#লেখিকাঃLamia_Tanha
#পর্বঃ২৭
[অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, চাইলে শেয়ার দিয়ে পাশে থাকতে পারেন]
ভয়াবহ এক হিমেল আতঙ্কের নিষ্ঠুর আলিঙ্গনে বুক কেঁপে উঠল আর্নির। অসীম, অফুরন্ত বিস্ময় নিয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ও। ওর থেকে কিছুটা দূরে সামনাসামনি এদুয়ার্দো দাঁড়িয়ে ছিল।
সিয়া যেনো নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেলো। ইনায়া বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইল। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ দু’জন হুবহু একই রকম দেখতে। একজনকে ইনায়া চিনে অন্য জনকে চিনে সিয়া।
আব্রাহামকে দেখে সিয়া প্রথমে এদুয়ার্দো ভেবে ভুল করছিলো। কিন্তু ইনায়ার কাছে ছেলেটার নাম আব্রাহাম স্যাভেরিন শুনে ওর মনে তীব্র সংশয় জেগে উঠলো। ভেবেছিলো এটাও এদুয়ার্দো শ’য়তানটার কোনো মায়া। ভয়ংকর ষড়যন্ত্র। মাথার চুল আর চোখের রং বদলে ইনায়ার কাছে নিজেকে আব্রাহাম বলে পরিচয় দিয়েছিলো। কিন্তু ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে এদুয়ার্দো চলে এলো। দাঁড়ালো মেয়েটার পাশে। মেয়েটা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাসে। তার দু’পাশে হুবহু একই চেহারার দু’জন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।
এদুয়ার্দোর গায়ে সাদা রঙের শার্টের উপর অফ-হোয়াইট রঙের ব্লেজার জড়ানো ছিলো। দু’হাতের কনুই পর্যন্ত ব্লেজারের হাতা গুটিয়ে ছাই রঙা প্যান্টের দু’পকেটে দু’হাত গুঁজে দিলো। সগর্বে দাঁড়িয়ে রইলো। সম্পূর্ণ মুখাবয়বে রাজ্যের গাম্ভীর্য। তার এমারেল্ড সবুজ দু’চোখের দৃষ্টি পাশের ছেলেটার দিকে স্থির। নেত্রপল্লব নাড়ালো না। এক ভ্রু উঁচিয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁটজোড়া কুঁচকে ফেললো।
গাঢ় সবুজ রঙের গাউন পরিহিত সুন্দরী মেয়েটার ডানপাশে এদুয়ার্দো আর বামপাশে এদুয়ার্দোর মতই দেখতে অন্য ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়েটা একবার ডান দিকে তাকালো। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে বাম দিকে তাকালো। পরপর দু’বার এরকম করে সহসা খিলখিল শব্দে হেঁসে উঠলো। তার হাসির ঝংকারে ইনায়া সম্বিত ফিরে পেলো। সিয়া তখনো স্তম্ভিত। আর্নি ওদের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটা তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির রেখাটুকু বজায় রেখে বললো,
– আজও আপনাদের পরিধেয় পোশাক মিলে গেছে? ভাগ্যিস চুল আর চোখের রঙ ভিন্ন। নতুবা আমি নিজেই দ্বিধায় পড়ে যেতাম। আচ্ছা বলুন তো, প্রায়ই এরকম পোশাক বা পোশাকের রঙ মিলে যাওয়ার ঘটনা কি নেহাতই কাকতালীয়? নাকি আপনাদের দু’জনের পূর্ব পরিকল্পিত?
এদুয়ার্দোর দৃষ্টি সরু হয়ে এলো। কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলো। পরিধেয় ব্লেজারটা খুলে সামনের দিকে ছুঁড়ে ফেললো। যাতে করে দু’জনের পোশাকে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। সাথে সাথে তার ছুঁড়ে দেওয়া ব্লেজারটা অ্যাভোগ্রেডো দু’হাতে লুফে নিলো। আব্রাহাম বেশ রাগান্বিত হলো। অপমান বোধ করলো।
– ভ্যাম্পায়ারদের ওভারলর্ড বলে কি যা খুশি তাই করবেন? এভাবে অপমান করবেন? আমি কি ইচ্ছে করে মিলিয়ে পোশাক পরেছি?—— আব্রাহাম মনে মনে ভাবলো। ভাবতে ভাবতে সে নিজেও তার পরিধেয় ব্লেজারটা খুলে অ্যাভোগ্রেডোর দিকে নিক্ষেপ করলো। বেচারা অ্যাভোগ্রেডো থতমত খেলো। আব্রাহাম নত মস্তকে সম্মান জানিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বললো,
– অনারেবল ওভারলর্ড। আশা করি এবার আপনি নিজের পরিধেয় শার্টটাও খুলে ফেলবেন। একাডেমির মেয়েগুলোকে দেখিয়ে দিবেন নিজের চওড়া বুক, পেশিবহুল দু’হাত আর তুষারশুভ্র ধবধবে ফর্সা শরীর। সবাই কেমন প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। ভাবতেই ছোট ভাই হিসাবে আমার বেশ গর্ববোধ হচ্ছে। আফসোস, এমনিতে আপনার এই তিক্ত গাম্ভীর্য মুখখানার দিকে কোনো মেয়ে ফিরেও তাকায় না। খুবই দুঃখজনক।
নিজের কথা শেষ করে হতাশার দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলো আব্রাহাম। এদুয়ার্দো তার দিকে অগ্নি ঝরা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। দুই ভাইয়ের এই খুনসুটিতে ইজাবেল ভীষণ মজা পেলো। এটা নতুন কিছু নয়। এরা একসাথে হলে সবসময়ই একজন আরেকজনের পেছনে লেগে রয়।
এদুয়ার্দো নিজের রাগাটুকু সংযত করে নিলো। অতি আদরের ছোট বোন ইজাবেলের সামনে তার ক্রোধিত ভয়ংকর সত্তাটাকে দেখাতে চাইলো না। দুষ্টু হাসলো আব্রাহাম। অহংকারী মহারাজ আজকে বেশ জব্দ হয়েছে। এদুয়ার্দো ইজাবেলকে পাশ কাটিয়ে আব্রাহামের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ভীতি জাগানো শীতল কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বললো,
– মুখ বন্ধ রাখো। কেনো অযথা নিজের গর্দান হারাতে চাইছো?
আব্রাহামের ঠোঁটের ভাঁজের হাসিটুকু খানিকটা দীর্ঘায়িত হলো। এদুয়ার্দোকে জব্দ করতে পেরে মনে মনে ভীষণ আনন্দ পেলো। ইজাবেল ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো,
– অনেক হয়েছে। চলুন এবার। প্রিন্সিপাল অপেক্ষা করছেন।
এদুয়ার্দো সোজা হয়ে দাঁড়ালো। থমথমে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো একাডেমির প্রধান ভবনের দিকে। তার পেছনে অ্যাভোগ্রেডো। ইজাবেল আব্রাহামকে সাথে নিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করল। এদুয়ার্দো প্রথমে আর্নিকে অতিক্রম করে গেলো৷ সিয়া ইনায়া আর আর্নি যেনো অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। দু’চোখে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছিলো একটা অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। সহসা এদুয়ার্দোকে এগিয়ে আসতে দেখে ওরা নিজেদের সম্বিত ফিরে পেলো।
ভয়াল ক্রোধের অনলে জ্বলতে শুরু করলো সিয়ার দেহের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র। রক্তবর্ণ চোখের উজ্জ্বল বাদামী রঙা মনিগুলোতে স্পষ্ট ভয়ংকর চাহনি ফুটে উঠল। ভিতরে ভিতরে দুর্দমনীয় আক্রোশে ফুঁসছিল। হৃদপিণ্ডে জাগ্রত হওয়া আক্রমণাত্মক সত্তাকে দমিয়ে রাখতে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। পারলো না কেবল হিংস্র সিংহীর মতো এদুয়ার্দোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে।
এদুয়ার্দো কোনো দিকে না তাকিয়ে সগর্বে বুক ফুলিয়ে হাঁটছিল। সিয়ার কাছাকাছি পৌঁছাতেই তার লাল টুকটুকে ঠোঁটজোড়ায় পৈশাচিক হাসি ছড়িয়ে পড়লো। অথচ তার দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। চোখে মুখে প্রবল আত্ম অহমিকা প্রকাশ পাচ্ছিল। আশে পাশে থাকা ছেলে মেয়েগুলো একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দু’চোখের পল্লব নাড়াতে ভুলে গেলো। এদুয়ার্দো চলে যেতেই ছেলে মেয়েগুলো আব্রাহামের দিকে তাকালো। ওদের দৃষ্টিতে ভয়ংকর ঘোর লেগে ছিলো। যেনো এরকম অসম্ভব সুন্দর মানুষ তারা আজই প্রথম দেখছে।
ইনায়ার কাছাকাছি এসে আব্রাহাম থমকে দাঁড়াল। পাতলা মসৃন সাদা কাপড়ের নিকাপ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা দু’জন মেয়েকে দেখতে পেলো। লালচে-সোনালি চুলের মেয়েটার চোখের দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা তীব্র ঘৃনায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ভয়াবহ রাগের বশবর্তী হয়ে যার সর্বাঙ্গ কাঁপছিলো। বামহাতে সিয়ার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরে ক্রোধ সংবরণ করে নিলো। ইজাবেল মিষ্টি স্বরে ডাকলো,
– ভাই। এসো।
আব্রাহাম একপা দু’পা করে এগুলো। হাঁটতে হাঁটতেও ইনায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। ইনায়াকে অতিক্রম করে অনেকটা সামনে এগিয়ে ফের পেছন ফিরে তাকালো। মাথায় লম্বা করে দেওয়া অবগুণ্ঠনের আড়ালে সুদীর্ঘ চুলের পুরু বিনুনি নজরে এলো। আব্রাহাম ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। মনে মনে বললো,
– তুমি এখানেও এসে গেছো! আমার শিকার তুমি। পালিয়ে যাবে কোথায়? আমাদের দেখা হবে। তোমার মিষ্টি মধুর র’ক্তের স্বাদ গ্রহণ করতে আমি আসবো।
ইজাবেল, আব্রাহাম আর এদুয়ার্দো প্রিন্সিপালের কামরায় প্রবেশ করলো। নিশ্চল, নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর্নি সিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখের পানিতে নিকাব ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। ভয়, যন্ত্রণা আর ঘৃণায় মৃদুমৃদু কাঁপতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর ক্রিসক্রিংগল ফিরে এলেন। আর্নি নিমেষেই সবকিছু কিছু ভুলে গিয়ে উচ্চস্বরে ডাকলো,
– মাস্টার।
সিয়া চমকালো। আর্নির একহাত মুঠোবন্দি করে ধরে ইশারায় কিছু বলতে বারণ করলো ওকে। ক্রিসক্রিংগল প্রত্ত্যুতর দিলেন,
– হ্যাঁ, বলো।
সিয়া তখনো দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে চুপ থাকতে বললো ওকে। আর্নি কাতর কন্ঠে বলে,
– আমি এই একাডেমিতে ভর্তি হতে চাইনা।
বেশ আশ্চর্য হলেন ক্রিসক্রিংগল। কয়েকপল নিশ্চুপ থেকে রাশভারি কন্ঠে বললেন,
– ভর্তির কার্যক্রম শেষ। আগামীকাল থেকে তোমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। প্রধান ফটক পর্যন্ত এসো। আমি দেখি কোনো ফিটন খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।
ক্রিসক্রিংগল চলে গেলেন। আর্নি আর ইনায়াকে নিয়ে সিয়া ধীরপায়ে হাঁটতে লাগলো। কিছুক্ষণ আগের দেখা দৃশ্য কল্পনা করছিলো। মেয়েটার নাম ইজাবেল। ওর চোখ আর চুলগুলো কালো রঙের ছিলো। ওষ্ঠদ্বয়ে হালকা গোলাপী রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছিলো। ইনায়ার মনে সংশয় হলো। ও অনুচ্চস্বরে বললো,
– মেয়েটাকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মনে হলো। কিন্তু এই শ’য়তান দু’টোর সাথে ওর কি সম্পর্ক?
– মেয়েটা ওদের বোন। সোনালী চুলের পি’শাচটাকে ও ভাই বলে ডেকেছিলো।——-সিয়া শান্ত কন্ঠে বললো।
– তুমি কি করতে চাইছো? বাবাকে জানাতে বারণ করছো কেনো?—–ইনায়া কৌতুহলী কন্ঠে জানতে চায়লো।
– এদুয়ার্দো, আব্রাহাম, পিদর্কা স্যাভেরিন, ভিক্টোরিয়া, ক্যারলোয়েন, উড্রো উইলসন, জ্যাসন মিকারলি, অ্যালিশ, ব্রাংকো, স্যান্ড্রি। ওরা দশজন ছিলো। এদের মধ্যে আমি শুধু এদুয়ার্দোকে চিনতাম। তুমি চিনতে আব্রাহামকে। আজ আমরা একসাথে দু’জন শয়তানকে চিনলাম। জানতে পারলাম এরা জমজ শ’য়তান। ঈশ্বর আমাদের এই খারকিভ শহরে কেনো এনেছেন জানো?——-সিয়ার সহজ সাবলীল প্রশ্ন।
– এই নিকৃষ্ট র’ক্তপিপাসুগুলোকে ধ্বংস করতে।—-ইনায়ার দৃঢ় কন্ঠ।
– হ্যাঁ। বাবা আমাদের জীবন বাঁচাতে, আমাদের সম্পূর্ন সুরক্ষিত রাখতে কাস্ত্রোরুজ ছেড়ে ইম্যুভিলে পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এখানে এসেও আমরা পুনরায় ওদের মুখোমুখি হলাম। ঈশ্বরের এটাই ইচ্ছে। নিয়তির থেকে পালিয়ে বাঁচা অসম্ভব। বাবাকে যদি বলো, তিনি ইম্যুভিল ছেড়ে আমাদের নিয়ে অন্য কোথায় চলে যাবেন। এভাবে কতদিন পালিয়ে বাঁচবো? তুমি কি মৃত্যুকে ভয় পাও?
– না। মৃ’ত্যু স্বল্প সময়ের যন্ত্রণা। বুকের মধ্যে যে অসামান্য যন্ত্রণা বহন করছি তার কাছে মৃ’ত্যু যন্ত্রণা নেহাতই তুচ্ছ।
– হুম। তুমি আর আমি শুধু দুইজনকে চিনি। বাকিদের সম্পর্কে জানার জন্য, তাদেরকে চেনার জন্য আমাদের এই মেয়েটাকে প্রয়োজন। হয়তো ও আমাদের সাহায্য করতে পারে।
– কিন্তু ঝোঁকের বশে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। পরিবারের বাকি সদস্যগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেটা এই খারকিভ শহরে থেকে কিভাবে সম্ভব?
– সময় দাও। আমাকে ভাবতে হবে।
সিয়া বললো। আর্নি আতংকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দু’জনের দিকে। সিয়ার দুশ্চিন্তা হলো ওকে নিয়ে। ভয়ের আধ্যিক্যে যেকোন সময় ক্রিসক্রিংগলকে সবটা জানিয়ে দিতে পারে।
————-★
কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
দুর্গের বিশাল হলরুমে কয়েকজন শক্তিশালী ভ্যাম্পায়ারের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সভা ডাকা হয়েছিলো। সভা ডেকেছেন পিদর্কা স্যাভরিন। মাঝখানের সোফায় বসে থেকে কারো অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলেন তিনি। দু’পাশের সোফাগুলোতে বাকিরা বসে ছিলো। বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠলো ক্যারলোয়েন। বেশ বিরক্ত হলো সে। ভিক্টোরিয়ার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
– মনে হয়না সে আসবে। মা অহেতুক আমাদের বসিয়ে রেখেছেন।
– চুপ করো। মা শুনতে পাবেন। এমনিতেই তিনি ভীষণ রেগে আছেন।
অকস্মাৎ সশব্দে দরজা খুলে গেলো। ঝড়ের বেগে কামরার ভিতর একটা কালো ধোয়ার কুন্ডলী প্রবেশ করলো। ধীরে ধীরে ধোঁয়ার কুন্ডলীটা মানুষের অবয়বে ফিরে এলো। কালো কুচকুচে পোশাক পরিধেয় একজন যুবক পিদর্কা স্যাভেরিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার দু’চোখের হালকা নীলাভ মনিগুলো থেকে অসাধারণ দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। মুখের উপর বেঁধে রাখা কালো রঙের ত্রিকোণ কাপড়টা খুলে ফেলে উচ্ছ্বসিত স্বরে ডাকলো,
– মা।
– আমার সাহসী ছেলে।
পিদর্কা স্যাভেরিন ত্বরিত দাঁড়িয়ে পড়লেন। দু’হাতে নিজের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ছেলেটা কামরায় উপস্থিত থাকা ভ্যাম্পায়ারগুলোকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলো। পিদর্কা স্যাভেরিন তাকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসতে বললেন। ছেলেটা বসলো। ক্যারলোয়েন আর ভিক্টোরিয়া বিস্ময়াহত চোখে চেয়ে রইলো। অথচ ওদের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠেছিল।
– খুঁজে পেয়েছো ওদের?–উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
– এখনো না। তবে খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। খুব শীঘ্রই তোমার কাছে সবাইকে উপস্থিত করবো মা।
– দ্রুত খুঁজে বের করো।
– আমি তখন ছোট ছিলাম। কিছুই মনে নেই। কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে, আঠারো বছর আগে ক্লারেসিয়াকে হত্যা করে তার রক্ত খেয়েছিলে। তাহলে অহেতুক দুশ্চিন্তা কেনো করছো?
– আমার দুশ্চিন্তা শুধু জাদুর তলোয়ার নিয়ে না। পাথর আর বই নিয়েও। ওসব তুমি বুঝবে না।
– আমি সব বুঝি। সব জানি মা। তোমার প্রতিটা পাপের সঙ্গী হয়েছি। আমাকে ছাড়া তুমি শূন্য। কোনো ক্ষমতা নেই তোমার। যখন এদুয়ার্দো তোমার সমস্ত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারবে, তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। তখন একমাত্র আমিই তোমার শেষ ভরসা।
ছেলেটার কন্ঠে প্রগাঢ় দম্ভ প্রকাশ পেল। পিদর্কা স্যাভেরিন ধৈর্য ধরে কথাগুলো হজম করে নিলেন। উড্রো উইলসন হতভম্ব হয়ে দেখছিলো। ভিক্টোরিয়া রাগমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
– মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? তাছাড়া তুমি কি ভুলে গেছো, তিনি ভ্যাম্পায়ার সাম্রাজ্যের একমাত্র সম্রাজ্ঞী?
– আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। আমি জানি আমি কার সাথে কথা বলছি। পিদর্কা স্যাভেরিন শুধু আমার মা না, তার আরও দু’জন সন্তান আছে। তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে আমার সাথে কেনো করবে না?——ছেলেটার কন্ঠে বিদ্রুপের রেশ।
– থামো তোমরা।—– পিদর্কা স্যাভেরিন বিরক্ত কন্ঠে ধমকে উঠলেন।
– তোমার মেয়েকে থামাও। যখন আমি আর তুমি কথা বলবো, তখন আমাদের মাঝখানে আর কেউ যেন কথা না বলে। তাছাড়া আমি ভুলে যাইনি, তোমরা আমাকে কতগুলো বছর কফিনে বন্দি করে রেখেছিলে।
– যা করেছি সবকিছু তোমার ভালোর জন্যে। নতুবা কবেই তোমার দ্বিখন্ডিত দেহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যেতো। শুধুমাত্র তোমার জন্য প্রতিনিয়ত শতশত সুন্দরী যুবতী নিয়ে এসেছি এই স্যাভেরিন ক্যাসলে। তুমি বেসমেন্টের গুপ্ত কামরায় বসে রক্তের হলি খেলেছো। এতো ঝুঁকি নিয়ে আমি এসব তোমার জন্য করেছি। তবুও আমাকে অবিশ্বাস করছো?
পিদর্কা বললেন। তার বলা কথাগুলো শুনে ছেলেটা উচ্চশব্দে হাসতে শুরু করলো। ঠোঁটের মাঝে হাসির রেখা বজায় রেখে বললো,
– শুধুমাত্র আমার জন্য?
– এব্যাপারে তোমার কোনো সন্দেহ আছে?—– ভ্রু-কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
– শোনো। এদুয়ার্দো তোমাকে ঠিক যতটা বিশ্বাস করে। আমি তোমাকে ঠিক ততটাই অবিশ্বাস করি। ও তোমার বলা প্রতিটা শব্দ ধ্রুব সত্য বলে মানে। অথচ আমি জানি তোমার আদি-অন্ত সবটাই মিথ্যে। আমাকে সাত পাঁচ বোঝানোর চেষ্টা করবে না। ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব সুন্দরী যুবতীদের অপহরণ করে এনে তুমি নিজের প্রয়োজন মিটিয়েছো। একদিকে এদুয়ার্দোর কাছে সৎ হওয়ার নাটক করে ওকে সততার উক্তি শুনিয়েছো, অন্যদিকে আমাকে ভয়ংকর পি’শাচ বানিয়েছো।আমি যদি বলতে শুরু করি, তোমার সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।
তাছাড়া তোমার আরেকজন সন্তানের কথা না হয় না-ই বললাম। ওকেও ব্যবহার করছো নিজের স্বার্থে। ভীষণ সরল ও। ওকেও ছাড় দিলে না! আচ্ছা তুমি কি সত্যিই আমাদের মা?
– ব্যস। থামো। অনেক বলেছো। আর কিছু শুনতে চাইনা। কামরা খালি করো এখুনি। বেরিয়ে যাও সবাই।
ছেলেটা পুনরায় শব্দ করে হাসল। পিদর্কা স্যাভেরিনকে রাগাতে পেরে বেশ আনন্দ বোধ করলো। আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে মনে।
একে একে কামরা খালি করে সবাই বাইরে বেরিয়ে গেলো। ছেলেটা বসে রইলো। অনুচ্চ স্বরে ফিসফিসিয়ে বললো,
– আমি সত্যিই একজন ভয়ংকর পি’শাচ। যে কিনা ক্ষমতার জন্য ভাইকেও হত্যা করতে পারে। আমার হৃদয়ে বিন্দুমাত্র মায়া দয়া নেই। পুরোপুরি তোমার স্বভাবের। একারণেই আমাকে ভীষণ ভয় পাও তুমি। তোমার থেকেও বেশি ভয় পায় তোমার মেয়েগুলো।
– তোমাকেও বের হয়ে যেতে বলেছি। ভয় পাইনা আমি। যার মৃ’ত্যু ভয় নেই, তার অন্য কিসের ভয় থাকতে পারে? আমি অমর। আমাকে বিনাশ করার জন্য যে দু’জন জন্মগ্রহণ করেছিলো, তাদের একজনকে পি’শাচ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।অন্যজনকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করেছি। স্বর্গে চলে গেছে ও।
ছেলেটা হাসলো। অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। হাসতে হাসতেই ধোঁয়ার কুন্ডলী হয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে গেলো। পিদর্কার গলা শুকিয়ে এলো। টেবিল থেকে রক্তের গ্লাস তুলে নিয়ে ঢকঢক করে রক্ত পান করে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে নিলো।
————–★
ইম্যুভিল।
গভীর রাত। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। কামরার এক কোণায় একটি ছোট মোমবাতি জ্বলছিলো। সিয়ার চোখে ঘুম নেই। উৎকর্ণ হয়ে সজাগ ছিলো ও। হঠাৎ বাইরে থেকে অদ্ভুত কিছু শব্দ ভেসে এলো। মৃদু আওয়াজে কেউ ফিসফিসিয়ে ওকে ডাকলো,
– ফ্লোরেনসিয়া। এসো, এসো আমার কাছে।
সিয়া ভয় পেলো। সেই লম্বা চুলের অদ্ভুত মেয়েটা নয়তো! সিয়া মনে মনে ভাবলো। বিশালাকৃতির সবুজ অ্যানাকন্ডাটার কথা মনে পড়তেই ওর গাঁ শিউরে উঠলো। ভয়াবহ গলা শুকিয়ে গেলো। শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিছানার কাছে থাকা টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিলো। এক নিশ্বাসে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করলো। বাইরে থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বরটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো। গত দু’রাতে এই কন্ঠস্বর যতবার শুনতে পেয়েছিলো, ইনায়াকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিলো ও। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কন্ঠস্বরটা সিয়া শুনতে পেলেও ইনায়া শুনতে পায়নি কখনো। এই অদ্ভুত শব্দগুলো আর মেয়েটার কন্ঠস্বর সিয়া ব্যতীত অন্যকেউ শুনতে পায়না। সিয়া বুঝতে পারে না, ওর সাথে কি হচ্ছে এগুলো?
– ফ্লোরেনসিয়া। আমি তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে দিবো। আমাকে ভয় পেয়ো না।
– ভ্যাম্পায়ারদের তবুও শরীর থাকে। কিন্তু এই মেয়েটা যদি অশরীরী হয়। আমি তার সাথে কিভাবে লড়বো?—- সিয়া অস্ফুট স্বরে বললো।
দরজার বাইরে থেকে খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেলো। মেয়েটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
– তুমি ভীতু। ভীষণ ভিতু একটা মেয়ে। তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। পারবে না তুমি রক্তপিপাসুগুলোকে বিনাশ করতে।
মেয়েটা সিয়াকে রাগাতে চায়ছিল। একসময় সফল হলো। প্রচন্ড রাগের বশবর্তী হয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল সিয়া। আলমারি খুলে হাতে তলোয়ার তুলে নিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজা খুলে কামরার বাইরে বেরিয়ে গেলো। ভয়াল অন্ধকার চারপাশে। হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে ধবধবে সাদা আলো ছড়িয়ে পড়লো। বেশ খানিকটা দূরে সাদা রঙের বড় ঘোড়ার মতো একটা জন্তু দেখতে পেলো। ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সিয়া। জন্তুটা আলোর গতিতে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। নিমেষেই চারপাশটা দিনের আলোর মতো ঝলমল করে উঠলো। সিয়া ঘোড়াটার কপালের মাঝখানে লম্বা প্যাঁচানো একটা শিং দেখতে পেলো। ও বিস্মিত কন্ঠে বললো,
– ইউনিকর্ন।
ইউনিকর্নটা ওকে চুম্বকের মতো টানছিলো যেনো। নিজের অজ্ঞাতেই সিয়া এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাচ্ছিলো। হাত রাখল ইউনিকর্নের পিঠে। ওর হাতের স্পর্শ পেয়ে অকস্মাৎ উধাও হয়ে গেলো ওটা। চারপাশ আবারও নিকষকালো অন্ধকার হয়ে গেল।
সিয়ার পিলে চমকালো। অদূরে ইউনিকর্নটাকে পুনরায় দেখতে পেলো। কেমন অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। ক্ষনকাল সময় গড়ালো। হঠাৎই সিয়া নিজের সম্বিত ফিরে পেলো। তখনো একহাতে শক্ত করে তলোয়ার ধরে ছিল। কিন্তু চারদিকে ভয়াবহ অন্ধকার। কোথায় আছে বুঝতে পারলো না ও। তীব্র শীত আর অজানা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলো।
আচম্বিতে চোখের সামনে দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। সিয়ার থেকে বেশ কিছুটা দূরে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলো কেউ। সিয়া শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো তাকে,
– কে? কে ওখানে?
পেছন ঘুরে দাঁড়ালো একজন সবল সুগঠিত দেহের যুবক। অন্ধকারে তার চোখ দু’টো জ্বলন্ত অগ্নিবিন্দুর ন্যায় জ্বলজ্বল করছিলো। সে থমথমে ভরাট কন্ঠে বললো,
– ফ্লোরেনসিয়া, আমার শহরে তোমাকে স্বাগতম।
…………
#চলবে