ্রাসার মেয়েগুলোর কিংবা জনগনের থাকার কথা না। কারন সবাই জানে এরা কার লোক। কেউ রাগ-ক্ষোভ মিটাইছে নিশ্চিত। কিন্তু কে?”
সোহানের কালো চামড়া চকচক করছে। সে গোঁফে হাত বুলিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে আরো কিছুক্ষণ লা*শ চারটের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যা কেবল এখন। আকাশে বৃষ্টি নেই তবে মেঘ জমে আছে। সকলের মতে এই চারজনকে জনগণ ধরে গনধোলাই দিয়েছে। মাদ্রাসার মেয়েগুলোও সেখানেই ছিল। জুতার বারি দিয়েছে। তবে সোহানের কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। মারধোরের ধরন দেখে মনে হয়েছে কেউ রাগ-ক্ষোভ মিটিয়েছে। কিন্তু কে?
“এখন লা*শগুলা তো উদ্ধার করতে পারছি তবে এগুলারে কি করমু?পুলিশ তো লা*শ খোঁজা শুরু কইরা দিছে।” সিফাত বলল।
” ট্রলারে মানুষ আছে না?”
“জে।”সিফাত কাঁধ ঝাঁকালো।
“চুরি-চাপাতি দিয়া পোলাপান গুলারে কাজে লাগাইয়া দে। লা*শগুলারে টুকরা টুকরা কইরা নদীর মাছগুলারে পেটভইরা খাওয়ানের ব্যবস্থা কর। লাশ হচ্ছে গিয়া প্রমান। লা*শ থাকলে প্রমান থাকবো,প্রমান থাকলে পুলিশ ঘাটাঘাটি করবো। গু যত লাড়বি তত গন্ধ ছুটবো। যা এখন। যেইতা কইছি ওইটা কর।”
সিফাত মাথা ঝাঁকালো। “বুঝছি ভাই।” একটু থেমে আবার বলল,
“ভাই, আরেকটা কথা। কাল রাতে যে চালান যাওয়ার কথা ছিল?ওইখানে ঝামেলা বাঁধছে। মাল দুইদিন পর তেনারা নিবো।”
সোহান ধীরস্থিরভাবে সিগারেট জ্বালাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা সমস্যা নাই। টাকা পাইছি এখন মাল নেক বা না নেক আমার তাতে যায় আসে না। তো মাইয়াগুলার যত্ন নিতাছোত তো?”
“হ।”
“সাবধান থাকবি। মাইয়া মানুষ হইলো ঝামেলা। তার ওপর এতগুলা মাইয়া মানুষ। ওগো হদিস যেন ভুলেও কেউ না পায়।”
সিফাত মৃদু করে হু বলে থামল। একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল,
“ভাই!”
“কইয়া লা।”
“কাল রাতে যে নতুন মাইয়াটারে আনছি, ওইটা কিন্তু এক্কেরে হিরা! চাইলে তৈয়ার কইরা রাতে আপনার কাছে পাঠাইতে পারি। আপনে তো ইদানীং অনেক চিন্তায় থাকেন।”
সোহান নদীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সিফাতের দিকে তাকাল।
“নাম কী ছ্যামড়ির?”
সিফাত একটু ভেবে বলল,
“নিলু… নিলুফা ওর নাম।”
–
চারপাশে মৃদু হলুদ আলো ছড়িয়ে আছে। বাতাসে শুকিয়ে যাওয়া র*ক্তের গন্ধ। মাটিতে পড়ে আছে একটা পুরুষ। চোখ বাঁধা। শরীরের বিভিন্ন অংশ নিখুঁতভাবে ছেঁটে নেওয়া হয়েছে। পুরোই দক্ষ কসাইয়ের কাজ লাগছে। তার চারপাশে আরও পাঁচটি নিথর দেহ পড়ে আছে।সামনের কাঠের চেয়ারে বসে থাকা ফারাজ পিস্তলট হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। তার চোখেমুখে অদ্ভুত দীপ্তি। মনে হচ্ছে মৃ*ত্যু তার জন্য নতুন কিছু নয় বরং একপ্রকার শিল্প। চারপাশে কালো পোশাকে ঢাকা কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের উপস্থিতি বাতাসের মতোই স্বাভাবিক তবে ভয়ানক। ফারাজ ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াল। একঝলক চারপাশে তাকিয়ে ইশারা করতেই একজন এগিয়ে এসে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার চোখ থেকে কালো কাপড়টা সরিয়ে দিল। লোকটা এক পলক তাকাল ফারাজের দিকে। ভেতরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। গলাটা ঢিলে হয়ে এসেছে। শরীর আরও বেশি কুঁকড়ে গেছে। ফারাজ হাঁটু গেড়ে বসে তার থুতনিতে ঠান্ডা ধাতব পিস্তলটা ঠেকাল। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বিদ্রূপাত্মক হাসি টেনে বলল,
“ট্রিগারটা তুমিই চালিয়েছ, তাই না জান্টুস?”
লোকটা থরথর করে কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু শব্দ বের হচ্ছে না। ভূমিকম্প হলে যেভাবে মাটি কাঁপে, ঠিক সেভাবেই কাঁপছে তার শরীর।
“ক… কথা বলো না কেন জন্টুমন্টু? তোমার সঙ্গে কি আমি এখানে বাসর সারতে এসেছি?তো লজ্জায় তোমার জবান অব্দি বাদরের পশ্চাৎদেশের মতো লাল হয়েছে কেন? মুখ থেকে স্বরবর্ণ- ব্যঞ্জনবর্ণ কিচ্ছু বের হচ্ছে না?বাট হুয়াই কাল্লু?”
“ভা..ভাই, কাউরে মারার উদ্দেশ্য আমার ছিল না…”
“তো? মাঝ রাস্তায় শাড়ি-চুড়ি পড়ে নার্গিস আপার গানে ডিসকো ডান্স দিয়ে জনগণের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল?”
লোকটা মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ভ…ভাই, ক্ষমা কইরা দেন। আর কোনোদিন ছিনতাই করমু না!”
“তোর নাম কি রে জলহস্তী?
লোকটা ঢোক গিলে বলল, হা..হারুন।”
ফারাজ লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখেমুখে প্রচণ্ড বিরক্তি। “আমি চিন্তা করি, তোদের এত সাহস দিলটা কে শা*লা?? দিনদুপুরে মেইনরোডে পিস্তল উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানো? পাবলিকের গায়ে হাত তোলা? গুলি ছোড়া, ছিনতাই করা?বাহ বাহ তালিয়া।
ছিনতাইকারীর মুখ শুকিয়ে গেছে। চোখদুটো পানিতে ভেসে যাচ্ছে। গলার শব্দ কেঁপে উঠছে কান্নায়। পুরুষ মানুষ শব্দ করে কাঁদছে। লজ্জার বিষয় না? ফারাজের কাছে এসব ছিনতাইকারীরা কখনোই “পুরুষ সমাজের” অংশ ছিল না। ভীরু কাপুরুষদের দেখলেই তার গায়ে জ্বালা ধরে যায়। এমন লোকেরা শুধুই ভয় পায়, কিন্তু সেই ভয় তাদের বদলায় না।
“ভাই, ছাইড়া দেন!” লোকটি আবারও আকুতি জানায়, কণ্ঠে ভয় আর অনুনয়ের স্পষ্ট ছাপ।
“দয়া দেখাতে বলছো শালা? তুমি বোধ হয় জানো না দয়া নামক ছোটলোকি শব্দ ফারাজ তার অভিধান থেকে মায়ের গর্ভে থাকতেই কিক মেরে বের করে দিয়েছে।” ফারাজ থামল।
“এমন কইরেন না ভাই। আমার বাসায় বউ বাচ্চা আছে। আমি ছাড়া তাগোর কেউ নাই।”
বিরক্তিতে মুখ বাঁকায় ফারাজ, “ছ্যাহ! তুমি তো একেবারে বাচাল সোনা।তোতাপাখির মতো পটপট করা তোমার মতো কালো চামড়ার গরিলার মুখে একদম মানায় না।”
লোকটি চুপ করে যায়। ফারাজের চোখে কেমন এক যেন একটা অদ্ভুত উপহাস খেলা করছে।হয়ত তার সামনে বসে থাকা ব্যক্তিটি মানুষ নয়, এক ক্ষুদ্র, তুচ্ছ কিছু। ফারাজ উঠে দাঁড়ায়। প্যাকেট থেকে একটা ধারালো ছুড়ি বের করে লোকটার আঙ্গুলের দিকে তাকায়। এই আঙুল দিয়েই তো ট্রিগার প্লেস করেছিল। তাই না? দু’জন কালো পোশাকধারী ব্যক্তি হারুনকে শক্ত করে তুলে বসায়। চেপে ধরে তাকে। হাতের আঙুলগুলো শক্ত করে টেনে ধরে যেন নড়তে না পারে। তবে নড়ার ক্ষমতাই বা কোথায়? তার শরীরের প্রতিটি জয়েন্ট ইতোমধ্যেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে এখন এখন কেবল নিস্তব্ধ, যন্ত্রণার ভারে অবশ তার দেহ। ফারাজ ঝু্ঁকল। কোনো সতর্কতা ছাড়াই এক ঝটকায় ছুরিটা চালিয়ে দিল। ছ্যাঁৎ! ডান হাতের তর্জনী মুহূর্তেই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গভীর কাটা অংশ থেকে গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ে।গটগট শব্দে মেঝেতে ছড়িয়ে যায়। ভোঁতা, কর্কশ এক আর্তনাদ ঘরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। তারপর মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা। কিন্তু নিস্তব্ধতা স্থায়ী হয় না। পরপর কয়েকটি আর্তনাদ বদ্ধ কক্ষের লোমহর্ষক পরিস্থিতির জানান দেয়। প্রতিটি চিৎকার ক্রমে ম্লান হয়ে আসে। ব্যথার চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুভূতিগুলো নিস্তেজ হয়ে আসছে। ফারাজের সামনে পড়ে আছে দশটি বিচ্ছিন্ন আঙুল। মেঝেতে জমে থাকা র*ক্তের কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারপাশ।ফারাজের শরীরের শার্ট টাও র*ক্তে ভিজে একাকার। মুখে র*ক্ত ছিটকে কি ভয়ানক দেখাচ্ছো তাকে। আগের থেকে বিরক্তভাব কিছুটা কমেছে,ফুটে উঠেছে এক শীতল, বিকৃত আনন্দ। হারুনের শরীর ধীরে ধীরে মাটিতে ঢলে পড়ে। তার গা থেকে শার্টটা কে যেন ছিঁড়ে খুলে ফেলে দিয়েছে, রক্তে ভেজা শরীর উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে হলুদাভ আলোর নিচে। ফারাজ এবার হাতের মুঠোয় তুলে নেয় বড় রামদাটা। চকচকে ফলাটা আলোয় ঝলসে ওঠে।
“কেন জানি আমার কলিজার প্রতি আলাদা একটা দূর্বলতা কাজ করে। তবে আজকে কেবল কলিজা না হৃদপিন্ডের প্রতিও কাজ করছে। দেখি মেপে তোর কলিজা আর হৃদপিন্ডের সাইজ কতখানি? শত হলেও তুই বড় সন্ত্রাসবাদী বলে কথা!”
ফারাজের কণ্ঠস্বর নিস্তরঙ্গ। কোনো উন্মত্ততা নেই। হারুনের গলায় পা রেখে জোরে চেপে ধরে ফারাজ। নরম কলাপসিবল হাড়গুলো চূর্ণ হওয়ার শব্দ হয়। তারপর বুকের ওপর কয়েকটা প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দেয়। হারুনের নিভু নিভু প্রাণ। চোখে-মুখে মৃ*ত্যুর ছায়া স্পষ্ট। শরীরে শক্তি পর্যন্ত নেই আর। এক মুহূর্ত দেরি না করেই ফারাজ হঠাৎ রামদাটা চালিয়ে দেয় হারুনের বুকে। শ্রাক! চামড়া বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে লাল রঙের কাঁচা মাংস। হৃদপিণ্ডের কাছে পৌঁছনোর আগেই হারুনের ফুসফুস থেকে ফেটে বেরিয়ে আসে এক বিভৎস চিৎকার। পুরো ঘর কাঁপিয়ে দেওয়া একটা চাপা আর্তনাদ। কিন্তু ফারাজ থামে না। সে রামদাটা টেনে নামিয়ে আনে বুকের মাঝখান বরাবর। হাড়ের গুঁড়িয়ে যাওয়ার খটখটে শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। তারপর তাজা উষ্ণ কলিজাটা তুলে আনে ফারাজ। র*ক্তে ভেজা কাঁপতে থাকা একটা অঙ্গ। যা এখনো জীবনের শেষ ছন্দ বাজিয়ে চলেছে। ফারাজের চোখে পৈশাচিক আনন্দ। হাতে ধরা র*ক্তমাখা কলিজার দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠল,
“হাহ! এত ছোট কলিজা নিয়ে সন্ত্রাসবাদী হতে এসেছিলি?”
জলজ্যান্ত মানুষটার বুক চিরে কলিজা বের করে আনার পরও ফারাজের মনে একচুল প্রশান্তিও আসছে না। এত সহজে হওয়া মৃ*ত্যুটা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সে আরও কিছু চাইছিল… আরও অনেক কিছু। ফারাজকে আজ কোনো অংশে নরপিশাচের থেকে কম লাগছে না। তার র*ক্তমাখা হাত থেকে লাফাচ্ছে টাটকা কলিজাটা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ লালচে র*ক্তের ধারা। তবুও সে নির্বিকার। ফারাজ কলিজাটাকে নিস্পৃহ হাতে ছুড়ে ফেলে দেয় হারুনের রক্তাক্ত বুকের ওপর। তারপর আবারও রামদার ফলাটা চালিয়ে দেয় বুকের খাঁচায়। দু’হাতে মাংসের গহ্বর ফাঁক করে টেনে বের করে আনে হৃদপিণ্ডটা। ধুকপুক… ধুকপুক… হৃদপিণ্ডটা তখনো জীবিত। তাজা, গরম, লাল র*ক্তে থপথপ করছে। ফারাজ হৃদপিণ্ডটা হাতের তালুতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। কী অদ্ভুত প্রাণের স্পন্দন! এত ছোট, অথচ এত ক্ষমতাধর একটা বস্তু। যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে আবার সে বিনা মানুষের মৃ*ত্যু অনিবার্য। ফারাজ আবারও হাসল।
হঠাৎ হৃদপিণ্ডটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছেলেগুলোর দিকে তাকায় ফারাজ। কণ্ঠস্বর আগের মতোই শীতল। তবে তাতে চাপা নিষ্ঠুরতা মিশে আছে।যা ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে।
“হৃদপিণ্ডটা ভালো থাকলে ডোনেট করে দিবি। আর শরীরের বাকি অংশগুলা যেগুলো ঠিক আছে, সেগুলোও কাজে লাগাবি।” কিছুক্ষণ থেমে চোখ সরু করে পুনরায় বলল,
“আর এই জা*নোয়ারের দেহ এক হাজার একশ এক টুকরো করে রাস্তার অনাহারী কুকুরগুলারে খাইয়ে আসবি। যেন তার পাপের শেষ কণাটুকুও পচে-গলে কুকুরের পেটে মিশে যায়।”
ঘরজুড়ে তখন র*ক্তের ভারী গন্ধ। হারুনের নিথর শরীর মেঝেতে পড়ে আছে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে। চারপাশের দেয়ালে ছিটকে থাকা র*ক্তের ছোপগুলো ফারাজের নীরব উন্মত্ততার সাক্ষ্য বহন করছে। সে বুলিয়ে কপালের সামনে চলে আসা র*ক্তমাখা চুলগুলো ঠিক করে নেয়। মুখের ওপর ছিটকে পড়া র*ক্তের ডলাটুকু থুতু দিয়ে গিলে নেয় অনায়াসে। তার চোখে এখন আর কোনো বিরক্তি নেই। নেই কোনো ক্রোধ… আছে কেবল এক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন বিকৃত প্রশান্তি। ঘরটা এখন শীতল হয়ে গেছে। পুরোই নিঃশব্দ। এতক্ষণ পর্যন্ত যে মৃ*ত্যু ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল কক্ষের কোণায় কোণায়, সে এখন ফারাজের মুখের সেই বাঁকা হাসির মধ্যে স্থায়ী বাসা বেঁধেছে। ফারাজ আরো একবার কলিজাটার দিকে তাকায়। ফিসফিস করে বলে, “কলিজাটা আজ আমি নিজ হাতে রান্না করব… তারপর… তারপর স্বাদ গ্রহণের পালা।”
চলবে?
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৪ ( দ্বিতীয়াংশ)
দখিনা বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ নিঃশব্দ মেঘাচ্ছন্ন রাতের মাদকতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। হাসপাতালের জানালা দিয়ে আসা হালকা পিড়পিড় হাওয়ায় চিত্রার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। সে চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের উদাসীনতার মধ্যে কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। হাসপাতালের একঘেয়ে বেডে সে শুয়ে আছে বাধ্য হয়েই। কিছুক্ষণ আগে ফারিয়া এসেছিল। কথা বলেছিল কিছুক্ষণ। এখন হয়তো করিডোরে পায়চারি করছে। চিত্রার হাতে স্যালাইনের সূঁচ বিঁধে আছে। শরীরও ভীষণ দুর্বল। কিন্তু চিত্রার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে সেই নিষ্পাপ শিশুটির নিথর দেহ। কি থেকে কি হয়ে গেল আজ?সন্ত্রাসের বিষবাষ্প আজ কিশোরগঞ্জকে গ্রাস করেছে, কাল হয়তো পুরো দেশকে করবে। এসব কেবল নৃশংসতার নয়। এর পেছনে আছে সুপরিকল্পিত এক ব্যবসা। যারা মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে, তাদের দিয়ে অপরাধ করিয়ে ফায়দা লুটছে তারাই এসব ঘটনার মূল কারিগর। রাজনৈতিক চালের চেয়ে এখানে ব্যবসায়িক স্বার্থই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
চিত্রা শ্বাস ছাড়ল। আজকের আকাশ তাকে বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই দিনে বাড়িতে কত আয়োজন হতো! গরম গরম ভাজাপোড়া,চায়ের আড্ডা চলত দীর্ঘরাত অব্ধি। চিত্রা নিজ হাতে সবকিছু করত। নিজের ভাগের খাবার টুকুও লুকিয়ে যখন সোহাগকে দিত তখন যে কি শান্তি লাগত চিত্রার। এক রাতের কথা,সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো।
বাড়িতে সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ ছিল না। চারদিকে কেবল প্রকৃতির নীরব কান্না। প্রতিদিনের মতোই চিত্রা লুকিয়ে লুকিয়ে সোহাগের রুমে গেল। সে প্রায়ই যেত, ঘুমন্ত সোহাগের পাশে বসে থাকত, নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে স্বপ্ন দেখত। একদিন এই মানুষটার পাশেই সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সেদিন সোহাগ রুমে ছিল না। চিত্রা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কোথায় গেল সে? হঠাৎ করেই তার মনে পড়ল ছাদের কথা। ছুটে গেল সেখানে। সোহাগ একলা দাঁড়িয়ে ছিল। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজছিল নিঃশব্দে। পরনের সাদা সেন্ডো গেঞ্জি ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছিল। লুঙ্গিটাও ভারী হয়ে গিয়েছিল জলে। কিছু না বলে চিত্রাও পাশে গিয়ে দাঁড়াল।সারারাত তারা একটাও কথা বলেনি। শুধু একসঙ্গে ভিজেছে। তাতেই চিত্রা খুশী ছিল। অথচ আজ সেই সোহাগ চিত্রাকে মনে রাখে না। যে সোহাগ একসময় চিত্রার সামান্য জ্বরেও পুরো বাড়ি মাথায় তুলত, সে এখন অন্য কাউকে ভালোবাসে, অন্য কাউকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে! চিত্রার চোখের কোণে অজান্তেই জল জমে ওঠে। মুহূর্তেই কান্না ফেটে বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে। সবাই বলে, কাঁদলে নাকি মন হালকা হয়, দুঃখ কমে যায়। যদি দুঃখের সঙ্গে তার স্মৃতিগুলোও যদি মুছে যেত, তাহলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু মানুষ স্মৃতির বাহক। স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে হয় তাকে। তবে যারা স্মৃতি ভুলতে পারে, তারাই সামনে এগোতে পারে। চিত্রার এখনো অনেক দূর যেতে হবে। মাঝপথে সে কিছুতেই থামতে পারবে না। কিছুতেই না…
“কাঁদছো কেন প্রিয়তমা?”
চিত্রা চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করল। পাশ ফিরে দেখল দাঁড়িয়ে আছে ফারাজ। গায়ে একটা শুভ্ররঙা শার্ট। ব্লেজারটা হাতে। ফারাজ এগিয়ে এসে চিত্রার পাশে এসে বসল। চিত্রা মুখ ফিরিয়ে অভিমান জড়িত গলায় বলল,
“আমি ঠিক আছি। জোর করে এখানে বন্দী করার কারন কি?”
” রোগীরা ঔষধের ভয়ে এমন দুই-চারটে চাপা মেরেই থাকে। তাই বলে কি সব বিশ্বাস করতে হবে?”
“চাপাবাজ বললেন?”
ফারাজ চোখ সরু করে তাকাল।ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। “কেন? কারো গায়ে লেগেছে বুঝি?”
“দেখুন…”
“এখানে দেখাবে?”
ফারাজ চারিপাশে চোখ বুলায়। জিহ্বা কেটে বলে,
“দুঃখিত বউ রুমে সিসি ক্যামেরা আছে। তবে তুমি চাইলে আমি ক্যামেরার চোখেও পট্টি বেঁধে দিতে পারি। দে…বো নাকি?”
চিত্রা বিরক্ত চোখে তাকাল।”আপনি কোন পদের মানুষ বলুনতো?”
ফারাজ মুচকি হেসে একদম স্বাভাবিক গলায় জবাব দেয়,
“সেই পদ, যেটা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আমার জন্য বানিয়েছেন।”
চিত্রা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আপনার মতো পুরুষ আমি আমার পুরো জীবনে আর একটাও দেখি নি। আপনার সঙ্গে পেরে উঠা দায়।”
” ফারাজ এলাহীর একটা ভার্সনই ওপরওয়ালা তৈরি করেছেন পিও। দুনিয়ায় শত পুরুষ পাবে তবে ফারাজ এলাহী হারিয়ে গেলে কচুও পাবে না।”
চিত্রা বিরক্ত হয়ে বলল,
“নিজের এত প্রশংসা কেমন করে করেন? মুখ ব্যাথা করে না?”
“তোমার ওপর দিয়েও তো কত ঝড় বয়ে যায় …কই ব্যাথা করে না?”ফারাজ চোখ টিপে মুচকি হাসল।
চিত্রা এক ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে বলল,”ছি! খালি ডাবল মিনিং কথাবার্তা।জাস্ট অসহ্যকর।”
ফারাজ মুখ ভেংচি কেটে চিত্রাকে ক্ষেপানোর জন্য বলল,
“খোদা তোমার মুখে কচু ধলে দিয়েছে নাকি?মুখ থেকে চুলকানো কথাবার্তা ছাড়া ভালো কিছু বের হয় না? মুড়ি খাও অক্কা পাওয়া শশুড় আব্বার মেয়ে।”
–
বাহিরে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের জানালা দিয়ে সোঁ সোঁ করে হাওয়া ঢুকছে। মার্জিয়া রান্নাঘরে ঢুকে ঠিক করে ফেলল আজ হবে জম্পেশ এক খাওয়াদাওয়া! মেনু? খিচুড়ি ,বেগুন- ইলিশ ভাজা, আর ইলিশের লেজ ভর্তা! সকালে সোহাগ ঘাট থেকে তাজা ইলিশ কিনে এনেছিল। জান্নাত নতুন বউ তাই মার্জিয়া তাকে কাজ করতে দিচ্ছেন না। মারিয়া শাশুড়ীকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে। শুক্রবার সোহাগ আর জান্নাতের বিয়ের একটা ছোটখাটো আয়োজন করা হবে। হাতে সময় নেই। সেই বাজার গুলোও তো করতে হবে।বাড়ি-ঘর এখন অগোছালো। দুনিয়ার কাজ পড়ে আছে। মার্জিয়া প্রথমেই পোলাওয়ের চাল আর মুগডাল একসঙ্গে ধুয়ে পানি ঝরাতে দিল। তারপর কড়াইয়ে অল্প ঘি গরম করে চাল-ডাল হালকা ভেজে নিল, যতক্ষণ না হালকা বাদামি রঙ ধরে। মসলা কষানোর পর ভাজা চাল-ডাল মিশিয়ে দিয়ে গরম পানি ঢেলে ঢাকনা দিয়ে রাখল। পনেরো-বিশ মিনিট পর ঢাকনা তুলতেই দারুণ এক সুবাস! খিচুড়ির দানাগুলো একদম ঝরঝরে হয়ে এসেছে। শেষে এক চামচ ঘি ছড়িয়ে দিল, যেন স্বাদ আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। মার্জিয়ার স্বামীর খুব পছন্দ ছিল এই খিচুড়ি তবে বছর খানেক পেরিয়ে গেল ভালো খাবার তার গলা দিয়ে নামেনি। ওদিকে ভাজাভুজির কাজ মারিয়া করছে। কড়াইতে সর্ষের তেল ধুঁয়া ওঠা গরম করে মাছ ছাড়তেই চিড়চিড় শব্দে রান্নাঘর মুখর হয়ে উঠল!
জান্নাত রুমে এসে বিছানায় ফেলে রাখা সোহাগের লুঙ্গিটা বাজ করতে করতে তাকে বলল,
“আপনে তারে এখনো ভালোবাসেন?”
সোহাগ তখন পুরোনো একটা ঘড়ির বেল্ট বদলাচ্ছিল। জান্নাতের কথায় তার কপাল কুঁচকে গেল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“কার কথা বলছ?”
“ওই যে, চিত্রা আপার কথা।”
সোহাগ হেসে বলল,”তোমাকে কে বলল যে আমি এখনো তাকে ভালোবাসি?”
জান্নাত চোখ নামিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“মন বলছে।”
সোহাগ একটা মেকি হাসি দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মন তোমাকে ভুল বুঝাচ্ছে।”
জান্নাত চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“শুনেছি, সে নাকি খুব সুন্দরী?”
সোহাগ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর জান্নাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাতে কী আসে যায়? তুমি কি কোনো অংশে কম?”
জান্নাত তিক্ত হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“সে তো সোনা, আর আমি কয়লা।”
সোহাগ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কয়লার মূল্য জানো?”
“জানতে চাই না।”
সোহাগ এবার আর কিছু বলল না। তবে জান্নাত থামল না। তার গলার স্বর কাঁপছিল,
“আপনি আমাকে ভালোবাসলে আমার কাছে আসতেন। ছুঁয়ে দেখতেন। কিন্তু আপনি তো আমার দিকে ফিরেও তাকান না। অথচ সবাই ভাবে, আমাদের মধ্যে কত মোহাব্বত! কিন্তু সত্যিটা শুধু আমি জানি।”
সোহাগ কোনো জবাব দিল না। কেবল পাশের টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিল।জান্নাত পিছন থেকে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
সোহাগ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু থামল, তারপর কটাক্ষভরা গলায় বলল,
“সিগারেটের সঙ্গে প্রেম করতে যাচ্ছি, সখী। একটু হাওয়া খেতে চাই। তুমি আম্মার কাছে যাও।”
জান্নাত আর কিছু বলল না। ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকে রাখল। কেন তাকে এভাবে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে হবে? কেন চিত্রা সোহাগের জীবনে না থেকেও সবটা নিয়ন্ত্রণ করছে? কোন অধিকারে? সৌন্দর্যের অধিকারে?জান্নাতের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এই কষ্টেরও কি কোনো শেষ নেই?
–
ফারাজের গাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই লোকজন দৌড়ে এল তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। কিন্তু ফারাজ কারও দিকে তেমন একটা তাকাল না। সে বরাবরের মতোই গম্ভীর। চিত্রার হাতে এখনো ব্যথা। সে ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামতে গেল। কিন্তু ফারাজ আগেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
“কোথায় যাচ্ছ, বউ?” ফারাজ একদম তার পথ আটকে দাঁড়াল। চিত্রা বিরক্ত গলায় বলল,
“মরতে।”
ফারাজ হেসে ফেলল। দুই হাতে কোমর ধরে বলল,
“এই মরামুখো শ্বশুরের ঘাড়ত্যাড়া মাইয়া! স্বামীর সঙ্গে রোমান্স করতে হয়, ত্যাড়ামি নয়। এসব শেখায়নি কেউ?”
চিত্রার চোখমুখ গরম হয়ে উঠল। কাঁপা গলায় বলল,
“আমার মরা বাবাকে নিয়ে কিছু বলবেন না! একেবারে মেরে চারার মতো বাগানে রোপণ করে দেব। তারপর…”
ফারাজ একদম স্বাভাবিকভাবে কথার মাঝেই যোগ করল,
“তারপর সেই চারা গাছ বড় হবে। আর সেখান থেকে ফারাজ এলাহী নামক একটা হ্যান্ডসাম ফুলের জন্ম হবে। ফুলের ঘ্রাণ একেবারে এলাচের মতো হবে!”
চিত্রা চোখ ঘুরিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তাতে আমার এলাচ কেনার টাকাও বেঁচে যাবে। আমি আপনাকে বাগান থেকে ছিঁড়ে নিয়ে গরম পানিতে ডুবিয়ে চা বানিয়ে আয়েশ করে খাব।”
ফারাজ নাক কুঁচকে বলল,
“যা দুষ্টু! তোমার মুখে দেখছি জমজমের পানি ছিটাতে হবে। খালি উল্টাপাল্টা কথা বলো! ছিঁড়ে, ডুবিয়ে… টুমাচ বেড সাউন্ড!”
চিত্রা হতবিহ্বল হয়ে গেল। আশপাশের কর্মচারীরা তো তাকিয়েই আছে! অথচ ফারাজ এলাহীর মনে একটুও লজ্জা নেই! চিত্রা কিছু বোঝার আগেই ফারাজ হঠাৎ ঝুঁকে তাকে দুই হাতে তুলে নিল।
“আরে! আপনি কি করছেন? ছাড়ুন বলছি!”
ফারাজ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল,
“ছাড়ার জন্য ধরিনি, বউ। শিকার করবো বলে ধরেছি!”
চিত্রা ধাক্কা দিয়ে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু ফারাজের বাঁধন শক্ত। চিত্রাকে নিয়ে সরাসরি বাড়ির মধ্যে ডুকে পড়ে। বাড়ির সবাই তাদের দেখছে। অথচ ফারাজের চোখেমুখে বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। চিত্রার মাথায় যেন বাজ পড়ল, এ লোককে কি সত্যিই কন্ট্রোল করা সম্ভব?
চিত্রাকে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফারাজ শার্টের উপরের বোতামটা আলগা করল। তারপর কোনো রকম ভণিতা না করেই গলা ফাটিয়ে ডাক দিল,
“মিতালি!! শালী কই তুমি?”
চিত্রা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এমন সময়, এমন মুহূর্তে ষাঁড়ের মতো চেঁচানোর প্রয়োজনটা কী? তার মাথা যেন ভো করে উঠল।
“মিতালিকে কেন ডাকছেন? কী দরকার?” চিত্রা বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল।
“মিতু?” ফারাজ কপাল কুঁচকে তাকাল।
“হ্যাঁ, আমি ওকে ভালোবেসে মিতু বলে ডাকি। কোনো সমস্যা?”
ফারাজ চোখ সরু করল। “ন্যাকামি…! যাক, আমিও ভালোবেসে আজ থেকে তোমাকে ‘চুতু’ বলে ডাকব। কোনো সমস্যা?”চিত্রা ধপাস করে উঠে বসে তাকাল।
“চুতু? এটা আবার কেমন নাম?”
“কেনো, পছন্দ হয়নি? চাইলে শুঁটকি,সাদা মুলা কিংবা লিলিপুট বলেও ডাকতে পারি। তোমার সঙ্গে নামগুলো বেশ যায়।”
চিত্রা রাগে চোখ গোল করে তাকাল।
“ধ্যাৎ!”
ফারাজ গলা নামিয়ে রহস্যময় কন্ঠে বলল,
“বুঝতে পেরেছি। তোমার যে প্রেমের নেশা ধরেছে। এমন হ্যান্ডসাম স্বামী থাকলে নেশা ধরাটা স্বাভাবিক। আই নো, আই নো… ডোন্ট ওয়ারি, নেশাটা যেহেতু আমার কারণেই ধরেছে, তাই তা কমানোর দায়িত্বও আমার।”
চিত্রা কিছু বলার আগেই দরজার কাছে হুড়মুড় করে মিতালি হাজির হলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে এসেছে সে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
“জে খালু?”
ফারাজ ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল।
“কী রে, হাঁপানি রোগীর মতো নিঃশ্বাস ফেলছিস কেন? যাক গে, আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আন।”
মিতালি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
“আইচ্ছা। চায়ে চিনি কতটু দিমু?”
ফারাজ একটু ভেবে বলল, “তোর যা ইচ্ছে। তবে বউয়ের মতো অত মিষ্টি যেন না হয়। পরে যদি অকালে সুগার লেভেল বেড়ে যায়,তখন লোকে তো আমায় ‘চিনিবাবা’ বলে ডাকবে!”
মিতালি কৌতুহল ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“চিনিবাবা মানে কী, খালু?”
ফারাজ এক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, “তোর শা…! ধ্যাত, কিছু না। যা, আমার বউয়ের মতো কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে আন। চা আর সিগারেট একসঙ্গে না খেলে আমার আবার বাথরুম হয় না। যাহ!”
মিতালি অবাক হয়ে ফারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আর চিত্রা? সে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ লোককে ঠিক করতে গেলে তার নিজেরই মাথা ঠিক থাকবে না!
ফারাজ চা সিগারেট খেয়ে গোসলে চলে গেল। রাতে গোসল না করলে তার ঘুম হয় না। দুনিয়ায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করলেও ফারাজ এলাহীর গোসল করা চাই! তার একটাই কথা দুনিয়া মারা খাক… তার শুধু গোসল করতে পারলেই হলো। গোসল শেষে চিত্রাকে রুমে দেখতে না পেয়ে ফারাজের মুখটা কালো হয়ে যায়। তার ঔষধটা যদি এমন দৌড়াদৌড়ি করে তাহলে ফারাজ নিজের রোগ কি করে সারাবে? ফারাজ কালো ট্রাউজার আর টি-শার্ট পড়ে নিচে নেমে আসল। ফারাজের লুঙ্গির সঙ্গে দুশমনি আছে। শালা লুঙ্গি চিজটা একেবারে বেইমান। হুটহাট খুলে যায়। চিত্রার থেকেও একধাপ উপরে এই ধাপ্পাবাজ লুঙ্গি। চিত্রাকে তো ফারাজ কন্ট্রোল করতে পারে তবে লুঙ্গিকে আয়ত্তে আনা তার পক্ষে সম্ভব নয় নি। ফারাজের মুসলমানির কথা,তাকে তার মা বিছানায় শুইয়ে রেখেছিল। লোকজন সবাই ফারাজকে দেখতে আসছিল। সবাই একটু পর পর লুঙ্গি উঠিয়ে ফারাজের মূল্যবান সম্পদ দেখে কত কি বলে চলে গেল। মানে কি একটা অবস্থা। মানুষ বলা নেই কওয়া নেই তার ইজ্জত দেখে চলে যাচ্ছে। বাবার বন্ধুর একটা মেয়েও তাকে সেদিন দেখতে এসেছিল। বয়সে ফারাজের সমানই। ওই শালীও ফারাজের লুঙ্গি তুলে ইয়েটা দেখে ফিক করে হেসে বলেছিল, হি হি সাদা কেঁচো। ফারাজ ব্যথায় সেদিন উঠতে পারে নি। যদি পারত তাহলে ওই শালীর চুল ছিঁড়ে দিত। সেইদিনের পর থেকে লুঙ্গি জিনিসটাকে ফারাজের ছোটলোকি মনে হয়। হুটহাট খুলে যায়। একবার তো লুঙ্গির সঙ্গে ফারাজকে বেল্টও পড়তে হয়েছিল। তাই ফারাজ লুঙ্গি পড়ে না। সে কেনো লুঙ্গি পড়বে? ওইসব ছোটলোকরা পড়ে। ফারাজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। ওইসব ভয়ানক দিনের কথা সে মনে করতে চায় না। ফারাজ নিচে এসে দেখে অন্দরমহলে সবাই মিলে মিলে আড্ডা দিচ্ছে। একসঙ্গে মিলে লুডু খেলছে। নদী ভাবী,ফারিয়া,নিরু আর মোহনা ভাবীও একসঙ্গে খেলছে। চিত্রা এক কোণে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। ফারাজ চিত্রার দিকে এগুতে গেলেই একটা কল আসে তার ফোনে। অভ্র কল করেছে। ফারাজ অভ্রের কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনল। শেষে জবাব দিল,
“আমি আসছি। রান্না করে পার্সেল পাঠাতে হবে না?”
চলবে?
( কলিজার কাহিনী নিয়ে আপনারা অযথাই উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবেন না। পুরো বিষয় ক্লিয়ার না হওয়া অব্দি এমন মন্তব্য করা উচিতও না। যাইহোক ১৪ পর্বের আরেকটা খন্ড আছে। আজকের পর্ব কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন।)
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_১৪ (বর্ধিতাংশ)
“ভাবী গন আপনারা আমার বউকে খেলায় নিচ্ছেন না কেনো? থাক বউ আমরা দুজন একা খেলবো। আই মিন লুডু।”
চিত্রা বিরক্ত ভঙ্গিতে মুখ বাঁকালো। বড়দের সামনে কি করে কথা বলতে হয় জানা নেই। বিদেশে থেকে একেবারে লাগামহীন হয়ে গেছে। নিরু একপাশ থেকে ফারাজের দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ করল,
“শার্টটা তোমায় খুব মানিয়েছে ফারাজ ভাই।”
“প্রথমে ভাই তারপর চেটে-পুটে খাই? মেয়ে জাতিকে দিয়ে ভরসা নাই রে নিরু। এদের নজর বহুত খারাপ। তুই কিন্তু নজর ঠিক রাখিস। আমার আবার কাজিন রিলেটেডে পোষায় না। থ্রিলার পছন্দ, ওটা ছাড়া জমে না।”
নিরু বিরক্ত হয়ে মুখ ভেংচি কাটল। ফারাজ তা দেখে আবার যোগ করল,
“মুখটা বাঁকা হয়ে গেলে বিয়ে শাদি কেমন করে দিব? প্রতিবন্ধী বিয়ে দিতে গেলে তো অর্ধেক সম্পত্তি আবার জামাইয়ের নামে সদকা দিতে হয়।”
নিরু রাগ করে উঠে গেল। ফাঁকা স্থানে ফারাজ চিত্রাকে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ফিরতে দেরি হবে। আড়তে যাচ্ছি। তুমি প্রিয়তমা আজকের রাতটা হ্যান্ডেল করো কোনোমতে। জানি আমাকে ছাড়া তোমার ঘুম আসবে না।”
চিত্রা সাদা রঙের একটা কামিজ পরহিত। বাড়ির অন্যসব বউরা শাড়ি পড়া কেমন যেন তার অস্বস্তি লাগছে। ফারাজ বিষয়টা লক্ষ করল। চিত্রাকে নিজের কাছে টেনে এনে হিসহিসিয়ে বলল,
“অস্বস্তির কিছু নেই প্রিয়তমা। তোমাকে সব কিছুতেই মানায়। ভাবছি তোমার কামিজ পড়ার বিধি চালু করব। শাড়ি পড়বে শুধু রাতে। একান্ত আমার জন্য।”
ফারাজ পোশাক বদলায় না। যেভাবে ছিল সেভাবেই বেড়িয়ে পড়ে। বাহিরে অভ্র তার জন্য অপেক্ষা করছে। তবে যাওয়ার আগে চিত্রাকে সে বলে যায়,
“বউ সাবধানে চাল দিও। মোহনা ভাবী কিন্তু একনাম্বারের খাইষ্টা। খালি বাটপারি করে।”
–
নিলুফাকে দেখার জন্য কেমন যেন মনটা ব্যাকুল হচ্ছে সোহানের। যেইভাবে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ব্যাকুলতা কাজ করাটা কি স্বাভাবিক নয়?সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে সোহান পালোয়ান ট্রলারের বন্দীশালায় গেল। একবার গিয়ে সব মেয়েদেরই এক নজরে দেখে নিলো সে। এই মেয়েগুলো মিয়ানমারে যাবে, যেখানে তাদের নানা কাজে লাগানো হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন কাজে, যা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। সোহানের কাছে এসব কেবলই সমাজের বোঝা। তার নিজের একটা দর্শন আছে। সে মনে করে, এই মেয়েরা এমনিতেই বেঁচে থাকার মতো কোনো কারণ খুঁজে পায় না। এদের জন্য লড়াই করার কেউ নেই, সমাজেও এদের মূল্য নেই। তাই তাদের সরিয়ে ফেলা কিংবা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া, এ যেন তার এক ধরনের সমাজ পরিশোধনের কাজ। আর তাই সে সবসময় নিম্নবর্গের মানুষদের নিশানা করে। সিফাত ইতোমধ্যে নিলুফার কাছে একটা ছেলেকে পাঠিয়েছে। তাকে তৈরি করার জন্য। অনেকক্ষণ কেটে গেছে, কিন্তু ছেলেটার কোনো খোঁজ নেই। অস্থির হয়ে উঠল সিফাত। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে কল করার ঠিক আগেই দেখা গেল, ছেলেটা দৌড়ে তাদের দিকে ছুটে আসছে। ছেলেটার শ্বাস অস্থির, কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। ভয় আর দুশ্চিন্তায় থতমত খাওয়া কণ্ঠে বলল,
“মাইয়াটা ট্রলারে নাই। পালাইছে! মাইয়াটা পালাইছে!”
–
রাতের বৃষ্টি এখনো থেমে থেমে পড়ছে। বাতাস কেমন যেন স্থবির। এখানকার সবই ঠিক আছে তবে সমস্যা একটাই বাতাস বইতে দেরি তবে বিদ্যুৎ যেতে এক মুহুর্তও সময় লাগে না। চিত্রার ঘুম ভাঙতেই পাশ ফিরে ফারাজকে দেখল। উদাম শরীরে উপুড় হয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। কোলবালিশটা যদি মানুষ হতো, তাহলে এতক্ষণে দম আটকে প্রাণ হারাতো। চিত্রা ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। ফরজের নামাজ পড়ে বারান্দায় গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল পুকুরের দিকে। বৃষ্টির পানিতে থইথই করছে চারপাশ। গাছপালার পাতায় পানি জমে টুপটাপ পড়ে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য পুকুরের জলে কী যেন একটা নড়ল। চিত্রার ভ্রু কুঁচকে গেল। তার দৃষ্টি আরও মনোযোগী হলো। পানির ওপর কিছু একটা ভেসে আছে। একটা নয়, দুটো। তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এল। সে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। মানুষ! হ্যাঁ, ওগুলো মানুষেরই শরীর! চিত্রার বুক কেঁপে উঠল। ধড়ফড়িয়ে ঘরের ভেতরে ফিরে এল সে।
“ফারাজ!” চিত্রার কণ্ঠে আতঙ্ক জড়ানো। ফারাজ কেবলই গভীর ঘুম থেকে জেগেছে। ভাঙা চোখে চিত্রার দিকে তাকাল।
“ফারাজ, নিচে… পুকুরে লাশ!” কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থাকল ফারাজ। সে চিত্রার কথার অর্থ বুঝতে পারছে না। চিত্রার চোখ ছলছল করছে। ভয় আর হতবাক ভাব মিলেমিশে গেছে তার চেহারায়। ফারাজ নিঃশব্দে উঠে বসল। এক নিমেষেই ঘুম উড়ে গেছে তার। ভারী চোখে একবার চিত্রার কাঁপতে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে সে ধীর পায়ে বারান্দায় গেল। পুকুরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সত্যিই দুটো নিথর শরীর ভেসে আছে পানিতে। তবে ফারাজের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে কিছু একটা বলছে। কিন্তু ফারাজ তা শুনছে না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল। নিঃশব্দে ধরিয়ে এক টান দিল। তারপর গায়ে একটা টি-শার্ট চাপিয়ে মোবাইল বের করল পকেট থেকে। কাকে যেন একটা কল দিল।
“নিচে নামছি।” শুধু এটুকুই বলল সে। তারপর কোনো শব্দ না করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। চিত্রা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পেছন পেছন ছুটে গেল। অনুমতির অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।
পুলিশ এসেছে তদন্ত করতে। তবে কেইস সাংঘাতিক। মানুষ দু’টোকে নৃশংস ভাবে মা*রা হয়েছে। চোখ দুটো কোঠর থেকে তুলে আনা হয়েছে। ধারালো কিছু একটা দিয়ে যৌ*নাঙ্গ উপড়ে ফেলা হয়েছে। আর দু’জনেরই ঠোঁট দু’টো সেলাই করা। মনে হচ্ছে কেউ নিখুঁত ভাবে কাঁথায় সেলাই টেনেছে। লা*শের গলায় ফুলের কাটা।গোলাপ ফুলের কাটা। তবে শরীরে কারফেন্টানিল ড্রাগজ পুশ করা হয়েছে। মৃ*ত্যু খুব জলদি হওয়ার জন্য। ফুলের মধ্যেই এই বি*ষ দেওয়া হয়েছিল। যার গন্ধ শুঁকতে গিয়েই ম*রণ চলে এসেছে। বাড়ির মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ কেউ কিছু টের অব্দি পায় নি। খু*নি নিশ্চয়ই রাতের বৃষ্টিময় অন্ধকারকে কাজে লাগিয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে চিৎকারের শব্দ কারো কানে আসার কথা না। আর সবচেয়ে বড় কথা পুরোনো পুকুর পাড়ের দিকে কেউ যায় না। খু*নী সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে। তবে অবাক করার বিষয় খুনীর সাহস কতখানি হলে এলাহীর বাড়িতে খু*ন করে লা*শ এলাহীদের পুকুরেই ভাসিয়ে দিতে পারে? তবে খু*নী আর যে কেউ হোক না কেন বাহিরের লোক না।
চিত্রা ফারাজের আড়ালে দাঁড়িয়ে লাশ দেখার সাহস দেখাতে চাইলেও। ফারাজ এক ঝটকায় তাকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে এল। রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বলল,
“এসব কাছ থেকে দেখার দরকার নেই তোমার। হুঁশ হারালে আবার হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হবে।”
কিন্তু চিত্রার ভেতরে আতঙ্ক চেপে বসেছে। কাল বাগানে যে কর্মী তাকে উত্তপ্ত করেছিল। আজ সে-ই লাশ হয়ে ভেসে উঠল! তার গলা শুকিয়ে এল। ধীরে ধীরে ফারাজের দিকে তাকাল। ফারাজ কিছু করেনি তো? গত রাতে ফারাজ কখন বাড়ি ফিরেছিল? সে জানে না। হাতে ব্যথা নিয়ে ঘুমাতে গিয়ে কখন গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি। চিত্রা আরও একবার ফারাজের দিকে তাকাল। অদ্ভুত, অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। ফারাজ তখনও কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ গ্লাসে মদ ঢেলে গিলছে, যেন সবকিছু স্বাভাবিক। চিত্রা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। ফারাজের সামনে বসে সরাসরি চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
“খুনের পেছনে আপনার হাত আছে নাকি?”
–
দোতলা বাড়ি। চারপাশ ঘন গাছপালায় ঘেরা। নাম পালোয়ান মঞ্জিল। এই বাড়ির দুই উত্তরাধিকারী। সোহান পালোয়ান ও তার ছোটভাই সুমন পালোয়ান। সুমনের সংসার আছে, স্ত্রী মাহবুবা ও দুই সন্তান নিয়ে সে ব্যস্ত। কিন্তু একত্রিশ পেরোলেও সোহান এখনও বিয়ে করেনি। সে মায়ের প্রতি অসম্ভব ভক্ত। মায়ের সুখের জন্য সে সব করতে পারে, এমনকি পাপেও জড়াতে দ্বিধা করে না। তবে তার মায়ের কাছে তার অন্ধকার দিক সবসময়ই অজানা। জানলে মা কষ্ট পাবেন, আর সেই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ানোর সাহস সোহানের নেই। আজ সকাল থেকেই তার মাথা ব্যথা করছে। গত রাত থেকে যা কিছুতেই কমছে না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা নিলুর নিখোঁজ হওয়া । অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার বাড়িতেও খোঁজ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সে সেখানে যায়নি। নিলু তার দলের অনেক সদস্যের চেহারা দেখে ফেলেছে। যদি কোনো ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে? মেয়েদের মন বোঝা কঠিন, তারা একটা ভাবে, আরেকটা করে। নিলুকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। ঝামেলা হওয়ার আগেই। আর ওপর দিয়ে হারুনকে সহ আরো কিছু লোককেও নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেছে তাদের মধ্যকার হারুনের ভুলবশত ট্রিগার চালানোর ফলে একটা বাচ্চা মারা গিয়েছে। সেটা নিয়েই ঝামেলা চলছে। এখন সেই ভয়েই কি সবাই একসঙ্গে উধাও হলো নাকি?
সুমনের স্ত্রী মাহবুবা গরম গরম কলিজা ভুনা আর গরুর তেলে ভাজা মোটা পরোটা সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। সোহানের মা অসুস্থ, তাই তার খাবার রুমেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখভালের জন্য এক মহিলা আছেন। তিনিই মাকে খাইয়ে দেবেন। সোহান হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বসতেই চোখ পড়ল কলিজা ভুনার দিকে। একটা অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ ভেসে আসছে। যেন খাবারের মধ্যে কিছু মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে পরোটা ছিঁড়ে কলিজা ভুনায় ডুবিয়ে মুখে পুরে দিল। স্বাদে তার চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর মাহবুবা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সোহান আঙুল চেটেপুটে খাচ্ছে। এতটাই সুস্বাদু হয়েছে? সোহান থালায় তাকিয়ে দেখল। খাবার প্রায় শেষ। সে বিস্মিত গলায় বলল,
“মাহবুবা, আজকে তোমার রান্নার হাত এত ভালো হলো কেমনে? আর কলিজা ভুনা নাই?”
মাহবুবা অবাক হয়ে বলল,
“যতটুকু ছিল, ততটুকুই তো গরম করে দিলাম।”
সোহান ভ্রুকুটি করল।
“ছিল বলতে?”
মাহবুবা জবাব দিল,“কেন? রাইতে না আপনে একটা টিফিনবাক্স পাঠাইলেন?”
সোহানের মুখ কঠিন হয়ে গেল।
“আমি?”
“হ, একটা লোক আইছিল। বাক্স দিয়া কইল আপনে পাঠাইছেন। রাইতে তো আপনি আসেন নাই, তাই সকালে গরম কইরা দিলাম। ভালো কথা, টিফিনবাক্স যেই ব্যাগে দিয়া দেওয়া হইছিল, সেইখানে একটা কাগজও ছিল। আমি খুইল্লা দেখি নাই।”
সোহানের শরীরটা কেমন জানি শিউরে উঠল। কপালের ব্যথাটা হঠাৎ যেন বেড়ে গেল। সে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। মাহবুবা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল ব্যাগটা আনার জন্য। মাহবুবা ব্যাগটা এনে কাগজটা বের করে সোহানের দিকে বাড়িয়ে দিল। সোহান কাগজটা খুলে চোখ বুলাতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কাগজে ছোট্ট করে লেখা,
“হারুনের কলিজা ভুনাটা কেমন হয়েছে? খুব যত্ন করে রান্না করেছি। সাবধান করছি আমাকে ঘাঁটতে আসিস না। নিজেই ঘেঁটে যাবি। নিজের লোকেদেরকে সর্তক করবি। আরেকবার ভুল হলে বিরাট মাশুল গুনতে হবে কিন্তু। এবার শুধু ডেমো দেখালাম পরের পার তোর কলিজাটা ছিঁড়ে ভুনা করব।”
সোহানের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। গা গুলিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি বেসিনের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। থুতু ফেলল। মানুষের কলিজা… এতক্ষণ ধরে উপভোগ করছিল সে? এত স্বাদ করে খাচ্ছিল?চিন্তাটা মস্তিষ্কে ধাক্কা দিতেই আরও একবার অস্বস্তিতে কুঁকড়ে ওঠল সে। গলার গভীরে একটা বমি বমি ভাব জমাট বাঁধে। হাতের আঙুলগুলো অবশ হয়ে আসছে। কোন হারামির কাজ এসব? কে হারুনকে মেরেছে?
চলবে?
(চিত্রাঙ্গনা গল্পটা নিয়ে একটা সুখবর আছে। আন্দাজ করুন তো কি হতে পার?)