: রুপু তোমার বিয়ের পরিকল্পনা কি এখনও আছে, থাকলে চল নিউমার্কেটে যাই।
: নিউমার্কেটে কেন!
: সেদিন না শাড়ি কিনতে চাচ্ছিলে, কিনবে না?
: হুম।
আমি অনেক দেখে শুনে একটা জামদানী শাড়ি কিনলাম। ছাই রঙের জমিনে জাম রঙের সুতার কাজ, বেশ চমৎকার দেখতে। শাড়ি কিনতে তেত্রিশ শো টাকা বেরিয়ে গেল। কিন্তু এরচেয়ে কমে কোন শাড়ি পছন্দ করতে পারলাম না। সোহেলের শুকনো মুখ দেখে বুঝলাম দামটা বেশি হয়ে গেছে কিন্তু ফেরতও দিতে দিল না। বলল,
: হাজার হলেও বিয়ের শাড়ি, তোমার পছন্দ না হলে হবে!
বাকি সব টুকিটাকি জিনিসও কিনল সোহেল এবং সব নিজের টাকায়। আমার প্রতি কঠোর আদেশ জারি হল যেন কিছুতেই আমি কোন টাকা খরচ না করি। তার মনের কথা বুঝে আমিও কোন জোর করলাম না। কথা হল, আট তারিখে আমরা বিয়ে করব। আমি বাসায় এই বলে আসব যে ভার্সিটি লাইফে শেষ দিন তো,তাই হলে রাত কাটাব। আর বাকি সব কিছু ম্যানেজ করবে সোহেল, আমাকে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ করল।
কাজেই সেই নির্দিষ্ট দিনে সাজুগুজু করে রতন মামার চায়ের দোকানে বসে আছি। এখানেই সোহেলের সাথে দেখা করার কথা। অথচ অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও তার আসার কোন নামই নেই।
আরও আধাঘন্টা পর হনহন করে শফিক কে আসতে দেখা গেল, শফিক সোহেলের বন্ধু।
: সরি রূপকথা, জ্যামে আটকে দেরি হয়ে গেল আমার।
: সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তোমার বন্ধুটি কই, সেও কি জ্যামে আটকে আছে?
: সে জায়গা মতোই আছে, আমাকে বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে, চল।
আমি দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন না করে শফিকের সাথে চললাম। একটু মন খারাপ হল, অন্তত আজকের দিনে সোহেল আমাকে নিতে আসলেই আমি বেশি খুশি হতাম।
আমার এই মন খারাপ ভাব কাজী অফিসে পৌঁছেই উধাও হয়ে গেল। কাজী অফিসের সামনে সোহেল দাঁড়িয়ে আছে, হাতে চা আর সিগারেট। সোহেলকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
: সিগারেট খাচ্ছো যে, টেনশন?
: হুম।
: টেনশনের কি আছে!
: বিয়ে কত বড় দায়িত্ব জানো তুমি?
: বাপরে, তুমি দেখি এখনই পুরোদস্তুর জামাই হয়ে গেছো। শোন জামাইবাবু, তোমাকে এখনই এতো কিছু টেনশন করতে হবে না। কাল তো চলেই যাব, কাজেই এতো চাপ নেবার কিছু নেই আর চারবছর পর যখন একবারে ফিরব তখন অনেককিছু বদলে যাবে, দেখো।
: তুমি বদলে যাবেনা তো!
: ধুর, কি যে বল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজি সাহেব আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। সোহেলের কয়েকটা বন্ধু সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকলো বিয়েতে। বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই শফিক কোত্থেকে গাঁদা ফুলের গাবদা দুটো মালা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল, মালা বদলের জন্য। আমি লজ্জায় একদম লাল হয়ে গেলাম।
বিয়ের ঝামেলা শেষ হতেই শফিক ঘোষণা দিল তার বোনের বাসায় যেতে হবে, সেখানে সব ব্যবস্থা করা আছে। সোহেল কোত্থেকে যেন ভাঙা চোরা একটা মাইক্রোবাস যোগাড় করেছে। সেটাতেই ঠেলাঠেলি করে বসে আমরা শফিকের বোনের বাসায় রওনা হলাম।
শফিকের বোনের বাসা পুরোটা খালি। উনারা কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গেছেন। এই সুযোগে শফিক সব ব্যবস্থা করেছে এখানে। একটা রুমে হাবিজাবি ফুল দিয়ে জবুথবু করে বাসরঘরও সাজিয়েছে, দেখতেই কেমন হাসি পেয়ে গেল।
হই হুল্লোড় করে প্যাকেট বিরিয়ানি খাওয়া শেষ করল সবাই। এরপর একে একে বিদায় নিতেই বাসাটা কেমন খালি খালি লাগা শুরু করলো আমার। অসম্ভব মন খারাপ হল। আজকের দিনে কত কিছু হবার কথা ছিল। বধূবরণ হতো, শরবত খাওয়ানো হতো, ভাই বোনেরা মিলে ঘরের দরজা আটকে টাকা আদায় করতো, জুতো লুকিয়ে রাখতো আরও কত কি, কিন্তু আমাদের! কিছুই হলো না।
: কি মন খারাপ লাগছে?
: নাহ্
: না লাগলেই ভালো, যাও ফ্রেস হয়ে আসো, ইচ্ছে করলে ঘুমিয়েও পড়তে পার না হলে গল্প করতে পার, যেটা তুমি চাও।
আমি ফ্রেস হয়ে এসে সোজা সোহেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থেকে সেও আমার দিকে এগিয়ে এলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহেলের খুব কাছে নিজেকে আবিষ্কার করলাম, এতো কাছে যেখান থেকে ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আমার মনে হল আমার চেয়ে সুখী কোন মেয়ে এই পৃথিবীতে জন্মেনি আর ভবিষ্যতে জন্মাবে সে সম্ভাবনাও নেই।
সকাল হতেই তড়িঘড়ি করে বাসায় ফেরত আসলাম। সন্ধ্যার পর পরই আমার ফ্লাইট, শেষ মুহূর্তের গোছগাছ বড় ঝামেলার তাই না এসে কোন উপায়ও ছিলো না। সোহেলের কাছ থেকে বিদায় নেয়া যত কঠিন মনে করেছিলাম ততোটা কঠিন হলো না। বিদায়ের মুহূর্তে সে সিগারেট হাতে মুখে কাঠিন্য ধরে রাখল। কথা আমিই বললাম।
: এইযে জনাব, আমার বিয়ের কাবিননামা, জামদানী আর বিয়ের মানুষ তিনটা জিনিসই আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি, এসে যেন সবকিছুই ঠিকঠাক ফেরত পাই, ঠিক আছে?
সোহেল কোন উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলো। আমার বুক কেমন হাহাকার করলেও বুঝতে না দিয়ে চলে এলাম। সেদিনই সন্ধ্যার ফ্লাইটে আমি জাপানের হামামাতসু শহরে এসে পৌঁছলাম।
হামামাতসু শহরটা দেখতে একদম ছবির মতো সুন্দর। এরকম ঠান্ডা ঠান্ডা দেশের কোন এক কফিশপে প্রিয়জনকে নিয়ে বসে আছি, এরকম একটা ছবি কল্পনায় আমি অনেকবার ভেবেছি। এখানে এসে সেই আগ্রহ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। খুব ইচ্ছে করল, সোহেলকে এখনই বাংলাদেশ থেকে ধরে নিয়ে আসি।
জেটলেগ কাটতেই কম্পিউটার নিয়ে বসলাম। সোহেলের অফিসে কম্পিউটার আছে, মেইল করলে সে অফিসে বসেই দেখতে পারবে। বাবার পাশাপাশি সোহেলকেও মেইল করলাম। সাথে এখানকার কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি।
এই যে জনাব,
আপনাকে খুব মিস করছি। ইচ্ছে করছে একছুটে আপনার কাছে চলে যাই অথবা আপনাকে ধরে নিয়ে আসি। কিন্তু বাস্তবে সেটা যে অসম্ভব সেটাও বুঝতে পারছি। কাজেই চুপ করে বসে দিন গোনা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না।
ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলাম। এখানকার সবাই বেশ মিশুক আর কোঅপারেটিভ। তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমার প্রফেসর বললেন, আমার এডাপটেশন ক্ষমতা নাকি বেশ ভালো। আমি অনেক ভালো করব। তবে প্রথমদিনেই স্যারকে কবে ছুটিতে দেশে যেতে পারব জিজ্ঞেস করে বিব্রত করে ফেলেছিলাম। উনি হেসে উত্তর দিলেন, ইয়াং লেডি, এতো তাড়া কেন! মাত্র তো এলে!
পরে অফিস থেকে জানলাম, ছুটি হবে গুনে গুনে ঠিক এগারো মাস পর। এগারো মাস! কিভাবে থাকব বলতো!
ইতি
তোমার রুপু
প্রিয় রূপকথা,
পিএইচডি এতো সহজ কোন বিষয় না। এটার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইসের প্রয়োজন, সেটা তুমি জানোই। কাজেই এতো অল্পতেই কাতর হয়ে যেওনা। তুমি কমপ্লিট কর, সেটা আমিই বোধহয় তোমার চেয়ে বেশি চাই। প্লিজ ডু ইট।
ঠিকমত খাওয়া দাওয়া কর, বিদেশি খাবার নিশ্চয় ভালো লাগছে না, তবু চেষ্টা কর। আর তোমার রেখে যাওয়া সবকিছুই সযত্নে তোলা আছে, সুদ সমেত ফেরত নিও। ভালো থেকো।
তোমার
সোহেল
এমনি করে মেইলের মাধ্যমেই আমাদের যোগাযোগ চলতে থাকলো। ছয় সাত মাস ভালোই চললো। এরপর হঠাৎ করেই দুই সপ্তাহ সোহেলের কোন খোঁজ নেই। আমি এখানে যেন পাগলের মত হয়ে গেলাম দুশ্চিন্তায়। একটার পর একটা মেইল করছি, কোন উত্তর নেই। আমার মাথা খারাপের মত হয়ে গেল।
এরপর হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটা মেইল এলো আমার কাছে, যেটার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক