#যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ২৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
‘তুমি আমার ওয়েট জানতে চাচ্ছ কেন? আমায় অপমান করছ তুমি?’ তিরিক্ষি মেজাজে পালটা প্রশ্ন করল আহনাফ। এরপর সে উঠে দাঁড়াল।
অর্ষাও সোজা হয়ে বসে বলল,’ওয়েট জানতে চাওয়া মানে কি অপমান করা?’
‘এই সিচুয়েশনে জানতে চাওয়া অবশ্যই অপমান করা। এন্ড লিসেন, ইট ওয়াজ অ্যান এক্সিডেন্ট। মোরওভার, নাথিং এলস্।’
অর্ষা নাকমুখ কুঁচকে বলে,’তো আমি কখন বললাম অন্য কিছু? একেই বলে চোরের মন পু্লিশ পুলিশ।’
‘কী বললে তুমি?’
‘কিছু না।’
‘কিছু তো অবশ্যই। কী বলতে চাচ্ছ ক্লিয়ার করে বলো।’
‘ছোটো বেলায় যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়তাম। তখন অঙ্ক ক্লাসে এক ছেলে বই দেখে অংঙ্কের সমাধান করেছিল। যাকে বলে চুরি করা। স্যারকে খাতা দিয়ে বলেছিল, ‘স্যার আমি কিন্তু দেখে লিখি নাই।’ তখন স্যার বলল,’ঠাকুর ঘরে কে রে? ঠাকুর থেকে উত্তর এলো, কলা তো আমি খাইনি।’ আপনি যদি বুদ্ধিমান হয়ে থাকেন, তাহলে আমার কথার সারমর্ম বুঝতে পারবেন। এখন সরুন, ঘুমাব।’
অর্ষা গিয়ে শুয়ে পড়ে। আহনাফ রাগে গজরাতে গজরাতে বলে,’তোমার ধারণা মোটেও ঠিক নয়।’
‘আচ্ছা।’ অর্ষা আর কথা বাড়াল না।
এদিকে রাগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না আহনাফের। অর্ষা কী ভাবল? সে কি ইচ্ছে করে পড়েছে নাকি? ওর কি চোখ নাই? দেখেনি ক্যাথির জন্যই তো… এবার আহনাফের ধ্যান ও রাগ সব গিয়ে পড়ল ক্যাথিওনের ওপর।
সে দাঁত কিড়মিড় করে ক্যাথির দিকে তাকিয়ে বলল,’বেয়া’দব তোর জন্য এখন আমাকে উলটা-পালটা কথা শুনতে হচ্ছে।’
ক্যাথিওন অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। ওর এই দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে, শক্ত হাতে বগলদাবা করে লিলিয়ার রুমে দিয়ে এলো আহনাফ। ঘরে ফিরে এসে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে নিজের উপস্থিতি এবং রাগের কথা অর্ষাকে জানান দিলো। অর্ষার অবশ্য এতে কোনো হেলদোল নেই। সে অলরেডি ঘুমিয়েও পড়েছে। লাইট নিভিয়ে আহনাফও গিয়ে নিঃশব্দে পাশে শুয়ে পড়ল। মাঝখানে বর্ডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আহনাফের আদরের কোলবালিশকে। কোলবালিশ যে জড়িয়ে ধরবে তারও কোনো উপায় নেই। পরে যদি কোনোভাবে অর্ষার গায়ে স্পর্শ লাগে, তাহলে নির্ঘাত মেয়েটা তাকে ক্যারেক্টারলেস ভেবে বসবে।
____
সকালে অর্ষার আগে আহনাফের ঘুম ভাঙে। এলার্ম বন্ধ করে ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। গোসল করে ফিরে এসে দেখে অর্ষা তখনো ঘুমাচ্ছে। হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আলমারির কাবার্ড থেকে জামা-কাপড় বের করে তৈরি হয়ে নেয়। বডিস্প্রে করার সময় আয়নায় চোখ যায় অর্ষার দিকে। তখনই গতকাল অর্ষার বলা ‘আপনার ওয়েট কত’ কথাটি মনে পড়ে যায়।
তখন সে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখে স্বগতোক্তি করে,’আমি কি মোটা হয়ে গেছি এই ক’দিনে? কই না তো! ফিট-ই তো মনে হচ্ছে। নাকি একটু মোটা সত্যিই হয়েছি? হলেও হতে পারি। অনেকদিন তো হলো শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়া হয় না।’
সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,’ধুর! কী যা তা ভাবছি। ধ্যাত!’
সে নাস্তা করতে চলে যায়। লিলিয়ার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,’স্মিথ কোথায়?’
‘ও তো ঘরে।’ লিলিয়ার উত্তর।
‘আসতে বলো। নাস্তা করে ও’কে স্কুলে ড্রপ করে দেবো।’
‘আচ্ছা।’ বলে লিলিয়া স্মিথকে ডাকতে চলে যায়।
স্মিথ যখন এলো তখন ওর সাথে সাথে নতুন বিড়ালটাও এসেছে। ক্যাথি অনুপস্থিত এখানে।
আহনাফ স্মিথকে চেয়ার দেখিয়ে বলল,’বসো এখানে।’
স্মিথ বসার পর ওর পা ঘেঁষে বসেছে নতুন বিড়ালটি। আহনাফ হেসে বলল,’আরে বাহ্! এক রাতেই দেখি ও তোমার ভক্ত হয়ে গেছে।’
উত্তরে স্মিথ শুধু হালকা হাসল। এই ছেলে চুপচাপ স্বভাবের। কথা কম বলে। রুটিতে কামড় বসিয়ে আহনাফ বলল,’ওর নাম রেখেছ?’
স্মিথকে এবার উৎসাহিত দেখাল। সে অতি উৎসাহে বলল,’না, ব্রো। তুমি রাখো।’
তখন চট করেই আহনাফের মাথায় ‘অ্যানিওন’ নামটা এলো। সে বলল,’ওকে। ক্যাথিওনের নামের সাথে মিলিয়ে অ্যানিওন রাখলে কেমন হয়?’
‘ভালো হয়।’
‘বেশ। তাহলে আজ থেকে ওর নাম অ্যানিওন।’
‘আচ্ছা।’
‘ক্যাথি কোথায়?’
‘তোমার রুমে।’
আহনাফ বাম হাতে নিজের কপাল চাপড়ে বলল,’হায় আল্লাহ্! ও আবার অর্ষার কাছে গেছে।’
স্মিথ মুচকি হেসে বলল,’আমার মনে হয়, ক্যাথিওন আপুকে অনেক পছন্দ করে।’
আহনাফও মুচকি হেসে বলল,’হতে পারে।’
ওদের খাওয়া শেষ হওয়ার পূর্বেই অর্ষা বিরক্তমুখে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এখনো যে ঘুম ছাড়েনি সেটা ওর দু’চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে সে স্মিথের পাশের চেয়ারে বসল। চোখে ঘুম থাকায় অ্যানিওনকে খেয়াল করেনি। কিন্তু তৎক্ষণাৎ অর্ষা আসার পর অ্যানিওন দৌঁড়ে লিলিয়ার রুমে চলে গেল। যাওয়ার সময় অর্ষা ও’কে দেখতে পায়। ঘুম ছুটে যায় তার।
অবাক হয়ে জানতে চাইল,’এটা কী হলো? আমি আসার পর এই বিড়ালটা দৌঁড়ে চলে গেল কেন?’
আহনাফ কাঁধ উঁচিয়ে বলল,’কী জানি!’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’হায়রে কপাল! একজন পিছুই ছাড়ে না আর অন্যজন দেখলেই পালায়।’
‘তোমার তো ঘুম শেষ হয়নি মনে হচ্ছে। উঠলে কেন?’
‘আবার কেন? আপনার সাধের বিড়ালের জন্য।’
‘ক্যাথি? কী করেছে আবার?’
‘কী আর করবে! ঘরে গিয়ে তার ম্যাউ ম্যাউ শুরু। চিৎকারের জন্য ঘুমানোর উপায় আছে নাকি।’
মাথায় হাত দিয়ে বসে কথা বলছিল অর্ষা। এবার সে সোজা হয়ে বসে আহনাফের উদ্দেশ্যে বলে,’আচ্ছা আপনার বিড়ালটা সবসময় আমার পিছে পিছে ঘুরে কেন?’
আহনাফ বিরক্ত হয়ে বলে,’তুমি আসার আগে থেকে ক্যাথিওন এই বাড়িতে থাকে। তোমার থেকে ওর অগ্রাধিকার অনেক বেশি। ও কোথায় যাবে, কোথায় ঘুমাবে কার পিছে ঘুরবে এটা একান্তই ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
‘আশ্চর্য! বিড়ালেরও আবার ব্যক্তিগত বিষয় হয়?’
‘হ্যাঁ, হয়। আর খামোখা কখনো ওর ভয়ে চেঁচাবে না এভাবে। ক্যাথিওন বাঘ কিংবা ভাল্লুক নয় যে তোমাকে গিলে খাবে।’
‘বাঘ, ভাল্লুকও যদি পালতেন এরচেয়ে ঢের ভালো ছিল। এক থাবাতেই পেটের ভেতর চলে যেতাম। কষ্ট, ভয় যা পাওয়ার একেবারেই পেতাম। কিন্তু আপনার ক্যাথিওন তো প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে আমায় ভয় দেখাচ্ছে।’
আহনাফ বিড়বিড় করে বলে,’ভীতুর ডিম।’
এরপর সে স্মিথের উদ্দেশ্যে বলল,’তোমার হয়েছে?’
স্মিথ মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ।’
‘যাও ব্যাগ নিয়ে আসো। আমি আসছি।’
স্মিথ চলে যাওয়ার পর আহনাফ অর্ষাকে বলল,’ঘরে আসো একটু।’
অর্ষা হেলতে-দুলতে ঘরে যায়।
জিজ্ঞেস করে,’ঘরে ডাকলেন কেন?’
‘এই নাও কিছু সুইস ফ্রাঙ্ক রাখো। বাইরে গেলে কাজে লাগবে।’
বোকার মতো প্রশ্ন করে অর্ষা,’সুইস ফ্রাঙ্ক কী?’
‘সুইজারল্যান্ডের মুদ্রাকে সুইস ফ্রাঙ্ক বলে। আমরা যেমন বাংলাদেশে টাকা বলি।’
‘ওহ। আমার লাগবে না।’
‘কেন?’
‘এমনি। তাছাড়া আমি তো বাইরে যাই না। এখানকার কিছু চিনিও না। কোথায় যাব একা?’
আহনাফ একটুখানি সময় চুপ থেকে কী যেন ভাবল। এরপর বলল,’আচ্ছা তাও রাখো। আমি সময় পেয়ে তোমায় ঘুরতে নিয়ে যাব।’
অর্ষা অবিশ্বাস্যকণ্ঠে বলল,’আপনি?’
‘আর কেউ আছে তোমার?’
অর্ষা থতমত খেয়ে বলল,’মানে?’
‘আসছি আমি।’
আহনাফ চলে যাওয়ার পরও অর্ষা বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ক্যাথিওনকে আবারও সে নিজের রুমে আসতে দেখতে পায়। বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয় সে।
নিজের নাস্তাগুলো একটা প্লেটে নিতে নিতে লিলিয়াকে বলল,’আন্টি আমি খাবার নিয়ে ঘরে যাচ্ছি। আপনি ক্যাথিওনকে বাইরে আনেন তো।’
অর্ষার যে বিড়াল ভীতি রয়েছে সেটা আহনাফ তাকে জানিয়েছিল। তাই সে মুচকি হেসে বলল,’আচ্ছা।’
খাবার নিয়ে রুমে যায় অর্ষা। গেইট লক করে লম্বা শ্বাস নেয়। ভেঙে যাওয়া ঘুমটা আর আসবে না। তাই ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। খেতে খেতে কী করবে ভেবে না পেয়ে বন্ধুদের গ্রুপে কল করে। সবার আগে কলে জয়েন হয় আহিল।
আহিল-ই প্রথম কথা বলে,’কী অবস্থা? কেমন আছিস?’
অর্ষা ক্ষীণস্বরে বলল,’ভালো। তুই কেমন আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্। কী করছিস?’
‘নাস্তা করি। তুই?’
‘আমিও।’
‘আঙ্কেল-আন্টি, রেণু আপা কেমন আছে?’
‘সবাই ভালো আছে।’
‘ঐ, ঐ আমারে একটু সাইড দে।’ কলে জয়েন হয়ে বলল লামিয়া।
ততক্ষণে আশিক, দিদার আর রেশমিও জয়েন হয়েছে। শুধু জুই নেই।
আশিক তখন বলল,’লামিয়া আর আশিক তোরা কালকে অফলাইনে ছিলি ক্যান? কাহিনি কী মামা?’
আহিল হেসে বলে,’কাহিনি কিছুই না মামা। লামিয়া বিয়াইত্তা মহিলা ওর সাথে কি আমার কাহিনি হবে?’
লামিয়াও দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’এই আশিক বান্দরডারে কেউ থামা। হুদ্দাই খালি ফাউ কথা কইব।’
‘ওর কাম-ই তো এইডা।’ বলল রেশমি।
অর্ষা বলল,’দিদার চুপ করে আছিস কেন?’
‘আমি ভাই সকাল সকাল এনার্জি নষ্ট করতে চাইতেছি না। তোরা ঝগড়া কর। আমি একটু শান্তিতে খাই।’ খেতে খেতেই বলল দিদার।
‘ভাইরে তুই খাওয়া ছাড়া আর কিছু বুঝিস না?’
‘না আফা। দুনিয়াতে খাওনের আর হাগনের মতো শান্তি আর কিস্সুতে নাই বুঝছিস মনু?’
সকলে দাঁতমুখ খিঁচে বলল,’খাচ্চোর। খাওয়ার সময়েও কী সব বলে!’
‘মামা হাছা কথা কইতে আবার সময়-অসময় কী?’
আহিল বলল,’না ভাই, কোনো সময়-অসময় লাগব না। তুই মুখ অফ রাইখা চুপচাপ খা। আর আমাদের শান্তিমতো খাইতে দে।’
‘অহ। তোরাও খাইতেছিস?’
আহিল বলল,’অনেকেই নাস্তা করতেছি।’
‘আচ্ছা খা। আমিও গিলি।’
আশিক আড়মোড়া ভেঙে বলল,’কীরে আজকে কুইকুই নাই?’
‘কার কথা বলিস? জুঁই?’ প্রশ্ন করল রেশমি।
‘আর কে তাহলে? ঐ একখানই তো কুইকুই আছে আমাদের।’
‘ঘুমায় মনে হয়। নয়তো রানতাছে দেখগা।’
লামিয়া বলল,’ঐ অর্ষা ভার্সিটিতে কোথায় পড়বি? বিডিতে আসবি না?’
আশিক বলল,’ঠিক কথা। ভালো প্রশ্ন করছিস। আমরা কিন্তু সবাই এক ভার্সিটিতে ভর্তি হমু।’
অর্ষা বলল,’আগে তো রেজাল্ট দেক।’
‘রেজাল্ট তো দেবেই। কিন্তু তোর কী ইচ্ছা শুনি?’
‘আমার আবার কী ইচ্ছা হবে? জানিনা এখনো কিছু।’
রেশমি মনমরা হয়ে বলল,’আমাদের মনে হয় ভার্সিটিতে একসাথে পড়া হবে না রে।’
দিদারের খাওয়া শেষ। সে কলে ফিরে আসে আবার। বন্ধুদের জানায়,’রেজাল্টের পর রাজশাহীতে চলে যাব রে।’
‘ওখানে কেন?’ জানতে চায় আহিল।
‘ফুল ফ্যামিলিসহ যাব। বাকি পড়াশোনা ওখানেই।’
‘পড়াশোনা না ছাই। তুই তো যাবি রাজশাহীর আম আর লিচু খাওয়ার লোভে।’ বলল লামিয়া
সবাই হেসে ফেলে। দিদারও হেসে বলে,’আমি তো খাব-ই। তোদের জন্যও পাঠাব। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানিস, তোদের মতো বন্ধু আমি আর কখনোই পাব না। তোদের ছাড়া যে কী করে থাকব কে জানে!’
সবার-ই মনটা খারাপ হয়ে যায় এবার। আসলে বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো এমনই। একটা সময়ে প্রত্যেককে নিজের ক্যারিয়ার কিংবা ব্যস্ততার কাছে হার মানতে হয়। চাইলেই যখন তখন দেখা করা যায় না। রাস্তার মোড়ে টং দোকানে চায়ের আড্ডা দেওয়া যায় না। চাইলেই একসাথে ভেজা যায় না ঝুমবৃষ্টিতে। জীবনের এই গতিধারাকে মানতে কষ্ট হয় তবুও আমাদের মেনে নিতে। মনে নিতে নয়। সকলের বুক ভারী হয়ে আসে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে প্রলম্বিত শ্বাস। মনের ভেতর চলছে কালবৈশাখীর ঝড়। এমন বিচ্ছেদ মেনে নেওয়া দুষ্কর, কষ্টদায়ক।
আহিল সকলের উদ্দেশ্যে বলে,’সবাই এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? এক ভার্সিটিতে না পড়লে কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে? শুরুতে আমাদের বন্ধুত্ব যেমন ছিল। জীবনের শেষ পর্যন্ত তেমন-ই থাকবে ইন-শা-আল্লাহ্। উদাহরণ হিসেবে অর্ষাকে দেখ। অর্ষা আমাদের থেকে কত্ত দূরে! সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশে। চাইলেই ও আমাদের কাছে আসতে পারবে না যখন-তখন। আমরাও ইচ্ছা হলে যখন-তখন যেতে পারব না। এতে কি অর্ষার প্রতি থেকে আমাদের বন্ধুত্বের টান কমে গেছে? নাকি অর্ষার আমাদের প্রতি থেকে টান কমে গেছে? আমাদের কিন্তু নিয়ম করে একবার হলেও প্রতিদিন ফোনে কথা হচ্ছে। ভিডিয়ো কলে একে-অপরকে দেখতে পাচ্ছি। এটাই বা কম কী বল? এই প্রাপ্তিটুকুও তো অনেক। বাস্তবতা তো উপেক্ষা আমরা করতে পারব না। এটলিস্ট বছরে একবার হলেও তো আমাদের দেখা হবে? সেই দিনটাকে আমরা স্মৃতিমধুর করে রাখব। সেই একটা দিনকেই আমরা এমনভাবে উপভোগ করব যাতে বাকি ৩৬৪ দিন একটা দিনের স্মৃতিকে মনে পুঁজি করে কাটাতে পারি সবাই।’
জুঁই কলে জয়েন হয়ে আহিলের কথা শুনে চুপ করে ছিল। সকলে ইমোশোনাল হয়ে পড়ে। জুঁই তো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করে,’আমাদের গ্যাঞ্জাম পার্টি যেন সবসময় এমনই থাকে দোস্ত।’
‘গ্যাঞ্জাম পার্টি শুধু একটা দল-ই নয়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। আমরা একসাথে ছিলাম, আছি আর থাকব।’ বলল অর্ষা।
লামিয়া তখন আবদার করে বলল,’মনটা ভীষণ খারাপ রে বোকারানী। বন্ধু নিয়ে গানটা শুনিয়ে দে তো।’
সকলে লামিয়ার সাথে সহমত পোষণ করে। অর্ষা বলে,’গাইতে পারি। যদিও তোরা আমার সাথে তাল মেলাস।’
আশিক বলে,’অবশ্যই। তাল মেলাতে মেলাতে মাতাল হয়ে যাব। তুই শুরু কর।’
অর্ষা গান শুরু করে। বাকিরাও সাথে তাল মেলায়। মুহূর্তেই মন খারাপ উড়ে গিয়ে ঝলমলে রোদের মতো আনন্দেও মনটা ঝলমল করে ওঠে সকলের। কিছু বন্ধুত্ব এমনই থাকুক। আজীবন।
__________
দুপুরের দিকে লিলিয়ার ফোনে কল আসে। তারপর থেকেই তাকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছিল। ফোনে কথা বলা শেষ হলে অর্ষা জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
লিলিয়া অস্থিরচিত্তে বলে,’আমার ছোটো বোন প্রেগন্যান্ট। খুব অসুস্থ হয়ে গেছে হঠাৎ করে। হাসপাতালে ভর্তি এখন।’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। ইন-শা-আল্লাহ্ তার কিছু হবে না। আর সময় থাকতে আপনিও বেরিয়ে পড়ুন।’
তিনি ইতস্তত করে বললেন,’আমি চলে গেলে তুমি থাকবে কী করে?’
‘আমার কথা ভাবতে হবে না। আমি থাকতে পারব। আর সে তো রাতে চলেই আসবে। আপনার বোন কোথায় থাকে?’
‘বার্ন সিটিতে।’
‘ওহ। তাহলে আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন। যাওয়ার পথে না হয় স্মিথকে সাথে করে নিয়ে যাবেন।’
‘তুমি কি শিওর থাকতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, পারব।’
লিলিয়া তৈরি হতে চলে যায়। এই সময়ে ছোটো বোনের পাশে না থাকতে পারলে সেও স্বস্তি পেত না। ঘরে গিয়ে আহনাফকেও সে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। আহনাফও বারণ করেনি।
যাওয়ার পূর্বে তিনি অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’সাবধানে থাকবে তুমি। আর বিড়াল দুটোকে আমার ঘরে রেখেছি। ভয় পেও না।’
অর্ষা স্মিত হেসে বলল,’সাবধানে যাবেন।’
লিলিয়া চলে যাওয়ার পর অর্ষা গেইট লাগিয়ে রুমে ফিরে এলো। কী করবে ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখল। টিভি দেখতেও তার ভালো লাগছিল না। তাই বুকশেলফ থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে। বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুম চলে এসেছে আর সে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায়নি।
.
.
আকাশের অবস্থা ভালো নয়। চারদিকে ঘুটঘুটে কালো মেঘের প্রভাব। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অর্ষা বাড়িতে একা। সূতরাং তাকে আহনাফকে আগেই বাসায় ফিরতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতের কাজগুলো শেষ করে নিল। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে হেলেন কল করেছিল বারে যাওয়ার জন্য। আহনাফ নাকচ করে দিয়েছে। এজন্য অবশ্য হেলেন অর্ষাকে জড়িয়ে মজা নিতেও সময় বিলম্ব করেনি।
আহনাফ যখন অফিস থেকে বের হয় তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। এরপর বৃষ্টি জোরে পড়তে শুরু করে। যেখানে সে তাড়াতাড়ি আসার জন্য চেষ্টা করছিল সেখানেই তাকে সমস্যায় পড়তে হয়। মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। গাড়ি সারাতে হয় তাকে বৃষ্টিতে ভিজেপুড়ে। বাড়ি ফিরতে আধ ঘণ্টা লেট হয়ে যায়।
বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে বাড়িতে পৌঁছায় সে। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় অর্ষা। আহনাফকে দেখে রীতিমতো চমকে ওঠে।
দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলে,’একি! ভিজে এসেছেন কেন?’
আহনাফ ভেতরে ঢুকে বলল,’শখে।’
অর্ষা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আহনাফ সত্যিই শখ করে ভিজেছে নাকি বুঝতে পারছে না। সে আহনাফের পিছু পিছু রুমে ঢোকে। আহনাফ সোজা ওয়াশরুমে চলে গেছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ষাকে বলল,’আলমারি থেকে একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার দিয়ে যাও।’
মেরুন রঙের হাফ স্লিভের একটা টি-শার্ট আর অ্যাশ কালারের ট্রাউজার নিয়ে অর্ষা ওয়াশরুমের কাছে গেল। আহনাফ জামা-কাপড় নিয়ে ফোন আর ওয়ালেট অর্ষার হাতে দিলো।
অর্ষা সেগুলো বেড সাইড টেবিলের ওপর রেখে চা বানাতে যায়। আহনাফের গোসল শেষ হতে হতে চা বানানোও হয়ে যায়।
অর্ষা চা নিয়ে আসায় আহনাফ মৃদু হেসে বলে,’থ্যাঙ্কিউ। এটার খুব প্রয়োজন ছিল এখন।’
অর্ষা খেয়াল করল, আহনাফের দু’চোখ অস্বাভাবিক রকমের লাল হয়ে আছে। সে আঁৎকে উঠে বলল,’আপনার চোখ দুটো ভীষণ লাল হয়ে গেছে।’
‘বৃষ্টিতে ভিজলে এমন হয়।’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল আহনাফ।
‘আপনি বৃষ্টিতে ভেজেন না তাহলে?’
‘ইচ্ছাকৃত কখনো ভিজি না। আজ মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়েছিল তাই এই অবস্থা।’
‘মনে হচ্ছে জ্বর আসবে।’
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটি টেবিলের ওপর রাখল আহনাফ। মাথা দুলিয়ে বলল,’আসতে পারে। আমি এখন একটা নাপা খেয়ে শুয়ে পড়ব। রাতে আর না-ও উঠতে পারি। তুমি খেয়ে নিও।’
অর্ষা কিছু বলল না। শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফ সত্যি সত্যি ট্যাবলেট খেয়ে ব্লাঙ্কেট গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। অর্ষা করার মতো কিছু না পেয়ে আবার বই নিয়ে বসে পড়ে।
ঘড়ির কাটায় ন’টা বাজে। বই পড়তেও এখন বোর হয়ে গেছে অর্ষা। উঁকি দিয়ে একবার আহনাফের দিকে তাকাল। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হাত বাড়িয়ে একবার দেখবে কিনা গায়ের তাপমাত্রা কেমন? বুঝতে পারছে না, কাজটা ঠিক হবে কিনা। পরক্ষণে মনে হলো এখানে বেঠিকের-ই বা কী আছে? সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরে ছুঁড়ে ফেলে। ডান হাতটি রাখে আহনাফের গায়ে। আশ্চর্য! জ্বরে শরীর তো পুড়ে যাচ্ছে। লিলিয়াও বাসায় নেই। কী করবে সে এখন?
দিকদিশা ভুলে গিয়ে সে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ভাবল আমেনা বেগমকে একবার ফোন করবে। পরবর্তীতে মনে হলো, মায়ের মন! উনি চিন্তায় পড়ে যাবে। তাই সে আহিলকে ফোন দিয়ে আহনাফের জ্বর হওয়ার কথা জানাল।
আহিল সব শুনে বলল,’তুই চিন্তা করিস না। ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজলে এমন জ্বর আসে। যতগুলো ওষুধ আছে সবগুলোর ছবি তুলে আমাকে পাঠাবি এখনই। কোনটা জ্বরের ওষুধ আমি বলে দিচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’
‘আর শোন, ভাইয়ার জ্বর কিন্তু সহজে ছাড়ে না। মাথায় পানি দিস।’
‘আচ্ছা।’
‘ওষুধ খাওয়ানোর আগে কিছু খাইয়ে দিস মনে করে। খালি পেটে ওষুধ খাওয়াইস না আবার।’
‘আচ্ছা।’
আহিল এবার চুপ মেরে যায়। কয়েক সেকেন্ড মৌন থেকে বলে,’সব কথায় আচ্ছা আচ্ছা বলছিস কেন? নার্ভাস তুই?’
‘আহিল! আমার না ভীষণ ভয় করছে।’
‘ধুর পাগলী! ভয় নেই। কারেন্ট আছে তো?’
‘আছে।’
‘মোমবাতি, ম্যাচ এসব কাছেই রাখিস। ভয় পাবি না। কিছু হবে না।’
‘আচ্ছা।’
‘এখন তোকে যা বললাম তাই কর।’
অর্ষা ছবি তুলে আহিলকে পাঠিয়ে রান্নাঘরে গেল খাবার গরম করতে। তখন মনে পড়ল, বিড়াল দুটোকেও তো খাবার দেওয়া হয়নি। সেই যে দুপুরে লিলিয়া শুধু খাইয়ে গিয়েছিল। ওদের-ও নিশ্চয়ই অনেক ক্ষুধা লেগেছে! সে অনেকটা সাহস সঞ্চয় করল। সে যদি এখন মনে না সাহস আনতে পারে, তাহলে বিড়াল দুটোকেও না খেয়ে থাকতে হবে।
খাবার গরম করা শেষ হলে বিড়ালের আলাদা খাবার আছে সেগুলো দুটো বাটিতে বেড়ে নিল। এরপর ভয়ে ভয়ে রুমের দরজা খুলল। বিড়াল দুটো মেঝেতে শুয়ে ছিল। অর্ষাকে দেখে মাথা উঁচু করে একবার তাকাল শুধু। একটা শব্দও করল না। খাবার রেখে জলদি ফিরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় অর্ষা। মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন।
ঘরে ফিরে আহনাফের বাহু ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,’এইযে শুনছেন?’
আহনাফ নিরুত্তর।
অর্ষা বলল,’শুনুন না? উঠুন। কিছু খেয়ে নিন।’
আহনাফ জড়ানো কণ্ঠে বলল,’চুপ।’
‘আচ্ছা আমি চুপ করব। আপনি খেয়ে নিন।’
আহনাফ আবারও জড়ানো কণ্ঠে বলল,’আমার ভালো লাগছে না। মাথা ব্যথা করছে।’
‘খাবার খেয়ে ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘খাব না কিছু। তুমি কে? চলে যাও।’
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,’অ্যা! আমি কে মানে?’
পরে আবার নিজেই মাথা নাড়িয়ে বলে,’জ্বরে প্রলাপ বকছে নিশ্চয়ই।’
সে অনেক কষ্টে আহনাফকে ধরে আধশোয়া অবস্থায় বসায়। লাজ-লজ্জাকে এক সাইডে রেখে মনকে স্থির করল, সামনের মানুষটি শুধু তার স্বামী-ই নয় বরং সে এখন অসুস্থও। তার সেবা করা অর্ষার দায়িত্ব ও কর্তব্য উভয়ই। তাই সে নিজের হাতেই আহনাফকে খাইয়ে দিলো। বেশি খাওয়াতে পারেনি অবশ্য। বহু কষ্টে দু’লোকমা ভাত শুধু খাওয়াতে পেরেছে। এরপর আহিলের বলে দেওয়া ওষুধ খাইয়ে আবার শুইয়ে দিয়েছে।
মাথার নিচে বড়ো একটা পলিথিন রেখে বালতি ভরে পানি নিয়ে আসে। পাশে বসে মিনিট বিশেক মাথায় পানি দিয়ে দেয়। এক হাত দিয়ে মগে পানি নিয়ে ঢালছিল আর অন্য হাতে আহনাফের মাথায় চুলের মাঝে বিলি কাটছিল যাতে পানি চুলের ভেতর অব্দি পৌঁছায়। হঠাৎ আহনাফ অর্ষার হাত ধরে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে,’উঁহু! আর না।’
অর্ষা শুনল তার কথা। পলিসহ বালতি ওয়াশরুমে রেখে আহনাফকে সোজা করে শুইয়ে দিলো। ঘরের লাইট নিভিয়ে সেও আহনাফের পাশে শুয়ে পড়ে। বরাবরের মতো আজও দুজনের মাঝে কোলবালিশ রয়েছে। একটু পর পর আহনাফের কপালে হাত রেখে দেখছে, জ্বর আবার বেড়েছে কিনা। আজ আর অর্ষার ঘুম ঠিকমতো হবে না বোঝা যাচ্ছে। আকস্মিক কোলবালিশ সরিয়ে অর্ষার গায়ে হাত রাখে আহনাফ। তার উত্তপ্ত হাত অর্ষার শীতল হাতের ওপর পড়তেই অর্ষা চমকে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় ঘুমন্ত আহনাফের দিকে। এরপর আস্তে-ধীরে হাতটি ধরে সরাতে যাবে, উলটো আহনাফ তখন অর্ষার হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যায় অর্ষা। আহনাফের শরীরের উত্তপ্ত উত্তাপ শুষে নিচ্ছে অর্ষার শীতল গাত্র। বাইরের রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ এখন আর সে শুনতে পাচ্ছে না। এখন শুধু শুনতে পাচ্ছে আহনাফের বুকের ভেতর হওয়া ঢিপঢিপ শব্দ।
চলবে…
ভালোবাসা রইলো …