#যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ২১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
দুপুরের দাপদাহ গরমে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর চলছে। তবে শান্তি মিলছে না। বাতাসটাও লাগছে ভ্যাপসা গরম। গরমে অস্থির হয়ে বারান্দায় পায়চারি করে অর্ষা। একটু যে ছাদে যাবে তারও তো কোনো উপায় নেই। রোদে একদম পুড়ে যেতে হবে। সে কী করবে না করবে কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছে না। সময়ও কাটতে চাইছে না এভাবে। জহির চৌধুরী অফিসে গেছেন। আহিল গেছে বাইরে। ছেলে মানুষ আর কতকক্ষণই বা বাসায় থাকে? আমেনা বেগম ঘুমিয়ে আছেন। সকালে ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন বিধায় ঘুমটাও হচ্ছে কড়া। এই মুহূর্তে অর্ষারও ইচ্ছে করছে টুপ করে একটা ওষুধ পেটে চালান দিয়ে ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করতে। এতে অন্তত জাগতিক গরম থেকে রেহাই মিলবে কিছু সময়ের জন্য। তবে এটা সম্ভব নয়। ঘুমের ওষুধগুলো বেশি পাওয়ারের। খেয়ে টাল হয়ে শুয়ে থাকলে আবার সকলে ভেবে না বসে শোকে-দুঃখে অর্ষা সুই’সাইড করতে চাচ্ছে।
পায়চারি করতে করতে আরো হাঁপিয়ে পড়েছে সে। বাসায় এখন রেণু আপাই শেষ সম্বল। তার সাথে গল্পগুজব করে সময় কতটুকু পার করা যায় দেখা যাক। সে রেণুর রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজা ভেতর থেকে চাপানো।
অর্ষা দরজায় করাঘাত করে বলল,’রেণু আপা? ঘুমিয়েছেন?’
রেণু ঘুমায়নি। সজাগ-ই ছিল। সে ব্যস্ত পায়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। চাপিয়ে রাখা দরজা নিজেই খুলে বলল,’আরে আপামুনি। আহেন ভিতরে আহেন।’
অর্ষা ভেতরে গিয়ে খাটে বসল। রেণু পাশে বসে গদগদ হওয়া ভঙ্গিতে বলল,’আমার যে কী কপাল আপামুনি।’
‘এ কথা বলছেন কেন?’
‘এইযে আপনে আমার ঘরে আইছেন।’
অর্ষা মলিন হেসে বলে,’আপনার রুমটা অনেক সুন্দর রেণু আপা। গোছানো, পরিপাটি। আমার বাবার বাড়ি কিন্তু এত সুন্দর না। এত পরিপাটিও নয়। পুরনো আমলের রঙচঙ ধরা বাড়ি।’
রেণু যেন একটু বিমর্ষ হলো। বিষাদিত কণ্ঠে বলল,’তবুও আপা আপনের বাপের ভিটা আছে। আমার তো নিজের বলতে কিছুই নাই।’
গল্প করার প্রসঙ্গ পেয়ে অর্ষার ভালো লাগছে। সে বিছানায় পা তুলে বসে বলল,’আমায় বলা যাবে আপনার জীবন কাহিনি?’
রেণু হাসল। হাসিটা আনন্দের কিংবা সুখের মনে হয়নি অর্ষার। মানুষ তো শুধু খুশি হলেই হাসে না। অতি কষ্টেও মানুষ হাসে। আর সেই হাসিটা ঠোঁটে স্পষ্ট হলেও, আসলে হাসিটা বের হয় পাঁজর ছিঁড়ে। সেই ব্যথা কখনো কাউকে দেখানো যায় না আবার বোঝানোও যায় না।
অর্ষা তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। রেণুর চোখজোড়া হঠাৎ-ই কেমন ছলছল করে ওঠে। সে ঠোঁটে সেই বিষাদমাখা হাসিটুকু ধরে রেখেই বলল,
‘আমি যহন ছোডো আছিলাম তহন আমার আব্বায় মা’রা গেছে। নানা-নানি জোর কইরা আম্মারে আবার বিয়া দিছে। আমি সৎ বাপের বাসাতেই থাকতাম। আম্মা বিয়া করছিল বইলা দাদা-দাদি আর কোনো সম্পর্ক রাখে নাই আমগোর লগে। আরেকটু বড়ো হওনের পর আমার একটা বুইন হইছিল। সেই বুইন হইতে গিয়া আমার মা-ও মই’রা যায়। সৎ বাপে আরেকখান বিয়া করে। এহন তো ঐ বাড়ির কেউ আমারে রাখব না। নানা গিয়া নিয়া আসলো। বয়স যহন আমার ১৭ তহন নানাও মা’রা গেল। বাইত্তে মামা, নানি আর আমি। মামা বিয়া ঠিক করল ৪০ বছরের এক ব্যাডার লগে। ব্যাডার আগের ঘরের বউয়ের লগে তালাক হইছিল। আমার বিয়ার এক বছরের মাথায় ঐ বউ আবার ফিইরা আসতে চায়।’
এটুকু বলে রেণু থামে। ওড়নার কোণায় চোখ মুছে নেয়। অর্ষার বুকের ভেতরে কেমন উত্থানপতন শুরু হয়। রেণুর মাঝে সে নিজেরও কিছু প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছে।
রেণু আবার বলা শুরু করে,’এরপর জামাই আমারে তালাক দিলো।’
‘আশ্চর্য! আপনার স্বামী তার আগের বউকে গ্রহণ করল?’
‘হ। কারণ হের পুলাপাইন হের পা ধইরা অনেক কান্নাকাটি করছে। আর হেয়-ও আগের বউরে মেলা ভালোবাসতো।’
‘তারপর কী হলো?’
‘তারপর আর কী হইব? মামা বাসায় রাখব না সোজা বইলা দিলো। গেরামের এক পরিচিত বড়ো বইনের সাহায্যে ঢাকায় আইলাম। ঐ আপাই এই বাইত্তে কাম নিয়া দিছিল। ভাগ্যিস এই বাসায় কাম পাইছিলাম। এই বাড়ির মানুষগুলান যে কত্ত ভালো আপা হেইডা আমি কইয়াও শেষ করতে পারমু না। দেহেন একটা রুম আমারে দিয়া দিছে। কোনো কাজের মানুষরে কেউ এত আহ্লাদ দিয়া রাখে কন? খালাম্মা আমারে নিজের মেয়ের মতোই দেহে। বাড়ির বেবাক মানুষজন আমারে ভালোবাসে। আগের কথা এখন আর মনে পড়ে না। অনেকদিন পর আপনে জিগাইলেন তাই মনে পড়ল।’
বোকাসোকা অর্ষা কাঁদছে। সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রেণুকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’আল্লাহর ওপর ভরসা রাখবেন রেণু আপা। তিনি অবশ্যই সকল বান্দার ভালো চান।’
‘ভরসা আছে আপামুনি। তিনি চাইছেন বইলাই তো এহন আমি এত ভালা আছি।’
অর্ষা চোখের পানি মুছে বলল,’আপনি আর বিয়ে করলেন না কেন?’
‘মন মই’রা গেছে আপা। একজনরেই ভালোবাসছিল। তারে হারাইয়া মনও মই’রা গেছে। মানুষ যে কয় বিয়ার পর ছেলে-মেয়ে আর একলা থাকতে পারে না; এইগুলা ভুয়া কথা। আবার সইত্যও হইতে পারে। কিন্তু মনের চাহিদা না থাকলে কি আর শরীর তার চাহিদা খোঁজে? আমার এমন কোনোদিন লাগে নাই। আমি একলাই ভালা আছি এই বাড়ির সবার লগে।’
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে। রেণুর সংঙ্গায়িত করা ভালোবাসার সংঙ্গা বোঝার চেষ্টা করে সে। অনুধাবন করে, আসলে ভালোবাসার ব্যাখা একেকজনের কাছে একেক রকম। ভিন্ন, বিচিত্র সকল ব্যাখা; তবুও সকলে এক নামে যা বোঝে তা হলো ‘ভালোবাসা’।
‘আপা একটা কথা কই?’
রেণুর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পায় অর্ষা। প্রত্যুত্তরে বলে,’অবশ্যই।’
‘আপনে অনেক ভালা। সহজ-সরল।’
অর্ষা হাসে। রেণু বলে,’সত্যি কইতাছি। বড়ো ভাইজানরেও তো আমি অনেক বছর ধইরা দেখছি। হেয় একেবারে চুপচাপ স্বভাবের। ব্যথা পাইলে, কষ্ট পাইলেও কাউকে কইতে পারে না। হেয় যদি কাউরে কষ্ট দেয় তাইলে ঐ মানুষের চেয়ে নিজে বেশি কষ্ট পায়।’
‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘একদিন ভাইজান কিরিকেট (ক্রিকেট) খেইলা বাসায় আইছে। ঐদিনও অনেক গরম পড়ছিল। তার হাঁটুতে কেমনে জানি ব্যথা পাইছিল। রক্ত পড়তেছিল। তাও কাউরে কিছু কয় নাই। আমি জিগাইলাম, ‘ভাইজান পায়ে কী হইছে?’ ভাইজান কইল,’কিছু না। তুমি যাও এখান থেকে।’ আমি তাও জেরা করতেছিলাম। পরে রাগ হইয়া আমারে একটা ধমক দিছিল। নিজের রুমে গেছিল গা। আমি কিন্তু কিছু মনে করি নাই। পরেরদিন সকালে চা দিতে গেছিলাম তখন ডাইকা কয়,’রেণু আপা কিছু মনে কোরো না। কাল খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। স্যরি।’ আপনে যদি তহন তার মুখটা দেখতেন তাইলে বুঝতেন।’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নেয়। মানুষটা ভেতরে ভেতরে গ্লানিবোধ করে অথচ কষ্টও দেয়। হয়তো অনিচ্ছায় এমন করে ফেলে। এছাড়া ক’জনই বা পারে সবসময় নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে? চাপা স্বভাবের লোকগুলো সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও বোধ করি হঠাৎ আসা রাগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আহনাফও বোধ হয় তেমন-ই একজন মানুষ।
রেণু ফের বলল,’আসলে আপা সব-ই ভাগ্য। নইলে বিয়া ঠিক হইল একজনের লগে আর হইল আপনার লগে। সব-ই আল্লাহর ইচ্ছা। তয় এতটুকু কইতে পারি, স্বামী হিসাবে জীবন ভালা একটা মানুষ পাইছেন। এই বাড়ির দুই ভাইজান-ই হিরার টুকরা। একটুও বানাইয়া কইতাছি না। ছোডো ভাইজানরে তো আপনে ভালো কইরাই চিনেন। আস্তে আস্তে বড়ো ভাইজানরেও চিনতে পারবেন।’
অর্ষা বাঁকা হাসে। ঐ মানুষটাকে চেনার তো কোনো উপায়-ই নেই। এছাড়া কেন জানি সে কোনো আগ্রহও খুঁজে পায় না তাকে চেনার কিংবা বোঝার জন্য। কাগজে-কলমের মাধ্যমে একটা সম্পর্কে আটকা পড়লেই কি আগ্রহ, ইচ্ছে জন্ম নেয় নাকি? তারা দুজনই দু’মেরুর মানুষ। বর্তমানে আছেও দু’প্রান্তে। বহুদূর!
কারেন্ট এলো বিকেলের দিকে। দুপুরে একবার গোসল করেছিল অর্ষা। কারেন্ট আসার পর আবার গোসল করেছে। অল্পকিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালের ঘুমটা এখনো বাকি পড়ে আছে। ঘুম ভাঙে তার সন্ধ্যায়। জহির চৌধুরী সেই সময়ে বাড়ি ফেরেন। অর্ষা ঘুম থেকে উঠে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কীভাবে বাড়ির মানুষদের জানাবে সেটাই ভাবছিল। যদিও কথাটি সবার আগে তার আহনাফকে জানানো উচিত ছিল। যেহেতু কাগজে-কলমে সে তার স্বামী হয়। কিন্তু সে তো এখানে নেই। তার সাথে কোনো যোগাযোগও নেই অর্ষার। সূতরাং যা বলার জহির চৌধুরী এবং আমেনা বেগমকেই জানাতে হবে।
সে তাদের ঘরের দুয়ারে গিয়ে কড়া নেরে বলল,’আসব?’
ভেতর থেকে জহির চৌধুরী বললেন,’এসো।’
অর্ষা ভেতরে গিয়ে মাথা নত করে দাঁড়ায়। আসার পূর্বে সব কথা তো মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছিল। এখন তাহলে সব এমন গুলিয়ে যাচ্ছে কেন? নার্ভাসও লাগছে খুব!
‘কিছু বলবে?’ জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম।
জহির চৌধুরী বললেন,’বসো আগে। বসে বলো কী বলবে। এত নার্ভাস কেন হচ্ছ? বিনা সঙ্কোচে বলো কী বলবে।’
অভয় পেয়ে মনে একটু সাহস ফিরে পায় অর্ষা। না বসে দাঁড়িয়েই বলল,’আসলে কিছু কথা বলতে চাই। যদি কিছু মনে না করেন…. আসলে এভাবে বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে না। আমি তো একটা জব করতাম শো-রুমে। আপনারা যদি অনুমতি দিতেন তাহলে আমি আবারও ঐ জবটা করতে চাই।’
জহির চৌধুরী কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন,’ঐ চাকরীটাই লাগবে? নাকি সময় কাটানোর জন্য করতে চাচ্ছ?’
‘সময় কাটানোর জন্যই।’
‘বাড়ির বউদের দিয়ে কাজ করানোর বিষয়টা আমার পছন্দ নয়। তবে তোমার বিষয় আলাদা। এখনো অনেক শখ, স্বপ্ন তোমার বাকি আছে। আমি বাবা হয়ে সেগুলো পূরণ করব। তবে সময় কাটানোর জন্যই যখন চাকরী নিতে চাচ্ছ তখন আমি বলব, শো-রুমে চাকরী করার দরকার নেই। একটা কিন্ডারগার্ডেন টিচারের জব নিতে পারো। আমি সাহায্য করব। সমস্যা আছে?’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে বলল,’সমস্যা নেই।’
‘ঠিক আছে। দুটো দিন অপেক্ষা করো। আমি কাল-পরশু কথা বলে তোমাকে নিয়ে যাব।’
‘ধন্যবাদ আঙ্কেল।’
জহির চৌধুরী হেসে ফেলেন। তার হাসিতে আমেনা বেগমও হাসেন।
‘এখনো আঙ্কেল হই নাকি?’ হেসে হেসেই প্রশ্ন করলেন জহির চৌধুরী।
অর্ষা সলজ্জিত হেসে বলল,’আসলে অভ্যেস হয়ে গেছে তো!’
‘কিন্তু আমার যে আব্বু ডাক শুনতে ইচ্ছে করে। আফরিনটা বাসায় থাকে না তো! ভেবেছিলাম দু’ছেলের দু’বউ আসবে মানে আমার দু’মেয়ে আসবে। ওরা আমায় আব্বু বলে ডাকবে। কিন্তু এখন তো দেখছি বড়ো মেয়ে আঙ্কেলই ডাকছে!’
অর্ষা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। আমেনা বেগম বললেন,’আরে এখনো অনেক সময় আছে। আগেই এত উতলা হচ্ছ কেন? ও’কে একটু সময় দাও।’
‘মেয়ে বলে কথা! সময় তো দেওয়াই যায়। দিলাম। সন্ধ্যায় নাস্তা করেছ মা?’
মা ডাক শুনে অর্ষার ভেতরটা শান্তি অনুভব করল। সে সন্তুষ্টচিত্তে বলল,’না। একসাথে খাব।’
‘আচ্ছা সবকিছু রেডি করো। আমরা আসছি।’
‘জি, আচ্ছা।’ বলে অর্ষা চলে যায়।
জহির চৌধুরী দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে বলেন,’কবে যে দুজনকে একসাথে দেখব!’
_______
অফিস শেষ করে বাড়িতে ফিরেছে আহনাফ। সময় তো তার নিয়মমাফিক চলে যাচ্ছে। তবে প্রতিটা সময়ই তার বিরক্তের সাথে কাটে। মনে শান্তি পায় না। অস্থির লাগে। একটু শান্তির জন্য কত কিছুই না করে। তবুও কোথাও যেন কমতি রয়েই যায়। রয়ে যায় শান্তির অভাব।
আহনাফের সাথে আজ ওর কলিগ হেলেনও বাড়িতে এসেছে। সে বেশ চটপটে ও চঞ্চল স্বভাবের। বিদেশি হওয়ার দরুণ এমনিতেই ফরসা; যেমন তার উচ্চতা তেমন শরীরের গড়ন। দেখলে মনে হবে চকোলেট বয়। তার ২৮ বছরের জীবনে গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যাও অসংখ্য।
হেলেন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আশেপাশে চোখ বুলাল। সম্ভবত সে ক্যাথিওনকে খুঁজছে। কেননা এর পূর্বেও সে বাড়িতে এসেছে। তাই নতুন করে খুটিয়ে দেখার কিছু আছে বলে মনে হয় না।
গলার টাই ঢিলা করে, শার্টের হাতা গুটিয়ে আহনাফও পাশে বসল। তাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মনে যেখানে বিষাদ সেখানে শরীরে ক্লান্তি ভর করাটা অতি স্বাভাবিক।
হেলেন আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলল,’চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’
আহনাফ চোখ বন্ধ করে সোফায় শুয়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে সে ঘটনাটি হেলেনকেও শেয়ার করেছে। সবার মতো হেলেনও চিল মুডে বলেছিল,’প্যারা নেওয়ার কিছু নেই।’ আসলে পরিস্থিতি যার, সমস্যাও শুধু সে-ই উপলব্ধি করতে পারে।
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হেলেন আবার ডাকল,’হেই আহনাফ!’
আহনাফ এবার সোজা হয়ে বসল। গা ঝাড়া দিয়ে বলল,’না, বাইরে কোথাও যাব না। তুমি বসো, আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি।’
হেলেন আহনাফের হাত টেনে ধরে বলল,’এখানে কিছু খাব না। আজ বাইরে খাব। এজন্যই তো তোমার সাথে বাসায় এলাম। তোমার কোনো বারণ শুনব না। যাও রেডি হয়ে নাও।’
আহনাফ বেশ কয়েকবার প্রস্তাব নাকচ করার পরও হেলেন জেদ ধরে বসে আছে। অবশেষে আহনাফ যাওয়ার জন্য রাজি হয়। ফ্রেশ হয়ে দুজনে একত্রে বেরিয়ে পড়ে। হেলেন একটা বারে নিয়ে যায়।
আহনাফ সেখানে গিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,’এখানে কেন?’
‘আমার গার্লফ্রেন্ডের বার্থডে আজ। এখানে সেলিব্রেট করা হবে।’
আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,’তোমার তো গার্লফ্রেন্ডের অভাব নেই। কোনটার বার্থডে?’
হেলেন হেসে ফেলে। হাসলে গালে ডিম্পল পড়ে। তাই তার হাসির প্রেমেও পড়েছে অসংখ্য রমণী। সে ডিম্পলওয়ালা হাসি দিয়ে বলল,’কয় নাম্বার মনে নেই। তুমি বোধ হয় দেখোনি।’
‘ঠিক আছে। তুমি যাও। আমি এখানেই আছি।’
‘আমার সাথে এসো।’
‘না। হৈচৈ ভালো লাগে না। আমি এখানেই ঠিক আছি।’
‘শিওর?’
‘১০০% শিওর।’
‘ওকে। আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসব।’
হেলেন অন্যদিকে যাওয়ার পর আহনাফ একটা সফট্ ড্রিঙ্কস নিল। সফট্ মিউজিকের সাথে সফট্ ড্রিঙ্কস। দারুণ কম্বিনেশন! এরপর থেকে সে শুধু একবার নয় বরং প্রতিদিনই হেলেনের সাথে বারে আসে। ড্রিঙ্কস করে। আগের তুলনায় এখন সে একটু স্বস্তি পায়। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অনেক কিছু ভুলে থাকতে পারে। রাতে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেই শান্তি! ঘুম!
.
.
লামিয়া ও জুঁইয়ের বাড়ি ছাদ থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোর অব্দি ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারদিকে আলোকসজ্জা। চোখ মেলে তাকানোটাই দুষ্কর। জহির চৌধুরীর কথা মতো অর্ষা কিন্ডারগার্ডেনে জব নিয়েছে। বাচ্চাদের সাথে হেসে-খেলেই তার সময় কেটে যায়। বিয়ের প্রভাব, অথবা সেদিনের ঘটনা; কোনোটাই এখন তার জীবনে প্রভাব ফেলে না। সে এখন দিব্যি আছে। না আছে সাংসারিক চাপ আর না আছে স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তা করেই বা কী হবে? মানুষটা তো বহুদূর। তার চেনা এলাকায়। ভালোই আছে নিশ্চয়ই!
দুই বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে তিনদিন ছুটি নিয়েছে। একদিকে যেমন তার আনন্দ লাগছে অন্যদিকে কষ্টও লাগছে। বিয়ের পর কি ওদের আগের মতো করে আর পাওয়া যাবে? মন খারাপ ও আনন্দ এ দুইয়ের সংমিশ্রণ মনে মিলিয়ে সে আহিলের সাথে বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। অর্ষার মন খারাপ আহিলের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না।
সে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে,’মন খারাপ কেন তোর?’
‘এমনি ‘
‘এমনি?’
‘হু, এমনি।’
বাড়িতে ঢুকে আশিক আর দিদারকে একসাথে পাওয়া গেল। দুজনের দৃষ্টিই মেয়েদের একটা দলের দিকে। সম্ভবত দুজনে কিছু আলোচনা করছে।
অর্ষা এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে দুজনের গালে আস্তে চপেটাঘাত করল। আচানক এমন প্রহারে দুজনেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে। মেয়েদের দলটার দিকে তাকিয়ে দিদার চাপাস্বরে বলে,
‘মারধোর করবি ভালো কথা। প্রয়োজনে নিজে লাঠি কিনে দেবো। আড়ালে নিয়ে বেধড়ক পিটাবি। এভাবে মেয়েদের সামনে মারছিস কেন? একটা মান-ইজ্জতের বিষয় আছে না?’
আহিল বলল,’মান-ইজ্জত থাকলে এভাবে হা করে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?’
‘বন্ধু তুমি বুঝবা না
আমার মনের বেদনা,
চাইয়া একটু দেখো না;
কী সুন্দর ললনা।’
আশিকের কবিতা শুনে অর্ষা কপাল থাপরায়। আহিলকে বলে,’এই চিড়িয়াগুলোর সাথে তুই থাক। আমি জুঁই আর লামিয়ার কাছে গেলাম।’
লামিয়া এবং জুঁই একই এপার্টমেন্টে থাকে। বাড়ির সামনে থাকা বিশাল বড়ো মাঠের সামনে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। রিসিপশনের অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে। অর্ষা স্টেজের সামনে গিয়ে দেখে জুঁই আর লামিয়াকে দু’পাশে রেখে রেশমি মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। ফটোগ্রাফার একের পর এক ছবি ক্লিক করেই যাচ্ছে।
অর্ষাকে দেখে ওরা তিনজনেই উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে। শুধু ভারী লেহেঙ্গা পরে থাকায় জুঁই আর লামিয়া আসতে পারে না। রেশমি দৌঁড়ে আসতে গিয়ে একজন ফটোগ্রাফারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।
বেচারা ফটোগ্রাফার কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিৎ পটাং। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্ষা, লামিয়া আর জুঁই। কিন্তু রেশমির কোনো হেলদোল নেই এতে। সে দৌঁড়ে এসে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে। হড়বড় করে বলা শুরু করে,’এতক্ষণে তোর আসার সময় হলো? এতগুলা কাপলের মাঝে নিজেকে কত এতিম এতিম লাগছিল জানিস?’
অর্ষা হেসে বলল,’আর এতিম লাগবে না। চলে এসেছি।’
এরমাঝে বাকি মেয়েদের ‘বর এসেছে, বর এসেছে’ ধ্বনিতে হৈ-হুল্লোড় করতে শোনা যায়। অর্ষা আর রেশমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দৌঁড়ে গেইটের কাছে যায়। ওদের পূর্বেই মেয়েরা গেইট ধরে রেখেছিল।
গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে গিয়ে মিলিত হলো বাকিদের সাথে। শুরু হয় দু’পক্ষের দর কষাকষি। তুমুল তর্ক চলছে দু’পক্ষের মাঝে। আশিকের সাথে বরপক্ষের এক মেয়ের বেশ কথা কাটাকাটি হচ্ছে। এক পর্যায়ে হুট করে আশিক থেমে যায়। ভালো করে তাকিয়ে রেশমির কানে কানে বলে,’দোস্ত দেখ, মেয়েটা সুন্দর না?’
রেশমি তখন চাঁদার টাকা তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আশিকের কথা শোনার মতো সময় নেই তার। আশিক নিজেই এবার সবার হট্টগোল থামিয়ে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
‘শোনো সুন্দরী, অপরূপা
যদি আমায় দাও তোমার দিল,
তোমার পক্ষ থেকে মিটিয়ে দেবো আমি সকল বিল।’
ওর কবিতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে অর্ষা ও রেশমি দু’পাশ থেকে দুজনে আশিকের দু’গালে থা’প্পড় বসায়। পুরো পরিবেশ এখন থমথমে। বরপক্ষের মেয়েরা মিটমিট করে হাসছে। আশিকের অভিমান হয়। অর্ষা কিংবা রেশমির ওপর নয়; অভিমান হচ্ছে ঐ মেয়েটির জন্য। তাকে দরদ দেখাতে গিয়ে সে নিজে বান্ধবীদের হাতে থা’প্পড় খেল, অথচ মেয়েটি কষ্ট না পেয়ে মুখ টিপে হাসছে! আচ্ছা কষ্ট না পাক, একটু দুঃখী দুঃখী ভান তো করাই যেত। তাই নয় কী?
মেয়েটি দুঃখী না হলেও আশিক মুখটা দুঃখী দুঃখী করে বলল,
‘যার জন্য করলাম চুরি
সে-ই বলল চোর,
আমি আর কিছু বলব না;
অর্ষা, রেশমি তোরা সবাই বরপক্ষকে ধর।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]