#যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
গুমোট অন্ধকার আকাশ। সারি সারি কালো মেঘের ছড়াছড়িতে নীল-শুভ্র আকাশের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। ভারী বর্ষণের প্রস্তুতি বোঝা যাচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ায় একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছে অন্যদিকে কেমন যেন একটু কষ্টও লাগছে। কলেজ লাইফটাকে ভীষণ মিস করবে অর্ষা। মিস করবে তার প্রিয় গ্যাঞ্জাম পার্টিকে। ভার্সিটিতে কি সবাই একসাথেই পড়তে পারবে? হয়তো সেটা হবে না। কে যে কোথায় চলে যাবে কে জানে!
থাইগ্লাসে বিন্দু বিন্দু জল এসে জমা হয়েছে। আনমনে ব্যাগ গোছাচ্ছিল অর্ষা। দৃষ্টি জানালার দিকে যেতেই এক সাইড খুলে দেয়। বড়ো বড়ো ফোঁটায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ভেতর থেকে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে আবারও কাপড় গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজই সে নিজেদের বাসায় চলে যাবে। রুহুল আমিন অর্ষাকে নিতে এসেছে মিনিট পাঁচেক হবে। বসার ঘরে বসে আমেনা বেগমের সাথে গল্প করছে এখন।
ব্যাগ গুছিয়ে অর্ষা নিজে রেডি হতে যায়। হিজাব বাঁধতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে একবার পরখ করে নেয়। সময়গুলো কীভাবে যেন পানির স্রোতের মতো বয়ে গেল। সে একটু টেরও পেল না। ভালো সময়গুলো বোধ হয় এমনই হয়। বেশিক্ষণ থাকলেও মনে হয়, অনেক কম! আরেকটু সময় থাকলে ভালো হতো। এসব ভাবতে ভাবতেই তার ঠোঁট হালকা প্রসারিত হয়। আচমকা খেয়াল করে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আহিল।
অর্ষা মৃদু হেসে বলল,’ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।’
‘বসার ঘরে তোর ভাইকে দেখলাম। তুইও রেডি হচ্ছিস। চলে যাবি নাকি আজই?’
হিজাবে পিন সেট করতে করতে অর্ষা প্রত্যুত্তর করল,’হুম।’
‘আশ্চর্য! মাত্র গতকাল পরীক্ষা শেষ হলো। আর আজই চলে যাচ্ছিস? কাল তো বললিও না আমায়।’
‘আরে আমিই তো জানতাম না। একটু আগে ভাইয়া এসে বলল রেডি হতে।’
‘এসেছে ভালো হয়েছে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে চলে যাবে। তুই কোথাও যাবি না। আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলছি।’
‘মানে কী?’
‘মানে তুই আরো কয়েকটা দিন এই বাড়িতেই থাকবি। গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে মিলে আমরা ঘুরতে যাব।’
কথা শেষ করে আহিল বসার ঘরের দিকেই যাচ্ছিল; অর্ষা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পিছু ডেকে বলল,’শোন, শোন!’
আহিল দাঁড়ায়। পিছু ঘুরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অর্ষা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে,’বাড়িতে ভাবির অনেক কষ্ট হয়ে যায়। তিয়াস তো ছোটো। ও’কে সামলানো আবার বাড়ির কাজ! বুঝিসই তো।’
আহিল বিরক্ত হয়ে বলে,’তুই বাড়ির কাজের লোক নাকি?’
‘এ কথা বলছিস কেন? ওটা আমারও তো বাড়ি।’
‘তোকে বাড়ির লোক বলে তো গণ্য করে না তারা।’
‘তুই এত ক্ষ্যাপা কেন আমার পরিবারের ওপর?’
‘উত্তরটাও তোর খুব ভালো করেই জানা আছে।’
‘যা হোক, তুই ভাইয়াকে কিছু বলিস না। অনেকদিনই তো থাকলাম। আর কত? তাছাড়া ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারেও কোনো সমস্যা নেই। কবে, কোথায় যাবি আমাকে জানিয়ে দিস তাহলেই তো হলো।’
‘তার মানে তুই যাবিই?’
অর্ষা অসহায় দৃষ্টিতে আহিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। আহিলও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্তকণ্ঠে বলল,’ঠিক আছে। সাবধানে যাস।’
অর্ষার ঠোঁট প্রসারিত হলো। আহিল যে রাগ করেনি এটাই অনেক! সে খুশি হয়ে বলল,’থ্যাঙ্কিউ দোস্ত।’
প্রত্যুত্তরে আহিল হালকা হেসে ড্রয়িংরুমে চলে যায়। অর্ষারও তৈরি হওয়া শেষ। তাই সে ব্যাগ নিয়ে বসার ঘরে যায়।
রুহুল আমিনের উদ্দেশ্যে বলে,’ভাইয়া চলো।’
রুহুল উত্তর দেওয়ার আগেই আমেনা বেগম বললেন,’চলো আবার কী? সকালে না খেয়েই যাবে নাকি?’
‘এখন ক্ষুধা নেই আন্টি।’ বলল অর্ষা।
‘আমি সেসব শুনছি না। খেয়ে তারপরই যেতে হবে। রুহুল তুমিও আসো।’
অগত্যা অর্ষা ও রুহুলকে খেতে বসতে হলো। জহির চৌধুরী আরো আগেই অফিসে চলে গেছেন। আমেনা বেগমও তার সাথেই সকালের নাস্তা করে নিয়েছেন। এখন শুধু অর্ষা, আহিল আর রুহুল খাচ্ছে। রেণুও আরো সকালেই খেয়ে নিয়েছে। খেতে খেতে আমেনা বেগম আর রুহুল গল্প করছে। অর্ষা এবং আহিল নিশ্চুপ হয়ে খাচ্ছিল আর ওদের গল্প শুনছিল।
খাওয়ার পাট চুকিয়ে অর্ষা বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠে বসে। অনেকদিন এখানে থাকায় মায়া জন্মে গেছে বিধায় এখন বেশ খারাপও লাগছে। বাড়িতে পৌঁছে ভেতরে যেতেই তিয়াস ‘ফুপি, ফুপি’ বলে দৌঁড়ে আসে।
অর্ষা হাত বাড়িয়ে তিয়াসকে কোলে তুলে নেয়। গালে, মুখে চুমু দিয়ে আদর করে। তিয়াসও অর্ষার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে। দেখে মনে হচ্ছে কত শান্তশিষ্ট! কিন্তু তিয়াস ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে।
কুসুম বারান্দায় বসে সিলিন্ডারে গ্যাসের চুলায় রান্না করছিল। তিয়াসকে কোলে নিয়েই অর্ষা কুসুমের কাছে যায়। জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো ভাবি?’
কুসুমের মুখ অন্ধকার। সে চোখমুখ কালো করেই বলল,’ভালো।’
একটু থেমে ফের বললেন,’আসলি কেন? ওখানেই পার্মানেন্টলি থেকে যেতি। নবাব-নন্দিনী হয়ে গেছিস না তুই!’
অর্ষা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা। বাড়ি ফেরার যেই আনন্দটুকু সাথে করে নিয়ে এসেছিল, তা এখন কুসুমের তিরস্কারে নষ্ট হয়ে গেছে।
তিয়াস ওর মায়ের রাগের প্রতিবাদ করে বলল,’ফুপিলে বকবা না। মালব তোমালে।’
অর্ষার প্রতি ছেলের এত দরদও কুসুমের সহ্য হয় না। রুহুল এই পর্যায়ে কুসুমকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,’থামবে তুমি?’
এরপর অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’তিয়াসকে আমার কোলে দে। তুই ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হ।’
অর্ষা কোনো বাক্যব্যয় করল না। তিয়াসকে ভাইয়ের কাছে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। কুসুম বেশ জোরে জোরেই অর্ষাকে শুনিয়ে রুহুলকে বলছিল,’এতদিন তো পরীক্ষা শেষ হোক, শেষ হোক বলে বোনকে আহ্লাদ দিয়ে রেখেছিলে। এখন তো পরীক্ষা শেষ। আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না বলে দিলাম। এবার নিজের রাস্তা নিজেকে দেখতে বলো। হয় চাকুরীবাকরি কিছু করতে বলো; নয়তো বিয়েশাদী দিয়ে দাও। অনেক করেছে আরাম-আয়েশ।’
রুহুল কিছু বলেছে কিনা অর্ষা শোনেনি। তবে কুসুমের কথা শুনেই তার চোখ ফেটে অশ্রু নির্গত হয়। ভাই-ভাবির সংসারে বুঝি সে এত বেশি হয়ে গেছে? হাতের উলটোপিঠে চোখ মুছে নেয় সে। কুসুম না বললেও সে চাকরী করত এবার। কারও গলগ্রহ হয়ে থাকার ইচ্ছে তারও নেই।
ফ্রেশ হয়ে অর্ষা বারান্দায় আসে ফের। কুসুমকে বলে,’তুমি ওঠো। আমি রান্না করছি।’
কুসুম কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। এরপর উঠে চলে যায় ঘরে। তিয়াসকে সাথে নিতে চেয়েছিল কিন্তু তিয়াস যায়নি। রান্না করতে করতে তিয়াসের সাথে দুষ্টুমি করছিল অর্ষা। তিয়াসের সুড়সুড়ি অনেক বেশি। একটু সুড়সুড়ি দিলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। অর্ধেক রান্না কুসুমই করে ফেলেছিল। তাই অর্ষার রান্না শেষ করতে বেশি সময় লাগল না। ভাত, তরকারি সব ঘরে রেখে এসে বারান্দা আর উঠান সুন্দর করে ঝাড়ু দিলো। এরপর তিয়াসকে গোসল করিয়ে, মাথায় তেল, শরীরে লোশন দিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল। কুসুমের কাছে দিয়ে আসার পরও তিয়াস থাকবে না। আজ ছাড়ছেই না সে অর্ষাকে। কুসুম বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ষার দৃষ্টি অসহায়।
কুসুম ছেলের রাগ অর্ষাকে দেখাল। জোরে ধমক দিয়ে বলল,’কাঁদাচ্ছিস কেন? দেখছিস থাকতে চাচ্ছে না এখানে, তবুও জোর করছিস। এখন ওর ঘুমানোর সময়। ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাস।’
অর্ষা কিছু বলল না। তিয়াসকে কোলে করে বাইরে বেরিয়ে এলো। তিয়াসের মাথা ওর কাঁধে রেখে পিঠে হালকা চাপড় দিতে দিতে ছড়া বলছে অর্ষা। বারান্দায় আর উঠানে হাঁটাহাঁটি করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। সেই সময়ে লামিয়া আর জুঁই এসে বাড়িতে উপস্থিত হয়।
ওরা চেঁচাবেই তার আগেই অর্ষা ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বলল। ফিসফিস করে বলল,’তিয়াস ঘুমাচ্ছে।’
ওরা-ও সাবধান হয়ে যায়। ফিসফিস করেই বলল,’বাড়িতে যে চলে আসবি জানাসনি কেন?’
‘আমিই জানতাম না।’
‘ছাই! আহিলও বাসায় নেই। ঐ বাড়িতে গিয়ে তোদের না পেয়ে ভাবলাম, পালিয়ে গেলি নাকি আবার! পরে রেণু আপু বলল তুই চলে এসেছিস। আর আহিল কোথায় গেছে জানে না। ফোন দিলাম কোনো রেসপন্স নাই।’ কথাগুলো বলল জুঁই।
অর্ষা মৃদু ধমকেরসুরে বলল,’থা’প্পড় খাবি। পালাব কেন আমরা? আমাদের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্ক নাই।’
‘আরে ভাই! মজা করছি। রাগ করিস না জানু।’
লামিয়া অর্ষার এক হাত ধরে বলল,’বাদ দে তো এসব। জরুরী একটা খবর দিতে এসেছি। কাল আমরা গ্যাঞ্জাম পার্টি মিলে ঘুরতে যাচ্ছি। সাথে নিহাল আর সুবাস ভাইয়াও যাবে।’
‘তোরা কাপলরা যাবি যা। মাঝখান থেকে আমাদের কেন কাবাব মে হাড্ডি বানাচ্ছিস?’
লামিয়া মুখটা একটুখানি করে বলল,’এটা কোনো কথা বললি বোকারানী? এর আগেও তো আমরা রেস্টুরেন্টে কত দেখা করেছি। আমি কি তোদের চেয়ে ও’কে বেশি সময় দিয়েছি বল? প্লিজ! তুই না করিস না। তুই বেঁকে গেলে গ্যাঞ্জাম পার্টির বাকি কেউই যাবে না।’
লামিয়ার সাথে জুঁইও অনুরোধ করে বলল,’প্লিজ! প্লিজ! সোনাপাখি না করিস না।’
ওদের বাচ্চামো দেখে অর্ষা হেসে ফেলে। বলে,’আচ্ছা ঠিক আছে যাব।’
ওরা খুশি হয়ে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। তিয়াস নড়েচড়ে উঠতেই অর্ষাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,’তুই সকালে রেডি হয়ে থাকিস। আমরা দশটায় মাইক্রো নিয়ে আসব। তোকে বাড়ি থেকেই পিক করব।’
‘আচ্ছা।’
‘এখন তাহলে যাই। কাল দেখা হবে।’
‘বসবি না?’
‘না রে। নিহালের সাথে দেখা করতে হবে।’
অর্ষা হেসে বলল,’আচ্ছা। সাবধানে যাস।’
.
.
রাতে ঘুমানোর সময় কেয়াকে চাকরীর ব্যাপারে বলল অর্ষা। কেয়া কাৎ হয়ে শুয়ে বলল,’একটা শো-রুমে লোক নেবে একজন। কিন্তু সমস্যা হলো মালিকের বউ খুব দজ্জাল স্বভাবের।’
অর্ষা হেসে বলে,’তাতে কী? কাজ ঠিকঠাকভাবে করলেই তো হলো।’
‘পারবি তুই?’
‘পারতে হবে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তাহলে গিয়ে কথা বলব। এখন ঘুমা।’
‘আচ্ছা।’
সকালে ভোরের দিকেই অর্ষার ঘুম ভাঙে। ফজরের নামাজ পড়ে চুলায় ভাত বসিয়ে দেয়। তরকারি কেটে বারান্দা, উঠান সব ঝাড়ু দেয়। রান্নাবান্না শেষ করে থালাবাসন ধুয়ে ফেলে। এই বাড়িতে কেউ তেমন চা খায় না বলে, সকালে চা বানানোর বাড়তি ঝামেলাটা নেই। কেয়া আর রুহুল খেয়ে-দেয়ে কাজে চলে যায়। কুসুম নিজের ঘরেই খায়। অর্ষাও খেয়ে-দেয়ে সবকিছু গোছগাছ করে রাখে ঘুরতে যাবে বলে। যাওয়ার সময় তো বলে গেছিল দশটার দিকে আসবে। এখনো হাতে সময় আছে তাই ময়লা কিছু কাপড়-চোপড় সাবান দিয়ে ভিজিয়ে ধুয়ে শুকাতে দেয়। কাপড় ধুতে গিয়ে নিজেও অনেকটা ভিজে গেছে তাই গোসলটাও সেরে ফেলে। কখন ফিরবে আজ তারও তো ঠিক নেই।
বোরকা পরে হিজাব বাঁধছিল তখন তিয়াসকে কোলে নিয়ে কুসুম আসে ঘরে। জিজ্ঞেস করে,’রেডি হচ্ছিস যে? কোথাও যাচ্ছিস?’
‘তোমাকে কাল বললাম না? সবাই মিলে ঘুরতে যাব।’
কুসুম একটুখানি সময় চুপ করে থেকে বলল,’যাওয়া লাগবে না আজ ঘুরতে। কেয়া ফোন করেছিল। শো-রুমের মালিকের সাথে কথা বলেছে। তারা আজই যেতে বলেছে।’
অর্ষা আহত হয়। বিমর্ষ হয়ে বলে,’ভাবি কাল থেকে যাই প্লিজ? ওরা অনেক আশা নিয়ে আসবে। আমি না গেলে নিরাশ হবে।’
কুসুমের মেজাজ গরম হয়। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে,’তোর মামার বাড়ি নাকি ঐটা যে যখন মন চায় তখন যাবি! চাকরী কি তোর চেহারা দেখে দেবে? আজ না গেলে যখন অন্য কাউকে নিয়ে নেবে তখন? আবার বসে থাকবি নতুন চাকরীর জন্য। বসে বসে গিলবি। ঐ আশা বাদ দে। আর তোর বন্ধুরা যে নিরাশ হবে বললি, ওদের নিরাশ হওয়ায় আমার কী? ওরা তোকে খাওয়ায়? নাকি পড়ায়?’
অর্ষার বলার মতো কিছুই নেই। আবার চাইলে হয়তো অনেক কিছুই বলতে পারে। কিন্তু যাদের আশ্রয়ে থাকছে, খাচ্ছে তাদের মুখের ওপর বলবেই বা কী? এ কথাও তো সত্য, চাকরীটা তার খুবই প্রয়োজন!
কুসুম কড়াকণ্ঠে বলল,’কোনো রকম কান্নাকাটি ছাড়া এখনই যাবি।’ বলে বিশ টাকার নোট গুঁজে দিলো হাতে।
অর্ষা তাই করল। হিজাব বাঁধা শেষ করে কেয়ার শো-রুমে চলে গেল। পথিমধ্যে হাতের উলটোপিঠে এতক্ষণ যাবৎ লুকিয়ে রাখা অশ্রু কণাগুলো মুছে নিল।
________
আহনাফ জগিং করে বাড়িতে ফিরে এসে ক্যাথিওনকে গার্ডেনে পায়। লেজ গুটিয়ে বসে ছিল। আহনাফকে দেখেই দৌঁড়ে কাছে চলে যায়। ক্যাথিকে কোলে তুলে মাথা চুলকে দেয় আহনাফ।
ভেতরে গিয়ে ক্যাথিকে ড্রয়িংরুমে রেখে গোসল করে রেডি হয়ে আসে। ডাইনিংরুমে গিয়ে ক্যাথিকে ওর খাবার দিয়ে নিজের খাবার খেয়ে নেয় আহনাফ। বাইরে যাওয়ার আগে ক্যাথিকে আদর করে বলে,’দুষ্টুমি করবি না। বাসার কোনো জিনিস কিন্তু এলোমেলো করবি না বলে দিলাম।’
ক্যাথি চোখ দুটো পিটপিট করে তাকাল। এর অর্থ হচ্ছে সে আহনাফের কথা রাখবে। আহনাফও হেসে দরজা বাইরে থেকে লক করে অফিসে চলে যায়। সুইজারল্যান্ড এসেছে অনেকদিন। কিন্তু মনটা মনে হয় সেই বাংলাদেশেই রেখেছে। এর আগে তো অনেকবার তাকে বাংলাদেশে যেতে হয়েছে; আবার দরকার শেষে সুইজারল্যান্ডে ফিরেও আসতে হয়েছে। কখনো তো এমন হয়নি।
অফিসে গিয়ে সে মাকে ফোন করে। বেশ কিছুক্ষণ মায়ের সাথে কথা বলে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করে।
দুপুরের লাঞ্চ টাইমে বাংলাদেশ থেকে হোয়াটসএপে ভিডিয়ো কল করে ইমরান।
আহনাফ খেতে খেতেই বাম হাতে ফোন রিসিভ করে বলে,’কী অবস্থা? হঠাৎ কী মনে করে?’
ওপাশ থেকে ইমরান বলল,’খাচ্ছিস নাকি? পরে ফোন করব?’
‘আরে না। সমস্যা নাই বল।’
‘কেমন আছিস?’
‘আল্লাহ্ রেখেছে ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। তোর কী খবর বল?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। ফোন করেছি একটা দরকারে।’
‘তা আমি জানি। নয়তো গার্লফ্রেন্ডকে কল না দিয়ে কি ইমরান আমায় কল করে?’ কথা শেষ করে আহনাফ মুচকি হাসে।
ইমরানও হেসে বলে,’লজ্জা দিস না তো!’
‘আচ্ছা বল কী দরকার?’
‘আগামীকাল গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিন। তো ও’কে ড্রেস থেকে শুরু করে কসমেটিক্স, জুতা সব গিফ্ট করতে চাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো, এসবে মানে মেয়েদের জিনিস-পত্র কেনায় আমি খুব আনাড়ি। তুই তো আফরিন আর আন্টির জন্য সবসময় নিজেই পছন্দ করে সবকিছু কিনিস। তোর পছন্দও একদম চোখ ধাঁধানোর মতো। তাই ভাবলাম, তুই-ই পারবি আমায় সাহায্য করতে।’
আহনাফ হেসে বলল,’বাপ্রে! গার্লফ্রেন্ডের ড্রেস,কসমেটিক্স পছন্দ করে দেওয়ার জন্য সুদূর বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে বন্ধুকে ফোন করছিস? ভাই তোর নাম তো গিনিস বুকে দেওয়া উচিত।’
‘পিঞ্চ মারিস না সবসময়? যখন নিজের কেউ আসবে তখন বুঝবি বুঝলি!’
‘অত বুঝে কাজ নেই। কী পছন্দ করতে হবে দেখা।’
‘ওয়েট। আমি শো-রুমেই আছি। দেখাচ্ছি।’ বলে ব্যাক ক্যামেরা অন করে ইমরান।
কাউন্টারে গিয়ে ওউনারকে বলে,’আমি জুয়েলারি, কসমেটিক্স এসব দেখতাম। এদিকের সেলসম্যান কোথায়?’
ওউনার ইমরানকে হাসিমুখে বলল,’ডেকে দিচ্ছি।’
এরপর সে ঘাড় ঘুরিয়ে একটা ছেলেকে ডেকে বলল,’নতুন মেয়েটা কোথায়? ও’কে ডাক।’
ছেলেটি এখান থেকেই নাম ধরে ডাকে,’অর্ষা, অর্ষা। ম্যাডাম তোমাকে ডাকছে।’
অর্ষা নামটি শুনে চকিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় আহনাফ। খাওয়া শেষ করে নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিল বলে দৃষ্টি ছিল পথের দিকে। এবার সে স্ক্রিনেই দৃষ্টি রাখে। দেখতে পায় ঝাড়ু হাতেই অর্ষা তড়িঘড়ি করে এদিকে আসছিল। এবং এটা সেই অর্ষা, নাম শুনে যার কথা আহনাফের প্রথম মনে এসেছিল। কিন্তু মেয়েটা এখানে কেন? তাও ঝাড়ু দিচ্ছে!
সে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি অর্ষার হাত থেকে ঝাড়ুটি রেখে ফিসফিস করে কিছু বলল। অর্ষাকে একটু ভীত-ই দেখাল। সে কাউন্টারে আসতেই ওউনার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’উনি কী দেখবে দেখাও।’
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে কসমেটিক্সের সাইডে গেল। ঘেমে চেহারার অবস্থা খারাপ। হাত দিয়ে বারবার ঘাম মুছেও কোনো লাভ হচ্ছে। অর্ষা যতটা সম্ভব হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল,’কী লাগবে স্যার?’
সেলসম্যানের প্রথম কাজটাই হচ্ছে হাসি-খুশি থাকা সর্বদা। যত কষ্টই হোক, খারাপ লাগুক না কেন কাস্টমারের সামনে একদম সেসব প্রকাশ করা যাবে না। সবসময় হাসির মুখোশ লাগিয়ে রাখতে হবে। কাস্টমারদের কথা বলে কনভেস করতে হবে।
ইমরান হেডফোন লাগিয়ে ছিল বিধায় আহনাফের কথা অর্ষা শুনতে পাবে না। ইমরান বলল,’সব ব্যান্ডের লিপস্টিক, মেকআপ করতে যা যা প্রয়োজন সেগুলো দেখান।’
অর্ষা একে একে সব বের করে সামনে ডেস্কের ওপর রাখছিল। আহনাফ তখনো নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ঘর্মাক্ত চেহারার অর্ষার শুকিয়ে যাওয়া মুখটি দেখছিল। মেয়েটার প্রতি একটা সফট্ কর্ণার বোধ হয় রয়েছে তার!
চলবে…