#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৩৩
কামিনী চৌধুরী আজ সবার চোখের আড়ালে হসপিটাল এসেছে। বাচ্চারা এতো দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিল তাই সে আসে নি। কানাডার এক পরিবারের সাথে কথা হয়েছে তার।দুটো বাচ্চা ই তারা নিবে। সে তো মেরেই ফেলতে চেয়েছিলো। বাচিয়ে রেখে যদি কিছু টাকা ইনকাম হয় তাহলে ক্ষতি কি। নূর কে সে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দিবে না। তার সব কিছু এই মেয়ে কেড়ে নিয়েছে। এতো সহজে ছেড়ে দেয়ার মানুষ সে না।সারাজীবন সন্তানের শোকে কপাল চাপড়ে মরবি এবার।নিজ মনে বিরবির করে নিজের পরিচিত নার্সের কাছে গেলো কামিনী চৌধুরী।
— আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।বাচ্চাগুলো কে নিয়ে এসো।
— স্যার জানলে আমাকে মে*রে ফেলবে ম্যাম। আপনি অন্য কাউকে বলুন।
নার্সের করুন গলা শুনে ক্ষেপে উঠলো কামিনী চৌধুরী। ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো হুংকার দিয়ে বললো,
— আমার কথা মতো কাজ না করলে আমি তোমার পুরো পরিবার কে মে*রে ফেলবো। এখন কথা না বারিয়ে যাও।টাকা তোমার একাউন্টে পৌঁছে যাবে।কাজ শেষ হলে কয়েকদিন অন্য কোথাও গিয়ে গা ঢাকা দিবে।
মধ্য বয়স্ক নার্স টি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললো,
— কোথায় গা ঢাকা দিবো? কবরে চলে গেলেও স্যার আমাকে মাটি খুড়ে খুজে বের করে আনবে।
কামিনী চৌধুরী বিরক্ত হলো। কর্কশ গলায় বলল,
— ঠিক আছে।আমি তোমার স্বামী আর বাচ্চাদের কবরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
— না না ম্যাম।প্লিজ এমন করবেন না। আমি এখনি যাচ্ছি।
কামিনী চৌধুরী বাকা হেসে নিজের গাড়ি তে গিয়ে বসলো। আশিয়ান কে এ ব্যপারে কিছুই বলে নি।আশিয়ান কে যতই নিজের মতো করে বড় করুক না কেন।তার শরীরে রাফসান শিকদারের ই রক্ত বইছে।সে কখনো ই এমন কিছু করতে দিবে না কামিনী চৌধুরী কে। তাই যা করার তাকেই করতে হবে।
আশমিন বেরিয়ে যেতেই নূর অমি কে করলো।
— চলে এসো অমি।আমি আজ ই এখান থেকে যেতে চাই।
— আরেক বার ভাবুন ম্যাম।স্যার জানলে আস্তো রাখবে না।
— এটাই আমার শেষ কথা। যা বলেছি তাই করো।
অমি আর কিছু বললো না। চুপ থেকে সম্মতি জানালো। সে কোন ভাবেই বিশ্বাস করে না আশমিন রাফসান শিকদার কে খু*ন করতে পারে। রাফসান শিকদার আশমিন কে অনেক স্নেহ করতেন। আশমিন নিজেও রাফসান শিকদারের প্রতিটি কথা মেনে চলতো। অমি নিজের চোখে আশমিন কে ভেঙে পরতে দেখেছে রাফসান শিকদারের মৃত্যুর পরে। আর কিছু না ভেবে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো অমি।
নূর ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।অমি এলেই তারা বেরিয়ে যাবে। নিজের বাবার খু*নির সাথে আর নয়।যতদিন আশমিন নির্দোষ প্রমাণ না হচ্ছে ততদেন সে বাচ্চাদের নিয়ে দূরে থাকবে।
নূর ওয়াশরুমে ঢুকতেই নার্স এসে বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। কেবিনের সামনের গার্ড গুলো তখন দরজায় দাঁড়িয়ে। নার্সের কোলে বাচ্চাদের দেখে তাকে আটকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
এমন রাশভারী গলা শুনে কেপে উঠলো নার্স।ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বললো,
— ডক্টরের কাছে চেকআপ করাতে নিয়ে যাচ্ছি।
গার্ড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো নার্স কে।একে প্রথমদিন থেকেই দেখেছে এখানে।তাই আর কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে যেতে বললো।
নার্স যেন হাফ ছেড়ে বাচলো।তড়িঘড়ি করে চলে এলো সেখান থেকে। লিফটে ঢুকে সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে পার্কিং-এ এসে কামিনী চৌধুরীর কাছে বাচ্চাদের দিয়ে দিলো।কামিনী চৌধুরী নাক সিটকে বললো,
— আমার কাছে দিচ্ছো কেন? পিছনের ঝুড়ি তে রাখো।
নার্স টি অবাক হয়ে তাকালো কামিনী চৌধুরীর দিকে। একটা কাপড়ের ঝুড়ি তে বাচ্চাদের রাখতে বলছে!
তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খ্যাঁক করে উঠলো কামিনী চৌধুরী। রাগী গলায় বলল,
— সঙ সেজে দাড়িয়ে আছো কেন? যা বলেছি তা করো।যত্তসব।
নার্স টি আর কিছু না বলে বাচ্চাদের বাস্কেটে রেখে একবার করুন চোখে তাকিয়ে বললো,
— আমার কোন টাকা লাগবে না ম্যাম।আমার স্বামি সন্তানদের ছেড়ে দিন। আমি তাদের নিয়ে খুব দূরে চলে যাবো।
— ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি তাদের ছেড়ে দিয়েছি।এখন এখান থেকে সরে পরো।তোমাকে যেন আর এই শহরে না দেখি।
বাচ্চারা কেদে উঠতেই কামিনী চৌধুরী বিরক্ত চোখে তাকালো। নার্স কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
গাড়ি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যেতেই নার্স দ্রুত পায়ে ছুটলো হসপিটালের দিকে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দোলনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেললো নূর।দ্রুত গতিতে সেদিকে গিয়ে বাবুদের না দেখে বুক কেপে উঠলো তার। চিৎকার করে গার্ডদের ডেকে বললো,
— বাহাদুর,,, আমার বাবু রা কোথায়?
গার্ড গুলো সাথে সাথে কেবিনে প্রবেশ করে নূর কে কাদতে দেখে বললো,
— বেবিদের ডক্টর চেকআপ করাতে নিয়ে গেছে নার্স।চিন্তা করবেন না।কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
নূরের চিৎকার চেচামেচি শুনে ডাক্তার আর নার্সরা ও এসে হাজির হয়েছে।একজন নূর কে বেডে বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে।এভাবে চিৎকার করলে সেলাই ছুটে যেতে পারে। ডক্টর গার্ডের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো,
— কি বলছেন? আমি নিজেই তো আসতাম বেবিদের দেখতে।আমার কাছে নিয়ে যেতে হবে কেন? আমি কাউকে বলি নি নিয়ে যেতে।
নূর ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো তাকাল সবার দিকে।রক্তিম চোখে নিজের সন্তানদের জন্য হাহাকার। সবার দিকে আঙ্গুল তুলে দাতে দাত চেপে বললো,
— আমার বাচ্চাদের দশ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে চাই।নাহলে একটা কেও জীবিত রাখবো না। এই এপ্যোলো হাসপাতাল গুড়িয়ে দিবো।
সবাই ভয়ে ঘেমে একাকার অবস্থা। অথোরিটি ও চলে এসেছে ততক্ষণে। আশমিন জায়িন চৌধুরীর মেয়েদের কিছু হলে সব কিছু ধ্বংস করে দিবে সে।
— কি হয়েছে?(অবাক হয়ে)
অমি কে দেখে ডুকরে কেদে উঠলো নূর। ভাই কে জাপটে ধরে চিৎকার করে বললো,
— আমার মেয়েদের এনে দাও অমি।আমার মেয়েদের কেউ নিয়ে গেছে।ওরা অসুস্থ। ওরা কাদছে হয়তো আমাকে ছাড়া। আমার মেয়েদের কিছু হলে আমি সবাই কে শেষ করে দিবো।
অমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। নূরের কান্নায় সবার চোখে পানি চলে এসেছে।
— কি বলছেন ম্যাম? বাবুরা কোথায়?কে নিয়ে গেছে ওদের?(অস্থির হয়ে)
নূর কিছু বলতে পারলো না।পেট ব্যথায় চিনচিন করে উঠতেই আর্তনাদ করে উঠলো। অমি নূর কে আগলে ধরে বেডে বসিয়ে দিয়ে নার্সদের নূর কে সামলাতে বললো। অথরিটি হেড ততক্ষণে সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে এসেছে।অমি আশমিন কে কল করে যাচ্ছে। আশমিন ফোন তুলছে না।সানভি কে কল দিতেই সে কল রুসিভ করলো। অমি সংক্ষেপে সব বলে আশমিন কে ইনফর্ম করতে বললো। গার্ডদের দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে বললো,
— বাহাদুর কোথায়?
— স্যারের সাথে গিয়েছে।(মাথা নিচু করে)
নূর নিস্তেজ হয়ে বেডে পরে আছে। ব্লিডিং হচ্ছে সেলাইয়ের জায়গা থেকে। অমির নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। নিজের চুল টেনে অস্থির পায়চারি করতে করতে কল করলো আশিয়ানের কাছে।
— বাবুরা কোথায় আশিয়ান? বাচ্চাদের গায়ে ফুলের টোকা লাগলে আমি তোকে খু*ন করে ফেলবো।(চিৎকার করে)
অমির চিৎকার শুনে আশিয়ান অবাক হয়ে গেলো। হতভম্ব গলায় বলল,
— কি বলছো ভাই? বাবুরা কোথায় আমি কিভাবে বলবো? কি হয়েছে?
অমির চেহারা রাগে লাল হয়ে গেলো। সব সময় শান্ত থাকা মানুষ টা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনের সোফায় লাথি দিয়ে বললো,
— একদম নাটক করবি না।তুই ওদের কিডন্যাপ করিস নি? আরে তোর বোনের মেয়ে ওরা! এতো টা নিচে কিভাবে নামতে পারলি! তোর দুশমনি সম্পত্তি নিয়ে।বাচ্চাদের দিকে কেন হাত বাড়ালি? আশমিন মেরে ফেলবে তোকে। কোথায় আছিস আমাকে বল।আমি ওদের নিয়ে আসবো। নূরের অবস্থা ভালো না।আমার বোন মরে যাবে।
অমি কথা বলতে বলতে কান্না করে দিলো। আশিয়ান স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে ওর।সে ক এতোটাই খারাপ যে দুধের বাচ্চাদের সাথে দুশমনি করবে! বাচ্চাগুলো হওয়ার পর থেকে ওদের দেখার জন্য মন আকুপাকু করছিলো। কতো কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখেছে একমাত্র ও ই জানে।ও রাফসান শিকদার কে ঘৃণা করে। নূরের প্রতি ওর কোন রাগ নেই।রাফসান শিকদারের রাজত্ব ধ্বংস করতে চায় ও।কিন্তু নূরের কোন ক্ষতি তো কোনদিন ও চায়নি।নিজেকে সামলে আমি আসছি বলেই কল কেটে দিলো আশিয়ান। গাড়ির চাবি নিয়ে তৎক্ষনাৎ বেড়িয়ে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আজ এই শত্রুতার শেষ করবে ও। যাদের জন্য এই দ্বন্দ্ব তারা কেউ ই তো আর বেচে নেই। তাহলে প্রতিশোধ নিয়ে কি হবে? তার নিজের ও একটা পরিবার চাই।আগাছার মতো জীবন তার নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে।
সমস্ত রোড ব্লক করে দেয়া হয়েছে।একটা গাড়ি ও নড়তে দেয়া হচ্ছে না। জনগণের মধ্যে অনেকেই পুলিশ কে সাহায্য করছে তল্লাশি করতে।সানভির কাছ থেকে নিজের মেয়েদের নিখোজ হওয়ার খবর শোনার সাথে সাথেই আশমিন ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। সে জানে এই কাজ কামিনী চৌধুরী ছাড়া আর কেউ করে নি।
তিন রাস্তার মাথা ব্লক করে সেখানেই গাড়ির ডিকি তে শুয়ে আছে আশমিন। এই রাস্তা দিয়েই সব গাড়ি বের হতে হবে। আহ! শেষে কি না তার হাতেই কামিনী চৌধুরীর মৃ*ত্যু লেখা আছে! আমজাদ চৌধুরী ছুটে এসেছে ছেলের কাছে।
আশমিনের ফোন বেজে উঠতেই সে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। কয়েকটা কথা বলে রক্তিম।চোখে আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
— চলো আব্বু।একটু ঘুরে আসি। (আমজাদ চৌধুরীর কাধে হাত দিয়ে) তোমাকে আমার টর্চার সেল দেখাবো আজ।চলো চলো।
আমজাদ চৌধুরী অসহায় চোখে তাকালো আশমিনের দিকে। মন বড় কু গাইছে। করুন গলায় বলল,
— প্রাণ টা না নিলে হয় না?
— আমি তোমাকে আরো তিনটা বউ এনে দিবো।এটা নিয়ে এতো বায়না করো না তো।ভালো ছেলেরা বায়না করে না। চুপচাপ গাড়ি তে বসো।নাহলে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর শেষ দর্শন ও পাবে না।
একটু থেমে আবার দাত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
— এই শহর আমার।আমার শহর থেকে আমার মেয়েদের দিকে হাত বাড়ানোর শাস্তি তাকে পেতে হবে।একদম পুরনো দিনের নায়িকাদের মতো ন্যাকামি করবে না।
চলবে,,,