#যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ২৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
কিছু অনুভূতি হয় মেঘের মতো। যখন মেঘগুলো সাদা মেঘের ন্যায় নীল আকাশের বুকে বিচরণ করে, তখন সেই দৃশ্য যতটা দৃষ্টিনন্দিত লাগে, ঠিক ততটাই শীতল মনোমুগ্ধকর লাগে যখন মেঘগুলো কালো হয়ে আকাশে বিচরণ করে। মুহূর্তের মধ্যেই ফের বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। শীতল করে তোলে উত্তপ্ত পৃথিবী। অর্ষার অবস্থান এখন সেরকম মেঘ ও বৃষ্টির মতো। অপরদিকে গনগনে উত্তপ্ত ধরণী হচ্ছে আহনাফ। যে এখন অর্ষার সংস্পর্শে এসে নিজেকেও শীতল করে নিচ্ছে।
জ্বরে ঘোরের মাত্রা বাড়ে। সেই সঙ্গে শুরু হয় আহনাফের প্রলাপ। জড়ানো কণ্ঠে সে মৃদুস্বরে ডাকে,’শোনো!’
অর্ষা শোনে তবে প্রত্যুত্তর করে না। বলা বাহুল্য, সে প্রত্যুত্তর করতে পারছে না। মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি শক্ত হাতে তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। সে একটা টু’শব্দও পর্যন্ত করতে পারছে না। আর না পারছে একটুকুও নড়াচড়া করতে! জমে বরফ হয়ে আছে। আহনাফের এতটা কাছে ইতিপূর্বে কখনো আসা হয়নি। কখনো আসবে এমন মনোভাব কিংবা চিন্তাও কখনো তার মনে, মস্তিষ্কে, মাথায় উদয় হয়নি। তাহলে আজ হঠাৎ কী হলো? কেন হলো? কেন অভাবনীয় ঘটনা এভাবে ঘটে গেল? মানুষটা কাছে টেনেছে। সেটা কি সেচ্ছায়? নয়তো! জ্বরের ঘোরে। সে জানেই না সে এখন কী করছে, কী বলছে। তাহলে কেন এই অনুভূতি? এই অনুভূতি ভয়ংকর। প্রবল ভয়ংকর। শুধু আহনাফের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ-ই নয়; বরঞ্চ স্পষ্টভাবে নিজের বুকের হৃদস্পন্দনও সে শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই বুঝি মিনি হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাবে।
আহনাফ বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে, ‘শুনছ না কেন?’
অর্ষা থমকায়। চমকে ওঠে। এই কণ্ঠে শুধু আকুতি নয়; রয়েছে আবদারও। কী সেই আবদার? কেন এমন হচ্ছে। কেন এমন লাগছে? সবকিছু উলট-পালট লাগছে অর্ষার। সে এই মানুষটির কণ্ঠস্বরেও পর্যন্ত হারিয়ে যাচ্ছে।
‘মারব তোমায়। কথা বলো না কেন?’ একই কণ্ঠে বলে ওঠে আহনাফ।
আবার একটুখানি চুপ। ঘোরলাগা কণ্ঠে ফের বলে ওঠে,’শুনছ?’
অর্ষার মুখ থেকে বহুকষ্টে বের হয়,’হু।’
‘তুমি অনেক নরম। তুলতুলে। ছোট্ট পাখির ছানার মতো।’
যতটুকু স্তব্ধ কিংবা বরফ হতে অর্ষার বাকি ছিল এবার আর ততটুকুও অবশিষ্ট রইল না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। জ্বরের ঘোরে বলে কি এই লোক?
আহনাফ এবার আরো ভয়ংকর একটা কান্ড করে বসে। সে অর্ষার গালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দেয়। শরীর হালকা হয়ে আসে অর্ষার। সে নিজেও কোনো ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে। যখন সম্বিৎ ফিরে পায়, তখন তড়াক করে উঠে বসে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আহনাফের বাহুবন্ধন থেকে।
আহনাফ বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠে বলে,’প্লিজ যেও না! আমায় একা করে যেও না। আমি আর কথা বলব না। সত্যি, প্রমিজ।’
অর্ষা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। মেঝে থেকে কোলবালিশটা তুলে বিছানায় রাখে। ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে চেয়ার টেনে এনে বিছানার কাছে এনে আহনাফের পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘যাচ্ছি না কোথাও। আপনি ঘুমান।’
‘সত্যিই?’
‘সত্যি।’
‘তুমি অনেক ভালো।’
‘আচ্ছা।’
অর্ষা নিরবে বসে আহনাফের ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আহনাফ ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন শুধু তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘুম নেই শুধু অর্ষার চোখে। সে ভুলতে পারছে না মুহূর্তটাকে। বারবার মানসপটে, দৃশ্যপটে শুধু একই দৃশ্য ভেসে উঠছে। অর্ষা মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে দৃশ্যটিকে ভুলে যেতে। আহনাফ ইচ্ছাকৃত এসব কিছু করেনি। জ্বরের প্রভাবে করেছে। জ্বর সারলে হয়তো মনেও থাকবে না। তাই তারও এসব মনে রাখা উচিত নয়। একদম-ই নয়।
.
.
ফজরের আজানের পর নামাজ পড়ে একেবারে ঘুমিয়েছে অর্ষা। সকাল ছয়টা বাজতেই আবার উঠে পড়েছে। আহনাফের কপালে হাত দিয়ে দেখে ঠান্ডা। গালে, গলায়ও হাত রেখে দেখল শরীরে জ্বর নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। অসুস্থতা মানুষটাকে কাবু করতে পারেনি তেমন! এই-ই ঢের তার কাছে।
সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে তাই পরিবেশ আজ ঠান্ডা। বাইরের সবুজ প্রকৃতিতে মিশে আছে মুক্তোদানার মতো বৃষ্টির ছোটো ছোটো ফোটা। সে কিচেনে গিয়ে সকালের নাস্তা বানিয়ে ঘরে ফিরে আসে। আহনাফকে ডাকতে গিয়ে কিছুক্ষণ এক পলকে তাকিয়ে থাকে। গভীর সেই দৃষ্টি। আহনাফ যদি এখন জেগে থাকত, তাহলে নিঃসন্দেহে এই দৃষ্টি তার অন্তর্ভেদ করত। বিশেষ কিছু কোথায় আছে? আহনাফের মায়া মায়া মুখটিতে নাকি অর্ষার টানা দুটো চোখদুটিতে?
পরক্ষণে দ্রুত দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নেয়। নিজের প্রতিবিম্বকে ভর্ৎসনা করে বলল,
‘একি কী হলো তোর? হঠাৎ করে কি মাথায় ভূত চেপেছে? কাল রাতের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যা। দিনদিন কি বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস নাকি?’
‘কী হয়েছে?’ আহনাফ ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে অর্ষার দিকে। ঘুম ভেঙে অর্ষাকে হাত নাড়িয়ে কথা বলতে দেখে প্রশ্নটা আর না করে পারল না।
অর্ষা লজ্জা পেয়ে যায়। অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’কই, কিছু না তো!’
‘কার সাথে কথা বলছ?’
‘কারও সাথে না। আপনি উঠুন। অফিসে যাবেন না?’
আহনাফ আলসেমি ভেঙে উঠে বসে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বলে,’ভালো লাগছে না আজ।’
‘এখনো মাথা ব্যথা করছে?’
‘হুম।’
‘তাহলে আজ আর যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে রেস্ট করুন।’
আহনাফ নিরুত্তর। অর্ষা বলল,’আগে গোসল করে আসুন। আমি কফি আর নাস্তা দিচ্ছি। খেয়ে ওষুধ খাবেন।’
এরপর সে নিজেই জামা-কাপড় বের করে আহনাফকে দিলো। আহনাফ বাধ্য ছেলের মতো গোসল করতে চলে যায়। সমস্যা হয়ে গেছে অর্ষার। সে আহনাফের দিক থেকে চোখ-ই ফেরাতে পারছে না। এরকম বেহায়া স্বভাব তো তার কোনোকালে ছিল না! লোকটাকে হঠাৎ করে এত সুন্দর লাগছে কেন? নাকি সে আগে থেকেই সুন্দর? হতেও পারে। হয়তো অর্ষাই আগে খেয়াল করেনি। আর নয়তো জ্বর আসার পর কিউট হয়ে গেছে। যাহ্! জ্বর এলেও বুঝি কেউ কিউট হয়? নিজের বোকা বোকা চিন্তা-ভাবনায় নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না সে।
আহনাফ গোসল সেরে এসে দেখে অর্ষা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। সে পাশের একটা চেয়ারে বসে বলল,’তুমি খেয়েছ?’
অর্ষা ছোটো করে বলল,’না। পরে খাব।’
‘পরে কেন?’
‘এখনো ক্ষুধা লাগেনি।’
আহনাফ কফির মগে চুমুক দিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,’বাহ্! কফি তো ভালোই বানাও।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
‘ইউ আর ওয়েলকাম। পরে একা একা না খেয়ে আমার সাথেই খাও।’
অর্ষার দৃষ্টি নত। সে তাকাচ্ছে না আহনাফের দিকে। হঠাৎ করে তার মাঝে বিশাল পরিবর্তন বুঝি এসে পড়েছে।
‘তুমি ঠিক আছো?’ অর্ষার পরিবর্তন দৃষ্টি এড়াল না আহনাফের।
অর্ষা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল। গুমোট স্বরে বলল,’জি।’
‘তাহলে মন খারাপ?’
‘কোনোটাই না। আপনি খেয়ে বিড়াল দুটোকে খেতে দিয়েন।’
‘তুমি কোথাও যাবে নাকি?’
অর্ষা রুমে চলে যেত। পাছে আহনাফ আবার কোনো সন্দেহ করে, অথবা অর্ষার পরিবর্তন পুরোপুরি পরখ করে নেয়, এই শঙ্কায় বলল,
‘না তো!’
‘তুমি কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে। বলো কী হয়েছে?’
‘কিছু হলে তো বলব।’
আহনাফ একটুখানি সময় চুপ করে থেকে বলল,’তোমার সাথে জ্বীন প্রজাতির কিছু নেই তো?’
অর্ষা অবাক হয়ে তাকাল। সরাসরি আহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,’মানে কী? এ প্রশ্ন কেন করছেন?’
‘হঠাৎ দেখি তুমি শান্তশিষ্ট, হঠাৎ দেখি ভীষণ চঞ্চল। এখন আবার দেখছি গম্ভীর হয়ে আছো। তাই জানতে চাইলাম।’
‘আপনি মানুষটা ভীষণ অদ্ভুত। আর সেই সাথে আপনার চিন্তা-ভাবনাও।’
অর্ষা রেগে গেছে বুঝতে পেরে মনে মনে হাসছে আহনাফ। ইনোসেন্ট লুক নিয়ে বলল,’তাই নাকি? আচ্ছা অদ্ভুত কাকে বলে?’
অর্ষা বিরক্ত হয়ে তাকায়। সেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে, আহনাফ তাকে ইচ্ছে করে রাগাচ্ছে। আর সে জেনেও বোকার মতো রেগে যাচ্ছে। অদ্ভুত সে নাকি আহনাফ এখন সেটাই ভাববার বিষয়।
অর্ষাকে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে আহনাফ বলল,’বলছ না যে?’
‘আপনি না অসুস্থ? খেয়ে রেস্ট করুন যান।’
‘এখন ততটা অসুস্থ লাগছে না। কফি খেয়ে মাথাও এখন হালকা লাগছে।’
‘তাহলে অফিসে যাবেন?’
‘না। অলরেডি ফোন করে ছুটি নিয়েছি। কী ব্যাপার বলো তো, আমাকে দূরে সরাতে চাইছ মনে হচ্ছে।’
অর্ষা থতমত খেয়ে যায় আহনাফের প্রশ্নে। আমতা আমতা করে বলে,’ক..কই! আমি তো এমনি বললাম।’
অস্বস্তিটুকু আহনাফের দৃষ্টির আড়াল করতে সেও নাস্তার প্লেট এগিয়ে নেয়। সাথে চেষ্টা করে নিজেকেও স্বাভাবিক করার।
খেতে খেতে সে বলল,’রাতে বিড়াল দুটোকে আমি খেতে দিয়েছি।’
আহনাফ অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,’তাই? খুব ভালো করেছ। সাহসীও হয়েছ।’
‘ছাই! পরিস্থিতির শিকার ছিলাম।’
‘তুমি শুধু শুধু ভয় পাও। ওরা কিছু করবে না। আমি তোমাকে ওদের কোলে নিতে শিখিয়ে দেবো।’
অর্ষা লাফ দিয়ে উঠে বলল,’কোনো দরকার নেই।’
‘ওকে, ওকে রিল্যাক্স। তুমি বসো শান্ত হয়ে। খাওয়া শেষ করো।’
অর্ষা শান্ত হয়ে বসে। খেতে খেতে আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
‘আপনি কি রসায়ন সাবজেক্ট অনেক পছন্দ করতেন?’
‘এ কথা জানতে চাচ্ছ কেন?’
‘না মানে, ক্যাথিওন ও অ্যানিওন নামটা কেমন জানি ক্যাটায়ন আর অ্যানায়নের মতো মনে হয়।’
খাওয়া বাদ দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে আহনাফ। বিস্ময় নিয়ে বলে,’এসব অদ্ভুত চিন্তা-ভাবনা তোমার মাথায় আসে কী করে?’
‘আমার মাথা থেকে আসেনি।’
‘তাহলে?’
‘অন্যদের মাথা থেকে এসেছে।’
‘এই অন্যরা কারা?’
‘আপনি চিনবেন না।’
‘না চিনলে বলো কেন? আজব!’
‘কাদের মাথা থেকে এসেছে সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আপনি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।’
‘রসায়ন, ফিজিক্স, হায়ার ম্যাথ, ইংরেজি এগুলো সাবজেক্ট আমার ফেভারিট ছিল। বাট গড সেক, তোমার মতো আজগুবি চিন্তা করে আমি ওদের নাম রাখিনি। এদেশে ক্যাথি, অ্যানি এসব নাম বিদেশি শব্দের মতো। যদিও অ্যানি নামে বাঙালি অনেক মেয়ে রয়েছে। ক্যাথিওনের নামের সাথে মিলিয়েই অ্যানিয়ন নাম রেখেছি। বোঝা গেছে?’
‘হ্যাঁ।’
খাওয়া শেষ হলে আহনাফ গিয়ে ক্যাথিওন আর অ্যানিওনকে খাবার দেয়। ওদের খাওয়া শেষ হলে বাইরে যাওয়ার আগে অর্ষার উদ্দেশ্যে বলে,
‘আমি ওদের নিয়ে গার্ডেনে যাচ্ছি। চাইলে তুমিও আসতে পারো।’
‘আপনি যান। আমি আসছি একটু পর।’
আহনাফ চলে যাওয়ার পর অর্ষা এঁটো থালা-বাসনগুলো কিচেনে রেখে আগে টেবিল গুছিয়ে ফেলে। এরপর থালা-বাসন ধুয়ে রান্নাঘর ঝাড়ু দেয়। ঘরে গিয়ে বিছানা গোছায়, ঘর ঝাড়ু দেয়। সবকিছু পরিপাটি করে গুছিয়ে বের হওয়ার সময় থেমে যায়। কী মনে করে যেন আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে আগাগোড়া পরখ করে নিতে নিতেই মনে মনে আবার নিজেকে ভর্ৎসনা জানায়।
খুশি মনে বাড়ি থেকে বের হলে কী হবে, বাইরে গিয়ে তার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। এক বিদেশি মেয়ের সাথে আহনাফ হেসে হেসে কথা বলছে। দুজনে পাশাপাশি বসে আছে বেঞ্চে। কখনো হাসতে হাসতে কথার ছলে মেয়েটি আহনাফের বাহুতে মারছেও।
কী অদ্ভুত! অর্ষা স্বগতোক্তি করে,’সে যা খুশি করুক। তাতে আমার কী! আমি কেন শুধু শুধু হিংসা করতে যাচ্ছি?’
মনকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। যেই প্রেম-সাগরে সে পড়েছে, সেখান থেকে ওঠার যে পথ নেই তা এখনো তার বোধগম্য হয়নি। গার্ডেনের মাঝখানে সবুজ গাছের ওপর বিড়াল দুটোকে নিয়ে বসে আছে হেলেন আর সেই বাচ্চাটা। কী জানি নাম! ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হানি।
মেয়েটি অর্ষাকে দেখে দৌঁড়ে আসে। হাত ধরে টেনে বলে,’আসো। আমার সাথে আসো।’
হেলেন যেখানে বসে আছে, হানি তাকে সেখানে নিয়ে যায়। ওদের পাশে বসতে বলে। অর্ষা পড়েছে মহা মুশকিলে। এই অপরিচিত মানুষ দুটো যদি জানে, অর্ষা বিড়ালকে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পায় তখন কী ভাববে? নিশ্চয়ই মজা নেবে?
তার ভাবনার মাঝেই হানি আরেকবার হাত ধরে টান দিলো। সে হানির পাশে বসল ঠিক-ই, তবে বিড়ালের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে। তার দৃষ্টি তো তখনো ছিল আহনাফের দিকেই। হঠাৎ হেলেনের দিকে দৃষ্টি আসায় চোখাচোখি হয়ে যায়। হেলেন এক পলকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল।
চোখাচোখি হওয়ায় অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামলে নেয় হেলেন। সে হেসে বলে,’হাই, আমি হেলেন।’
অর্ষা ভদ্রতাসূচক মৃদু হেসে বলল,’আমি অর্ষা। আপনাকে আমি চিনি।’
হেলেন হাসল। তাকে হাসলে কতটা সুন্দর লাগে সেটা ইতিপূর্বে বহুবার বলা হয়েছে। আজ কাছাকাছি হওয়ায় তার সুন্দর হাসিটা অর্ষার দৃষ্টিতেও আটকাল।
হেলেন হেসে হেসে বলল,’সেদিনের ধাক্কার জন্য মাফ করেছিলে তো?’
‘জি।’
হেলেন নিজের ধবধবে প্রশস্ত বুকে ডান হাত রেখে বলল,’থ্যাঙ্কস কুইন।’
অর্ষা ভ্রুঁকুটি করে বলল,’কুইন? আমার নাম অর্ষা।’
‘আই নো, ইউ আর অশা।’
‘অশা’ শুনে মুখটা হা হয়ে যায় অর্ষার। সেই সঙ্গে আহতও হয়। ভাগ্যিস মশা-টশা কিছু বলেনি!
‘হেই!’ অর্ষাকে অন্যমনস্ক দেখে তুড়ি বাজাল হেলেন।
সম্বিৎ ফিরে পেল অর্ষা। মৃদু হাসিররেখা ঠোঁটে ফুটিয়ে বলল,’ইয়েস?’
সেই সময়ে আহনাফ মেয়েটিকে নিয়ে এখানে আসে। অর্ষাসহ সকলে উঠে দাঁড়ায়। আহনাফ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,
‘ওরা আমার ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ড। হেলেনকে তো আগেই দেখেছ। আর ও হচ্ছে গ্লোরিয়া।’
অর্ষা হেসে বলল,’নাইস টু মিট ইউ।’
আর গ্লোরিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,’আর ও অর্ষা। আমার স্ত্রী।’
গ্লোরিয়াও হেসে বলল,’অলসো নাইস টু মিট ইউ।’
অর্ষার সেদিকে কোনো ভাবান্তর নেই। সে তো আহনাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বারবার কানে বাজছে আহনাফের বলা ‘আমার স্ত্রী’ কথাটি। এর আগেও তো সে অর্ষাকে তার বউ বলে পরিচয় দিয়েছে। তখন তো এমন অনুভূতি হয়নি। গতকাল রাত থেকে কী হয়ে গেল তার! ধ্যাৎ। নিজের ওপর সে যেমন বিরক্ত হচ্ছে, আবার নিজের জন্য তার মায়াও লাগছে।
________
নিহাল আজ অফিসে যায়নি। কয়েকদিন ছুটি নিয়েছে। লামিয়া কাপড় ভাঁজ করছিল।
শুয়ে থাকা নিহালের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,’শুনছেন?’
নিহাল ফোনে গেইম খেলতে খেলতে উত্তর দিলো,’হু।’
‘বলছিলাম যে, বিয়ের তো কতদিন পার হয়ে গেল। আমাদের কিন্তু এখনো কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি।’
‘বলেছি তো, তোমার রেজাল্ট দেওয়ার পর নিয়ে যাব।’
‘সেটা মনে আছে। আমি বলতে চাচ্ছি, কোথায় নিয়ে যাবেন?’
‘তুমিই বলো কোথায় যাবে।’
‘যেখানে যেতে চাইব নিয়ে যাবেন?’
নিহাল মুচকি হেসে বলল,’অবশ্যই।’
হাতের কাপড়গুলো রেখে লামিয়া নিহালের পাশে বসল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,’সুইজারল্যান্ড যাব।’
হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ে নিহালের। শোয়া থেকে উঠে বসে। অবাক হয়ে বলে,’বাংলাদেশ রেখে সুদূর সুইজারল্যান্ড?’
লামিয়া মুখটা অন্ধকার করে বলল,’তাতে কী হয়েছে? আপনার বাপের কি টাকার অভাব পড়েছে নাকি আপনার?’
‘কারও-ই না। চাইলে যাওয়া যায়। কিন্তু অনেক ঝামেলা আছে। পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি। এসবের সময় কোথায়?’
লামিয়া চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,’সময় যখন নাই-ই তাহলে বিয়ে করতে বলেছিল কে? বউকে সঙ সাজিয়ে রাখার জন্য?’
‘আরে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘রাগ করব না তো কী করব? একটা মাত্র আবদার করেছি। সেটাও রাখতে পারবেন না? উলটো বাহানা বানাচ্ছেন।’
নিহাল লামিয়ার হাত ধরে টেনে কাছে আনল। জড়িয়ে ধরে বলল,’বাচ্চাকাচ্চা বিয়ে করা মানেই ঝামেলা। একটু কিছু হলেই শুধু গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।’
‘তো যান, বুড়ি কাউকে বিয়ে করেন।’
নিহাল হেসে ফেলে বলে,’না। আমি তো আমার বাচ্চা বউটাকেই ভালোবাসি। আমার আর কাউকে লাগবে না। আমি তোমার আবদার রাখব।’
‘সত্যিই? সুইজারল্যান্ড ঘুরতে নিয়ে যাবেন?’
‘হ্যাঁ, ইন-শা-আল্লাহ্।’
‘সরুন। আমি অর্ষাকে ফোন করে জানাই।’ বলে নিজেই নিহালের হাতের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
নিহাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,’বাপ্রে বাপ! বরের চেয়েও বান্ধবীর প্রতি দরদ বেশি।’
.
.
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল বিধায় বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছিল আহিল। দূর থেকে দেখতে পায় ছাতা মাথায় একটা মেয়ে বসে রয়েছে। তাও আবার রাস্তার মাঝামাঝি। তাই বাধ্য হয়েই স্পিড কমিয়ে দিতে হয়।
বাইক নিয়ে কাছে যাওয়ার পর মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। পরনে স্কুল ড্রেস। ছিপছিপে গড়নের, গোলগাল চেহারা। মুখের আদলে বাচ্চা বাচ্চা ভাব। অবশ্য স্কুল পড়ুয়া মেয়ে তো বাচ্চাই হবে। ইনোসেন্ট লুক নিয়ে আহিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আহিল ভ্রুঁকুটি করে জিজ্ঞেস করে,’মাঝরাস্তায় বসে আছেন কেন?’
মেয়েটি তার ডান হাত উঁচু করে জুতাগুলো দেখাল। এরপর বাচ্চা বাচ্চা কণ্ঠে বলল,’জুতা ছিঁড়ে গেছে।’
‘তো এজন্য রাস্তায় বসে থাকতে হবে?’
‘একটু বাসায় পৌঁছে দেবেন? প্লিজ!’
আহিল দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় কী করবে। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত নেয়, মেয়েটিকে সে সাহায্য করবে।
মেয়েটিকে উদ্দেশ্য বলল,’উঠুন।’
মেয়েটা খুশি হলো। ছাতা বন্ধ করে পিছে গিয়ে বসল। আহিলের কাঁধে হাত রেখে বলল,’চলুন।’
‘ভালোমতো বসেছেন?’
‘জি। আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। আমি তো আপনার ছোটো। তুমি করে বলবেন।’
আহিল মেয়েটির কথায় পাত্তা না দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর মেয়েটি নিজে থেকেই বলল,
‘আমার নাম সকাল। গার্লস স্কুলে পড়ি। আপনার নাম কী?’
আহিল নিরুত্তর। সকাল কাশি দিয়ে বলল,’শুনছেন?’
‘চুপ করে বসে থাকুন।’
আহিল শান্তভাবে কথাটা বললেও কথার সুরে কেমন যেন ধমকের একটা আভাস ছিল। তাই সকাল আর বলার মতো সাহস পেল না।
সকালের বলে দেওয়া স্থানে গিয়ে বাইক থামায় আহিল। সকাল বাইক থেকে নেমে বলে,’একটা কথা বলি?’
আহিল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সকাল আশেপাশে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,’আপনার অনেক ভাব। কিন্তু আপনি দেখতে দারুণ! একদম পুরাই আগুন।’
কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না সে। এক দৌঁড়ে চলে গেল পাশের গলিতে। আহিল হতবিহ্বল হয়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। সেখানে আরো কতগুলো স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখতে পায়। সকালও ওদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সবগুলো মেয়ে সমস্বরে হাসছে। সকাল যাওয়ার পথে হাসতে হাসতে একবার পিছু ফিরে তাকায়।
আহিল স্বগতোক্তি করে বলে,’আজ-কালকার মেয়েগুলো ছোটো হলে কী হবে! বিচ্ছু একেকটা।’
__________
গ্লোরিয়া মেয়েটা ভালো ছিল। বেশ হাসি-খুশি স্বভাবের। মিশুকও। সব ভালো লাগলেও, আহনাফের সাথে এত ফ্রি ভাবটা অর্ষার মোটেও ভালো লাগেনি। সে সকাল থেকেই থম মেরে ছিল। হেলেন, গ্লোরিয়া আর হানি যতক্ষণ ওদের সাথে ছিল জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখেছিল অর্ষা। বিকেলে সকলে চলে যাওয়ার পর হনহনিয়ে রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে।
আহনাফও ঘরে এসে বলল,’চলো ফুপির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তুমি এখানে এসেছ শুনে অনেকবার যেতে বলেছিল।’
‘কোথাও যাব না।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
‘তুমি এখানে এসে কোথাও-ই যাও নি। যাও গিয়ে রেডি হও। ঘুরে আসি। ভালো লাগবে তোমার।’
‘আমার এমনিতেই ভালো লাগছে। আজ আর কোথাও যাব না।’
আহনাফ কাঁধ নাচিয়ে বলল,’ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছা।’
এরপর সে ড্রয়িংরুমে চলে যায় টিভি দেখতে। অর্ষা শোয়া থেকে উঠে বসে। দাঁতমুখ খিঁচে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলে,’ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছে। ঢং!’
সন্ধ্যায় আহনাফকে নাস্তা বানিয়ে দিলেও কোনো কথা বলেনি সে। চুপচাপ থেকেছে। রাতে খাওয়ার পর অর্ষা গম্ভীর হয়ে বলে,
‘আপনার ম্যাউ দুইটাকে নিয়ে আপনি এই রুমে থাকেন। আমি আজ ঐ রুমে ঘুমাব।’
আহনাফ বিনাবাক্যে রাজি হয়ে বলেছে,’আচ্ছা।’
অর্ষা তীক্ষ চোখে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না। রাতে সত্যি সত্যিই আলাদা রুমে ঘুমাল। এটাই ভালো হবে। এসব অনুভূতি ভালো নয়। এক ঘুমে রাত পার করে ফেলে। সকালে ঘুম ভাঙার পর বালিশের কাছে ফোন খুঁজে পেল না। পরে মনে হলো, ফোন তো ঐ রুমেই রয়ে গেছে। কেউ ফোন দেয়নি তো? দিলেও বা কী! ফোন তো সাইলেন্ট করা।
সে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে ঘড়ি দেখে। নয়টা বাজে। আজ বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছে। আহনাফ কি অফিসে চলে গেছে? ওদের বেডরুমে গিয়ে দেখল দরজা খোলা। বারান্দার দরজাও খোলা। ওখান থেকে কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
সে গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় যায়। ক্যাথিওন আর অ্যানিওনকে কোলে বসিয়ে ওদের সাথেই আহনাফ কথা বলছিল। হাফ স্লিভের কালো টি-শার্টের সাথে সাদা প্যান্ট আহনাফের পরনে।
অর্ষা চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বলে,’একি! আপনি নেং’টু প্যান্ট পরে বাড়িতে ঘুরছেন কেন?’
অর্ষার কথা শুনে চকিতে ফিরে তাকায় আহনাফ। যেন সে আকাশ থেকে পড়েছে। চোখে-মুখে বিস্ময়। একবার নিজের দিকে ভালোমতো তাকিয়ে বলল,
‘নেং’টু প্যান্ট মানে? এটাকে শর্টস বলে।’
‘নাম যাই হেক। নেং’টু প্যান্ট তো নেং’টু প্যান্ট-ই। হাঁটু দেখা যায়।’
আহনাফ হতবিহ্বল হয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। নির্বোধ মনে হচ্ছে এখন তার নিজেকে। কী বোঝাবে সে এই মেয়েটিকে?
চলবে…