#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৩০]
” রুমু আমি ওই বাড়িতে যাব না কিছুতেই যাব না।এমন বিশ্রি জীবনে আর কতকাল থাকব?যত দিন যাচ্ছে রাশেদ সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে।জানিস রুমু রাতে মেয়ে সাথে কথা বলে আমি প্রতিবাদ করতে গেলে গায়ে হাত তুলে।”
এই তো গতরাতেই কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেছিল আনিকা।ভাইয়ের অধঃপাতনের কথা শুনে প্রত্যুত্তর করতে পারেনি রুমু।যে নিজের মায়ের পেটের বোনকেই ছাড় দেয় না পরের মেয়েকে কতটা ছাড় দিচ্ছে তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না।যে মেয়েটা গতরাতে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেছিল সেই মেয়েটাই এখন শ্বশুর বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।সৈয়দ ইসমাইলকে সব কথা জানিয়েছিল উজ্জ্বল তিনি ভোরে বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।এসব নিয়ে রাশেদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয় সব যখন সহ্যের সীমানায় পেরিয়ে যাচ্ছিল তখনি রাশেদের গালে চড় বসালেন তিনি।এই ছেলেকে মারলে কি দমে?উলটা ইসমাইলের দিকে তেড়ে আসল।
বাড়ির বউ বাইরে থাকবে ব্যাপারটা ইসমাইলের নিকট সমীচীন নয় সকাল দশটায় তিনি উপস্থিত হন উজ্জ্বলদের বাড়িতে।বেশ অনেক বছরপর ভাইয়ের ঘরে এসে কি বলবে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।তার বিব্রত ভাবটা উজ্জ্বল ঠিকি ধরতে পারল ছেলেটা টিপ্পনী কেটে বলে,
” চাচাজান ইতস্ত বোধ করছেন কেন?মনে রাখবেন আপনি কিন্তু আপনার ভাইয়ের বাসায় নয় বেয়াইয়ের বাসায় এসেছেন।”
” বেয়াই!”
চোখাচোখি হলো দুই ভাইয়ের।অন্যরকম অনুভূতিতে চুপসে গেল তারা।নার্গিস আজ ভীষণ খুশি কি করবেন না করবেন তিনি ভেবে পাননা কত বছর পর রুমুর বাবা এসেছে।তিনি চটজলদি রান্নার কাজে লেগে গেলেন সেই সাথে রুমুও টুকটাক সাহায্য করছিল।খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে আনিকাকে নিয়ে ফিরে গেলেন তিনি।
দিন আসে আবার ব্যস্ততা ঘিরে রেখে দিন যায়।বেশ অনেকদিন কেটে গেল রাশেদ আর আনিকার সম্পর্ক এখনো ঠিক হলো না ইদানীং রাশেদ নেশা করে বাড়ি ফিরে।রাশেদের মা এখন আর প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না।যে ছেলে বখে গেছে সেই ছেলেকে যত যাই বলুক আর কি পোষ মানে?রাশেদের প্রত্যেকটা কাজে কথায় সাফাই গাইতেন রাবেয়া,ভুলকে ভুল তিনি কখনোই বলতেন না।রাশেদ যা করছে তাই সঠিক এরূপ মনোভাব ইদানীং কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তার।
এতদিনের জল্পনা কল্পনাকে রূপ দিয়ে অবশেষে উজ্জ্বলের সেই দিন এসেই গেল।আজ উজ্জ্বলের নতুন রেস্টুরেন্টের উদ্বোধন কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।তাদের হাতে যতটা সময় ছিল উজ্জ্বলের বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষীগন রুমু তারা পুরো দস্তুর অফলাইন অনলাইনে প্রচারণা চালিয়েছে।উজ্জ্বলের এখন নিজস্ব একটা পরিচয় গড়ে উঠেছে অপরদিকে অনলাইনে উজ্জ্বলের বেশ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি হয়েছে।তারা সকলেই উজ্জ্বলের গানের ভক্ত।যদিও উজ্জ্বল শুধু গান গায় আর বাকি সব রুমুর দায়িত্বে।অনলাইনের এসবে উজ্জ্বলের খুব বেশি ধ্যান ধারণা নেই।
মানুষের ভিড়ে উজ্জ্বল হতভম্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছেলেটা এতটাও আশা করেনি এত এত মানুষ আসবে।এক দেখায় সবার কাছে রেস্টুরেন্টটা ইউনিক লেগেছে বিশেষ করে যারা ছবি তুলতে পছন্দ করে তাদের জন্য এই রেস্টুরেন্টটা যুতসই।খাওয়া দাওয়ার মান বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছে উজ্জ্বল।সকালে উদ্বোধনের সময়টাতে রুমু নার্গিস,সৈয়দ সামসুল, সৈয়র ইসমাইল এসেছিলেন।সবাই বাড়ি ফিরে গেলেও থেকে গেল রুমু।ব্যস্ততম একটি দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নামল সৈয়দ শামসুল তার কাজে ফিরছিলেন হঠাৎ রাস্তার ধারে থমকে দাঁড়ালেন তিনি।ঝলমলে আলোয় সুসজ্জিত একটি ভবন আশেপাশে মানুষের ঢল বোঝাই যাচ্ছে ব্যস্তময় স্থান।এই তো এই স্থানটাই অকর্মা উজ্জ্বলের কর্মের স্থান।তার চোখ ভিজে উঠল একটা ছেলেটা কম কাটখোট্টা হয়ে এতদূর আসেনি,কিন্তু সব বুঝেও তবু সৈয়দ শামসুলের রাগ কমলো না সহানুভূতি জাগল না। তিনি চোখ মুছে চলে গেলেন নিজ গন্তব্যে।
.
ফোন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল রুমু হঠাৎ গালে ঠোঁটের স্পর্শে চমকে উঠে সে।উজ্জ্বলের ভেজা চুল গলায় ঝুলানো গামছা দেখে তড়িঘড়ি উঠে বসল।
” কখন এলেন?”
” অনেকক্ষণ হলো।”
” আমাকে উঠালেন না কেন।”
” সারারাত যখন জাগবি এখন ঘুমিয়েই থাক।”
” বাজে কথা ছাড়ুন।”
রুমু উঠে বসল ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে রইল উজ্জ্বলের পানে।ছেলেটা মিষ্টি হেসে মুখ ডুবায় রুমুর গলায় ভেজা ছোঁয়ায় ছলকে উঠে মেয়েটা।রুমু সরাতে চায় উজ্জ্বলকে কিন্তু উজ্জ্বল তার কাজে ব্যস্ত। সে ছাড়া তো দূরের কথা বরং আরো কাছে টেনে নেয় কোলে তুলে চুলের বাঁধন খুলে দেয়।
” উজ্জ্বল সব ঠিকঠাক ছিল?”
” হুম।”
” সবাই সন্তুষ্ট তো?”
” হুম।”
“আজকের দিনটাতে আপনার বন্ধুটা এলে ভালো হতো উনি এতটা সাহায্য করলেন অথচ থাকতেই পারলেন না।”
” হুট করে চলে আসা যায়?সে নিজেও ব্যস্ত বুঝলে।”
” উজ্জ্বল।”
” বলো ডার্লিং।”
” খেয়েছেন?”
” এই তো খাচ্ছি।”
রুমু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল উজ্জ্বলকে কত বড় বেয়াদব ছেলে এসব বলে।উজ্জ্বল নেশাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুমুর পানে অথচ রুমুর চাহনি আগুনের চুল্লির ন্যায়।উজ্জ্বল পুনরায় এগিয়ে এলো রুমুর ঠোঁট ঠোঁট মিশিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালো।রুমু উজ্জ্বলকে আবার সরালো হুটহাট উজ্জ্বলের এসব আক্রমণ সে নিতে পারে না কিন্তু উজ্জ্বল কি বাঁধা মানে? ছেলেটা এগিয়ে এসে আবার জড়িয়ে ধরে রুমুকে তার ওষ্ঠের ছোঁয়ায় রুমু প্রতিবারি হার মানে।রুমু কাতর হয়ে হেলে পড়ার আগেই উজ্জ্বল তাকে টেনে ধরে।
” সৈয়দ উজ্জ্বল আনিসের ওয়াইফ এইটুকুতে কুপোকাত হলে চলবে?একটুতো স্ট্রং হ।”
রুমু উজ্জ্বলের কথায় প্রত্যুত্তর করতে পারে না।মেয়েটা জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে বসে পড়ে বিছানায়।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সে পানি খুঁজলো কিন্তু পানির দেখা নেই।উজ্জ্বল বুঝতে পারে তার চাওয়া দ্রুত পানি এনে রুমুর হাতে ধরিয়ে দেয়।
” এতদিনেও তোকে স্ট্রং করতে পারলাম না।আমি ব্যর্থ।”
” আর এতদিনেও আপনাকে কন্ট্রোলে আনতে পারিনি আমি ব্যর্থ।”
” তুই আমাকে কন্ট্রোলে আনবি?তোকে দেখলেই তো আমার কন্ট্রোল ব্যাগপত্র গুছিয়ে বিদায় জানায়।তুই হাসলেও ভাল্লাগে,কাঁদতেও ভাল্লাগে,রাগলেও ভাল্লাগে।এত ভালোলাগা বোধহয় অপরাধ।”
” ভীষণ অপরাধ।”
রুমু উঠে দাঁড়াল উজ্জ্বল তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে,
” কোথায় যাচ্ছিস?”
” ক্ষুধা পেয়েছে।”
” এই তো খাওয়ালাম তাও ক্ষুধা পায়!এটা পেট নাকি মহা সাগর?”
রুমু বিরক্ত হলো।উজ্জ্বলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেল রুমের বাইরে।রাতের খাবার টেবিলে উজ্জ্বল রুমু একাই খেল।খাওয়ার মাঝেই উজ্জ্বল রুমুর পাতে শিং মাছ তুলে দিতে চাইলে রুমু বাঁধা দিলে ছিটকে ঝোল পড়ল রুমুর গায়ে।
” এই আপনি জানেন না আমি শিং মাছ খাই না।”
” তোর মতো বেক্কল মেয়ে আর কারো ঘরে আছে বলে তো মনে হয় না।এই স্বাদের মাছ তুই রিজেক্ট করিস!আজ পর্যন্ত তুই ভালো জিনিস চিনতে পারিসনি খাবি তো বয়লার বোটকা মুরগি দেশি জিনিস চিনবি নাকি।”
” ঠিক বলেছেন আমি ভালো জিনিস চিনি না।এই যে দেশে এত ছেলে থাকতে আপনার মতো ছেলেকে কেন যে বিয়ে করলাম।”
আফসোস সুরে কথাটি বলল রুমু।নিজের যুক্তিতে নিজেই ধরা পড়ল উজ্জ্বল।আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত হাতে প্লেট নিয়ে চলে যায় হাত ধুতে।
রুমু রুমে গিয়ে জামা কাপড় হাতে তুলে নেয় উজ্জ্বল গায়ে ঝোল ফেলায় তার মেজাজটা বড্ড বিগড়ে গেছে।উজ্জ্বল যখনি রুমে প্রবেশ করল রুমু তাকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিল।
” এটা কি হলো! আমাকে বের করে দিলি কেন?”
” আমি জামা পাল্টাব আপনি জান।”
” যাব কেন?এটা যাওয়ার মতো কিছু?”
” অবশ্যই।আপনার লজ্জা শরম না থাকতে পারে আমার তো আছে।”
রুমু মুখের উপর সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিল।উজ্জ্বল তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
” নিজের স্বাধীন করা দেশে নিজেরি প্রবেশ নিষিদ্ধ ভাবা যায়!”
চলবে…