#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৭]
সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।সময়ের কথা সময়ে বলতে হয়।সময়টা পেরিয়ে গেলে অসময়ে সবটাই ফিকে এই যে রুমুর সাথেও একই কান্ড ঘটেছে।হিমেলের কথা অতীতে কাউকে না জানালেও মেয়েটা আজ জানাতে বাধ্য হয়েছে।রুমুর রাশেদ মন দিয়ে সবটা শুনলো কিন্তু হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেললো সে।রাশেদ ভেবেই নিল বিয়ে ভাঙার উদ্দেশ্যে রুমু এসব বলছে।কেউ শুনলো না তার কথা কেউ গুরুত্ব দিল না।হিমেল সবার চোখের মনি।
হলুদের আয়োজন শেষে সবাই যে যার কাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়লো।গায়ের হলুদ শাড়ি জড়িয়ে হাত পা গুটিয়ে মেঝেতে বসে আছে রুমু।সারা শরীরে যন্ত্রণা করছে অবশ্য এই যন্ত্রণার কাছে মনের যন্ত্রণা কিছুই না।মনে মনে উজ্জ্বলকে কতবার যে চেয়েছে তার হিসাব নেই।এই ঘোর বিপদে একমাত্র উজ্জ্বল তাকে স্বশরীরে সাহায্য করতে পারে।যদি নিজের ফোনটা আজ থাকতো সবার আগে সে উজ্জ্বল ভাইকে ফোন করতো কিন্তু ফোনটা নিয়ে গেল রাশেদ।তার ফোন এখন রাশেদের জিম্মায়।
খালা হালিমা আজ তার কক্ষে ঘুমিয়েছে মেয়েটাকে কত বোঝালেন তিনি কিন্তু রুমু তার জেদেই অনড়।এই বেয়াদবকে বিয়ে করার চাইলে উজ্জ্বল ভাইয়কে গলায় ঝুলানো ঢের ভালো।
ছোট থেকে দেখে আসছে উজ্জ্বল ভাই রুমু রুমু করে কতটা পাগল।উজ্জ্বলের ভালোবাসা বুঝতে পেরেও রুমু কখনো সাড়া দেয়নি।কেন দেয়নি?মেয়েদের এই এক বদ অভ্যস যে ভালোবাসে তাকে পাত্তা না দিয়ে ঘুরাতে বেশ আনন্দ পায়।
দেয়াল ঘড়িতে জানান দিচ্ছে এই রাত শেষ হতে চলেছে।ভোর চারাটার কাটা ছুঁয়েছে।হঠাৎ দরজা খুলতে রুমু ভয় পেয় গেল।অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে দু’চোখ ঝাপসা হলো তার।মাথায় যখন খোলা আকাশ তখনি ভরসার একটি হাত তার মাথা ছুঁয়ে দিল সাহায্য করলো দেমাগে ভরা সৈয়দ বাড়ি ছেড়ে পালাতে।রুমু পালাতে পেরে যতটা না খুশি হয়েছে নিজের ফোন ফিরে পেয়ে ততটাই খুশি হয়েছে এখন অন্তত উজ্জ্বল ভাইকে সবটা জানানো যাবে।এই ছাড়া আর কাকে জানাবে?পরিবারের বাইরে কেউ নেই তাকে সাহায্য করার।
উদ্দেশ্যহীন অনেকটা রাস্তা গিয়ে থামলো রুমু।নিরিবিলি পথে হাটতে তার বুক কাঁপছে।ভয়ে বিবশ হচ্ছে সারা শরীর।একটি দোকানের বেঞ্চিতে বসে ফোন করলো উজ্জ্বল ভাইকে।উজ্জ্বল তখনো ঘুমায়নি রুমুর চিন্তায় তার ঘুম আসছে না।কই এমন তো আগে হয়নি হঠাৎ মেয়েটা নিরুদ্দেশ কেন?
উজ্জ্বলের ফোন বাজতে সাথে সাথে ফোন তুললো সে।রুমু ফোন করেছে!তাও অসময়ে!ভারি আশ্চর্যের বিষয়!
” রুমু ঠিক আছিস?”
গলা ধরে এলো মেয়েটার কিন্তু কাঁদলো না।নিজেকে শক্ত রেখে বলে,
” উজ্জ্বল ভাই আপনি আসতে পারবেন?”
” কোথায়?”
” সুরাইয়াদের বাড়ির পাশে যে দোকানটা আছে আমি সেখানে বসে।”
” কি!তুই এত রাতে সেখানে কি করছিস।মাথা ঠিক আছে? “
” তাই তো বললাম আসুন।প্লিজ কাউকে জানাবেন না।”
” কি হয়েছে বলবি আমায়?”
” বলবো বলেই তো ডাকছি।আপনার বাইকটা নিয়ে আসেন সাথে টাকাপয়সা যা আছে নিয়ে আসেন আমি কিন্তু খালি হাতে।”
” রুমু তুই সাবধানে থাক আমি আসছি।”
” উজ্জ্বল ভাই আপনি যে বের হবেন টু শব্দ যেন না হয়।কেউ যেন আওয়াজ না পায়।বাইক স্টাট দিয়ে বের হবেন না।আমার এই রিকুয়েষ্ট গুলো রাখুন।আপনি তাড়াতাড়ি আসুন হাতে সময় কম।”
উজ্জ্বল তাড়াহুড়োর মাঝে বেশ কৌশলে বাড়ি থেকে বের হলো।চারিদিকে ফজরের আযানের ধ্বনিতে মুখোরিত।কিছুটা দূরে গিয়ে বাইক স্টাট করলো সে।প্রায় তিন মিনিটে পৌঁছে গেল কাঙ্খিত স্থানে।উজ্জ্বল ভাইকে দেখা মাত্র রুমু বাইকে চড়ে বসলো।কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,
” উজ্জ্বল ভাই এমন কোথাও নিয়ে যান যেখানে আমার ভাই আমাকে খুঁজে পাবে না।”
” কি হয়েছে বলবি তো।”
” বলবো সব বলবো চলুন আগে।”
উজ্জ্বল রুমুকে নিয়ে গেল বেশ দূরে একটি পার্কে।এটি লোকাল পার্ক আশেপাশে অনেকে ভিক্ষুক কাথা জড়িয়ে শুয়ে আছে।ঘন আঁধার কেটে আঁধারের বুক চিড়ে আলোর দেখা মিলছে।উজ্জ্বল পরিপূর্ণ দৃষ্টি রাখলো রুমুর পানে।মেয়েটা হলুদ শাড়ি পড়েছে আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে তার গালে থাকা আঁচড়।
” রুমু শাড়ি পড়লি কেন?তোর গালে এসব কিসের দাগ?”
রুমু কেঁদে ফেললো।কান্নার মাঝেই শুরু থেকে শেষ সবটা বললো উজ্জ্বল ভাইকে।কান্নার গতিক বাড়তে বাড়তে কখন যে উজ্জ্বলের বুকে মাথা রেখেছে তার হুশ নেই।উজ্জ্বল স্তব্ধ,বাকরুদ্ধ তবে ভেতরে জমে থাকা নিয়ন্ত্রণহীন রাগ ক্ষোভ ধীরে ধীরে বাড়লো।মস্তিষ্ক টগবগ করছে রক্ত চলাচল অতি সত্বর বাড়ছে।উজ্জ্বল রুমুর গালে হাত রাখলো ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
” আর কোথায় মেরেছে?”
” স..সারা শরীরে।”
ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো উজ্জ্বল।দাঁতে দাঁত পিষে জড়িয়ে ধরলো রুমুকে এতটাই জোরে ধরলো আঘাত প্রাপ্ত পিঠে চাপ পড়তে মেয়েটা কুঁকিয়ে উঠলো।
” আমি জানতাম তোর মা তোর ভাই জানোয়ার,জঘন্য,লোভী।নিজের বোনের ভালো বোঝেনা কেমন ভাই?”
” বিশ্বাস করুন, হিমেল ভাই সবার সামনে ভদ্রতার মুখোশ ধরে থাকে।আপনি কখনো ভেবেছিলেন উনি এমন?”
উজ্জ্বলের শ্বাস প্রশ্বাস ক্রমাগত বাড়লো।সত্যি তো ভদ্র শিক্ষিত ছেলে সে কখনো ভাবেনি হিমেল এতটা নোংরা মস্তিষ্কের লোক।
” ছোট বেলায় এতবার হেনস্তা হলি একবার আমাকে জানালি না।তোর উজ্জ্বল ভাই কখনো তোর খারাপ চেয়েছে?হ্যাঁ আমি পাগলামি করি সেটা তোর জন্য তোর ছোট বড় সব বিপদে পাশে ছিলাম এইটুকু আমাকে জানালি না!”
” আমি ভ…ভয়ে ছিলাম।এই ছোঁয়া গুলো কতটা যন্ত্রণা দেয় আপনি ভাবতেও পারবেন না।”
” আমি এখন এসব ভাবতে চাই না।সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।বাসা থেকে পালিয়েছিস তার জন্য ধন্যবাদ।এখন কি করবি?”
রুমু ছটফট করলো।সত্যিতো সে কি করবে?যেখানে যাক রাশেদ তাকে ধরে ফেলবে জেদের হেতু নিয়ে হলেও হিমেলের সাথে বিয়ে দেবে।কার কাছে যাবে?কোথায় যাবে?এমন কোন অদৃশ্য বন্ধন দরকার যার মাধ্যমে রুমুকে পরিবারের কেউ আর জোর খাটিয়ে কিছু বলার অধিকার থাকবে না।শ্বাস প্রশ্বাসের আন্দোলন বাড়লো মেয়েটার।আড় চোখে তাকালো উজ্জ্বলের পানে, উজ্জ্বল ছটফট করছে বোঝাই যাচ্ছে রাগটাকে সংবরন করছে ছেলেটা।দুদিকের নিরবতা কাটিয়ে নিঃসংকোচে আবদার করে বসলো রুমু।
” আমাকে বিয়ে করবেন উজ্জ্বল ভাই?”
প্রশ্নটা অদ্ভুত শোনালো উজ্জ্বলের কাছে।এমন কোন প্রশ্ন যে সে শুনতে পাবে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।রুমুকে বিয়ে করতে শতভাত রাজি হলেও কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায় মনে।রুমু ঘোরের মাঝে বিয়ে করতে চায় পরবর্তীতে যদি মেয়েটা মত পালটায়?তাছাড়া রুমু কি তাকে ভালোবাসে?উজ্জ্বল চেয়েছে সুস্থ স্বাভাবিক বিয়ে কিন্তু জল ঘোলা করে বিয়েটা হলে দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব কমবে না বরং বাড়বে।
” তুই আমাকে ভালোবাসিস না তাহলে বিয়ে করতে চাইছিস কেন?বেঁচে যেতে?”
” আপনি আমাকে খুব বাঁচিয়ে রাখবেন বুঝি?”
উজ্জ্বল ভাইকে পছন্দ করে রুমু কিন্তু এই কথা মুখ ফুটে বলার ইচ্ছে নেই তার।এই বিপদেও চিকন বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে চলছে সে।একবার যদি উজ্জ্বল ভাই জানে সে তাকে পছন্দ করে তবে মাথায় নুন মরিচের কৌটা রেখে বরই খাবে।
বিয়ে কি বললেই হয়ে গেল?নিজের ভরণপোষণের ভার যে ছেলে সামলাতে পারে না সেই ছেলে আবার আরেকটা মেয়ের দায়িত্ব নেবে!
এই সমাজে বেকার ছেলেদের বিয়ে করা অপরাধ।শুধু অপরাধ নয় ঘোর অপরাধ কেউ কখনো সরল চোখে ব্যপারটা দেখতে নারাজ।
উজ্জ্বল কিয়ৎক্ষণ পায়চার করলো।উজ্জ্বলের দ্বিধাদ্বন্দ্ব মুখখানি দেখে রুমু বলে,
“উজ্জ্বল ভাই আপনি কি বিয়েতে রাজি না?”
” এমন মনে হলো কেন?”
” বিয়ে করবেন কি না বলে দিন।আর না হয় আমাকে তাড়াতাড়ি বাসে তুলে দিন আমি রাজশাহী মামার কাছে যাব।”
” পারবি যেতে?”
” হুম।”
” ওকে উঠে বস তোকে বাসে তুলে দিচ্ছি।সাথে কিছু টাকাও দিয়ে দিব চিন্তা করিস না।”
হতভম্ব হয়ে গেল রুমু।সে তো এসেছিল উজ্জ্বলের ভরসায় অথচ উজ্জ্বল তীরে এসে তরী ডুবিয়ে দিল!উজ্জ্বলের এসব নাটক ছিল!সে ভালোবাসেনি রুমুকে!
রুমুর দু’চোখ ঝাপসা হলো মনে মনে উজ্জ্বলকে দিল অভিশাপ।
” উজ্জ্বল ভাই আপনি যদি সত্যি ভালোবাসার নামে নাটক করে থাকেন তাহলে অভিশাপ দিলাম, বিয়ের পর আপনার বউকে খুশি করতে কলিকাতা হারবাল খেতে হবে।”
চলবে…