ফ্রিজ পর্ব ১১
গরুর হাটে এসেছি। আনোয়ার চাচা অনেকটা জোর করে নিয়ে এসেছেন। বাবা, আমি আর আনোয়ার চাচা হাটে হাঁটছি। কয়েকটা গরু দেখা হয়েছে। এখনো অবশ্য কোনো গরু কেনা হয়নি।
একেকটা গরুর কত দাম! হাটে এত মানুষের ভির। হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়। আমার মতো আর অনেকেই এসেছে হাটে।
কিছু গরু দেখে আনোয়ার চাচা একটা গরু পছন্দ করে ফেললেন। আমার গরুটাকে বেশ ভালো লেগেছে! গরুটা কিনে আমরা চলে এলাম। গরু অবশ্য আমরা আনিনি। গরুর মালিক বাড়িতে পৌঁছে দিবে।
বাড়ি ফেরার সময় পথে লিটন ছেলেটার সাথে দেখা হলো। কালো একটা টি-শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে।ইদানিং একটু কম দেখা যায়। আড্ডাবাজি মনে হয় কমিয়ে দিয়েছে। নাকি আস্তানা পরিবর্তন করেছে। কে জানে? জমিয়ে দিলে তো ভালোই হয়।
বাবা আর আনোয়ার চাচা কে লম্বা করে সালাম দিলো। কুশল বিনিময় করে ইদের দাওয়াত দিলো। সবাই কে যেমন দেয় আরকি।
লিটনরা গরু কিনেছে তিনটা। হাতির মতো একেকটা গরু। প্রতিবছর ওরা তিনটা গরু কুরবানি দেয়। আমাদের এলাকায় একটা দেয়াল ঘেরা মাঠ আছে এখানে সবাই গরু কুরবানি দেয়।
বাড়িতে আসার পর মা আমার দিকে কটকট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কোন আক্কেল ধাই ধাই করে হাটে চলে গেলি!”
আমি মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বললাম না। আপা এসে বলল,” ছোটো মানুষ একটু হাট দেখতে গেছে । আর বাবা তো সাথে ছিলই মা।”
মা কিছু বলল না। আপা মার পাশে গিয়ে বসল। মা মনে হয় পিঠা বানাচ্ছে। ইদ আসলে মা কয়েকপদের পিঠা বানায়। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার মাটা জানি কেমন! একটু কিছু হলেই বকা দেয়। টুম্পার মা কী সুন্দর করে কথা বলে! ওকে কখনোই বকা দেয় না।
ঘরে এসে দেখি আপা একটা খোলা বই উল্টো করে রেখেছে। মনে হয় আবার এসে পড়বে। আমি আমার টেবিলে এসে বসে পড়লাম। একটা খাতা আকিঁ ঝুঁকি করছি। একটুও ভালো লাগছে না। কখন যে টেবিলে মাথা রেখেছি জানি না। একটু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বা তন্দ্রা -টন্দ্রা হবে। মাথায় একটা হাতের ছুঁয়া টের পেলাম।
“কী হয়েছে রে মা?”
বাবার কোমল গলা। হিমেল হাওয়ার মতো বুকের মধ্যে স্পর্শ করল। হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস চোখে লাগার মতো চোখদুটো কেমন ভিজে গেছে! আমি কথা বলতে পারছি না। বাবা কে জরিয়ে ধরলাম।
বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “মা বকা দিয়েছে বুঝি?”
বাবা আমাদের ঘরের খাটটাতে বসে আমাকে ডাকল। আমি বাবার হাঁটুতে মাথা রেখে শুলাম। বাবা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর টুক টুক করে কথা বলছে। বাবার এ সব গল্প শুনতে কী যে ভালো লাগে!
প্রায়ই এমন হয় আমরা দুইবোন বাবার দুই পাশে শুয়ে থাকি বাবা গল্প করে। আপাও খুব ভালো গল্প বলতে পারে। আপার গল্প শুনে বাবা হো হো করে হেসে উঠে। আপার অনেক গুন! আমি আপার মতো কিছুই পারি না।
মায়ের হাঁক শুনা যাচ্ছে। ” রুনু, এই রুনু।”
বাবা বলল, “যা তো মা। তোর মা কেন ডাকে দেখে আয়।”
আমি রান্নাঘরে গেলাম। আপা এখনো মায়ের পাশে বসে আছে। মা একটা বাটিতে পিঠা দিয়ে বলল,” যা তো মা তোর আনোয়ার চাচা কে দিয়ে আয়।”
আমি পিঠার বাটিটা নিয়ে আনোয়ার চাচার বাসায় গেলাম। চাচা টিভিতে কী একটা মুভি দেখছে? মনে হয় ইরানি কোনো মুভি বাংলা ডাবিং করা হবে। ছবির মানুষগুলো লম্বা জুব্বা পরেছে। চাচা আমায় দেখে একটু ঘুরে তাকিয়ে আলগা হাসি দিলো।
“হাতে কী নিয়ে এসেছিস?”
“মা আপনার জন্য পিঠা দিয়েছে।”
“কী পিঠা রে?”
আমি পিঠার বাটিটা চাচার সামনে রাখলাম। কেমন বিস্মিত দৃষ্টিতে পিঠার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুটা সময়। “আরে তোর মা তো হেব্বি পিঠা বানইছে রে!”
চাচা মাঝে মাঝে হেব্বি শব্দটা ব্যবহার করে। এটা এ যুগের পোলাপানের শব্দ। চাচা যে কী করে শিখল! কে জানে? শব্দটা বলার সময় চাচার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। অনেক খুশি হলেই তিনি এ শব্দটা বলেন।
চাচা পিঠার বাটিটা হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করেছেন। এটা চাচার প্রিয় পিঠা। চাচার খুশি দেখতে বেশ ভালো লাগছে! বড়ো মানুষ হাসলে খুব সুন্দর লাগে! এ খবরটা মনে হয় বড়োরা জানে না। জানলে সারাক্ষণ গোমড়া হয়ে থাকত না।
আমি রিমোটটা নিয়ে টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করলাম। কী দেখা যায় ঠিক করতে পারছি না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে আসলাম। বাঘ আর বানোরের একটা দৃশ্য দেখাচ্ছে। বানোরটা কী যে শয়তান! বাঘটা কে নানা ভাবে রাগিয়ে দিচ্ছে। বাঘটা বানোরটা কে ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না!
এমন একটা খেলা আমারও খেলতে ইচ্ছে করে। বানোরের মতো করে খেলতে পারি না।
চাচার পিঠা খাওয়া শেষ। পিঠা মনে হয় খুব ভালো হয়েছে। চাচা এতটা কখনো খায় না। আজ পুরোটা চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। মা কে বলে আরেকবাটি পিঠা দিয়ে যেতে হবে।
চাচা বললেন, ” কফি বানাত মা। পিঠা খেয়ে খুব ভালো লাগছে! এখন এক কাপ কফি খেলে মন্দ হয় না, কী বলিস?”
চাচা দেখি এখন শুধু কফি খায়। চা খাওয়া পুরো ভুলে গেছে! অবশ্য কফিটা খেতে বেশ মাজা! আমি চাচার রান্নাঘরে ঢুকলাম। রহিমার সব কিছু কী সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। ছোটো ছোটো কৌটা থরে থরে সাজান। মসলার রংয়ের সাথে মিলিয়ে কৌটার রং! দেখলেই বুঝা যায় কোনটা কী মসলা। এ সব চাচাই বলে দিয়েছে হয়ত।
কফির পটটা খুঁজে পেতে একটুও সময় লাগল না! কফির পাশেই আছে চায়ের পট। তার গা ঘেঁষে চিনি আর দুধের পট রাখা।
কুট্টি পাতিলটায় পানি বসিয়ে দিলাম। কফি বানানটা খুব সহজ। গরম পানিতে দুধ আর চিনি মিশিয়ে দিয়ে তাতা কফি ঢেলে দিলেই কফি হয়ে যায়। কফির পরিমানটা ঠিক মতো দিলেই স্বাদটা ভালো হয়।
চাচা কে কফি দিয়ে চলে এলাম। ইচ্ছে করছিলো এক কাপ কফি নিয়ে ছাদে চলে যাই। এখন ছাদে যাওয়া যাবে না। মা খুব রাগ করবে। আপা সাথে থাকলে অবশ্য যাওয়া যেত। আপা কী করে যেন সবাইকে ম্যানেজ করতে পারে! এত রাগী মা কেও আপা কী করে ঠান্ডা করে ফেলে।
চাচার বাসা থেকে বের হয়েছি আবার চাচা ডাকল। “রুনু শোন তো মা।”
আমি আবার ঘরে ঢুকলাম। চাচা কফির কাপে আরাম করে চুমুক দিচ্ছে। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার দিকে তাকিয়ে আলগা হাসি দিয়ে বলল, “তোরা নাকি ফ্রিজ কিনবি?”
আমি চাচা কে বুঝতে চেষ্টা করলাম। ঠিক মতো বুঝতে পারছি না। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে দিলাম। চাচার মুখে এক চিলতে হাসি। সেই হাসিতে প্রাণ নাই! আমার বুঝতে কষ্ট হলো না। চাচা এ খবরে খুশি না! কিন্তু কেন? এখন আমরা তার বাসায় ছুটে আসছি। যখন -তখন ফ্রিজ খুলছি। উনি নিশ্চয়ই বিরক্ত হোন। হয়ত বিরক্তি প্রকাশ করেন না। ওনার তো খুশি হওয়ার কথা এ সব ঝামেলা আর হবে না। মানুষ কে ঠিক বুঝা যায় না!
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ