#ডার্ক সাইড অফ এ বিউটিফুল লেডি
পর্ব ৩
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
-তুমি তোমার মেয়েকে কেন খুন করেছো?
এইবার ওর চোখের পাতা অনবরত কেঁপে কেঁপে উঠছে। ও হয়ত মনে মনে কিছু ভাবছে কিংবা এমন কিছু ওর চোখের সামনে ভাসছে। যা ওকে কষ্ট দিচ্ছে। এক হাত অন্য হাতের সাথে ধরে আছে।
এতক্ষন ওকে স্বাভাবিক লাগলেও এইবার ওকে অস্বাভাবিক লাগছে।
আমি কিছুক্ষন সময় দিলাম ওকে। ওর দিকে তাকিয়ে আছি৷ ও যেন মূহুর্তে কেটে উঠলো দোটানাটা, পানির নিচ থেকে ডুব দিয়ে উঠল এমন ভাবে ফিরে তাকালো আমার দিকে।
– আপনি আমার গল্প বিশ্বাস করছেন না তাই তো?
– করছি তবে তোমার সত্যের সাথে মিথ্যা মেশানো গল্পটা আমার সত্য মনে হচ্ছে না। আমার ধারণা তুমি নিজের হাতেই সবাইকে খুন করেছো। নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজেকে ভিক্টিম বানাচ্ছো। তুমি তোমার বাবাকেও খুন করেছো। তোমার মেয়েকেও। স্বামীকেও। যারা একটা খুন করার পর আরেক টা খুন করে ঠান্ডা মাথা তারা নিজেদের নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। কিছু কিলার নিজেদের অতি জ্ঞানী প্রমাণ করতে চায় তাদের গল্পে, কিছু কিলার নিজেকে ভিক্টিম বানাতে চায়। তুমি দ্বিতীয় শ্রেনীর। তুমি তোমার গল্পটাও সাজিয়েছো তিন স্তরে, যারা তোমার রূপে মুগ্ধ হবে তারা মোটেও তোমার এই গল্পে তোমাকে সন্দেহ করবে না। করুণা করবে। দ্বিতীয় যারা মিনিমাম সন্দেহ করবে তাদের জন্য কয়েক টা খটকা রেখেছো। আর যারা সত্যিই বুদ্ধিমান তারা সত্যের সাথে মেশানো মিথ্যা গুলো ধরতে পারবে।
তুমি পুরোপুরি সত্য যেমন বলছো না। তেমনি পুরোপুরি মিথ্যাও বলছো না। তুমি মিথ্যার মাধ্যমে সত্য জানাতে চাইছো কিংবা সত্যের সাহায্য নিচ্ছো তোমার মিথ্যা ঢাকতে।
সে আবার আলতো করে হাসলো, মাথাটা টেবিলে রাখলো। ছোট করে কাটা চুল গুলো সামনে এসে ছড়িয়ে আছে। আমি ওকে সময় দিচ্ছি। দেখতে চাচ্ছিলাম ওর পরর্বতী গল্প কীভাবে শোনায়। কারণ ওকে যত মিথ্যা বলতে দেওয়া হবে তত সত্য বের করা যাবে।
অনেকক্ষন পর ও উঠছে দেখে। আমিই আবার কথা বললাম। ফাইল থেকে পরীর মতো দেখতে ওর মেয়ে অধরার ছবিটা বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম-
-তোমার মেয়েও তোমার মতো সুন্দরী ছিলো তাই তো?
এইবার ও মাথা তুলে তাকালো। টেবিল ওর মেয়ের ছবিটা দেখে ওর কান্না আটকানো চোখ টা চকচক করছে। আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। একটা ফোঁটাও পানি গড়িয়ে পড়ল না। চোখের কাজল গুলো যেন জলন্ত আগ্নেয়গিরি আটকে রেখেছে৷
আমি আবার ছবিটা ফাইলে ঢুকিয়ে বললাম,
-তোমার ধারণা ছিলো তোমার মেয়েও তোমার মায়ের মতো তোমার মতো আজীবন তার রূপের জন্য কষ্ট পাবে। তাই তুমি ওকে খুন করেছো। তাই তো?
ও এইবার সোজা হয়ে বসলো। গলার স্বর টা অনেক টা কঠিন কিছুতে প্রতিধ্বনি হচ্ছে এমন শোনাচ্ছে।
– হ্যাঁ। কারণ আমার প্রায় মনে হতো আমাকে যদি মা না আনতো। কিংবা ছোটবেলায় গলা টিপে হত্যা করতো তাহলে নিজেকেই নিজের শত্রু মনে হতো না। জানেন না? ❝অপনা মাংসে হরিণা বৈরী❞ হরিণের মাংসেই হরিণের জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
অধরা হওয়ার পর থেকে আমার নির্ঘুমতা রোগ আবার ফিরে এলো। আমি সারাদিন রাত না ঘুমিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।আশেপাশে কাউকে আসতে দিতাম না। এমন কি তুহিনকেও না। আমি মিনিট পাঁচেকের জন্য ওয়াশরুমে গেলে আমার মনে ওকে কেউ অত্যাচার করবে। একটু যখন বড় হলো, ওর সুন্দর চেহেরাটা সবার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। যেই আসতো ওকে আদর করতে চাইতো। কোলে নিতে চাইতো৷ আমি দিতাম না। রুমে ওকে নিয়ে বসে থাকতাম। সবাই আমাকে দোষ দিতে শুরু করে। অধরাও সবার কাছে যেতে চাইতো। যখন ওর বয়স চার বছর ওকে নিজের কাছে আর আটকে রাখতে পারতাম না। সবার কাছে যেতে চাইতো।
-অস্বাভাবিক কিছু না। তখন বাচ্চারা চঞ্চল হয়।
– তাই আমি ওকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতাম খাটের সাথে।
কথাটা বলে থামলো ও। ওকে আমার এখন পুরোপুরি মানসিক রোগী মনে হচ্ছে৷ তবে এইটা নতুন না। বাইরের দেশের মায়েরা এই রোগে বেশি ভোগে। আমাদের দেশেও এখনো অনেক মা এই রোগে ভুগে। তবে তা নিজেরাই জানে না। তারা বাচ্চাদের জন্য ভীতিকর কিছু তাদের আশেপাশে আসতে দিতে চায় না। এইটা পোস্ট পার্টেম ডিপ্রেশনে ভয়াবহ স্টেজ। বাইরের দেশে অনেক মা এখনো বাচ্চাদের ডে কেয়ারে রাখতে চায় না। আমাদের দেশের মায়েরাও এইটা করে। নিজের সাথে হওয়া ভয় গুলো যাতে সন্তানের কাছে না আসে তার জন্য তাদের কোথায়ও যেতে দেয় না। আগলে রাখে। যে বাবারা নিজেরা ভালো পড়লেখার করতে না পারার কারণে বর্তমানে খারাপ অবস্থায় থাকে তারা ছেলেমেয়ে কে প্রচুর চাপ দেয় মনে করে এইটা ভালো হবে। এরা সন্তানের ক্ষতি চায় না তবে, ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু সন্তানটায় হয়। আর বাবা মা কখনো নিজের দোষটা ধরতেই পারে না। তাই ওর মধ্যে অধরাকে খুন করার কোন আক্ষেপ নেই৷ কারণ ও ভাবছে ও মেয়েকে আজীবন কষ্ট পাওয়ার থেকে মুক্তি দিয়েছে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, তারপর? কেন মারলে ওকে? ওর সাথে কি এমন কিছু ঘটেছিলো যা নিয়ে তুমি ভয় পেতে?
ও এইবার কথা বলছে না। যেন ভেতর উল্টে পাল্টে যাওয়া কোন বইয়ে তাক সে আনমনে গুছিয়ে ফেলছে।
– একসময় সবাই মিলে আমাকে অধরার থেকে দূরে সড়িয়ে দেয়। আমাকে রুমে বন্ধ রাখতো ওরা ওকে নিয়ে খেলতো।
-তারপর?
-আমার চিন্তাটা আরো ভয়াবহ হতে শুরু করে। সারাক্ষণই অস্থিরতা। কিছু দিন পর ওকে স্কুলে দিতে সবাই উঠে পরে লাগে। চারিদিকে এত বাচ্চা ধর্ষনের খবর আমি রীতিমতো আঁতকে উঠতাম। কারো কোন শাস্তি হত না। মায়ের একটু একটু পরিশ্রমে গড়ে তোলা সন্তান কে ওরা দুই মিনিটে শেষ করে দিতো। এইসব চিন্তা আর নিতে পারছিলাম না। তাই একদিন ওকে বড় বালতি তে ডুবিয়ে-
আমি আঁতকে উঠলাম। গ্লাস টা টেনে নিয়ে পানি খেলাম। গলা খাকিয়ে কোন মতে বললাম-
– কে দেখলো এইটা?
-কেউ না।
-তবে আমি এরপর থেকে অধরা কে নিজের মত করে পেতে থাকি। একদম একা। শরীর নিয়ে ভয় নেই। শুধু আত্মা যেন আমার মেয়েই হয়েই আছে৷ এইটাই ভালো।
-তুমি কি ওকে এখনো দেখতে পাচ্ছো? বার বার দেওয়ালে দিকে তাকাচ্ছো কেন?
ও চমকে উঠলো না। কারণ ও হয়ত চাইছিলো আমি এমন কিছু বলি, ও নিজেকে রহস্যময়ী করে তুলতে চাচ্ছিলো। আশেপাশে মায়া ছড়িয়ে দিতে চাইছিলো। আমাকে ভাবতে বাধ্য করাতে চায় ওর সাথে ভৌতিক কিছু আছে। আমিও সেটা করতে ওকে সাহায্য করছিলাম। ও উত্তর দিচ্ছে না। নিজেকে আরো রহস্য জালে জড়াতে চায়। আমি আবার বলে উঠলাম-
– তুমি অন্য দের কীভাবে খুন করেছো একে একে বলো। কেনই বা খুন করেছো তোমার আশেপাশে যত পুরুষ ছিলো সবাইকে?
এইবার ও উচ্চস্বরে হাসলো, ওর সামনের দিকে চলে আসা চুল গুলো পেছনে নিয়ে যেতে যেতে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল-
– বললাম তো। আপনি বিশ্বাস না করলে আমি কি করব?
– তুমি জানো আমি বিশ্বাস করি নি। কারণ অন্য সবার মতো আমি তোমাকে প্রশ্ন করি নি সবাই এইডসের কারণে মারা গেলে তুমি কীভাবে বেঁচে আছো? কারণ এইটার পেছনেও কোন ভৌতিক যুক্তি তুমি দেখাবে।
আর সবার মৃত্যুর সময় এক ছিলো না। কারণ ও এক না। একেক জন কে একেক ভাবে খুন করেছো তুমি। সবটা সজ্ঞানে। তোমার গল্পটাতে অনেকটা সত্য ছিলো। অনেক টা মিথ্যা,
-যেমন?
– আমার ধারণা তুমি নিজেই বিত্তের সাথে সেক্স করছিলে। তোমাদের প্রেম ছিলো। এখনো আছে। তাই সে বেঁচে আছে।
বান্ধবীদের সাথে তুমি মদ খেয়েছিলে সাথে অন্য ছেলেরা ছিলো। তবে তুমি মাতাল হওয়ার পর তারা সেটার সুযোগ নিয়েছিলো।
তোমার স্বামী আর তার অন্য ভাইয়েদের ব্যাপারটায় হয়ত কিছুটা সত্য আছে। বাকিটা আমি আঁচ করতে পারছি না এখন।
ও তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে, হাত দুইটা লম্বা করে টেবিলে এগিয়ে দিয়ে থুতনি টা রাখলো। ওর চেহেরাটা এখন কোন দক্ষ হাতের শিল্পীর নিদারুণ সৃষ্টি মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে এখনিই পাথর খোদাই করে এই চেহেরাটা বের করে আনা হয়েছে। আমিও মুগ্ধ না হয়ে পারছি না। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– তাহলে আপনিই বলুন আমি কীভাবে করেছি?
– তাহলে তোমার বাবাকে দিয়েই শুরু করি? তোমার বাবাকে কি মায়ের মতো সেজে ভয় লাগিয়েছিলে? কিংবা এমন কিছু যা শুধু তোমার মা করতো তোমার বাবার সাথে?
-চলবে………..