#ডার্ক সাইড অফ এ বিউটিফুল লেডি
পর্ব ৫
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
– পানির অনেক রূপ জানেন তো? তার একটা রূপ দিয়ে তুহিন কে খুন করেছিলাম। আর আরেক টা দিয়ে ওর বাবাকে। এখন আপনি বের করুন কীভাবে?
ও বেরিয়ে যেতেই আমি অদ্ভুত দোটানায় পড়ে গেলাম। আমি বুঝতেই পারছি না ঠিক কীভাবে এরপরে আমার ভাবা উচিত।
আমার চেম্বারের জানালার গ্লাসে কুয়াশা জমেছে। তিনতলা থেকেও বাইরের রাস্তায় পুলিশের গাড়িটা চলে যাওয়া দেখা যাচ্ছে। আমি জানালা ঘেঁষে একপাশের পর্দা সরিয়ে দেখছিলাম ওর যাওয়াটা৷ মনে হচ্ছে আমি ভালোই আটকে পড়েছি ওর মায়াজালে।
ওর গল্প আমার মস্তিষ্কে কত টা জায়গা করে নিয়েছে তা ও যাওয়ার পরে আমি টের পাচ্ছি। কারণ শেষের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটা ছাড়া আর কিছুই যেন ভাবতে পারছিলাম না। আমি আবার ওর ফাইল খুলে বসলাম, বিশাল ফাইল ; অনেক গুলো কেইসের ছোট্ট ছোট্ট ডিটেইলস।
তবে কোন কিছুতেই যেন স্থির হতে পারছিলাম না। বার বার পানি আর বরফ শব্দ দুটো মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে।
পানির আরেক রূপ বরফ, বরফ খাইয়ে মেরে ফেলার গল্প তো অনেক পড়েছি বিদেশী বইয়ের গল্পে। বরফ গলে পানি হয়ে যাবে কোন প্রমাণ থাকবে না?
কিন্তু মাথা নাড়লাম,এইটা হতে পারে বরফাচ্ছন্ন পরিবেশে যেখানে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে। সেখানে বরফ এমন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হতে পারে।
অধরাকে মেরেছে বালতিতে ডুবিয়ে, তাহলে অন্যদেরকেও ?
না আর ভাবতে পারছিলাম না।
রুমের মধ্যে পায়চারী করছিলাম, আনমনে হাঁটতে গিয়ে বার বার ধাক্কা খাচ্ছিলাম চেয়ারের সাথে। দুইবার ধাক্কা খাওয়ার পর সরিয়ে রাখলাম চেয়ারটা।
তখন হঠাৎ একটা ব্যাপার মাথায় এলো— ও আমাকে একটা প্রতিবন্ধকতা দিয়ে গেল যাতে আমি ওতেই বার বার ধাক্কা খেয়ে আটকে থাকি।ভাবলাম এইটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। কিন্তু ওকে এইখানে পাঠানোর কারণটা খালিদার কাছ থেকে আগে জেনে নেওয়া উচিত।
খালিদাকে ফোন করলাম। রিসিভ করতেই তীব্র গালাগালির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
– হ্যালো মাহি? কিছু পেলে?
– না তেমন কিছু না। যা পেয়েছি সবটা আমার অনুমানে, সে সায় দিয়েছেও কিছুটা। তবে আমার ওর পুরো গল্পটায় কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে।
আমার মনে হচ্ছে পুরো কাহিনীটা একটা রূপক গল্প, উদ্দেশ্য ও ভিন্ন। ও কিছু লুকানোর জন্য এইসব করছে। কিন্তু সেটা কি ধরতে পারছি না। ওর সব কথায় মিথ্যা মেশানো। এত সহজে বের করা যাবে বলে মনে হয় না।
– হ্যাঁ খুব মিথ্যা বলে ও আর এমনভাবে বলে সব সত্য মনে হয়। আমার ওকে ভীষণ রহস্যময়ী মনে হয় না। ও খুনের ব্যাপার গুলো স্বীকার করেও না আবার অস্বীকার করে না । বড় অদ্ভুত! এক পরিবারের এতগুলো মানুষের খুনের ব্যাপারটায় বড্ড প্রেশার, বুঝলে? মেয়েটাকে টর্চার করলেও কিছু হয় না। না কোন চিৎকার করে, না এক ফোঁটা পানি ফেলে ; পনের বছরের ক্যারিয়ারে এমন কেইস আর পাইনি।
-তোমার কেন মনে হলো ওর কাউন্সিলিং দরকার?
– কারণ মেয়েটা স্বাভাবিক নয়, ওর মধ্যে কিছু তো আছে যা কেউ ধরতে পারে না। ওর সাথে যে সেলমেট দেওয়া হোক না কেন তারা অদ্ভুত কারণে ওকে ভয় পায়। সেল চেইঞ্জ করে ফেলতে চায়। তাই ভাবলাম তোমার কাছে পাঠাই। তুমিও তো পারছো না!
– না না আমি পারবো, তুমি আর একবার পাঠাও ওকে।
– কাল পরশুর মধ্যে তো সম্ভব না।
– তাহলে কি আমি আসবো? ওখানে ঘন্টা দুয়েকের জন্য আমাকে ওর সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?
– এইটা তো মুশকিল হবে। আচ্ছা দাঁড়াও তাও আমি কোন একটা ব্যবস্থা করতে পারি কিনা !
– আচ্ছা, ওর উপর আরোপ করা সব খুনের পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো আমাকে পাঠাতে পারবে?
– ওকে আমি ব্যবস্থা করছি। একঘন্টার মধ্যে পেয়ে যাবে।
ফোন রাখতেই আমি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, আমার মনে হলো ওর সুন্দরী হওয়া যত টা ডার্ক সাইড আমাকে জানিয়েছে সে সেটার ঘনত্ব হয়তো আমার চিন্তার বাইরে।
ফাইল বের করলাম, লিখলাম ডার্ক সাইড অফ বিউটিফুল লেডি।
বাড়ি ফিরেও সারারাত খালিদার পাঠানো কাগজপত্রগুলো নিয়ে পড়ে রইলাম। যত দেখছিলাম তত যেন আরো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিলাম।
সব এত স্বাভাবিক মৃত্যু। একবার দুইবার তিনবার পড়তে লাগলাম, কোন কিছু যদি পাওয়া যায় যা আমাকে এই রহস্য সমাধান করতে সাহায্য করবে।
এখন রাত দুইটা, খালিদাকে আবার ফোন দিলাম, ঘুম ঘুম কন্ঠে ও বলল,
– বেশী ভেবো না ওকে নিয়ে, ঘুমিয়ে পড়ো।
– আচ্ছা ওর মেয়ে অধরার মৃত্যুটা পানিতে ডুবার আগে হয়েছিল নাকি পানিতে ডুবার পরে হয়েছিলো।
– কি বলতে চাইছো? কেউ মারার পরে পানিতে ফেলেছে ?
– হ্যাঁ, এই সব মৃত্যুতে শুধু অধরার মৃত্যুর কারণ দেওয়া আছে। আর সেটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে এতটা সহজ হয়তো না।
– আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না তোমার কথার–তোমার কি মনে হয় খুনগুলো ও করেনি?
– সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। চিন্তা করো, তোমার পরিবারের কোন মানুষকে তুমি কারো খুনের জন্য জেলে পাঠালে, আবার তাকেই ঘরে রাখলে। অন্যদের মারার সুযোগ করে দিলে। ব্যাপার টা এতোটা স্বাভাবিক কীভাবে হতে পারে? আচ্ছা ওর কি আর কোন বাচ্চা আছে?
– না, একটাই মেয়ে ছিলো।
– ওর বিরুদ্ধে কেস করেছে কে? মানে ওকে জেলে পাঠিয়েছে কে? কারণ ওর পরিবারের সব ছেলেই তো মারা গিয়েছে।
– ওর শ্বাশুড়ি। শুধু সে মহিলা বেঁচে আছেন।
-আমি উনার সাথে দেখা করতে পারি?
– উনি দেখা করবে কিনা আমি জানি না, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি, কেইস টা শেষ হোক আমিও চাই।
-তাহলে কাল সকালে আমি যাবো উনার সাথে দেখা করতে৷
খালিদা হাই তুলে ফোন রাখতে রাখতে আমি টেবিলে ছড়িয়ে রাখা কাগজপত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম ফাঁকা দৃষ্টিতে।
পরের দিন সকালে খালিদার পাঠানো এক পুলিশের সাথে সেই বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে যেতেই আমি ছোট্ট একটা ধাক্কা খেলাম। এইটা বাড়ি নয়, রাজপ্রসাদ।
বিশাল এলাকা জুড়ে ছবির মতো সাজানো বাড়ি। এতক্ষন ধরে আমি ভাবছিলাম কোন মধ্যবিত্ত বাড়ির বউ হবে হয়তো ময়ূরাক্ষী। এত চাপ কেন ওকে নিয়ে খালিদার?
এতক্ষনে বুঝতে পারলাম কেন এত চাপে আছে খালিদা, কেন সেও সব রকমের চেষ্টা করছে কেইসটা দ্রুত শেষ হোক।
বসার রুমে বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে, এত চাকচিক্য আর দামী আসবাবে ভরা এই ঘর। কোন ঘরই মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন হোটলের রুম।
কেমন যেন নিষ্প্রাণ সব কিছু। দুইদিকে বেয়ে উঠা সিঁড়ি যেন এইঘরে দাম্ভিকতা পরিচয় ধরে রেখেছে।
সিঁড়ির দেওয়ালে টাঙ্গানো সোনালী ফ্রেমের বিশাল ছবি। সবার গায়ে আভিজাত্যের ছাপ। একজন মহিলা কালো শাড়ি আর ডায়মন্ড এর দুল পরা সোফায় বসে আছে। বাকি তার তিনছেলে আর স্বামী কালো কোট পরে দাঁড়িয়ে।
ছবিটা দেখতে উঠে সিঁড়ির কাছে চলে গিয়েছিলাম। পেছন থেকে ঝাঁঝালো একটা স্বরে ফিরলাম।
– ছবিটা দেখে লাভ নেই ওরা কেউ বেঁচে নেই।
কলাপাতা রঙের পরিপাটি শাড়ির সাথে সাদা ফুল হাতের ব্লাউজ পরা এক ভদ্রমহিলা। বুঝতে অসুবিধা হয়নি উনিই ছবির সে রাজরানী।
আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম,
-আমি মাহাবুবা খানম, আমি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট । আমি ময়ূরাক্ষীর কেইসের ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।
উনি আমাকে যেন হাত মেলানোর যোগ্য মনে করছেন না। কিংবা তিনি যে বিরক্ত তা বুঝাতে চাইছেন।
সোফায় বসে আমাকে বিপরীতে রাখা সোফায় বসতে বললেন!
ভদ্রমহিলাও অসম্ভব সুন্দরী, ময়ূরাক্ষীর চেয়ে বেশি সুন্দরী বলা যায়।
আমরা সাধারণত বলি ছেলেটা একেবারে রাজপুত্রের মতো, রাজকন্যার মতো। রাজপুত্র বা রাজকন্যারা সুন্দর হয় কারণ রাজারা সেরা সেরা সুন্দরীদের বিয়ে করেন। তাই তাদের সন্তানও সুন্দর হয়। ছবিতে থাকা তিনটি ছেলেকেই রাজপুত্র বলা যায়৷ এমন ছেলের জন্য ময়ূরাক্ষীর মতো মায়াবী মেয়েই খুঁজে আনবে এমন পরিবার সেটা বড্ড স্বাভাবিক ব্যাপার যেন।
আমি কিছু বলার আগেই উনি নাক কুঁচকে অবজ্ঞা আর বিরক্তি মেশানো স্বরে বলে উঠলেন,
– সে খুনী মেয়ের জন্য আবার সাইক্রিয়াটিস্ট! ধরে ফাঁসি না দিয়ে দেবে।
– কিন্তু প্রমাণ তো নেই, মৃত্যু গুলো খুব স্বাভাবিক।
– আমি প্রমাণ, আমি বলছি তো সে মেয়ে খুনী।
-কিন্তু সে খুনগুলো কীভাবে করেছে ?
উনি চুপ হয়ে গেলেন, আমার এইভাবে প্রশ্ন করাতে যে উনি মোটেও খুশি না। তা ভ্রু কুঁচকে রাখা স্থির দৃষ্টিটা জানান দিচ্ছে।
আমি আবার বললাম-
– আমাকে সেটাই খুঁজে বের করতে বলেছে। খুনগুলো সে কীভাবে করেছে।
-তা পারলেন?
– অনুমান করছি, তবে তার জন্য আপনার কাছে জানতে এসেছি, কেন আপনার ওকে খুনী মনে হলো। মৃত্যু গুলোতো স্বাভাবিক –
আমি কথাটা শেষ করতে পারলাম না তার আগেই উনি চিৎকার করে উঠলো,
– এক সাথে একটার পর একটা মানুষ মারা গেলো এক ঘরে, আর আপনার মৃত্যু গুলো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? ও ছাড়া আর কে বা করবে এইটা?
– তারমানে আপনি বলতে চাইছেন ওদেরকে খুন করার যথেষ্ট মোটিভ ওর ছিলো, কিন্তু সেটা কি?
আমার এই প্রশ্নে উনার এতক্ষণের দাম্ভিকতা ভরা চেহেরাটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। হয়ত ভয় লুকাতেই রাগের আশ্রয় নিচ্ছেন।
– আপনি জানেন আপনি কি বলতে চাইছেন? আপনার কি ধারণা ওকে কোন অত্যাচার করা হয়েছে, যার জন্য ও সবাইকে –
– আমার ধারণা ওকে এই ঘরে অত্যাচারের চেয়েই বেশি কিছু ভোগ করতে হয়েছে, তাছাড়া-
– যান, বেরিয়ে যান-
আমি কথাটা শেষ করার আগেই উনার এই ধরনের আচরণ আমার সন্দেহটা আরো তীব্র করছে। আমি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলাম আরো কিছু প্রশ্ন করার জন্য। উনি আমাকে সে সুযোগ না দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে যেতে বললেন,
– এই কে আছিস, এই অসভ্য ডাক্তারটাকে এখান থেকে বের করে দেয়, আর যেন ত্রিসীমানায় আমি না দেখি। আমারিই ভুল হয়েছে সে মেয়েকে পুলিশে না দিয়ে আমারই ওকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিলো।
– যেভাবে অধরা কে দিয়েছেন সেভাবে?
আমার কথায় উনার পা যেন থমকে গেল ; পা সিঁড়িতে পড়ার আগেই যেন ফসকে যেতে চাইলো। আমার দিকে ফিরে তাকালেন। আমি আমার ধারালো দৃষ্টি আর ধারালো প্রশ্ন গুলো আবারো শান দিতে লাগলাম।
-চলবে……..