কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৮
সিরাজুল আর কাকি মা’য়ের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। যতদূর দেখেছি কাকি কখনো আব্বুর সামনে আসেনি, বাইরের লোকের সাথে তেমন কথা বলে না। সে-ই মানুষ কি দূর সম্পর্কের ভাইকে জড়িয়ে ধরবে? ধোঁয়াশা কাটাতে গিয়ে আরো জড়িয়ে ফেললাম মনে হয়।
সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো, বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম। রাতের খাবার খাওয়া হলো না আর। একবারে সেহরির সময় উঠলাম। মা গরুর গোশত রান্না করেছে, অনেকদিন পর তৃপ্তি করে খাবার খেলাম। গরম ভাত, দুই টুকরো গোশত, দুই টুকরো আলু, সামান্য ঝোল, সাথে এক ফালি লেবু। আহা! সে যে কি স্বাদ, বলে বোঝাতে পারবো। আগে মাসের ভিতর এক-দুবার গরুর গোশতের দেখা মিলতো, কিন্তু আজ মনে হয় সাত মাস পরে গরুর গোশত খেলাম। বর্তমানে সবকিছু দাম যেভাবে বাড়ছে, এমন চললে কিছুদিন পর এসব খাবারের নাম ভুলে যেতে হবে দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তদের।
সেহেরির পরে ঘুম আসছিল না, অনেক সময় আকাশ পাতাল ভেবেছি। দেরি করে ঘুমানোর ফলে বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো। তড়িঘড়ি করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, যে করে হোক মানিকের বাবার সাথে দেখা করতে হবে। আমি কি করে এতটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন হলাম! আমার আরো আগে ঘুম দিয়ে ওঠা উচিত ছিলো। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাইকেল চালাতে লাগলাম, পাছে মানিকের বাবা চলে না যান। ভাগ্য সহায় থাকায় উনার সাথে দেখা হলো।
” আসসালামু আলাইকুম, আপনার সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো। “
” বাদশা বাবা, তুমি এমন করে হাঁপাচ্ছ কেন? এসো এসো ভিতরের এসে বসো। মানিক বাদশাকে এক গ্লাস পানি দেও তো। “
মানিক পানি নিয়ে এলো, এক নিঃশ্বাসের সবটুকু পানি শেষ করে ফেললাম। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালানোর ফলে অনেক হাঁপিয়ে গেছি। আর একটু হলে দ”ম আঁটকে গেছিল আর কি! কিছু সময় পর স্বাভাবিক হলাম।
” আঙ্কেল, একজন মাদক ব্যবসায়ীর সন্ধান পেয়েছি। মনে আছে আমাদের গ্রামে একটা বাচ্চা মেয়ে মা*রা গেছিলো। ওর কবরের ভিতরে সাদা সাদা প্যাকেট লুকানো আছে। আমার মনে হয়েছে ড্রা”গ”স!”
” তুমি কিভাবে জানলে এটা?”
” আমি তিন্নির ক*ব*রের পাশে গোলাপ গাছ লাগাতে গেছিলাম। তখন সিরাজুল মামা তেড়ে এসেছিলেন। উনাকে আমার এমনিই সন্দেহ হয়। তাই পরে দেখতে গেছিলাম কি ব্যাপার। তখন সামান্য কিছু মাটি সরাতেই প্যাকেটগুলো বেরিয়ে গেছিলো। সময় নষ্ট না করে আপনাকে জানাতে এসেছি।
” সাবাস! আমি এখনই ফোর্স নিয়ে ক*ব*র খোঁড়ার ব্যবস্থা করছি। তোমার ইনফরমেশন যদি সঠিক হয় তাহলে আজকেই উনাকে গ্রেফতার করা হবে। “
” তিন্নিকে কে মে”রে”ছে কিছু জানতে পারলেন?”
” এ দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়নি, আমাদের সিনিয়র স্যারকে দিয়েছে, উনি ব্যাপারটা দেখছে। “
” আচ্ছা। তাহলে আমি এখন আসি। “
” ঠিক আছে, সাবধানে যেও। “
মানিকদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, সাইকেলে উঠবো এমন সময় মনে পড়লো আমি রোজা! কিন্তু কিছু সময় আগে এক গ্লাস পানি সাবাড় করে দিয়েছি, হায় আল্লাহ! এখন কি হবে? নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে, এক মুহূর্তে মন খারাপ হয়ে গেছে, যদিও ভুল করে কিছু খেয়ে ফেললে রোজা নষ্ট হয় না, তবুও কিছু ভালো লাগছে না আমার।
বাড়ি ফিরে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এলাম, কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই এখন। দাদি অনেকক্ষণ ধরে বাদশা বাদশা করেই চলেছে, অবশেষে বিরক্ত হয়ে দাদির কাছে গেলাম।
” কি হয়েছে আপনার? এতো ডাকাডাকি করছেন কেন?”
” তিন্নির মা’কে এই কাপড়গুলো দিয়ে আয়, তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু।”
” এগুলো কিসের কাপড়?”
” কাঁথা সেলাই করবে।”
” কি বলেন এসব? মেয়ে মা*রা গেছে এক সপ্তাহ হলো না, এখনই কাঁথা সেলাই করবে?”
” এই পোলা সবসময় বেশি কথা বলে, আরে নিজে সেলাই করবে না। ওর এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় এসেছে সকালে, সে-ই আমাকে বলেছে তাঁকে ছোটখাটো কাজ দিতে, কাঁথা সেলাই করা, ঝুড়ি বোনা এসব। তাঁকে দিয়ে সেলাই করাবো। তুই তিন্নির মা’য়ের কাছে দিয়ে আসলেই হবে। “
” ওহ্! আচ্ছা দেন তাহলে যাচ্ছি আমি। “
মনে হচ্ছে দাদির সারাজীবনের সব শাড়ি আমার মাথায় বোঝাই করে দিয়েছে, এতো শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই করবে উনি। তিন্নিদের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সত্যিই একজন অল্প বয়সী মেয়ে এসেছে। সবুজ রঙের একটা থ্রি-পিছ পরা, ওড়না কপাল পর্যন্ত টেনে দেওয়া। আমাকে দেখে ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলো।
” আরে মাহমুদা এইতো বাদশা, ওঁকে দেখে তোর মুখ ঢাকতে হবে না। “
” জ্বি আচ্ছা খালা।”
” তা বাবা এ সময়ে কি মনে করে এলে?”
” দাদি এই কাপড়গুলো দিয়ে পাঠালেন, উনি নাকি কাঁথা সেলাই করবেন। “
” তা বেশ ভালোই করেছ। একটু কষ্ট করে কাপড়গুলো রান্নাঘরের মাচার উপর রেখে আসবে?”
“জ্বি যাচ্ছি। “
সুযোগ নিজে থেকে আমার কাছে এসেছে, এই সুযোগে সিরাজুল মামার ঘরটা দেখতে হবে। কাপড়গুলো মাচার উপর রেখে সিরাজুলের ঘরের ভিতর চলে গেলাম। কপাল ভালো ঘরে কেউ নেই। শার্টের পকেট হাতিয়ে কিছু পেলাম না, বালিশ সরিয়ে দেখলাম কিন্তু সেখানেও কিছু নেই। হতাশ হয়ে ফিরে আসছিলাম, দরজা পর্যন্ত আসার পরে মনে হলো বিছানার চাদর উল্টে দেখলে কেমন হয়। বিছানার চাদর উল্টাতেই নজর এলো একটা কাঁচের চুড়ি! হ্যাঁ, এটা সে-ই চুড়ির মতো যা তিন্নির লা”শে”র জায়গায় পেয়েছিলাম। হয়তো সেগুলোর একটা!
তার মানে আমার সন্দেহই ঠিক৷ সিরাজুল তিন্নিকে খু*ন করেছে, কিন্তু কেন? কারণ না জেনে ওঁকে খু*নি বলা যাবে না। সিরাজুল বেশ ধূর্ত, চুড়িটা নিজের কাছে লুকিয়ে দরজা পর্যন্ত আসলে সিরাজুল মামার সাথে দেখা,
” তুই ঘরের ভিতর কি করছিস?”
” কাকিমা কাপড় রাখতে পাঠিয়েছে, ওই যে কাপড়।”
সিরাজুল উঁকি দিয়ে কাপড়গুলো দেখলো, তারপর নিজের ঘরে চলে গেল, ভ্যাগিস আমাকে উনার ঘরে দেখেন নি। দূত পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসলাম, মিনিট পাঁচেক পর শুনলাম তিন্নিদের বাড়িতে পুলিশ এসেছে।
তিন্নির ক*ব*র খুঁড়ে নানান জিনিস উদ্ধার হলো। ড্রা*গ*সের প্যাকেট, সোনার মুদ্রা, গহনা। পুলিশ সিরাজুল মামাকে ধরে নিয়ে গেলেন। যদিও সিরাজুল স্বীকার করেনি এসব তাঁর জিনিস তবুও পুলিশ তাঁকে নিয়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আদালতে নির্দোষ প্রমাণ হলে ছাড়া পাবে, নয়তো জে*লের ভিতরে থাকতে হবে। ব্যাপারটা খুব দূত ঘটে গেল। তিন্নিলে মা*রার ব্যাপারে কোন কথা হলো না। পুলিশের কাজে প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো। কোথায় সবকিছু ক্লিয়ার করে তারপর উনাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু না আসলো, মা*দ*কদ্রব্য পেল, আর ধরে নিয়ে গেল। বিরক্তিকর!
সিরাজুল যাওয়ার পর কাকিমা গম্ভীর হয়ে বসে আছে, কাকা তখনও ক্ষেতে, কাকাকে কল দেওয়া হয়েছে কিন্তু কেন আসলেন না বুঝতে পারলাম না।
ওদিকের ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরতেই ফুফু দৌড়ে এলো। আমার হাত ধরে উনার ঘরে নিয়ে যেতে বললো, ” বাদশা এদিকে আয় তো। তোর সাথে কথা আছে। “
আমি চুপচাপ ফুফুর সাথে যেতে লাগলাম। ফুফু আমাকে উনার ঘরে নিয়ে এলেন। খাটের উপর বসতে বসতে বললেন, ” তিন্নিদের বাড়িতে কি হয়েছে রে? চিৎকার চেচামেচি শুনলাম। “
” কি হয়েছে আপনি জানেন না?”
” না আমি ঘুম ছিলাম, চিল্লাপাল্লা শুনে উঠেছিলাম কিন্তু বাইরে যাইনি। বল তো কি হয়েছে।”
” সিরাজুল মামাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। উনি মা”দ”ক”চ”ক্রের সাথে জড়িত ছিলেন। তিন্নির ক*ব*রের ভিতর ড্রা”গ”স”সহ নানান জিনিস পাওয়া গেছে। সেজন্য। “
ফুফুর মুখটা মলিন হয়ে গেল। ব্যস্ত গলায় বললেন, ” এসব জিনিস সিরাজুল রেখেছে তার কি প্রমাণ আছে? উনি তো খুব ভালো মানুষ। “
” উনি ভালো মানুষ না ছাই! আমি সেদিন গোলাপ গাছ লাগাতে গেলে আমার দিকে তেড়ে এসেছিল, ক*ব*রের আসে পাশেও ঘেঁষতে দেয়নি আমাকে। আমি নিশ্চিত উনি এই কাজ করেছেন। “
” পুলিশ কি উনাকে ছাড়বে না? “
” তা জানি না, তবে তুমিও জে”লে যেতে পারো। তিন্নির কানের দূল আমি তোমার কাছে দেখেছি। “
” কোনটা তিন্নির কানের দূল?”
” ওই যে সোনারূপা মিশিয়ে বানানো কানের দূলটা, যার একটা আছে তোমার কাছে।”
ফুফু হকচকিয়ে গেলেন। ঘরের পরিবেশ ঠান্ডা হলেও ফুফুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেললেন, একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে মনে হয়। মিমিট দুয়েক চুপ থাকার পরে বলে উঠলেন,
” ওইটা যে তিন্নির কানের দূল তোকে কে বলেছে? এটা আমাকে আমার বন্ধু দিয়েছে। “
” সিরাজুল মামা তোমার বন্ধু নাকি? “
” মানে কি বলতে চাইছিস তুই?”
” দেখেন ফুফু এতো উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, আমি খুব ভালো করে জানি ওটা তিন্নির কানের দূল, তাছাড়া তিন্নি আমাকে এমন দূল দেখিয়ে ছিলো। “
” তুই মিথ্যা বলবি না একদম। “
” ফুফু এই কানের দূল জোড়ার একটা সিরাজুল কাকার কাছে দেখেছি আমি। আমি অযথা সময় নষ্ট করছেন। হয়তো আপনিও সিরাজুল মামার সাথে এই খু*নের সাথে জড়িত। নয়তো অন্য ব্যাপার আছে। সময়ের সাথে সেগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে। “
ফুফুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। তিন্নির মা’কে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতে হবে। খু*নি*কে পাওয়া গেলেও খু*নের কারণ এখনও জানা যায়নি।
বাড়ি দিয়ে বের হতে যাবো এমন সময় মা ডাক দিলেন।
” বাদশা তোর সাথে কে যেন কথা বলবে। এই নে মোবাইল। “
মোবাইল কানে ধরতে ওপাশ থেকে মানিকের বাবার গলা শোনা গেল।
” বাদশা, এই সিরাজুল মা”দ”ক”চ”ক্রের সাথে জড়িত, এছাড়া চুরি, বা”ট”পা”রি এসব অপরাধও স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু কিছুতেই তিন্নির খু*নের ব্যাপারটা মানতে চাচ্ছে না। তাঁর বক্তব্য তিন্নিকে সে খু*ন করেনি। “
” আঙ্কেল উনি মিথ্যা বলছেন। আমি নিশ্চিত। “
” না বাবা, সিরাজুল মিথ্যা বলছে না, এতো দিন এসব লোক দেখে আসছি, কে মিথ্যা বলে কে সত্যি বলে আমরা বুঝি। তবে তুমি চিন্তা করো না তিন্নির খু”নি খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে।”
আঙ্কেল কল কেটে দিলেন, আমি হতাশ হয়ে সোফায় বসে রইলাম।
চলবে