[গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং সম্পূর্ণ গল্পটি কাল্পনিক। দয়া করে কেউ বাস্তবের সাথে তুলনা করবেন না]
অতিপ্রাকৃত রহস্যে পরিপূর্ণ গহীন জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছে একটি মেয়ে। পেছনে কতগুলো অতৃপ্ত আত্মা তাকে ধাওয়া করছে। ছুটতে ছুটতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদের আঘাতে আঘাতে তার পা দু’টো রক্তাক্ত হয়ে যায়। তবুও সে থামে না। যেন জীবনকে হাতের মুঠোয় পুরে বাঁচার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে। পেছন থেকে ভয়ানক এক কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– ছুটো। আরোও জোরে ছুটো। যতক্ষণ ছুটবে ততক্ষণই বাঁচতে পারবে। থেমে গেলেই মৃ’ত্যু অবধারিত।
মেয়েটার গলা শুকিয়ে আসে। ভীষন তৃষ্ণার্ত সে। এই মুহূর্তে পানি না খেতে পারলে এমনিতেও মা’রা যাবে। কিন্তু ম’রে গেলে চলবে কি করে? তাকে বাঁচতে হবে।
প্রাণপনে ছুটে সে। পৌঁছে যায় একটি ঝিরিপথের কাছে। ঝিরিপথের দু’পাশে থাকা ছোট ছোট ধারালো পাথরের আঘাতে মেয়েটার আত্মা বেরিয়ে আসে। যতবার পাথরগুলোর উপর পা রাখে ততবার চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরে। গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। ঝিরিপথ পেরিয়ে ফের ছুটতে শুরু করে। দৌড়াতে দৌড়াতে ঘন হয়ে আসা গাছপালার সাথে ধাক্কা খেয়ে স্যাঁতস্যাঁতে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত মাটিতে ছিটকে পড়ে। করুন কন্ঠে গোঙ্গানি দিয়ে উঠে। অস্পষ্ট স্বরে ডাকে,
– বাবা।
যেন সাথে সাথে তার বাবা উত্তর দেন। সাহস যুগিয়ে বলেন,
– উঠে দাঁড়াও আমার সাহসী মেয়ে। শয়তানগুলো তোমার সন্নিকটে। যদি মোকাবিলা করার শক্তি না থাকে, তবে পূর্ন শক্তি অর্জন করেই জা’নোয়ারগুলোর মুখোমুখি হবে।
মেয়েটা পেছন থেকে হ্রেষাধ্বনি শুনতে পায়। তার বাবার কন্ঠস্বর হাওয়াই মিলিয়ে যায়। অসাড় হয়ে আসা শরীরটাকে কোনোরকমে টেনে তুলে সে উঠে দাঁড়ায়। ফের ছুটতে শুরু করে। পেছনে থাকা অতৃপ্ত আত্মাগুলো তাকে দৌড় করিয়ে ভীষণ মজা পায়। উচ্চশব্দে ভয়ংকর ভাবে হাসতে শুরু করে।
চারদিকে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। আবছা আলো আবছা অন্ধকারে জঙ্গলের গাছপালাগুলোকেও কেমন অদ্ভূতুরে মনে হয়। মনে হয় দানবীয় গাছগুলো তাদের দু’হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে জাপ্টে ধরতে চায়ছে। বিশাল হা করে তাকে গিলে নিতে চায়ছে। ঝোপঝাড়ের পাশে কি যেন সড়সড় করে উঠে। গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলো আতংকিত হয়ে ডানা ঝাপ্টায়। শঙ্কিত কন্ঠে চেঁচামেচি করে মেয়েটার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বহুদূরে পাড়ি জমায়।
মেয়েটা ছুটে। ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরে দেখে। ঘোড়াগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। অসাবধানতাবশত ধাক্কা খায় সামনে থাকা শক্ত কিছুর সাথে। নজর সরিয়ে সামনের দিকে তাকায়। মুহূর্তেই ভয়াবহ চমকায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটাকে দু’হাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। নিজেও দু’কদম পিছিয়ে যায়। তার চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে কন্ঠস্বর অবরোধ হয়ে আসে। পুনরায় পিঠ পেছনে হ্রেষাধ্বনি শুনতে পায়। মেয়েটা ফের পিছন ফিরে তাকায়। সহসা তার হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে আবারও সামনের দিকে তাকায়। একসাথে দু’জায়গায় অবিকল একই ব্যক্তিকে দেখে সে নিশ্চল, নির্বাক হয়ে যায়। একজন সামনে দাঁড়ানো, অন্যজন ঘোড়ার পিঠে চড়ে দলবল সাথে নিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসে। কিন্তু একই ব্যক্তি দু’টো জায়গায় কিভাবে থাকতে পারে? মেয়েটা ভাবে। তার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে আলোর গতিতে একটা তীর ছুটে আসে। বিদ্ধ হয় মেয়েটার পিঠে। ঠিক মেরুদন্ডের হাড়ের বা’পাশে। একটা ক্ষিপ্ত করুন আর্তনাদ শোনা যায়। পেছনে থাকা শয়তানগুলো শব্দ তুলে হাসে। মেয়েটা লুটিয়ে পড়ে মাটির উপর কাঁটা ছড়িয়ে থাকা ঘাসে।
_________★★__________
ইউক্রেন।
ইউরোপ মহাদেশের একটি প্রত্যন্ত প্রদেশ। দেশটি ইউরোপের পূর্ব অংশে অবস্থিত। এর পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া এবং হাঙ্গেরি অবস্থিত। দক্ষিন পশ্চিমে রোমানিয়া ও মলদোভা। দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর ও আজভ সাগর, পূ্র্বে এবং উত্তর পূর্বে রাশিয়া, উত্তরে বেলারুশ অবস্থিত। ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইউক্রেনের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। প্রাচীনকালে এটি স্কিথিয়ার অংশ ছিলো এবং গেটাইরা এখানে বসতি স্থাপন করেছিলো। কিয়েভান রাশ’দের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইউক্রেন প্রকৃত ইতিহাসে প্রবেশ করে। কিয়েভান রুশ মধ্যযুগে একটি শক্তিশালী অবস্থায় চলে আসে। কিন্তু তেরো শতাব্দীতে মোঙ্গল আক্রমণে এটি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যায়। চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউক্রেন তিনটি বিদেশি শক্তির অধীনে চলে আসে। যেগুলো ছিলো-গোল্ডেন হোর্ড, লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড। পঞ্চাদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চল ক্রিমিয়ান খানাত এর অধীনে চলে আসে। ১৬৪৮ সালে পোলিশ ক্যাথলিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ হয়। এরপর ১৬৫৪ সালের জানুয়ারিতে স্থানীয় গনপরিষদ(রাদা)পেরেয়স্লাভ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। শীঘ্র নিপার নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত পোলিশ-লিথুয়ানীয় সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ রুশ শাসনের অধীনে আসে এবং কয়েক শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলে রুশ শাসন চলতে থাকে।
★★
সাল ১৭২১।
কাহিনীটা এখান থেকেই শুরু।
ইউক্রেনের লোকেরা রুপকথার গল্প শুনতে ভীষণ ভালবাসতো। বিশেষ করে খারকিভ, ওডেসা, মারিওপল এবং খেরসন শহরের অধীনস্ত গ্রামগুলোতে বসবাস করা অধিবাসীরা রুপকথার গল্প শোনায় প্রবল আগ্রহী ছিলো। সেসময় ভ্যাম্পায়ার আর মায়া-নেকড়ের কাহিনী বহুল আলোচিত ছিলো। বাচ্চারা যখন কান্না করতো, মায়েরা তখন তাদের ভয় দেখিয়ে চুপ করাতো। মুখে আঙ্গুল রেখে অনুচ্চ স্বরে ফিসফিসিয়ে বলতো,
– হুশশশ। কেঁদো না। তোমার কান্নার শব্দ শুনতে পেলে রক্তচোষা প্রাণীরা চলে আসবে। হিংস্র নেকড়েরা চলে আসবে।
বাচ্চাগুলো কি বুঝতো কে জানে। কিন্তু রক্তচোষা প্রাণী অথবা নেকড়েদের কথা শুনে ওদের কান্না থেমে যেত। ওরা ভীষন ভয় পেত। গুটিশুটি মে’রে মায়ের বুকে মুখ লুকাত। সেসময় বিভিন্ন জায়গায় ভোর হতে না হতেই রক্তশূণ্য মৃ’তদেহ দেখা যেত। কখনো বা মাংসহীন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হাড়গোড় পাওয়া যেত। কখনো বা দেখা যেত আধ খাওয়া বীভৎস লা’শ। বন-জঙ্গলের পাশে অবস্থিত লোকালয়গুলোতে এরকম ঘটনা বেশি ঘটতো। তাই জঙ্গলের কাছাকাছি বসবাস করা মানুষগুলো সন্ধ্যার পর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকতো। রাত যত গভীর হতো দূর থেকে অপার্থিব আত্মচিৎকার ভেসে আসতো। শোনা যেত ক্রুদ্ধ কন্ঠের জান্তব গর্জন।
অধিকাংশ শহরের বনাঞ্চলের পাশে থাকা লোকালয়গুলোতে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত মৃ’ত্যু দেখা গেলেও কিয়েভ ছিলো অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ একটি শহর। সেসময় ইউক্রেনের শাসক ছিলেন ডেভিড যোসেফ স্যাভেরিন। রাজধানীতেই ছিলো তার সুবিশাল দুর্গ। যা স্যাভেরিন ক্যাসল নামে পরিচিত ছিলো। যোসেফ ছিলেন বীর যোদ্ধা। ন্যায়পরায়ন শাসক এবং প্রজাদরদী। মনের দিক থেকে বেশ কঠিন এবং দৃঢ়। অথচ এই কঠিন মনের শাসকটাও নিজের একমাত্র সহধর্মিণীর প্রতি ভীষণ দূর্বল ছিলেন। বলতে গেলে স্ত্রী অন্ত প্রাণ। যোসেফ স্যাভেরিনের সহধর্মিণী ছিলেন ভীষণ সুন্দরী। যতবার তিনি নিজের সহধর্মিণীকে দেখতেন, ততবার সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করে বলতেন,
– হে ঈশ্বর, আমাকে আমার সহধর্মিণীর সাথে বহু বছর বেঁচে থাকার আয়ু দান করুন।
চল্লিশোর্ধ্ব যোসেফ ছিলেন নিঃসন্তান। সহধর্মিণীর সাথে বহু বছর বাঁচার আয়ু কামনার পাশাপাশি তিনি প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের কাছে একটা সন্তান লাভের প্রার্থনা করতেন। কিন্তু তার স্ত্রী’র এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল ছিলো না। সে বেশ আনন্দ উল্লাসে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছিলো। ডেভিড যোসেফ অবশ্য এতে করে বেশ প্রশান্তি অনুভব করতেন। বুক ভরে স্বস্তির শ্বাস টেনে নিয়ে ভাবতেন,
– অন্তত মা না হওয়ার যন্ত্রণা আমার সহধর্মিণীকে কাবু করতে পারে নি।
সমস্যা’টা মূলত যোসেফের মাঝেই ছিলো। তিনি কখনো বাবা হতে পারবেন না। এই চরম সত্যিটা জেনেও তার সহধর্মিণী তাকে ভীষণ ভালোবাসতো। যা বুঝতে পেরে যোসেফ তৃপ্তিদায়ক হাসতেন। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ মনে করতেন।
রাজ্য, শাসনভার, প্রিয় সহধর্মিণী সবকিছুকে ঘিরে ডেভিড যোসেফের বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন তার জীবনে কালো মেঘের আঁধার ঘনিয়ে আসে। যখন তার সহধর্মিণী অকস্মাৎ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায়। যোসেফ স্যাভেরিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। বাবা হওয়ার মতো এক অনাবিল খুশির খবর পেয়েও তিনি ভীষণ ক্রোধান্বিত হন। কিন্তু কেনো তার এই ক্রোধ?
ডেভিড যোসেফের সমস্ত ক্রোধ জমা হয় চিকিৎসকের উপর। নিশ্চয়ই সে মিথ্যা বলেছিলো! নতুবা তার পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি অবশ্যই ছিলো। কোনটা সত্যি? কোনটা মিথ্যা? কে অপরাধী? কে নির্দোষ? অবশেষে প্রাণ যাবে কার? ভাবতে ভাবতে যোসেফ গাম্ভীর্য মুখে করিডোরে ইতস্তত পায়চারি করেন। তারপর হন্তদন্ত হয়ে সত্যির মুখোমুখি হতে বেরিয়ে যান।
এই ঘটনার ঠিক দু’দিন পর এক ভর সন্ধ্যা বেলায় দুর্গের ছাদ থেকে তার লাশ ঝুলে পড়ে। ডেভিড যোসেফের এমন ভয়াবহ পরিণতি দেখে তার স্ত্রী সেখানেই চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ঝুলন্ত লাশ’টা নামিয়ে নিতে রক্ষীদের শিরদাঁড়া বেয়ে আতংকের শীতল স্রোত গড়িয়ে যায়। তাদের মহামান্য শাসকের রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখখানার ঠোঁটদ্বয় ছিলো কুচকুচে কালো। খুলে রাখা চোখ দু’টো যেন কোটরের বাইরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলো। দুর্গের মানুষগুলো একজন প্রভাবশালী ক্ষমতাবান শাসকের এমন বীভৎস পরিণতি দেখে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। তাদের ভয় আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতে দুর্গের ছাদের উপরে অনেকটা উঁচুতে কতগুলো ভয়ংকর দেখতে বিশাল আকৃতির বাদুড় উড়ো উড়ি করে। একটা কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী দলা পাকিয়ে গোল গোল ঘুরে। বাদুড়গুলো নিজেদের দাঁত খিচিয়ে সমবেত মানুষগুলোকে হঠাৎই আক্রমন করে বসে।
এই দিনটা ছিলো কিয়েভে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার সূচনা। ওগুলো কি ছিলো? একদল অতৃপ্ত আত্মা নাকি কতগুলো পিশাচ সত্ত্বা?
__________★★__________
নিস্তব্ধ প্রকৃতি। নিকষ কালো অন্ধকার। প্রকাণ্ড এক পাথুরে গুহা। যার চারপাশে কতগুলো দানবীয় ওক গাছ। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো গাছগুলো। একটি ওক গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে ঝুলন্ত দোলনায় দোল খাচ্ছিলো মেয়েটা। দুইপাশে শক্ত, মোটা রশি দিয়ে টানানো কাঠের সরু তক্তা দিয়ে বানানো দোলনাটা প্রায় দশফুট উঁচুতে ঝুলছে। দোলনার উপর বসে থাকা মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে।
তখন মাঝরাত। মেয়েটার অস্বাভাবিক লম্বা বাদামী রঙা চুলগুলো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। থেকে থেকে মেয়েটার চোখের রং বদলে যাচ্ছে। তার কাঁধের উপর বসে থাকা বৃহদাকৃতির পেঁচাটা গম্ভীরমুখে এদিক সেদিক দেখছে। মেয়েটা মাথা ঝাঁকায়। তার অস্বাভাবিক লম্বা চুলগুলো ছোট ছোট হয়ে কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। চোখের মনি লাল থেকে স্বাভাবিক রঙে ফিরে আসে। সে ডাকে,
– থ্যাসো।
তার ডাক শুনতে পেয়ে নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে একটি ইউনিকর্ন ছুটে আসে। যার সম্পূর্ণ শরীর থেকে সাদা রঙ্গের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। যেন মূহুর্তেই ঝকঝকে দিনের আলোর মতো জায়গাটুকু আলোকিত হয়ে যায়। ওক গাছের মোটা ডালে পেঁচিয়ে থাকা সবুজ অ্যানাকোন্ডা গলা উচিয়ে ফোঁস ফোঁস করে উঠে। যেন মেয়েটা প্রানীদের ভাষা বুঝে, তাদের সাথে কথা বলতে পারে।
গুহার ভেতর থেকে লন্ঠন হাতে একজন বৃদ্ধা মহিলা বেরিয়ে আসেন। দৃষ্টির সম্মুখে ঘটা এমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে তিনি আশ্চর্য হন না। বরং খিলখিল করে হাসেন।
★★
সাল ১৮৭১।
কাস্ত্রোরুজ থর্প।
খারকিভ থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে একটি রহস্যে ঘেরা গ্রাম। গ্রামটিতে মোট পরিবারের সংখ্যা ৬১৬টি। গ্রামের মাথাল ব্যক্তি রবার্ট ক্রিসক্রিংগল। মার্শাল আর্টে বেশ দক্ষ তিনি। গ্রামের সব যুবক যুবতীদের মার্শাল আর্ট শেখান। পাশাপাশি হিংস্র জন্তুদের থেকে আত্মরক্ষা করতে তীর এবং অসি চালনার প্রশিক্ষণ দেন। গ্রামের ছোট বড় সবাই তাকে মাস্টার বলে সম্বোধন করেন। স্ত্রী, বৃদ্ধা বাবা-মা আর দুই মেয়েকে নিয়েই তার পরিবার। রবার্ট ক্রিসক্রিংগলের বড় মেয়ের নাম ইনায়া ইবতিসাম। বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী হতে আগ্রহী মেয়েটা। তার মধ্যে সেই মনোবল এবং আত্মবিশ্বাস দেখা যায়। অনেক পরিশ্রমী ও। ছোট মেয়ের নাম ফ্লোরেনসিয়া। ভীষন অলস প্রকৃতির। কোনো কিছু শেখার প্রতি তার খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। বরং সবসময় বইয়ে মুখ গুজে বসে থাকে। সময় পেলে পোষা কাঠবিড়ালির সাথে খেলা করে। বই পড়তে এবং নদীতে সাঁতার কাটতে বেশ পছন্দ করে ফ্লোরেনসিয়া।
ভোরের আলো ফুটতেই দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন রবার্ট ক্রিসক্রিংগল। ফ্লোরেনসিয়ার চোখে তখনো ঘুমের রেশ। ও আধবোজা চোখে ঢুলু ঢুলু শরীরে পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে পা টিপে টিপে হাঁটে। গন্তব্য পাহাড়ের চূড়া। পাশ থেকে ওর বড় বোন একহাত মুঠোবন্দি করে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। স্পষ্ট গলায় বলে,
– ঢুলে ঢুলে হাঁটছো কেনো? এখনই তো পায়ে পা লেগে হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে খাঁদে পড়ে যাবে। আমি বুঝিনা তোমার চোখে এতো ঘুম কোথা থেকে আসে? পা চালিয়ে হাঁটো। এভাবে হাঁটতে থাকলে চূড়ায় পৌঁছতেই সূর্য মাথার উপর এসে দাঁড়াবে।
সামনে থেকে তাদের বাবার ডাক ভেসে আসে,
– ইনায়া! থেমে গেলে কেনো?
– এইতো আসছি বাবা। সিয়ার হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে।
ক্রিসক্রিংগলের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ছোট মেয়েটাকে তিনি এতো চেষ্টার পরও কোনো বিষয়ে কর্মদক্ষ করে তুলতে পারেননি। বিষয়টা ভাবেন। ক্ষনকাল নিশ্চুপ থেকে কঠিন গলায় উচ্চস্বরে বলেন,
– তাড়াতাড়ি এসো।
সিয়া দ্রুত পা চালায়। বড় বোন ইনায়া ওর হাত ধরে হাঁটে। সিয়া নিচু আওয়াজে বলে,
– প্রতিদিন ভোর বেলা এতো উঁচুতে উঠে অনুশীলন করার কি আছে? আমাদের বাড়ির পশ্চাদ্ভাগের উঠান কি বাবার কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছে?
– বাবা চান আমরা কর্মদক্ষ হই। এইযে প্রতিদিন সকাল বেলা দীর্ঘ সময়ের ঢালু রাস্তা বেয়ে পাহাড়ের চূড়োয় উঠি। অনুশীলন করে তারপর আবার পাহাড় থেকে নেমে বাড়ি ফিরে যাই। এতে করে আমাদের শারীরিক ব্যায়াম হয়। স্ট্যামিনা বৃদ্ধি পায়। আমাদের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং ফিটনেস মজবুত হয়। তুমি কি একটা বিষয় খেয়াল করেছো?
– কি? ____বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে সিয়া।
– পাহাড়ের চূড়োয় পৌঁছাতে আগের তুলনায় এখন আমাদের অনেকটা কম সময় লাগে।
– আমার এরকম মনে হয়না। কারন আমি সময় দেখে পাহাড়ে উঠি না।
– তুমি কখনোই বুঝবে না সিয়া। ___ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাটা বলে।
কথা বলতে বলতেই দুজনে পাহাড়ের চূড়োয় উঠে আসে। সিয়া দ্রুতপায়ে হেঁটে একটা আপেল গাছের নিচে গিয়ে বসে। এই পাহাড়ের চূড়ায় আপেল, বেহুই, এপ্রিকট, আখরোটসহ বেশ কিছু ফলের গাছ লাগিয়েছেন তাদের বাবা। যাতে করে রোদের সময় বাচ্চারা এখানে গাছের ছায়ার নিচে বসে জিরিয়ে নিতে পারে। ক্ষুধা লাগলে গাছ থেকে ফল ছিঁড়ে খেতে পারে।
গাছের নিচে বসে পড়তেই সিয়া চোখ বুঁজে নেয়। ধীরে ধীরে পাহাড়ের চূড়োয় আরও কিছু ছেলে মেয়ে উঠে আসে। নিজের বাবাকে উদ্দেশ্য করে সিয়া উচ্চস্বরে বলে,
– বাবা! একে একে সবার প্রশিক্ষণ শেষ হলে আমাকে ডেকে নিবেন। ততক্ষণে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।
ওর কথা শুনে বাকি ছেলে-মেয়েগুলো শব্দ করে হাঁসে। মোটেও পাত্তা দেয়না সিয়া। ক্রিসক্রিংগল বেশ বিরক্ত হলেন। সিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
– তুমি যদি একবারও চোখ বুঁজে নাও, তাহলে বাকিদের থেকে ৩০ মিনিট বেশি প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
সিয়ার গলা শুকিয়ে আসে। শুকনো একটা ঢোক গিলে নেয় ও। যেখানে ৩০ মিনিট প্রশিক্ষণ নিতেই প্রাণ বেরিয়ে যায় সেখানে ১ঘন্টা প্রশিক্ষণ নিবে কি করে?
এক ঘন্টা প্রশিক্ষণ নেওয়া ওর কাছে অনেক বড় শাস্তি মনে হয়। তবুও ওর চোখ দু’টো বিশ্বাসঘাতকতা করে। গাছে হেলান দিতেই নিমেষেই ঘুমিয়ে পড়ে। কেবল আজ নয়, এটা নিত্যদিনের ঘটনা।
ক্ষণকাল সময় গড়িয়ে যায়। সহসা সিয়ার কপাল বরাবর একটা ঢিল গিয়ে লাগে। ও হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে। উপস্থিত বাকি যুবক যুবতীগুলো পুনরায় শব্দ করে হাসে।
– এটা কি হলো? কে ঢিল নিক্ষেপ করেছে আমাকে উদ্দেশ্য করে?___ সিয়া রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।
– বাবা দেখতে চেয়েছিলেন আমার ঢিল ছোঁড়ার নিশানা কতটা ভালো। ____ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে রেখে ইনায়া কথাটা বলে।
– তাই বলে আমার কপালের মাঝখানে? যদি চোখে লেগে যেতো?
– খুব একটা ক্ষতি হতো না। সামান্য একটা আখরোট’ই তো। তাছাড়া আমি বাবার আদেশ পালনে বাধ্য।
– বাবার আদেশ পালনে বাধ্য। _____সিয়া মুখ ভেঙ্গিয়ে বিরবির করে বলে।
– উঠে এসো সিয়া। প্রথমে তোমার পালা।
আদেশের স্বরে কথাটা বলেন ক্রিসক্রিংগল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিয়া উঠে দাঁড়ায়। পায়ে পায়ে নিজের বাবার দিকে এগিয়ে যায়।
………..
#চলবে
#সূচনা_পর্ব
#গল্প ফ্লোরেনসিয়া
#লেখিকাঃLamia_Tanha
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক