#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৯]
সময়েরা চোখের পলকে ছোটাছুটি করলেও রুমুর কাছে মনে হয়েছে এই এক মাস এক বছরের সমান।প্রতিটা সেকেন্ড মিনিটের সমতুল্য,প্রতিটা মিনিট ঘন্টায় এমনকি ঘন্টা যেন দিন হিসেবে ছুটছে।টানা একমাসের কসরত বিদায় জানিয়ে অবশেষে রুমুর ছুটির দিন এসেছে মেয়েটার আজ পরিক্ষা শেষ।রুমুর খুশি দেখে কে এই ছুটিতে কত কি করবে ভেবে বসে আছে।পরিক্ষা শেষ করে বাড়ি ফেরা হয়নি তার উজ্জ্বলের সাথে চলে এসেছে তাদের রেস্টুরেন্টে।
রেস্টুরেন্টের বিল্ডিংএর কাজ অনেকটা শেষ।রঙ করাও হয়ে গেছে বাইরের কিছু কাজ বাকি।এদিকে একটা রেস্টুরেন্ট নির্মানে যেসব লাইসেন্স প্রয়োজন সব ঝামেলাই উজ্জ্বল কাটিয়ে উঠেছে কিন্তু সবকিছুর মাঝেও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে টাকা।শূন্য হাতে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়া যে চারটিখানি কথা নয়।বন্ধুদের কাছ থেকে অনেকটাই সাহায্য পেয়েছে এছাড়াও বোন দুলাভাই কম করেনি তার জন্য।শেষ পর্যায়ে উজ্জ্বলের মা নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারলেন না এতদিন স্বামীর ভয়ে উজ্জ্বলকে সাহায্য করতে না পারলেও একটা সময় এসে ঠিকি তিনি তার এতবছরের জমানো টাকা থেকে উজ্জ্বলকে সাহায্য করলেন।সবাই সব দিক থেকে উজ্জ্বলের জন্য মানসিক আর্থিকভাবে এগিয়ে এলেও সৈয়দ শামসুল ছিলেন তার জেদের কাছে অনড়।উজ্জ্বল সাহস করে তার বাবাকে টাকার কথাও বলেনি শামসুল আদৌ ছেলের এত বড়ো উদ্যাগে খোঁজ নেয়নি।
ভিডিও কলে উজ্জ্বল তার বিদেশে থাকা বন্ধুর সহিত কথা বলছে ছেলেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু দেখাতে ব্যস্ত।এক কোনায় বসে রুমু গরম গরম সিঙ্গারা মুখে পুরে তাকাল সিয়ামের পানে,
” সিয়াম ভাই উনার বিদেশি বন্ধুটাকে দেখেছেন?দেখতে শুনতে একটা হিরোর চেয়ে কম না।”
” নজর দিচ্ছিস নাকি?”
” আরেহ না।”
” উজ্জ্বল জানলে তোকে মাটিতে গেড়ে দিবে।তোর জন্য এতসব আর তুই যদি বাইরে নজর ঘুরাস তবে কিন্তু…. “
” তবে মানে?আমি কি অন্য কোন ইনটেনশনে কথাটা বলেছি নাকি?আরে উনার ঘরে বউ আছে ছি ছি সিয়াম ভাই এভাবে আপনি বলতে পারেন না।”
উজ্জ্বল এগিয়ে এসে বসল সিয়াম এবং রুমুর মুখোমুখি ছেলেটার চাহনিতে বোঝা যাচ্ছে সে কোন সুসংবার দিতে চলেছে।
” একটা গুড নিউজ আছে।”
রুমু কৌতূহলি চোখে শুধায়,
” কি?”
” আমার সেই বন্ধুটা আমাকে টাকা পাঠাবে বলেছে।আমার একাউন্টে যথা সময়ে টাকা এসে পৌঁছে যাবে।”
” কি সত্যি!তাহলে তো কাজ আর থেমে থাকবে না তাই না?”
” একদম তাই এবার অন্তত বাকি কাজ করা যাবে।বাকি সব ডেকোরেশনের কাজ আমরা কাল থেকে শুরু করব।সিয়াম তুই বাড়ি চলে যা আজ আর কাজ নেই রাতে একবার দেখা করিস।”
উজ্জ্বলের আদেশ পেয়ে সিয়াম বিদায় জানাল।রুমু চোখ ঘুরিয়ে পুরো রেস্টুরেন্টটা একবার দেখল।নীল সাদা রঙের মিশেলে রেস্টুরেন্টের ভেতরের কাজটা বেশ সুন্দর হয়েছে এক কথায় চোখের শান্তি।
” উজ্জ্বল আপনার রেস্টুরেন্টের প্রথম দিন স্পেশাল কি খাওয়াবেন আমায়?”
” চুমু খাওয়াবো।”
” দূর প্রতিদিন খাই অন্যকিছু বলেন।”
” থাপ্পড় খাবি?”
” মেজাজ খারাপ করছেন কেন আমি সিরিয়াস।”
” বাড়ি চল, কি খাওয়াবো বাড়ি গিয়ে বলছি।”
রুমু ঠোঁট বাঁকাল।কাঁচা রঙের গন্ধে আচমকা তার মাথা ধরে গেল।মেয়েটা দ্রুত বের হতে উজ্জ্বলকে তাড়া দিল।
.
রুমু খেয়াল করেছে উজ্জ্বলের হাবভাব বেশ অনেকটা পালটে গেছে এই যে তার এতদিন শক্তপোক্ত শাসন শাসন ভাব এখন এসব কিছুই নেই।এ যেন আগের বেহায়া বেশরম উজ্জ্বল।এই যে ঘুমে কুপোকাত রুমু উজ্জ্বলের কি উচিত ছিল না তাকে ঘুমাতে দেওয়া?কিন্তু উজ্জ্বল তো তা করেনি সে জেদ ধরে রুমুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।রুমু ঘুমের মাঝেও বেশ কয়েকবার উজ্জ্বলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়েছে অথচ উজ্জ্বল যেন পাথর মানব নড়েনা চড়েনা।
” উজ্জ্বল এই উজ্জ্বল ছাড়েন।”
” উহ।”
” আল্লার ওয়াস্তে ছাড়েন এত পুতুপুতু এতদিন কোথায় ছিল?”
” চুপ থাক।ঘুমাতে দে।”
” কে কাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না?”
” তোর হাজবেন্ড কতটা পরিশ্রমি তুই জানিস না?মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দে।”
” একদম চুল তুলে ন্যাড়া করে দিব।”
” দে সমস্যা নাই।”
ঘুমের ঘোরেই তর্কতর্কি হলো তাদের।এর মাঝেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল তারা।এক ঘুমে রাত বেজে গেল নয়টা উজ্জ্বল ঘুম থেকে উঠেই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে কত কাজ বাকি অথচ সে ঘুমিয়েছিল!এই যে উজ্জ্বল এতক্ষণ বেঘোরে ঘুমিয়েছে এর পেছনে দোষটা কার?নিশ্চয়ই রুমুর।রুমু হাত মুখ ধুয়ে কক্ষে ফিরতেই উজ্জ্বল বলে,
” গায়ে কি ঘুমের ওষুধ মেখে রাখিস?”
” মানে?”
” মানে তোর কারণে এতক্ষণ ঘুমালাম।আমার কতটা লস হয়েছে জানিস?”
” এতে আমার দোষ কি?”
” তোকে জড়িয়ে রেখেছি বলেই ঘুমের ঔষুধ নাকে যেন সুড়সুড়ি দিয়েছে।”
” আশ্চর্য আমি বলেছিলাম আমাকে ধরে থাকেন?”
উজ্জ্বল ভ্রু নাচালো রুমুকে হেঁচকা টেনে বিছানায় ফেলে তার উপর ভর ছেড়ে দিল।
” তুই বললে তোকে ধরে থাকব এই চিন্তা ভাবনা আসে কেমনে?তুই আমার ডার্লিং না?কলিজা না?ময়না না?চুমু বউ না?”
” বাতাস অন্যদিকে বইছে কেন?”
” আর আমার চুমু বউ ডিউটিতে ফিরেছে এখন শুধু তার কাজ আমাকে ভালোবাসা।”
” পরিক্ষা শেষ আমাকে কোথাও একটু ঘুরতে নিয়ে যান।”
” যাবি?”
” যাব বলুন কোথায়?”
” চল তোর রাশেদ ভাইপারের সাথে দেখা করে আসি।”
” মজা নিচ্ছেন?আমাকে ছাড়ুন।আজ কিন্তু আপনাকে গান গাইতে হবে।”
” অসম্ভব।”
” উজ্জ্বল আমায় কিন্তু কথা দিয়েছিলেন আপনাকে গান গাইতেই হবে।”
.
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমু উজ্জ্বল ছাদে এলো।আজকের আকাশে তারায় ভরা থাকলেও চাঁদের দেখা নেই।দুজনে ছাদের কোণায় বসে নিজেদের গালগল্পে মেতে আছে।এর মাঝে উজ্জ্বল খালি গলায় গান ধরল আজ নেই কোন গিটারের সুর।রুমু ভিডিও করল এই ভিডিওটাও সে পোস্ট করবে।
যেহেতু অনেকটা সময় তারা ঘুমিয়েছে মাঝ রাতেও তাদের ঘুমের রেশ নেই।উজ্জ্বলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রুমু মস্ত বড় আকাশটা আজ তার ছাউনি।নিরিবিলি পরিবেশটায় হঠাৎ হট্টগোলের শব্দে দুজনে সচেতন হয় কান খাড়া করতে শুনতে পেল রাশেদের গলা এবং কে যেন কিছু একটা ভাঙছে।রুমু ভয় পেয়ে যায় তার জানা মতে বাবা আজ বাড়িতে নেই তবে কি সেই সুযোগটাই নিল রাশেদ!তবে রাশেদ ঝামেলা করছেই বা কি নিয়ে?
” উজ্জ্বল আমার ভয় লাগছে রাশেদ ভাই কার সাথে এতটা ঝামেলা করছে?”
” চাচির গলাও তো শোনা যাচ্ছে, মা ছেলে ঝামেলা লাগলো নাকি?”
” বু..বুঝতে পারছি না উজ্জ্বল।আমার ভয় করছে।”
” আরে ভয় পায় না।আমি বরং দেখে আসি তুই ছাদে একা থাকতে পারবি না?”
” পারব।”
উজ্জ্বল গাছ বেয়ে রুমুদের ছাদে গেল।এরপর ছাদ থেকে সুপারি গাছ বেয়ে নেমে গেল নিচে।রাশেদের রুমের জানলা একটু ফাঁক ছিল বিধায় সে দেখতে পেল আসল ঘটনা।আনিকাকে বেল্ট দিয়ে দেদারছে মারছে রাশেদ তবে কি নিয়ে তাদের ঝগড়া বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই।উজ্জ্বলের দম বন্ধ হয়ে এলো একটা মানুষ এতটা পাষাণ কি করে হতে পারে?সবচেয়ে বড় পাষাণ তো রাবেয়া যিনি কি না ছেলের অন্যায়ে মুখ বুঝে সহ্য করছেন আনন্দ লুটছেন।উজ্জ্বল যখনি চেচিয়ে রাশেদকে ডাকতে যাবে তখনি রাশেদ কাঁচের একটি ঔষুধের শিশি ছুড়ে দিল আনিকার মাথায়।মুহূর্তে মেয়েটার মাথা ফেটে গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে।এই দৃশ্য উজ্জ্বলকে হিংস্র করে তুলে চোখের সামনে এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল রুমুকেও নিশ্চয়ই এভাবেই মারা হয়েছিল!উজ্জ্বলের চিৎকার চেচামেচিতে এলাকার সকলে জড়ো হয় বাড়ির উঠনে।আনিকা মাথা চেপে দাঁড়িয়ে আছে রুমু দ্রুত আনিকার ফাটা মাথা ওড়নার সাহায্যে চেপে ধরল।আনিকাকে ধরে রিক্সা নিয়ে উজ্জ্বল এবং রুমু চলে গেল হাসপাতাল।সবাইকে উঠনে দেখে রাশেদের রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।দেদারসে গালাগাল দিয়ে সবাইকে বের করে গেট বন্ধ করল সে।
রুমুর চোখে চোখ রাখতে ভীষণ লজ্জায় পড়ল আনিকা।যে মেয়েটাকে সে জমের মুখে ফেলেছিল সেই মেয়েটাই আজ তাকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে।আনিকা নিজের ভুলের অনুশোচনায় ভুগে কিন্তু রুমু কি তাকে আদৌ ক্ষমা করবে?রুমুর গায়ের জামাটায় রক্তের ছড়াছড়ি ওড়না ভিজে আছে রক্তে।উজ্জ্বলের মুখখানি পাংশুটে বর্ণ ধারণ করেছে সবচেয়ে বড় কথা উজ্জ্বল প্রচন্ড রেগে আছে তার চোখে চোখ রাখলে আঁতকে ওঠে রুমু।আনিকার মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে টুকটাক ঔষুধপত্র কেনা শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তারদের সময় লাগল রাত চারটা।উজ্জ্বল বাইরে দাঁড়িয়ে রিক্সা খুঁজে কিন্তু এই রাতে রিক্সা কি সহজে পাওয়া যায়?আনিকার শরীর ভেঙে আসে তাই তাকে বসানো হলো টং দোকানের একটি বেঞ্চিতে।
রুমু আনিকাকে রেখে এগিয়ে এলো উজ্জ্বলের কাছে।
” উজ্জ্বল আপনি ঠিক আছেন?”
” না একদম ঠিক নেই।বাড়ি চল।”
” কি হয়েছে?”
উজ্জ্বল প্রত্যুত্তর করে না অনেকক্ষণ পর একটি রিক্সা পেলে বাড়ি পৌঁছাতে সক্ষম হয়।আনিকাকে রুমু নিয়ে এলো উজ্জ্বলের বাড়ি সে কিছুতেই চায় না রাশেদের কাছে এই মুহূর্তে আনিকা ফিরে যাক।
বাড়ি ফিরেই উজ্জ্বল শটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।রুমু জামা কাপড় পালটে ফিরল উজ্জ্বলের কাছে।
” আপনি রেগে আছেন কেন?”
” একটু কাছে আয় কথা আছে।”
রুমু ভ্রু কুচকালো।এই তো সে কাছে আর কতটা কাছে আসবে?উজ্জ্বল মেজাজ দেখিয়ে রুমুকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল।রুমু অবাক হলো না চুপচাপ মুখ বুঝে রইল সে।
” তোকেও কি এইভাবেই আঘাত করেছিল?জানোয়ারটাকে কি করি বল তো।রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে।”
” আব্বা আসুক ওর একটা উচিত শিক্ষা হবে।”
” শিক্ষা!জানোয়ারটার শিক্ষা হবে বলে মনে হয় না।”
রুমু প্রত্যুত্তর করে না।তার শরীর কাঁপছে চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেদিনের দৃশ্য, রাশেদ কিভাবে মেরেছিল তাকে।একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে এমন কাজ করতে পারে তা ভেবে কুল পায় না রুমু।
চলবে…..