#অবন্তিকা_তৃপ্তি
আয়োজিত সে রাতে, অতশত মানুষের সামনে বারবার, বারবার অদিতির চোখ পরে যাচ্ছিলো ধ্রুবর উপর। ধ্রুব হাঁটছে, ব্যস্ত ভীষণ আজ, বারবার এ-ওকে অর্ডার দিচ্ছে। সবকিছু কেমন অধৈর্য্যর মতো দেখে যাচ্ছে অদিতি। মাঝেমধ্যে ধ্রুব নিজেও এদিকে তাকালে, সঙ্গেসঙ্গে ও চোরের মতো চোখ সরিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলে। ধ্রুব তখন মাথাটা একটু নিচু করে মৃদু হেসে, আবারও কোনা চোখে ছয়! ম্যাডামের নজরে পরেছে তাহলে সে।
প্রধান অতিথির আসনে যখন ধ্রুবর বাবা এসে বসলেন, দেখা গেল ধ্রুব তখন চোখ-মুখ কুঁচকে সে জায়গা থেকে সরে এসেছে। ধ্রুবর বাবাকে নিয়ে স্যাররা নানা ভালো কথা শোনাচ্ছিলেন সবাইকে,ছেলে হয়েও সেদিকে ওর একটুও মন নেই। ও নিজের মতো করে সবকিছু থেকে অনেকটা দূরে এসে সিগারেট ধরালো।
হঠাৎ করে মেয়ে কাউকে কেশে উঠার শব্দে ধ্রুব সিগারেট মুখে ধরিয়ে পাশে তাকাল, অদিতি মুখে হাত চেপে কাশছে, আশেপাশে সিগারেটের ঘন ঘূর্ণায়মান ধোঁয়া। ধ্রুব থতমত খেয়ে সিগারেট ফেলে দিল, জুতো দিয়ে সিগারেট পিষে নিয়ে, হাত দিয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে ধোঁয়া কাটানোর চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। ও সরতে সরতে কখন এসে অদিতির পাশে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই ছিলো না ওসব। কিছুক্ষণ পর অদিতির কাশি কিছুটা থামলো। ধ্রুব অপরাধী ভঙ্গিতে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল—-‘ঠিক আছো তুমি?’
অদিতি মুখ থেকে হাত নামলো। কানের পেছনে বেবি হেয়ার গুঁজতে গুঁজতে নম্র গলায় বলল -‘হ্যাঁ।’
ধ্রুব শুনে আর দ্বিতীয়বার তাকালো না অদিতির দিকে।চোখ সরিয়ে নিল। স্টেজে পারফরম্যান্স চলছে। বুকে হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে সেটাই দেখতে লাগল। অদিতি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে তখনও ধ্রুবকে। ধ্রুবর পাশে দাঁড়িয়ে ওকে দেখার জন্যে অদিতির হৃদয়ে নেশা কাজ করছে যেন। মস্তিষ্ক বলছে- ফেঁসে যাবি অদিতি, আগাস না ওদিকে; দয়া করে আগাস না। কিন্তু ওর মন যেন আজ ভুল করতে উঠেপরে লেগেছে। এইযে ধ্রুবকে বারবার দেখা, ওর প্রতি হঠাৎ করেই ফল করা-এসব কিছু অদিতির অনিচ্ছাকৃত। তবুও অদিতি ফেঁসেছে। কিন্তু ও তো ফাঁসতে চায়নি।তবুও কেন?
অদিতি নিজেকে আটকালো, লাগাম টানলো নিজের এলোমেলো, নিষিদ্ধ ভাবনাগুলো। কথা বললো না, দাঁড়ালো না ধ্রুবর পাশে। চলে এলো ওখান ঘেকে। ওর পারফরম্যান্সের জন্যে ডাক এসেছে ততক্ষণে। ধ্রুব সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল, দূরে দাড়িয়ে থেকে দেখছে— অদিতি স্টেজে উঠছে।
ধ্রুবর হঠাৎ কি মনে পরলো। ও পাশ থেকে হাত উঁচিয়ে একজনকে ডাকলো-
‘ওই নিরব; এদিকে আয়!’
নিরব কোকের গ্লাস নিয়ে ছুটছিলো। ধ্রুব ডাকতেই তড়িগড়ি করে এগিয়ে এসে একশ্বাসে বলে উঠলো—-‘কি ধ্রুব ভাই? কোক খাবেন? এই নিন।’
ধ্রুব একটা ক্যান নিলো, তারোএ সেটার ছিপি খুলতে খুলতে নির্বিকার গলায় বলল -‘-তোদের ভাবি পারফর্ম করছে, কেউ যেন ছবি বা ভিডিওস না তুলে; খেয়াল রাখ।’
‘ভাবি—‘ —নিরব অবাক হয়ে স্টেজের দিকে তাকাল। অদিতি সেখানে জোরোসরো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। নীরব এবার দাঁত বের করে হাসলো, বললো—-‘ওকে ভাই, কাজ হয়ে গেছে ভাবো।’
নীরব আবারদৌড়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। ধ্রুব বুকে আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে তখনও স্থির ভঙ্গিতে দেখছে নীল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা অদিতি হায়াতকে।
অদিতি মাইক হাতে গান গাইছিল, চোখ বুজে। গান গাওয়া শেষ করতেই, সবাই একসঙ্গে করজোরে হাততালি দিয়ে উঠলো। মেয়েটা যেন লজ্জায় পরে গেল; এসব অনুপ্রেরণা, হাততালি সবকিভুই ওর জন্যে বড্ড নতুন। তবে এই নতুন অনুভূতিগুলো ওর দারুণ লাগছে। অদিতি লাজুক হেসে সবার দিকে তাকিয়ে হেসে, নিচে নেমে এলো।
অদিতি নিচে নামতেই একজন প্রফেসর এগিয়ে এলেন—-‘অদিতি, লিসেন!’
অদিতি ডাক শুনে এগিয়ে গেল, প্রফেসর বললেন-‘বিরিয়ানির প্যাকেট দশটা কম পরেছে, রেস্টুরেন্ট থেকে এনে দিতে পারবে?’
অদিতি অবাক হয়ে বলল —‘স্যার আমি একা?’
—‘কাউকে লাগবে? ওকে বলছি।অ্যাই ইমন।’
ইমন পাশে দিয়েই যাচ্ছিল ধ্রুবর কাছে, প্রফেসরের ডাক শুনে ও কিছুটা বিরক্ত হলো যেন। তবুও মুখে হাসি বের করে এগুলো;— ‘জ্বী স্যার?’
‘অদিতির সঙ্গে যাও, রেস্টুরেন্ট থেকে আরো দশ প্যাকেট বিরিয়ানি লাগবে, দুজন মিলে নিয়ে আসো।’
ইমনের অদিতির দিকে তাকাল বিরক্ত হয়ে। পরপর ওর চোখ-মুখ হঠাৎ করে যেন উজ্জল হয়ে এলো! ও অদিতির দিকে বাঁকা চোখে দুষ্টু ভঙ্গিতে তাকালে, অদিতি কেশে উঠে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। ইমন প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল —-‘স্যার,কিন্তু ধ্রুব তো ওদিকেই যাচ্ছে, ওরে বলি?’
প্রফেসর ধ্রুব যাবে শুনে যেন আকাশ থেকে যেন পরলেন। চশমা নাকের ডগা থেকে আঙুল দিয়ে ঠেলে তুলে, থমথমে গলায় বললেন—-‘তোমাদের ধ্রুব ভাই যাবে? এ কি শুনছি আমি?’
ইমন দ্রুত বলল -‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট যাবে স্যার, আমি বন্ধু হয়ে ওকে অর্ডার দিব এখন, ও না গেলে আজকেই আমাদের বন্ধুত্বের এখানেই টাটা; বাই-বাই হয়ে যাবে। মার্ক ম্যাই ওয়ার্ড, স্যার।’
প্রফেসর ইমনের কথায় খুব একটা পুলকিত হলেন বলে মনে হলো না। তিনি দায়ছাড়া ভাবে অদিতির দিকে একবার চেয়ে আবার ইমনের দিকে তাকালেন, ধ্রুবর যাওয়ার কথা একবিন্দুও পাত্তা না দেওয়ার ভান করে বললে——‘যাও দেখো সে রাজি হয় কিনা। মন্ত্রীর ছেলেকে তো আমার কিছু বলার সাধ্য নেই। সে রাজা, আমরা তো প্রজা মাত্র। যাও বলো এখন।আমার কাজ ঠিক মতো হলেই আমি খুশি।’
ইমন মাথা নিচু করে সালাম দিল। প্রফেসর চলে গেলেন। ধ্রুব যাবে শুনে, অদিতি কোনঠাসা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ইমনের সামনে। ইমন ধ্রুবকে ডাকল-
‘এই যে আমাদের ধ্রুব, আসুন তো এদিকে।’ —ইমনের কণ্ঠ ফুরফুরে, মেজাজ আজ ভীষণ আমেজে আছে মনে হচ্ছে। যেন দুজন মানব-মানবীর মধ্যে প্রেম করিয়ে দেওয়ার মতো মহৎ কাজ করতে পেরে সে অত্যন্ত গর্বিত।
ধ্রুব ইমনের এভাবে ন্যাকামো করে ডাকাতে বড্ড বিরক্ত হয়ে তাকাল, ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ইমনের সামনে। পাশে অদিতি দাঁড়িয়ে আছে,ধ্রুব ওর দিকে একবার চেয়ে; ইমনকে বলল —‘ সবার সামনে ন্যাকামো না করলে চলে না তোর?’ ’
ইমন দাঁত কেলিয়ে হেসে অলক্ষে অদিতিকে ইশারা করে বলল ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল —‘তোর প্রেমের জন্যে রাস্তা ক্লিয়ার করছি ব্যাডা। অদিতি রেস্টুরেন্টে যাবে বিরিয়ানির প্যাকেট আনতে। তুই ওরে কোম্পানি দিবি।’
ধ্রুব কান সরিয়ে ফেলল ইমনের কাছে থেকে, অদিতির দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে চেয়ে বলল —‘তুমি রেস্টুরেন্টে যাচ্ছো?’
অদিতি ঢোক গিলে, আস্তে করে মাথা নাড়লো —-‘জ্বী।’
ধ্রুব ইমনের দিকে তাকাতেই, ইমন চোখ টিপলো; রাস্তা ক্লিয়ার। ধ্রুব ইমনের এমন অদ্ভুতরকম ন্যাকামো দেখে চোখ উল্টে ফেলে হতাশ শ্বাস ছাড়ে।তারপর নিজেও ন্যাকামোর চুড়ান্তে গিয়ে অদিতিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল —-‘তো তুই যা না, আমাকে টানছিস কেন এখানে?’
অদিতি অবাক হলো; ধ্রুব কি ওর সঙ্গ চাইছে না? ওর বুকটা মুচড়ে উঠল হঠাৎ যেন। ইমন ধ্রুবর হঠাৎ বদলে যাওয়া দেখে যারপরনাই অবাক হলো , বললো —‘তুই যাবি না?’
ধ্রুব ভ্রু বাঁকালো,ইশারা করলো কিছু। ইমন সঙ্গেসঙ্গে শুধরে গিয়ে বলল —‘না রে আমার কাজ আছে, ওই গেইটের দিকে নজর দিতে হবে এখন। ফুল-বেলুন নাকি কে যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রফেসর থাকতে বলেছে।’
ধ্রুব-ইমন অদিতির আড়ালে একে অন্যের দিকে চেয়ে হেসে উঠলো নিঃশন্দে। ইমন এটা বলার পরপরই দৌড় লাগালো সামনে।ও যেতেই ধ্রুব ওর ডান হাত হাতটা জেন্টেলম্যানের মতো সামনে এগিয়ে ইশারা করে বললো—‘লেডিস ফার্স্ট।’
অদিতি ধ্রুবর হাতটা দেখল, যা ধ্রুব রাস্তার দিকে ইশারা করে আছে। অদিতি মনেমনে আরো একবার ভীষণ মুগ্ধ হলো। ও মৃদু হেসে, আবার দ্রুত হাসি লুকিয়ে ফেলে এগিয়ে গেল সামনে, ধ্রুব হাত আবার সরিয়ে নিয়ে পেছন পেছন হাঁটছে।
রেস্টুরেন্ট পাশেই যেহেতু, ওরা হাঁটছে দুজন ফুটপাথ ধরে। অদিতি বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, কেউ কি ওদের দেখছে? ধ্রুব হয়তো সেটা লক্ষ্য করল, ও সামনের রাস্তার দিকে চেয়েই হেঁটে হেঁটে বলে উঠলো——-‘তুমি কোনো সেলিব্রেটি নও যে সব জায়গায় মানুষজন তোমার ছবি তোলার জন্যে ডেসপারেট হয়ে থাকবে।’
ধ্রুবর আচমকা বলা কথায় চমকে উঠলো অদিতি। লজ্জায় পরে গিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে; বেবি হেয়ারগুলো কানের পেছনে গুঁজতে গুঁজতে নিচু গলায় বলল—-‘তেমনটা নয়। আমি তো এমনি—‘
‘বাবাকে অনেক ভয় পাও, রাইট?’—ধ্রুবর নির্বিকার গলা।
অদিতি অবাক হলো, ধ্রুব ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে এসব কিভাবে জানে? অদিতি ধ্রুবর দিকে অবাক চোখে চেয়ে ছিলো, ধ্রুব সেটা বুঝতে পেরেছে হয়তো। ও অদিতির দিকে তাকাল এতক্ষণে, বললো —‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেদিন গুজব শুনে কেঁদে কেঁদে আমার কাছে এসেছিলে, সেদিনই বুঝেছিলাম।’
অদিতি এবার মৃদু হাসল, হাঁটতে হাঁটতে আনমনা হয়ে জবাব দিলো——‘আমার ব্যবহারগুলো হয়তো মানানসই নয় সব জায়গায়; বারবার আপনাদের অপ্রস্তুত করেছি আমি। কিন্তু এই ব্যবহারগুলো আমার ইচ্ছাকৃত নয়, আমি ঢাকা শহরের সঙ্গে এখনও ফিট হতে পারিনি সম্ভবত।’
‘ঢাকা শহর? নাকি বয়েজদের সঙ্গে?’ -ধ্রুবর গম্ভীর কন্ঠ।
অদিতি থামল, কি বলবে ভেবে পেল না বোধহয়। ও লজ্জিত ভঙ্গিতে শাড়ির কুঁচি সামলে নিতে নিতে বলল -‘হু, হয়তো ওটাই।’
অদিতিকে না বোঝালেও; ধ্রুব মনেমনে ভীষণ স্বস্তি পেল। ওর মতোই ওর গার্লফ্রেন্ডও একই আচরণ-বৈশিষ্টের হবে। ধ্রুব ইয়ামিন এত পপুলার হওয়া স্বত্বেও নিজের হীনমন্যতা, নিজেই নিজেকে ছোট করে দেখার জন্যে আজ অব্দি কোনো মেয়ের কাছে ঘেঁষেনি। ওর গার্লফ্রেন্ডও হবে তেমনি, বাবার ভয়ে আজ অব্দি ও-ও কোনো ছেলের পাশে ঘেঁষেনি। ধ্রুব নিজেই নিজেকে খুশি হয়ে মনেমনে বাহবা দিলো; হিরা জুটিয়েছে ও নিজের জন্যে।
ধ্রুব রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে অদিতিকে ইশারা করলে আগে ঢোকার জন্যে। ও ধ্রুবর চোখে একবার চেয়ে দেখল, ধ্রুব হাত দিয়ে দরজা খুলে রেখে চোখের ইশারায় অদিতিকে আগে ঢোকার জন্যে ইশারা করছে। মনেমনে ও মুগ্ধ হলো আরেকবারের মত; ধ্রুবর থেকে চোখ সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ধ্রুব তারপর দরজা ঠেলে অদিতির পেছন পেছন রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। সেখানে অদিতির কিছুই করা লাগলো না। ধ্রুব নিজেই পেমেন্ট করে বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো দুটো বড় পলিথিনে নিয়ে নিলো। অদিতির ক্যারি করতে চেয়েছিল ব্যাগ, ধ্রুব মানা করে বসেছে; অগ্যতা অদিতি থেমেছে।
এবার দরজা খোলার সময়, ধ্রুব দাঁড়িয়ে পরলো। ওর হাত দুটো বাধা, পলিথিন হাতে। ধ্রুব কাঁচুমাঁচু ভঙ্গিতে অদিতির দিকে তাকালো। অদিতি হেসে উঠল নিঃশব্দে,রাজার বড়াই এখানেই শেষ তবে!
অদিতি আলগোছে এগিয়ে গিয়ে নিজেই দরজা খুলে দিল, তারপর ইশারা করলো ধ্রুবকে আগে যেতে। ধ্রুব এগিয়ে গেল আগে,অদিতি দরজা আটকে পেছনে পেছন এগুলো।
ধ্রুব একা একা এতকিছু বইছ; এভাবে অদিতির কেমন একটা লাগছে। ও তাই আবারও জোর করলো- -‘পলিথিন আমাকে কাছে একটা দিন, দুটো একা সামলাচ্ছেন।’
ধ্রুব হাঁটার মধ্যে নিজের মতো করেই জবাব দিলো—-‘মেয়েরা ব্যাগ ক্যারি করে না। ওসব আমাদের কাজ।’
অদিতি হেসে উঠল, যেন কৌতুক শুনছে। ও যেহেতু ধ্রুবর পেছনে হাঁটছে; তাই ধ্রুব দেখতে পেলো না ওর হাসি। অদিতি কৌতুকভরা হাসি ঠোঁটে টেনে রেখেই, হাঁটতে হাঁটতে বলল —‘মেয়ে-ছেলেদের এই নিয়ম কি কোথাও লেখা আছে?’
ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল -‘ওগুলো আমার ভাবনা, আমি আমার মা কে কখনো ব্যাগ বইতে দেখিনি। আমি নাহয় উনি বইতেন।’
‘উনি?-‘ অদিতি চিনতে পারলো না।
ধ্রুব এবার হাঁটার গতি কিছুটা কমালো। গম্ভীর স্বরে; ছোট করে জবাব দিল —-‘ম্যাই বায়োলজিকাল ফাদার।’
অদিতি অবাক হলো। হয়তো বুঝতে পেরেছে- ধ্রুব কোনো কারণে তার মন্ত্রী বাবার প্রতি অসন্তুষ্ট। এই সেনসেটিভ ব্যাপারে গভীর যাওয়া ঠিক হবে না, তাই ও এ ব্যাপারে তেমন কথা বাড়ালো না।
ওরা প্রায় চলেই এসেছে ভার্সিটির কাছে। ভার্সিটি এরিয়ায় আসতেই ধ্রুবকে এ-ও সালাম দিতে শুরু করেছে। ধ্রুব ওদের দিকে একবার চেয়েই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। অদিতি দেখছে; আশপাশের মানুষ ওকে ধ্রুবর সঙ্গে দেখে বাঁকা বজরে দেখছে। এতক্ষণ কোনো এক অজানা কারণে স্বাভাবিক থাকলেও; এবার যেন অদিতির হুশ ফিরলো। ও নিজের মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে নিল দ্রুত; মুখ আঁচলের এক কোণায় লুকিয়েও নিলো।
ধ্রুব বিরিয়ানির পলিথিন বেঞ্চের উপর রাখতে রাখতে কেন যেন অলক্ষ্যে অদিতির দিকে তাকালো। অদিতি তখন শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে ইতি-ওতি দেখছিল। ধ্রুব থমকে গেল যেন; অবাক হয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে রাখা অদিতির দিকে চেয়ে রইলো হা হয়ে। নীল শাড়িতে আঁচল মাথায় তোলা অবস্থায় সম্পূর্ণ বউ-বউ দেখাচ্ছিল ওকে তখন।
ধ্রুব সামনা-সামনি অদিতির এমন মারাত্মক রূপ কখনোই দেখেনি। সবসময় ঢিলে সালোয়ার-কামিজে ঢেকে থাকা অদিতির এমন ভোবনমোহিনী সৌন্দর্য্যে থমকে রইলো যেন ধ্রুব।
অদিতি চলে যাবে কিনা ভাবছিলো তখন। এখনও কাজ বাকি; প্যাকেটগুলো ওদেরই সার্ভ করতে হবে।একটা মানুষ শুরু থেকে এত কাজ করছে, তাকে এভাবে অর্ধেক কাজের মধ্যে রেখে চলে যাওয়াটাও তো অনুচিত। তাই ও সেভাবেই দাঁড়িয়েই রইলো,অথছ ভয় এখন কাটেনি ওর। বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে; সবাই যেতে যেতে একবার হলেও ; ধ্রুব-অদিতির দিকে চোখ যাচ্ছিল। অদিতি সেটা বুঝতে পারছে; মূলত এইজন্যেই অদিতি আরো কোনঠাসা হয়ে গেছে।
ধ্রুবর এসবে মনোযোগ নেই। ওর সম্পূর্ণ ধ্যান-ধারণা অদিতির সরলতায় ঘেরা মুখের উপর এসে আটকে গেছে। আচমকা ধ্রুব এক অদ্ভুত কাজ করে বসলো। অদিতির চোখের দিকে চেয়ে নিজের মতো করেই স্প্যানিশ ভাষায় বলে বসলো-
‘অ্যারেস মি এনামোরাদা; মি আমোর।’
এ কি বলছে ও? ধ্রুব কথাটা বলে নিজেই থতমত বনে গেল। ওর মস্তিষ্ক যেন এবার সচল হলো! অদিতি কথাটা শুনে ফেলেছে;ও ভ্রু কুঁচকে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে উঠল -‘জ্বি?’
‘কিছু না।’ —-ধ্রুব অদিতির দিকে পিঠ দেখিয়ে তড়িগড়ি করে পলিথিন থেকে প্যাকেটগুলো বের করা শুরু করেছে। অথচ অদিতি বুঝতে পেরেছে; ধ্রুব কিছু একটা বলেছে ওকে, চাইনিজ ভাষায় কি যেন! ধ্রুবকে তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে দেখে ও আর সেটা নিয়ে ঘাটাল না। কাজে হাত লাগালো ধ্রুবর সঙ্গে।
ওদিকে দূর থেকে সৌরভ ইয়ামিন ধ্রুব-অদিতির দিকে চেয়ে আছেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে। ওরা কাজ করছে; একে অপরের এতটা কাছে থাকছে; এসব কিছুই সৌরভের চক্ষু শীতল করছে যেন। উনি একসময় পাশে থাকা সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করলেন—-‘এটাই কি ওই মেয়ে?’
—-‘জ্বী স্যার।’
—‘মেয়েটার বাড়ি, নাম-ধাম বের করো। আমি চাইছি- দ্রুতই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে মেয়েটার বাড়িতে। ধ্রুবকে এবার আমি সারপ্রাইজ দিতে চাইছি; রাহুল। আমার ছেলেটার খুশি আমি দ্রুত নিজের দুই চোখে দেখতে চাইছি। ছেলেটা আমার বড্ড একরোখা;গম্ভীর। হয়তো মুখ ফুটে নিজের পছন্দ বলবে না কোনদিন, তবে বাবা হিসেবে আমার তো একটা কর্তব্য আছে, বলো। তুমি সব ব্যবস্থা করে ফেলো দ্রুত।’
—-‘ ওকে স্যার।’
#চলবে