: তারপর বলুন, কি নেবেন চা না কফি?
: যে কোন একটা হলেই হবে।
: তবুও ..আমি স্পেসিফিক্যালি জানতে চাই কি নেবেন।
: কফি।
আমি দু’কাপ কফির অর্ডার দিয়ে ভালোমতো জেঁকে বসলাম। জেঁকে বসার কারন হল আমার সামনে বসা ভদ্রলোকের সাথে বেশ খানিকক্ষণ কথা বলতে হবে, এটা তার প্রস্তুতি।
ভদ্রলোক ডাক্তার, নাম আশফাক হোসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে প্রতিটা প্রফ পরীক্ষায় কোন না কোন সাবজেক্টে অনার্স পেয়ে পাশ করেছেন তিনি। এফসিপিএস না কি যেন সেটাও করে ফেলেছেন এক ধাক্কায়। বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোক ভীষণ মেধাবী।
আশফাকের সাথে আমার পরিচয়ের যোগসূত্র হল আমার বাবা। বিত্তশালী লোকেদের বাঁধাধরা ডাক্তার থাকে, আশফাক সাহেব হলেন আমার বাবার সেই বাঁধাধরা ডাক্তার। বাবার যে কোন সমস্যাতে ভদ্রলোক কে ডাকা হয় এবং উনিও নিষ্ঠার সাথে ব্যাপক আন্তরিকতা নিয়ে রোগী দেখতে আসেন। সেই আন্তরিকতা দেখেই কি না জানিনা, ভদ্রলোক কে আমার জন্য দুম করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছেন আমার বাবা।
: আমার বাবা যে আমাকে না বলেই এরকম একটা কাজ করতে পারে, আমি ভাবতেই পারিনি, প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
: কিছু মনে করব কেন! মেয়ে থাকলে বাবাদের একটু তো চিন্তা থাকবেই, তাই না।
: তা ঠিক, তবুও…
: আমি কিছু মনে করিনি তবে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি জিনিসটা সহজ ভাবে নেননি, আমাকে আপনার উপযুক্ত মনে করছেন না তাই তো?
: ছি ছি, তা কেন হবে!
: আমি কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ না, আমার বাবাও ব্যবসায়ী, সেই সূত্রে আপনার বাবার সাথে উনার ভালোই পরিচয় আছে। ধানমন্ডিতে আমাদের বাসা, বাসায় বাবা আর ছোট একটা বোন ছাড়া আর কেউ নেই।
: আপনার মা?
: উনি বেশ কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন।
: ও ..
এরপর আমি আর কোন কথা খুঁজে পেলাম না। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আশফাক নিজেই আবার কথা শুরু করল।
: সামনে আপনার কি প্ল্যান, দেশে থাকবেন নাকি বাইরে?
: দেখি..
: শুনলাম জাপানের সেই ইউনিভার্সিটিতে আপনাকে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশীপের অফার করেছে, যাবেন?
: এখনও ভাবিনি সেই বিষয়ে..
: আমার মতে যাওয়াই উচিত, এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।
: আমি যদি চলেই যাই, তাহলে আমাকে বিয়ে করে কি করবেন?
ভদ্রলোক আমার কথায় অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন। আমি হেসে কফির কাপে চুমুক দিলাম।
: আমি ইউনিভার্সিটির দিকে যাব, চলুন, যাবার পথে আপনাকে ধানমন্ডিতে নামিয়ে দেই।
: ধানমন্ডি নামাতে হবে না, আমি এখান থেকে ফার্মগেট যাব, চেম্বারে।
: আচ্ছা, তাইলে চলুন, উঠি।
: জী, তবে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম যদি অভয় দিন তো…
: দিলাম।
: আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আর আপনার নামটাও, একটু অন্যরকম, রূপকথা।
: শুনে ভালো লাগল।
: আমার বিষয়ে আপনার কি কোন আপত্তি আছে?
: শুনুন আশফাক সাহেব, আপনাকে কিছু কথা বলি, আমার বাবা হয়তো আমার বিষয়ে অনেক কিছুই আপনাকে বলেছেন কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ন একটা জিনিস বাবা মিস করে গেছেন। অবশ্য সেটার জন্য বাবাকে ঠিক দোষও দেওয়া যাচ্ছে না কারন বাবা সেটা জানেনই না।
: বিষয় টা কি?
: আমি জাপানে যাবার আগে একটা ছেলেকে বিয়ে করেছিলাম।
: তারপর?
: তারপর সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
: কোথায়?
: জানিনা আর জানার চেষ্টাও করিনি কখনও। দয়া করে এই বিষয়ে আমাকে কোন প্রশ্ন করবেন না আর।
কথা শেষ করেই কফিশপ থেকে গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে এলাম। আজ অনেকদিন পর সোহেলের কথা বলতে গিয়ে চোখ জ্বালা করে উঠল আমার।
ড্রাইভার চাচাকে ক্যাম্পাসের দিকে যেতে বললাম। যেতে যেতে দেখতে লাগলাম আশপাশটা। চার বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। রাস্তাঘাট, গাছপালা, রাস্তার জ্যাম সব কিছুই। শুধু ক্যাম্পাসের সেই পরিচিত গন্ধটা একই আছে। সেই ছেলেমেয়ের ভীড়, জটলা, রতন মামার চায়ের দোকান। শুধু সেই পরিচিত মুখ গুলোই নেই। শুধু এই না থাকাটাই হৃদয়ে একদম হাহাকার তুলে দিল যেন।
বহুদিন পর ক্যাম্পাসের সেই পরিচিত পথ ধরে হাঁটলাম আবার। সেই করিডোর, যেখানে সোহেলের সাথে কথা হতো। এক নিমেষে যেন ফিরে গেলাম সেই সময়ে। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। তবু কান্না আটকে ফিরে এলাম সেই স্মৃতির পাড়া থেকে। বেলা পড়তেই ফিরে চললাম বাড়ির পথে।
বাবার শরীরটা ভালোই খারাপ করেছে। আগের মতো সেই তেজ নেই। বাগানে অল্প কিছু সময় পায়চারি করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কেমন বুড়োটে দেখায় বাবাকে আজকাল।
আমি বারান্দায় দাঁড়াতেই বাবা বাগান থেকে হাত ইশারায় ডাকলেন।
: বল বাবা
: ওখান থেকে বল বাবা বলছিস কেন, নিচে আয়, চা দিতে বলেছি, আয় একসঙ্গে চা খাই।
আমি নিচে নেমে বাগানের পাতানো চেয়ার গুলোতে বসলাম। বাবাও বসলেন, চায়ে চুমুক দিয়ে ছোট করে গলা খাঁকারি দিলেন। বুঝলাম, বিরাট কোন বক্তৃতা দেবার পূর্ব প্রস্তুতি।
: শুনলাম আশফাকের সাথে আজ বাইরে গিয়েছিলি?
: হুম।
: কেমন লাগলো ছেলেটাকে?
: ভালোই।
: ভালোই আবার কি! বল চমৎকার ছেলে। এখনকার দিনে এরকম কম্বিনেশন পাওয়াই মুশকিল। যেমন চেহারা, তেমনি আদব কায়দা, তেমনই তার মেধা, ভাবাই যায়না।
: হুম।
: তাহলে কথাবার্তা আগাই, কি বলিস?
: তোমার যা ইচ্ছে…
: এটা আবার কেমন কথা! শুনে মনে হচ্ছে তোর কোন আগ্রহ নেই, আমার জোরের কারনেই রাজি হচ্ছিস।
: না বাবা, এরকম কিছু না।
: তাহলে কি, তোর কি কোন পছন্দ আছে? থাকলে বল, পিতা হিসেবে আমি অবশ্যই তোর পছন্দের মর্যাদা রাখব।
: না বাবা, আমার কোন পছন্দ নেই, তুমি যার সাথে বিয়ে দেবে আমি তাকেই বিয়ে করব, সেটা যদি আশফাক সাহেব হন, তাকেও। তবে তিনি আমাকে বিয়ে করবেন বলে আমার মনে হয়না।
: করবে না মানে! আলবত করবে, আমার একমাত্র মেয়ে বলে কথা।
আমি মিষ্টি হেসে উঠে এলাম। আশফাক সাহেবকে যা বলেছি এরপর বিয়েতে রাজি হবার তেমন কোন কারন দেখিনা। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে পরের দিনই খবর আসল, উনারা বিয়ের তারিখ ফাইনাল করার জন্য আসতে চান।
আমি এতো বোকা হয়ে গেলাম যে বলার বাইরে। আমি ভেবেছিলাম উনি রাজি হবেন না। এজন্যই নির্ভয়ে বাবাকে বলেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি রাজি হয়ে গেলেন, কি আশ্চর্য!
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক