টেবিলের অপর প্রান্তে বসে আছে অতি সুন্দরী একজন মহিলা, ফাইলে তার বয়স ৩১ লেখা আছে বলেই মহিলা বলছি, তাকে দেখে সদ্য ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে মনে হচ্ছে। অতি সুন্দরী মহিলারা অপরিচিত কারো কাছে নিজেকে আরো সুন্দর করে ধরার চেষ্টা করে। এই মোটেও তা করছে না। কোন পুরুষ ডাক্তার হলে হয়ত করতো মহিলা ডাক্তার বলেই হয়ত সে আমাকে পাত্তায় দিচ্ছে না। সুন্দরী মেয়েরা অন্য মেয়েদের পাত্তা না দেওয়ার সূক্ষ্ম একটা ইগো থাকে। অজান্তেই থাকে এইটা। এইটাকে দোষ বলা যায় না। তারা এমন পরিবেশ পেয়ে থাকে বুদ্ধি বয়স থেকে।
এক মনে সে ফ্যাশন ডিজাইনের ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে। গত মাসের ওটা।
এই মেয়ে দেখে রবীন্দ্রনাথ কয়েক দফা সুরের ছন্দ রচনা করে ফেলতে পারতো। কিংবা হুমায়ূন আহমেদের গল্পের ভয়ংকর সুন্দরী নায়িকার সাথে তুলনা করা যায়। আমি
আমার বয়স চল্লিশ পার হলেও আমিও মুগ্ধ না হয়ে পারছি না।
কিন্তু এই মেয়েটা ছয়টা খুনের আসামী। তার বিরুদ্ধে কোন জুতসই প্রমাণ যোগাড় করতে পারে নি তাকে আসামী বানানো ফ্যামিলি বা এত দিন রিমান্ডে রাখা পুলিশেরা।
মেয়েটাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করছে না। ভাবছে শ্বশুড়বাড়ির লোকজন মিথ্যা ফাসাচ্ছে। তবে ওর কিছু হাবভাব দেখে আমার কলেজের ব্যাচমেট খালিদা মনে হলো ওর কাউন্সিলিং প্রয়োজন। তাই আমার কাছে পাঠানো হয়েছে। অনেক বছর যুক্তরাজ্যে থাকার পর দেশে ফিরলাম বছর তিনেক আগে। খুব একটা ইন্টারেস্টিং কেস পাই না। এইখানে যারা ভয়াবহ পাগলামী করে তাদের কাউন্সিলিং জন্য পাঠানো হয়। যাদের কারণ দেওয়াই থাকে। কেউ জম্মগত, কেউ drugs addicted. স্বাভাবিক দেখতে কোন মানুষ আসে না, যাদের সমস্যা বুদ্ধি দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়।
আমি ওর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললাম,
– পানি খাও,
ও ম্যাগাজিন টা ভাজ করে ঠিক জায়গায় রেখে বলে,
-কেন ওখানে কিছু মিশিয়ে দিয়েছেন?
ম্যাগাজিন টা যেভাবে ছিলো সেভাবেই রেখেছে এতে বুঝা যায় ওর গুছিয়ে রাখার স্বভাব আছে। একটু বেশিই আছে। কারণ সে ছড়িয়ে রাখা কলম গুলো গুছিয়ে রাখছে।
আমি হেসে বললাম,
-মোটেও না।
সে আমার নেম প্লেট টা খুব তাচ্ছিল্যের সাথে বাকা থেকে সোজা করে বলে,
– মাহাবুবা খানম। আপনার নাম টা মোটেও আপনার সাথে যায় না। এত স্মার্ট একজন ডাক্তার আপনার নাম হওয়া দরকার ছিলো আরো আধুনিক।
আমি খুব আগ্রহ নিয়েই বললাম,
-যেমন?
ও কিছুক্ষন চিন্তা করে বলে, এখন কিছু মাথায় আসছে না।
– আচ্ছা সময় নাও। ভেবে বল কি রাখা যায় আমার নাম? তবে তোমার নাম টা সুন্দর, ময়ূরাক্ষী। তোমার শর্ট নাম কি? ময়ূ নাকি রাক্ষী?
ও খুব সুন্দর করে হাসল। হাসতেই একটা গজ দাঁত বেড়িয়ে এলো। সত্যিই সুন্দর লাগছে ওকে।
-আপনি আমাকে বাচ্চাদের মতো ইনফুলেন্স করার চেষ্টা করছেন। যা করার মোটেও কোন দরকার নেই। আপনার যা জিজ্ঞেস করার তা করতে পারেন৷ আমি উত্তর দেব আমার মতো আপনি ধরতে পারলে ধরবেন। না পারলে আবার পাঠিয়ে দেবেন।
-কোথায়? যেখান থেকে এসেছো? তোমার কি বাড়ির থেকে জেলেই বেশি ভালো লাগছে নাকি?
চুপ করে একমনে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা বনসাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ও।
– আপন মানুষ না থাকলে আপনি খোলা মাঠ কেও জেল ভাববেন। চার দেওয়াল কে ঘর।
-তুমি কি তোমার স্বামীকে মিস করছো?
ময়ূরাক্ষী আরেক দফা হাসে তবে এই হাসিতে অবজ্ঞা।
-যার খুনের চার্জ আমার উপর, তাকে মিস করব এমন ভাবছেন কেন?
– তাহলে? মা বাবা? উনারা তো মারা গিয়েছে অনেক আগে।
ওর চেহেরাটা কিছুটা শক্ত হয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে চোয়াল টা। আমি আস্তে আস্তে ওকে পড়ার চেষ্টা করছি আর ধীরে ধীরে লিখছি।
মেয়েটা যতটা সুন্দর তত টা ভয়ংকর শক্ত মন।
সে মোটেও ঘাবড়ে যাচ্ছে না কোন কথায়। কিংবা প্রচন্ড রকম আত্মবিশ্বাসী।
– তোমার কি এমন রাগ ছিলো যে এক পরিবারের ছয় কে তুমি খুন করেছো? তাও নিজের।
-আমি কাউকে খুন করি নি। ওরা ওদের কর্মফল ভোগ করেছে।
– কর্ম টা কি ছিলো?
আবারো চুপচাপ সময় কাটছে। আমার পিএ সাহেলা মাথা ঢুকিয়ে দেখল। ওকে ইশারায় অন্যদের পাঠিয়ে দিতে বললাম।
-তুমি কি চা খাবে? দিতে বলব?
একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, বলতে পারেন। অনেক দিন ভালো চা খাই না। আবার কখন বের হবো জানি না।
-তোমার কি নিজেরেই ইচ্ছে নেই মুক্তি পাওয়ার? নিজের জন্য কোন ডিফেন্স কেন করছো না?
– আমি যা করি নি তার দোষ আমি কীভাবে স্বীকার করব কিংবা কীভাবে ডিফেন্স করব?
– তাহলে তুমি সেসব খুন করো নি? কে করেছে?
চা এসে গেল, চা খেতে খেতে ওর চোখের মণিটা কিছুটা খুলে যাচ্ছে। সত্যিই হয়ত ওর চা টা ভালো লেগেছে।
– আচ্ছা এইসব কথা বাদ দাও। আমাকে তোমার কথা বলো তোমার ছোট বেলা। মজার স্মৃতি। প্রেমিক দের কথা বলো। সুন্দরী মেয়েদের অনেক প্রেমিক থাকে।
আমি হাসার চেষ্টা করি, ওর চেহেরার খুশিটা চলে যাচ্ছে চোয়াল টা শক্ত হচ্ছে আবার।
– আমাদের এই দেশে কালো মেয়েদের যত টা খারাপ ভাবে ট্রিট করা হয় তারচেয়ে বেশি জঘন্য ভাবে ট্রিট করা হয় সুন্দরী মেয়েদের।
-আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমাদের দেশে তো সুন্দরী মেয়েদের অনেক কদর রীতিমতো ডিমান্ড বলা যায়।
ও আবার তাচ্ছিল্য সুরে হাসে। ম্যাগাজিন টা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই যে এই খোলামেলা পোশাকে মেয়েটা, নিসন্দেহে সুন্দরী তবে সে ভার্জিন হোক বা ডির্ভোসি, ওকে দেখে সবার চোখ শান্তি পায়, তবে অজান্তে ওদের চেহেরাটা দেখলে সবার মনে যে শব্দ টা হুড়মুড় করে৷ তা হলো মাগি, নিসন্দেহে এদের বিছানায় নিয়ে যাওয়া যায়।কালো মেয়েরা নিজেদের মন বা চরিত্র নিয়ে গর্ব করে তবে ফর্সা মেয়েদের এইসব করার কোন কারণ থাকে না।
-তোমার কি বাজে অভিজ্ঞতা আছে এইটা নিয়ে?
-আমি সুন্দরী কারণ আমার মা সুন্দরী আর সারাজীবন মাকে কান্না ছাড়া কিছুই করতে দেখি নি। কারণ বাবা মাকে সন্দেহ করতো। বাবা না থাকলে কোন আত্মীয় স্বজন বাসায় আসা মায়ের কাছে এক প্রকার আতংক। যেকোন বিল নিতে আসা ছেলেদের ও ছুটির দিনে আসতে হতো, মা দরজা খোলতো না। এমন কি নিজের ভাইয়েরাও আসতে পারতো না। বাবার বিচ্ছিরি কথা ছাড়তো না, মায়ের ভাই কিংবা বাবাকেও।
বাবার কলিগরা আসতে চাইতো বাসায়। মা ভয়ে থাকতো এই বুঝি কেউ আবার মায়ের রূপের প্রশংসা না করে দিলো। বাবা ওদের সাথে তাল মিলিয়ে প্রশংসা করলেও মধ্যরাতে মায়ের গোঙ্গানিতে আমার ঘুম হতো না। মেয়েদের বিশেষ জায়গায় আঘাত করতো যেটা তাদের বিশেষ ক্ষমতা মনে করতো পুরুষেরা।
এক রাতে মা আত্মহত্যা করলো। সেদিন আমি একটু ও কান্না করি নি। আমার মনে হলো মা মারা গিয়ে বেঁচে গেলো। মাকে স্নান করানোর দায়িত্ব আমার ছিলো, মায়ের যৌনাঙ্গের আশেপাশে প্রচুর সিগারেটের ছ্যাকা ছিলো।
আমি একটু পানি খেলাম। আমার ভীষণ রকম গলা শুকিয়ে আসছে ওর কথায়, ভয়ে না ঘৃণায়।
-এরপর তোমার বাবা বিয়ে করেন নি?
– না, মা মারা যাওয়ার ১৪ দিনের মাথায় বাবা হার্ট এট্যাকে মারা যায়।
আমি এইবার ভ্রু কুচকে তাকালাম, ওর মন টা এত শক্ত হওয়ার ব্যাপার টা ধরতে পারছি।
-এতে কি তোমার কোন হাত ছিলো?
ভীষণ নিস্পৃহ গলায় বলল,
– না, আমি তখনো মাত্র চৌদ্দ বছরের কিশোরী ছিলাম।
-চলবে
#ডার্ক সাইট অফ এ বিউটিফুল লেডি
পর্ব ১
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক একসাথে