#যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
মাঝরাতে ফের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল অর্ষার। সে জ্বরের ঘোরে কিছুই টের পায়নি। ভোর রাত অব্দি ওর শিয়রে বসে ছিল আহিল আর রেণু। জ্বর কমে আসতেই যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়েছে। যখন অর্ষার ঘুম ভাঙে তখন ঘড়ির কাটায় সাড়ে ছয়টা বাজে। মাথার ওপর ফ্যান চলছে, তবুও শরীর ঘামছে খুব। জ্বর ছাড়ছে ধীরে ধীরে। শুক্রবার হওয়ায় কলেজ বন্ধ। তাই তাড়াতাড়ি ওঠারও তাড়া নেই। সে আরেকটু শুয়ে থাকে। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খায়।
আহনাফের ঘুম ভেঙেছে ফজরের আজানের সময়। সে নামাজ পড়ে আর ঘুমায়নি। অর্ষার ঘরের লাইট জ্বালানো দেখে একবার ভেবেছিল গিয়ে দেখে আসবে শরীরের অবস্থা কেমন। পরবর্তীতে মনে হলো ইচ্ছেটা অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি। অর্ষা তার ছোটো ভাইয়ের কলেজ বন্ধু। তার তো আর কেউ নয়। মানবিকতার খাতিরে যতটুকু সাহায্য করার প্রয়োজন ততটুকু সে করেছে। সূতরাং এখন আর তার এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আহিল নিজেই অর্ষার দেখভাল করতে পারবে। এছাড়া মা আর রেণু তো আছেই।
নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ সে ল্যাপটপে অফিসের মেইল চেক করেছে। কাজ শেষ করে বই পড়েছে। এই মুহূর্তে সে অনুভব করেছে এখন আর চা না হলে তার চলবেই না। তাই সে রুম থেকে বের হয় চা খাওয়ার জন্য। ড্রয়িংরুমে যাওয়ার সময় বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠে। রেণু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল। আহনাফ ইশারায় বলল,’আমি দেখছি।’
এরপর দরজা খুলতে যেতে যেতে বলল,’আমায় এক কাপ চা দিস রেণু।’
‘জে আচ্ছা ভাইজান।’
আহনাফ দরজা খুলে সারপ্রাইজ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়েই থাকে। তার দেখার ভুল নয় নিশ্চয়ই। সামনে কেয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে অফ হোয়াইট রঙের একটা শাড়ি। ওর ডান কাঁধে ব্যাগ আর কোলে তিয়াস। সে মুখে একটা আঙুল ঢুকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তো তার কাছে আহনাফকে চেনা চেনা লাগছে, আবার মনে হচ্ছে অচেনা। এর কারণ হচ্ছে আহনাফ এবং আহিলের চেহারায় অনেক মিল রয়েছে।
আহনাফ হেসে অবাক হয়ে বলল,’আরে আপনি!’
প্রত্যুত্তরে কেয়াও হেসে বলল,’হ্যাঁ। উপায় না পেয়ে আসতেই হলো।’
‘বেশ তো। ভেতরে আসুন।’
‘না,না। ভেতরে যাব না। আসতে হলো তিয়াসের জন্য। গতকাল রাতে অর্ষা চলে আসার পর থেকে তিয়াস খুব কান্নাকাটি করছিল। রাতে কোনো রকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাখলেও সকালে আর রাখা যাচ্ছিল না। আসলে তিয়াস অর্ষার খুব নেওটা বুঝলেন। তাই ওর কান্নাকাটি থামাতে আমাকেই আসতে হলো। অর্ষার তো কলেজ ছুটি আজ। তিয়াস ওর কাছে থাকুক। বিকালে দুলাভাই এসে নিয়ে যাবে।’
‘তা না হয় হবে। সমস্যা নেই। আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন?’
কেয়া এবারও হেসে বলল,’নইলে যে শো-রুমে যেতে দেরি হয়ে যাবে।’
‘আজও খোলা?’
‘হ্যাঁ। ছুটির দিন, আজ তো ভিড় আরো বেশি থাকবে।’
একটু থেমে হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’আর বেশিক্ষণ থাকলে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে। অর্ষা কোথায়?’
‘মনে হয় ঘুমাচ্ছে। ও’কে আমার কাছে দিন। অর্ষার ঘুম ভাঙলে দিয়ে আসব।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’ বলে তিয়াসকে আহনাফের কোলে দেয় কেয়া। দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আহনাফ অনেকক্ষণ পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেয়া চলে যাওয়ার পর সে দরজা লাগায়।
তিয়াসকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসে। এত বড়ো বাড়ি দেখে তিয়াস বেজায় খুশি। কোল থেকে নেমে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। তিয়াস অনেক ফরসা। ওর ফরসা গায়ে নীল শার্ট একদম ফুটে উঠেছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় সে। রেণুও তখন চা নিয়ে বের হচ্ছিল। তিয়াস রেণুর পায়ের সঙ্গে ধাক্কা খেতেই রেণু ‘ও বাবা গো’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে।
তিয়াস ওর চিৎকারে ভয় পেয়ে যায়। আহনাফ এগিয়ে গিয়ে ও’কে কোলে তুলে নেয়। রেণু হা করে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে বলে,’ও আল্লাহ্! সাঁঝসকালে বাচ্চা টপকাইল কই থেইকা?’
আহনাফ বিরক্ত হয়ে বলল,’কীসব আজেবাজে কথা বলছিস?’
‘এই বাচ্চা কি আপনের ভাইজান?’
আহনাফ কিছু বলার পূর্বেই রেণু ‘খালাম্মা, ও খালাম্মা’ বলে আমেনা বেগমকে ডাকতে লাগল। আমেনা বেগম রুম থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলেন,’কী হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘দেইখা যান খালাম্মা।’
আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,’কী দেখব?’
‘বাচ্চা দেখেন বাচ্চা। বড়ো ভাইজানের বাচ্চা।’
তিনি তিয়াসকে দেখে রেণুকে ধমক দিয়ে বললেন,’না জেনে কোনো কথা বলতে বারণ করেছি না তোকে?’
‘না দেইখা কী আবার? এইতো জলজ্যান্ত বাচ্চা লইয়্যা ভাইজান দাঁড়াইয়া রইছে।’
‘অর্ষার ভাতিজা এটা।’
রেণু জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,’ওপস! ছরি খালাম্মা। ছরি ভাইজান।’
আহনাফ সংশোধন করে দিয়ে বলল,’ছরি নয় স্যরি।’
‘ঐ হইল একটা! আপনের চা তো ঠাণ্ডা হইয়া গেছে ভাইজান।’
‘চা না দিয়ে এত বকবক করলে ঠাণ্ডা তো হবেই।’
‘একটু দাঁড়ান। আমি আরেক কাপ নিয়া আইতাছি।’
রেণু চলে গেল রান্নাঘরে। আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,’তিয়াসকে দিয়ে গেল কে?’
আহনাফ বিস্তারিত সব বলে তিয়াসকে নিয়ে আবার সোফায় বসল।
আমেনা বেগম অর্ষাকে ডাকতে যাওয়ার পূর্বেই অর্ষা ঘর থেকে বেরিয়ে এদিকে আসছিল। ও’কে দেখেই সোফা থেকে নেমে দৌঁড়ে যায় তিয়াস। তিয়াসকে দেখে ভারী অবাক হয় অর্ষা। কোলে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নরম তুলতুলে শরীরটা বুকে নিয়ে শান্তি প্রায় অর্ষা। গালে, মুখে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে,’আমার সোনা বাবা ভালো আছো?’
তিয়াস ডান হাতের তর্জনী তুলে অর্ষাকে শাসিয়ে শাসিয়ে বলে,’তুপ! তুমি পতা ফুপি। তুমি কুব পতা। আমালে লেকে তলে আসছ!’
অর্ষার সাথে আহনাফ আর আমেনা বেগমও হাসেন। বাচ্চারা যখন নতুন নতুন কথা বলা শেখে, অস্পষ্টভাবে কথা বলে তখন ওদের কথাগুলো শুনলে মনে হয় তোতাপাখি কথা বলছে।
অর্ষা তিয়াসকে নিয়ে এগিয়ে এলো। আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’কে দিয়ে গেল ও’কে?’
‘কেয়া এসেছিল।’
‘আমার সাথে দেখা করল না কেন?’ মনঃক্ষুণ্ণ দেখাল অর্ষাকে।
উত্তরে আহনাফ বলল,’সময় ছিল না তার। আজও নাকি শো-রুম খোলা।’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’হুম।’
‘এখন তোমার শরীর কেমন মা?’ জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম।
‘আলহামদুলিল্লাহ্।’
‘রাতে নাকি আবার জ্বর এসেছিল রেণু বলল। আহিল আর রেণু জেগে ছিল তোমার পাশে। কী পাগল বলো তো, আমায় ডাকবে না ওরা? আহিল ডাকতে দেয়নি।’
অর্ষা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। তবে তার মনে হচ্ছিল এই বাড়িতে এসে শুধু শুধু মানুষগুলোকে কষ্ট দিচ্ছে সে। আহিল বাদে সবাই সকালের নাস্তা একসাথে খেয়ে নিল। রাত জেগেছিল বলে আহিলের ঘুমের রেশ কাটেনি এখনো। খাওয়া শেষে আহনাফ আর জহির চৌধুরী অফিসে গেছে। আহনাফ অবশ্য বাবার সাথে অফিস ঘুরে দেখবে বলে গেছে। আহিল তো ঘুমে। ড্রয়িংরুমে বসে অর্ষা, আমেনা বেগম, তিয়াস আর রেণু টিভি দেখছিল। তিয়াস অবশ্য স্থির নেই। সে এদিক-সেদিক এখনো ছুটোছুটি করছে।
আহিল ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ফোন নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অর্ষাকে বলে,’লামিয়া কথা বলবে। দেখ কী বলে।’
অর্ষা বাদে বাকিদের একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। ওরা গ্রুপের নামটাও দিয়েছে ‘গ্যাঞ্জাম পার্টি’। যেহেতু অর্ষার ফোন নেই তাই সে গ্রুপে এডও নেই।
অর্ষা উঠে গিয়ে ফোন হাতে নেয়। সবাই ভিডিয়ো কলে ছিল। লামিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে,’আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে বোকারানী।’
অর্ষা জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে? তুই কাঁদছিস কেন?’
লামিয়া টিস্যুতে নাক মুছে বলে,’সর্বনাশ হলে কাঁদব না?’
দিদার বিরক্ত হয়ে বলল,’বালের সর্বনাশ হইছে।’
জুঁই দিদারকে ধমক দিয়ে বলল,’উ’স্টা খাইবি কইলাম। বন্ধু হয়ে বন্ধুর কষ্ট না বুঝে বকা দিচ্ছিস।’
আশিক বলল,’ঠিক। একদম ঠিক। বন্ধুর সুখে, সুখী হওয়া যেমন দরকার তেমনই বন্ধুর দুঃখে দুঃখী হওয়া উচিত। এই যেমন আমাকে দেখ। লামিয়ার কষ্টে আমি কষ্টিত।’
এই ড্রামাবাজদের ড্রামা দেখলে মানুষ সিরিয়াস মুহূর্তেও হেসে ফেলবে। তবে বিষয়টা যখন লামিয়ার সর্বনাশের, সেখানে ভুল করেও হেসে ফেলা মানে দণ্ডনীয় অপরাধ। পাশ থেকে আহিল ওদেরকে বলল,’এক কাজ কর। সবাই মিলে আমার বাসায় চলে আয়। তারপর শুনি কী সর্বনাশ হয়েছে।’
‘এটা ভালো কথা বলেছিস। তোর ভাই বাসায় আছে তো?’ খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করল রেশমি।
লামিয়া এবার রামধমক দিয়ে বলল,’খবরদার মহিলা! উনার দিকে নজর দিবি না। সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে বলে কি আমি তোদেরকে বিলিয়ে দিয়েছি উনাকে?’
‘ইশ! তুই যেভাবে বলছিস, মনে হচ্ছে উনি লিখিতভাবে শুধুই তোর।’ বলল জুঁই।
এবার আশিক ধমক দিয়ে বলল,’এইযে চুমকি থুক্কু রেশমি! আর জুঁই বেশি না করে কুইকুই; দুজনে ফোন রাখ। রেডি হ আর আহিলের বাসায় আয়। আমিও ফোন রাখছি।’
সবাই মিলে মিনিট পনেরোর মাঝে বাসায় এসে উপস্থিত হয়। আহিল তখন ডাইনিংরুমে নাস্তা করছিল। ভরপেটে দিদার আর আশিকও খেতে বসে যায়।
লামিয়া নাকমুখ কুঁচকে বলে,’আঙ্কেলের বাচ্চা খাদক, তোরা কি এখানে গিলতে এসেছিস?’
আশিক খেতে খেতে বলল,’না। তোর সর্বনাশের সমাধান করতে এসেছি। তার আগে একটু খেতে তো দিবি!’
‘খা। খেয়ে ম’রে যা তোরা। একটু শান্তি পাই আমি।’
‘আমি তোর জন্য একটা গিফ্ট এনেছিলাম। আর তুই আমাকে এভাবে বললি?’
‘কী গিফ্ট?’
আশিক ব্যাগ থেকে বসুন্ধরা টিস্যুর প্যাকেট বের করে বলে,’টিস্যু এনেছি। তোর চোখের পানি, নাকের পানি মুছতে কাজে দেবে। এমনিতে অবশ্য নাক দিয়ে ইয়ে ছাড়া তো আর চোখ থেকে পানি বের হয় না। হবে কীভাবে? কাঁদিস তো কুমিরের কান্না। তবুও নাকের ইয়ে মুছতে কাজে লাগবে। নে ধর।’
লামিয়া ন্যাকিসুরে বলল,’মজা নিচ্ছিস তো? নে। তোদেরই তো সময় এখন।’
অর্ষা বলল,’ওরা খেয়ে আসুক। তোরা আমার ঘরে আয়।’
ঘরে গিয়েও লামিয়ার কুমিরের কান্না কিছুক্ষণ চলল। অবশেষে সকলে গোল বৈঠকে বসে জানতে পারল সর্বনাশটা হলো লামিয়ার বিয়ে ঠিক করেছে ওর বাবা-মা। কিন্তু ও তো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে না।
লামিয়া কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল। টিস্যু দিয়ে ফের নাক মুছে আহিলকে বলল,’আমাকেও তোর বাসায় নিয়ে আয় না জান। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। বিয়েও করতে হবে না; আবার সারাক্ষণ তোর ভাইকে দেখতে পারব।’
‘ভাইয়ার বউ করে আনি?’
‘আমি তো এক পায়ে রাজি? তবুও অন্য কাউকে এখন বিয়ে করব না।’ মেকি কান্না করে বলল লামিয়া।
আশিক আরেকটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,’ওহে লামিয়া, এখন কী আর হবে কাঁদিয়া? বউ সেজে অন্যের বাড়িতে যা চলিয়া।’
রেশমি খ্যাঁক করে বলে উঠল,’তোরে না বলছি এসব ফালতু কবিতা বানাবি না।’
‘তোর কী চুমকি? উফ! থুক্কু রেশমি। বালের একটা নাম রাখছে। খালি ভুইলা যাই। আমার ক্ষমতা থাকলে তোর জন্য একটা গরু জবাই দিয়া নাম পাল্টাইয়া চুমকি রাখতাম। তারপর গান গাইতাম,’চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে?’ কিন্তু তোর কপাল খারাপ। গরু কেনার টাকা নাই আমার কাছে।’
‘তুই নিজেই তো একটা গরু। আল্লাহর ওয়াস্তে নিজেই নিজেরে জবাই দিয়ে দে।’ বলল জুঁই।
‘জুঁই, তোরে না বলছি বেশি করবি না কুইকুই?’
‘এই বাল থামবি তোরা? আমার সমস্যার সমাধান দে।’ বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলল লামিয়া।
আহিল বলল,’সমাধান আর কী? তুই ঐ ছেলের সাথে দেখা করবি আলাদা। দেখে করে বলে দিবি, তুই এখন বিয়ে করবি না।’
‘আমি একা যাব?’
‘তা কেন? আমরা তো আছি। আমরাও যাব।’
দিদার খুশি হয়ে বলল,’হ মামা। দারুণ হইব। যা মন চায় সবাই মিললা খাইয়া-দাইয়া বড়ো লিস্ট ধরাই দিমু ব্যাটার হাতে। তখন লামিয়ার কথায় বিয়ে ক্যানসেল না করলেও লামিয়ার আমাদের মতো খাদক বন্ধুদের ভয়ে ঠিক ঠিক বিয়ে ক্যানসেল করবে দেখিস।’
এবার সবাই উচ্চস্বরে হাসে। অর্ষা হঠাৎ খেয়াল করে তিয়াস নেই ঘরে। তাই সে তিয়াসকে খুঁজতে বের হয়। এদিকটায় সবার প্রথম রুমটা আফরিনের। মাঝখানের রুম আহনাফের আর শেষেরটা আহিলের। সবাই আফরিনের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
অর্ষা আগে আহনাফের রুমে উঁকি দেয়। দেখতে পায় তিয়াস ড্রেসিংটেবিলের সব পারফিউম, লোশন আরো যা যা ছিল সব নিয়ে ফ্লোরে সাজিয়ে খেলছে। এ দৃশ্য দেখে অর্ষার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা।
অর্ষা দৌঁড়ে ঘরে যায়। সবকিছু আবার ড্রেসিংটেবিলে রাখতে রাখতে বলে,’খেলবি তো খেলবি ভালো কথা। তাই বলে আর রুম পাসনি?’
এদিকে অর্ষা সব নিয়ে নিচ্ছে বলে তিয়াস কান্নাজুড়ে দেয়। অর্ষা ও’কে আদর করে মানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিয়াস তো তিয়াসই। তার কান্না থামে না। আহনাফ বাড়ি ফিরে আসে তখন। ওদের দুজনকে রুমে দেখে বলে,’কী ব্যাপার?’
অর্ষা থতমত খেয়ে বলে,’না মানে, কিছু না। তিয়াস ভুল করে চলে এসেছে।’
আহনাফ কিছু বলল না। ওয়ারড্রব আর আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় বের করে গোছাতে লাগল। তিয়াস অর্ষার কোল থেকে নেমে আবারও লোশন আর পারফিউমের বোতলগুলো নামিয়ে খেলতে শুরু করে।
অর্ষা ভীরু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’আপনি কোথাও যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। সুইজারল্যান্ড ফিরে যাচ্ছি।’
‘হঠাৎ?’
‘আমি তো ওখানেই থাকি। আফরিনের বিয়ের জন্য এসেছিলাম। অবশ্য আরো সাতদিন বাংলাদেশেই থাকার কথা ছিল। তবে অফিসে জরুরী কাজ পড়ে গেছে। তাই আজই ফিরতে হবে।’
‘এখনই?’
‘না। রাতে ফ্লাইট।’
‘ওহ।’
আহনাফ এবার তিয়াসকে জিজ্ঞেস করল,’কী ব্যাপার? পারফিউম পছন্দ হয়েছে?’
তিয়াস ওর কথায় কান দিলো না। সে তার মতো খেলছে। আহনাফ হেসে বলল,’আমারও ছোটো তুলতুলে একটা বাবু আছে।’
অর্ষা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,’কীহ! আপনি বিবাহিত?’
‘তুমি বিবাহিত?’
‘মানে কী?’
‘তিয়াসকে তুমি তোমার বাবু বলো না?’
‘বলি।’
‘আমিও ক্যাথিওনকে আমার বাবু বলি। তার মানে তো এই নয় যে আমি বিবাহিত।’
অর্ষা বিড়বিড় করে বলল,’যাক বাবা! এই যাত্রায় আমার তিন বান্ধবী অদৃশ্য ছ্যাকা খাওয়া থেকে বেঁচে গেল।’
মুখে বলল,’ক্যাথিওন কে?’
‘আমার বিড়াল।’
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,’অ্যা!’
‘অ্যা নয় হ্যাঁ। আমি আদর করে ডাকি ক্যাথি।’
‘তার মানে তোর প্রেমিকা আছে? নাম ক্যাথি?’ আহনাফের শেষের কথাটা শুনে দরজায় দাঁড়িয়েই বললেন আমেনা বেগম।
আহনাফ হতাশ দৃষ্টিতে একবার মায়ের দিকে তাকায়। আরেকবার অর্ষার দিকে তাকায়। সে ভারী গলায় বলে,’প্রতিটা বার ভুল সময়ে এসে ভুল কথা শোনো কেন বলো তো?’
‘ভুল শুনেছি মানে? স্পষ্টই তো শুনলাম। অর্ষা তুমিই বলো, আহনাফ মাত্রই না বলল, ও আদর করে ক্যাথি ডাকে?’
তারপর তিনি ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,’ক্যাথি নাম তো বিদেশি বিদেশি লাগে। তার মানে তুই একটা বিদেশিনীকে ভালোবাসিস?’ এরপর ওর হাতে থাকা নখের আঁচড়ের দিকে ইশারায় ইঙ্গিত করে বলেন,’আবার সাথে করে দেশেও নিয়ে এসেছিস? কোথায় রেখেছিস বল?’
আহনাফ কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার মা তো অর্ষার চেয়েও এক কাঠি ওপরে সহজ-সরল। বাবা যে কীভাবে এতগুলো বছর মাকে সামলিয়েছে আল্লাহ্ মালুম! তার এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,’মা, তুমি যার কথা বারবার জানতে চাইছ সে তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
কিন্তু মনের কথাটা আর মুখে বলা হয়ে উঠল না। জহির চৌধুরীর ডাক পড়ায় আমেনা বেগম বাধ্য হয়েই চলে গেলেন। নয়তো আজ ছাই দিয়ে তিনি ছেলেকে ধরতেন। কে এই মেয়ে সেটা তিনি জেনেই ছাড়তেন।
মা চলে যেতেই আহনাফ রেগেমেগে বলল,’সব হয়েছে তোমার জন্য।’
‘আমি কী করেছি?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল অর্ষা।
‘তোমার নখের আঁচড়ের জন্যই মা আমাকে এত সন্দেহ করছে। ইচ্ছে তো করছে বলে দেই, সেই মেয়েটা অন্য কেউ নয় বরং তুমি নিজেই। সেটাও তো বলতে পারছি না। তুমি তো আর আমার প্রেমিকা নও। ছোটো ভাইয়ের বান্ধবী বলে কথা। এসব বলা যায়? ভাবলেও তো লজ্জা লাগে।’
এতগুলো কথা শুনেও অর্ষাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহনাফ বলল,’আল্লাহ্ ভালো জানে, কার জীবন তেজপাতা করতে তার বউ হবে! তোমাকে সবকিছু বিশ্লেষণ করে বোঝাতে বোঝাতেই তার অর্ধেক জীবন পার হয়ে যাবে।’
‘যার-ই বউ হই না কেন; আপনার তো আর হব না। আপনি এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন?’ নিচুস্বরে বলল অর্ষা। তারপর তিয়াসকে জোর করে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
আহনাফ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’অদ্ভুত সব নারীজাতি! বিয়েটিয়ে করার চেয়ে সন্ন্যাসী হয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া ঢের ভালো।’
চলবে…