#ডিভোর্স ৩য় পর্ব
নিলীমা ফারহানার কাছ থেকে বিদায় ভার্সিটিতে ফিরে আসলো। ও টিচার্স কোয়াটারে থাকে। আসার পথেই রায়হানের সাথে দেখা, ওকে দেখেই গাড়ী দাঁড় করালো, রায়হানকে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন ভাই, ভাল তুমি? জ্বি ভাল। রায়হান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানতে চাইলো, তোমার সাথে ফারহানার কথা হয় না? হয়তো, কেন ভাই? নিলীমা জিজ্ঞেস করলো না কিছুনা। হঠাৎ রাস্তার উল্টোদিকে বৈশাখীকে দেখতে পেলো নিলীমা, এদিকেই আসছে। নিলীমা তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে একটু সামনে গিয়ে আবার গাড়ী দাঁড় করিয়ে ওদের খেয়াল করতে লাগলো।
ওরা রিক্সায় উঠে শাহবাগের দিকে চলে গেল।
বৈশাখীর শরীরটা ইদানিং ভাল যাচ্ছে না। বৈশাখীর মা মারা যায় ছোট বেলায়, তারপর ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করে কিন্তু ছোট বেলা থেকেই সৎ মা ওকে নির্যাতন করতো, ও ছিল খুবই ব্রিলিয়ান্ট, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেনীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়, এসএসসি তেও স্টাণ্ড করার পর থেকে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাতো, টিউশনি করে। ওর বাবার কিছু করার ছিলনা। এইচ এস এসি তে খুব ভাল রেজাল্ট করে ও ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মেধা তালিকায় চান্স পায়।
একদিন ক্লাস চলাকালীন সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
তাড়াতাড়ি ওকে অন্যরা ধরে উঠিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে সুস্থ করে তুললো। রায়হান ওকে গাড়ীতে করে হলে পৌঁছে দিয়ে আসলো।
ছাত্রী ভাল হওয়ার কারনে বৈশাখী সবসময় ফেবার পেতো। এই নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্প ওর কানেও এসেছে। কিন্তু বৈশাখী বলতো স্যার এসবকে পাত্তা দিলে তো আমরা নৈতিক ভাবে হেরে যাবো। রায়হানও তাই বিশ্বাস করে। বৈশাখী দিন দিন আরও অসুস্থ হতে লাগলো, রায়হান ওকে পিজির একজন মেডিসিনের ডাক্তার দেখালো। নানান টেস্ট করে ডাক্তার রায়হানকে পরামর্শ দিলো একজন নিউরো স্পেসালিস্টকে দেখাতে। বৈশাখী বারবার রায়হানকে নিষেধ করতো, বলতো স্যার আমার জীবনের লড়াইটা আমার একার, সেই ছোটবেলা থেকে শুরু করেছি, শেষটাও আমিই নিজেই করতে চাই, আপনি কেন জড়াচ্ছেন এর সাথে? রায়হান বলতো কেন? আমি যদি তোমার ভাই হতাম? পারতাম বোনকে একা লড়াই করতে দিতে? পাশে থাকতাম না? বৈশাখী আর কোন কথা বলেনি, শুধু বললো, আসলে আমি কারো উপরে নির্ভর করতে চাইনা। সেই থেকেই রায়হান আর বৈশাখী একসাথে চলা। যদিও মানুষের গল্পের শেষ নাই।
নিউরো মেডিসিনের ডাক্তার এম আর আই করাতে বললো বৈশাখী কে, অনেক টাকার ব্যাপার, রায়হান বললো বৈশাখী তুমি টাকার চিন্তা করবা না। বৈশাখী কোনভাবেই রাজী হচ্ছিলো না, কিন্তু রাহয়ানের চাপাচাপিতে অবশেষে এম আর আই করালো। একদিন পরে রিপোর্ট দেবে, বৈশাখীকে হলে নামিয়ে দিয়ে রায়হান বাসায় গেলো। তখনও ফারহানা বাসায় ফেরেনি। রুহী বাগানে ঘুরছিলো, বাবাকে দেখে দৌড়ে আসলো, বাবা তোমার কি শরীর খারাপ? না তো মা, তোমার টিচার আসেনি? রায়হান মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো। না আজ টিচার আসবে না, ফোন করে জানিয়েছে। ও তাহলে চলো আমি তোমাকে একটু দেখিয়ে দেই। ওকে বাবা, খুব মজা হবে। বাবা মেয়ে বসে পড়াশুনা করছে এমন সময় আসলো ফারহানা। এই দৃশ্য দেখে ওর মনটা ভরে গেল। ফারহানাও ওদের পাশে গিয়ে বসলো।
ফারহানা বিশ্বাস করতে পারছে না, যে রায়হানের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে, কিন্তু ও যে নিজের চোখে দেখেছে, অবিশ্বাসই বা করবে কিভাবে? এমন সময় নিলীমা ফোন করলো, ফারহানা সরে এসে ফোন রিসিভ করলো, কি রে নিলীমা? কোন খবর আছে? নিলীমা বললো দ্যাখ তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, এতদিন কিছু বলিনি তোর সংসারে অশান্তি হবে এই ভেবে, কিন্তু তোর চোখে যে আকুতি দেখলাম তাতে আর মন স্থির রাখতে পারছি না, তারপর তোর ওখান থেকে আসার পথে দেখলাম রায়হান ভাই রিক্সায় করে বৈশাখী কে নিয়ে শাহবাগের দিকে গেল। বৈশাখী কে রে? রায়হান ভাইয়ের এক ছাত্রী, অনেকদিন ধরে ওদের নিয়ে কানাঘুষা চলছে, ফারহানা স্তব্ধ হয়ে গেল, তোর কাছে কি ওর কোন ছবি আছে? দাঁড়া দিচ্ছি বলে নিলীমা আজকেই তোলা দুজনের ছবি পাঠালো।
এই মেয়েটাকেই ফারহানা সেদিন দেখেছিলো রায়হানের সাথে। ও গিয়ে বললো রায়হান চলো ঘরে যাই তোমার সাথে কিছু কথা আছে, খুব জরুরী। রায়হান বললো তুমি যাও আমি আসছি, ফারহানা রুহীর সামনে থেকে কান্না লুকিয়ে ঘরে চলে আসলো। কিছুক্ষণ পর রায়হান ঘরে আসলো, কি ব্যাপার জানতে চাইলো, ফারহানা বললো মেয়েটা কে? রায়হান? তুমি আমার সাথে এতবড় প্রতারণা করতে পারলে? রায়হান বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলো কিসব আবোলতাবোল বকছো? কোন মেয়ে আবার? ও তাহলে কতজন আছে তোমার? ফারহানা চিৎকার করে বললো, প্রতারক তুমি একটা প্রতারক, তোমার সঙ্গে আর যাই হোক সংসার করতে পারবো না, রায়হান বলরো প্লিজ একটু শান্ত হও, ফারহানার হাত ধরতে গেল, খবরদার তুমি আমাকে ছোঁবে না, অন্য মে য়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে আবার আমার কাছে এসে সাধু সাজছো? রায়হানের আর সহ্য হলোনা, ফারহানাকে চড় মেরে বসলো, ফারহানতো নির্বাক হয়ে গেল, ঐ মেয়েটার জন্য আমার গায়ে হাত তুললে? আমি ডিভোর্স চাই, ফারহানা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো, আর যাই হোক তোমার মত প্রতারকের সাথে একঘরে থাকতে পারবো না? তুমি বেরিয়ে যাও আমিই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করছি। রায়হান অনেকবার ফারহানাকে বোঝাতে ব্যার্থ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
রুহী ওকে দেখে বললো বাবা, তুমি আর পড়াবে না? না বাবা আজ না, আরেকদিন সব বুঝিয়ে দেবো, আমি একটু বাইরে যাবো। তোমরা খেযে নিও, আমি হয়তো নাও আসতে পারি। রুহী একটু অবাক হলো, বাবা তো বাসার বাইরে কখনো রাত কাটায় না, আজ কি হলো?। মাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
পরদিন সকালেই উকিল ডেকে রায়হানকে ডিভোর্স নোটিশ পাঠালো ফারহানা, অবাক হয়ে গেল রায়হান একটা মিথ্যা অভিযোগে এতবড় সিদ্ধান্ত নিলো ফারহানা? ওর ও জেদ চেপে গেল, দেখা যাক কতদিন এভাবে একা থাকতে পারে। রায়হানও উকিলের মাধ্যমে নোটিশের জবাবে ওর সম্মতির কথা জানিয়ে দিল।
তবে রুহীর সাথে সবসময় যোগাযোগ ছিল রায়হানের, বাবা হিসেবে সব দায়িত্বই ও পালন করতো, যদিও ফারহানা ওর কাছ থেকে কোন খরচ নিতে চাইনি, কিন্তু রায়হান বলতো আমার মেয়ের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।
সেই রুহীর মুখোমুখি হতে হলো, ফারহানার, ডিভোর্স কেনো হয়েছিলো? সত্যিই তো এটা তো শুধু ওর আর রায়হানের ব্যাপার ছিলোনা, ওদের সন্তানও এর ভবিষ্যৎ এর সাথে জড়িত। তখন জেদের কারনে একথা কেউ চিন্তা করেনি। ফারহানার মাথায় হঠাৎ চিন্তা ঢুকে গেল, আচ্ছা ওকি বেশী রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিল? শুধু মাত্র একটা মেয়ের সঙ্গে রিক্সায় যেতে দেখেই ওদের সম্পর্কে খারাপ ধারনা করা কি ঠিক হয়েছিলো? কিন্তু সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলে রায়হান স্বীকার করলো না কেন? যদিও দ্বিতীয় দিনে রায়হান বারবার ওকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শুনতেই চায়নি। নিলীমার পাঠানোর ছবি দেখে ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলো। ওর বাবার কথা খুব মনে পড়তে লাগলো, বাবা বেঁচে থাকলে অবশ্যই তাৎক্ষণিক এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে দিতেন না।
রায়হানও তো সময় নিতে পারতো, যদিও রায়হান সব সময়ই প্রচণ্ড জেদি প্রকৃতির। এখন রায়হান কে খুব মিস করে। ওদের ডিভোর্স তো ছয়মাসও হয়নি। ফারহানা সিদ্ধান্ত নিলো রায়হানের ব্যাপারে আবার একটু খোঁজ নিতে হবে, এখন কি ও বিয়ে করেছে বৈশাখীকে? ভাবতেই আবার শরীরটা রি রি করে উঠলো, ওর মত একটা মেয়ের কাছে ওকে পরাজিত হতে হলো?
ফারহানা মন খারাপ করে ফেসবুক ঘাটাঘাটি করছিলো, হঠাৎ নজরে আসলো একটা মুমূর্ষু রোগীর জন্য এ নেগেটিভ রক্ত প্রয়োজন। রোগীর অবস্থান ঢাকা নিউরো সায়েন্স হসপিটাল লেখা, তবে যোগাযোগের ঠিকানায় রায়হানের নাম ও ফোন নম্বর ও ব্যাংক একাউন্ট নং দেওয়া। ও নিলীমাকে ফোন করলো, নিলীমা জানালো বেশ কিছুদিন রায়হান ভাই ক্লাস নিচ্ছে না। ঐ মেয়েটা নাকি খুবই অসুস্থ, ব্রেইন টিউমার, বেশীদিন হয়তো বাঁচবে না, তাই ওর কাছেই থাকে সব সময়। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন, ওর বন্ধুবান্ধবরা যদিও নানাভাবে চেষ্টা করছে কনসার্ট করছে। টাকাও উঠছে প্রচুর কিন্তু সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা করাতে আরও অনেক টাকা লাগবে। রায়হান ভাইও অনেক খরচ করছে কিন্তু কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শুনেছি সরকারের কাছেও আবেদন করেছে। ফারহানা বললো, নিলীমা একটা কাজ করতে পারবি? আমাকে জেনে দিতে পারবি মোট কত টাকা লাগবে? কেন তুই কি করবি? দেখি কিছু সাহায্য করা যায় কি না?। নিলীমা বললো ঠিক আছে। আমি জানিয়ে দেবো।
পরদিন নিলীমা জানালো প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা লাগবে সিঙ্গাপুরে, চেন্নাইতে হয়তো একটু কম লাগবে, কিন্তু রায়হান ভাই রিস্ক নিতে চাচ্ছেন না, উনি সিঙ্গাপুরেই নিতে চান। ফারহানা সিদ্ধান্ত নিল ওই টাকাটা দিবে, ওর বাবার নামে একটা চ্যারিটেবল ফাণ্ড করা আছে প্রায় কয়েক কোটি টাকা আছে সেখানে, ওখান থেকেই দেবে।
অফিসে গিয়েই চিফ একাউন্টেন্টকে ডেকে চ্যারিটেবল ফাণ্ড থেকে ত্রিশ লক্ষ টাকা তুলে বৈশাখীর সাহায্যের জন্য খোলা একাউন্টে জমা দিতে বললো।
দুপুর একটার দিকে রায়হানের মোবাইলে ম্যাসেজ আসলো ঐ একাউন্টে টাকা এসেছে, রায়হান ম্যাসেজ দেখে প্রথমে ভাবলো ত্রিশ হাজার, যখন টোটাল ব্যালেন্স দেখলো তখনতো চক্ষুছানাবড়া। এতটাকা কে পাঠালো? জগতে তাহলে এখনও ভাল মানুষ আছে?।
চলবে…….
শওকত জাহিদ