###জীবন যখন যেমন ১৪তম পর্ব
###লাকি রশীদ
মাকে চিন্তায় ফেলতে মন চায় না। ভেবেছিলাম কিছুই জানাবো না। কিন্তু আমার দেরী দেখে মা নাকি উঠোনে দাঁড়ানো ছিল। শাওনদের বাসায় ঢুকতে দেখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই
গলা জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ দাঁড়ালো তারপর তাড়া লাগালো চল্ জলদি ঘরে চল্। ডাইনিং চেয়ারে বসিয়ে একগ্লাস পানি ঢেলে বলে,খা কতো গরমে যে সিদ্ধ হয়ে এসেছিস। আমি মনে মনে ভাবছি, মায়ের সবকিছু এতো বেশি ভালো কেন। ফাহিম ভাই ডেকে নিয়ে গেল কেন, কৌতূহলে বুক ফেটে
গেলেও আগে ছেলের পিপাসার কথা মনে রেখেছে। দোলা ও মেঘলাও চলে এসেছে। এবার মা জিজ্ঞেস করছে, ওরা তোকে ডেকে নিয়ে গেছে
বাবা? আমি বলি,হ্যা শাওনকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেছে এটা লিখেনি, বিয়ে করবে না বলে চলে গেছে। মা ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলছে, শাওন চলে গেছে বলে তোকে ডাকছে কেন? এখানে তুই
কি করেছিস?
মায়ের সাথে আমার যতই ভালো সম্পর্ক থাকুক না কেন,এসব প্রসঙ্গে কথা বলিনি কখনো। কেমন
যেন বাধো বাধো ঠেকে। আমি দোলার দিকে তাকাতেই ও বললো,প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে
শাওন আপু ছোটভাই কে বলছে সে তাকে খুব ভালবাসে। ছোটভাই সবসময় না করে আসছে।
হয়তো আর কাউকে বিয়ে করবে না বলে, বাসা থেকে চলে গেছে। এবার মা বলছে সে যাক্। কিন্তু আমার ছেলেটা কে নিয়ে টানাটানি কেন? মায়ের চিন্তাযুক্ত মুখ দেখে আমি বলি, এতো চিন্তা করো
না তো মা। তোমার শরীর খারাপ করবে শেষে। মা এবার অবাক হয়ে বলছে, চিন্তা করবো না !!! এরা যে ঠিক কেমন লোক, তোরা জানিস না? আমার জন্য ই কেন যে এসব ঝামেলা থাকে? মা আমার
দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে রুমে যা। হুটহাট বাইরে যাস্ না। কলিংবেল দিলে আমি দরজা খুলে দেবো। দোলার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ক’দিন সবাই চোখ কান খোলা রেখে চলবে।
আমি রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি, মায়ের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। ফাহিম ভাইরা অনেক হিংস্র ও প্রতিশোধ পরায়ণ মানুষ। একবার কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে গাছ কিনতে আসা এক ভদ্রলোক কে মারতে মারতে তারা আধমরা করে ফেলেছিলেন। পরে ছোটচাচা
দোলার কাছে থেকে খবর পেয়ে হাসপাতাল থেকে ছুটে আসেন। এসে ওকে দড়ি খুলে গাড়িতে করে বাসায় পাঠান। পাড়ার সবাই এদের ভীষণ ভয় পায়। আমি এজন্যই এতোদিন মনকে দমিয়ে দমিয়ে রাখছিলাম। আর ভাবতে পারছি না। যা হয় হোক।
মানুষ দুশ্চিন্তায় থাকলে বলা হয় ঘুম আসে না।
আমি এই অবস্থায় কিভাবে এতো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম, সেটাই এক বিস্ময় বলা যায়। দেড়
ঘন্টা এক নাগাড়ে ঘুমানোর পর,অভি এসে আস্তে আস্তে ধাক্কা মারছে। দরজার ওপাশে মা বলছে,
গভীর ঘুমে থাকলে ডাকিস না বাপ। আমার ঘুম ভাঙল,শোনলাম আর মনে হলো, আমার চামড়া দিয়ে তোমার জুতা বানিয়ে দিলেও তোমার এক কণা ঋণ আমি শোধতে পারবো না মা। সেই মুহূর্তে পাগলা অভি চেঁচিয়ে উঠলো,আমি বসে আছি। তোমার বিন্দাস ছেলে উঠুক, তুমি ততক্ষণে রেষ্ট নাও গিয়ে। তোমার ছেলে অভি যেখানে উপস্থিত,
সেখানে সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। নিশ্চিন্তে খানিকক্ষণ থাকার চেষ্টা অন্তত করে দেখো।
মা চলে যেতেই অভি বলছে,আর মটকা মেরে পড়ে থাকতে হবে না। উঠে পড়ো সাদি ভাই। আমি উঠে বসতেই বললো,আচ্ছা তুমি বড়মামীর সামনে প্রেম ভালবাসার কিছু বলতে বা শেয়ার করতে এতো সংকোচ বোধ করো কেন? আমি তো বড়মামী কে আমাদের ব্যাচের অনেকের প্রেমের গল্পই করি। আমি মৃদু হেসে বলি, আমি তো তোর মতো এতো ভালো না রে অভি। এবার সে বলছে, ভালো না হয়েই দেখছি সেধে মেয়েরা চলে আসছে তোমার কাছে। এই শাওনকে আবার
কি বলে পাগল করলে? আমি বলি, আমি টু শব্দ না করেও কেউ যদি পাগল হয়ে যায়….কি করবো
বল? অভি বিজ্ঞের মতো নানান কথা জিজ্ঞেস করছে, আমি রোবটের মতো উত্তর দিচ্ছি। হঠাৎ বলে উঠলো,চলো বড়মামীর কাছে যাই। কি না কি চিন্তা করছে হয়তো। গিয়ে দেখি মা মালাবু কে বকছে, এতো চাল ধুয়েছিস কেন শুনি? ভাত কি এতগুলো রাতে কেউ খাবে? তোদের কি?গায়ে
তো লাগে না। আমার বাচ্চাদের কতো কষ্টের টাকা দিয়ে চাল কেনা হয়। অভি আস্তে আস্তে বলছে,দেখো অলরেডি চিন্তা চলে আসছে মনে। এজন্যই এভাবেই চেঁচামেচি করছেন বড়মামী।
আমি আমার ঠান্ডা গাল,মায়ের গরমে লাল উত্তপ্ত
হওয়া গালে ঠেকিয়ে বলি, মালা বুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে মা। তোমাকে এতো বকাচ্ছে বলে। বা্চাল মালাবু এবার আমাকে সাক্ষী মানছে
আমি মাফমতোই বওয়াইছি চাউল( মাপমতো চাল বসিয়েছি) ছোটভাই। মাইঝে মাইঝে হুদাই (মাঝে মাঝে এমনিই) আম্মা এমনডা করে। মা এবার বলছেন, চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। এদের চা দে। মা এর কথায় পাত্তা না দিয়ে মালাবু এবার বলল,আমি দোকান থাইক্যা আওনের সময় মর্জিনা আমারে দাড় করাইয়া কয়, আমারে সাদি ভাই খালি গাইল পাড়ে। এহন মজাডা বুঝবো, শাওন আফারে না পাইয়্যা ভাইগুলান ফাগল অই গেছে। হুনতাছি থানায়ও যাইবো। এইডা হুইন্যা আম্মার মাথাডা আগুন অইয়া পড়ছে। দোলা এবার বলে,তোমারই বা আগ বাড়িয়ে মর্জিনার সব কথা মাকে এসে বলার দরকার কি? বেশি কথা বলার অভ্যাস তোমার আর যায় না।
তারপর সবাইকে নিয়ে মায়ের রুমে গিয়ে বললো, দেখো আমি ভেবে দেখেছি, পানি মাথার উপর উঠার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। পরশু মেঘলা কে
নিয়ে ছোট ভাই সিলেট যাবে। তাছাড়া, ওরা থানা
তে গেলে আমাদের আবার কি না কি সমস্যা হয় !!! তাই এখন কি করলে ভালো হয় তাড়াতাড়ি ভাবো সবাই। মা বললো, তোর ছোট চাচাকে নিয়ে
আমরা সবাই শাওনের বাসায় গিয়ে বুঝিয়ে বলি। ওর নীতি আছে, আমি বললে জান দিয়ে করবে। এরমধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ভাইয়া দেখি ছোট চাচা ও বড় ফুপু কে নিয়ে ঢুকছে। দোলা না
কি ভাইয়াকে জানানোর পরই, ভাইয়া গাড়ি নিয়ে ক্লিনিক থেকে ছোট চাচা ও বাসা থেকে বড়ফুপু কে ধরে নিয়ে এসেছে। বড়ফুপু মাকে বলছেন,
এতো বেশি চিন্তা করো না তো বড়ভাবী। আমার
সাদি কোনো দোষ করলে না ওকে কিছুতে পাবে।
এটা মগের মুল্লুক না কি? মা কিছু বলার আগেই, ডাঃ খালেদা হক ফোন ধরেছেন। দোলা বিস্তারিত বলার পর আশ্বস্ত করলেন, আমার আপন ভাই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আমি কথা বলে রাখছি, আল্লাহ না করুক খারাপ কিছু ঘটলে, তুমি শুধু আমাকে জানাইও। তোমার মাকে বলো চিন্তা না করার জন্য। কিছু করতে পারবে না ওরা।
ছোট চাচা বললো,মেজভাইর বাসায় গিয়ে ফাহিম
ও তার ভাইদের সাথে আলাপ করে দেখি কি বলে। চলো সময় নষ্ট না করে ওখানে যাই। একটা অনুরোধ করছি, কেউ মাথা গরম করবে না কিন্তু।
মা বললো, আমিও যাবো। দোলা স্পষ্টস্বরে বলে, না তুমি কেন তাদের বাসায় যাবে? তুমি এখন নামাজ পড়ে দোয়া করো। আল্লাহ তাআলা যেন এসব অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ ও অসম্মানি থেকে আমাদের রক্ষা করেন। মালাবু মায়ের দিকে নজর
রেখো, আমরা আসছি। আমি এবার বললাম, আমি জ্ঞানত কোনো অন্যায় করিনি। তাদের মেয়ে কোথায়…….. তাও বিন্দুবিসর্গ জানি না। সুতরাং,
একই দিনে ওদের বাসায় দুইবার যাবার কোনো ইচ্ছে নেই। তোমরা যাও, মায়ের পাশে আছি আমি। অভি বলছে,সাদি ভাই তোমার ফোন দাও।
শাওনের মেসেজ সবার সামনে ওদেরকে দেখিয়ে
একদম চুপ করিয়ে আসবো মেজমামী ও তার
ইডিয়ট ছেলে মেয়েদের। ফোন ওর হাতে দিতেই অভি মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে,
ভাত বেশি করেই রাধো। রাতে এখানে খেয়ে যাব।
সবাই জানে মাকে চিন্তা থেকে দূরে রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে খাওয়ার কথা বলা। সত্যিই
মা এবার মালাবু কে নিয়ে ছোট মাছের চচ্চড়ি করাচ্ছে ও ডাল বসাতে বলছে। অভির জন্য আলু
ভাজি করবে বলে,মালা বুকে আলু কুচি করে দিতে বলছে। আমি জায়গায় বসে ভাবছি কোথায়
গেল শাওন? বন্ধুদের বাসায় গেলে এরা খুঁজে পাবে না কেন? কোনো বিপদে পড়লো না তো? ইস্
জীবনটা আরেকটু সহজ হলে কি এমন হতো? ঝামেলায় হয়তো ফেলেছে আমাকে, কিন্তু আমি কেন যেন ওর প্রতি বিরক্ত হতে পারছি না। অদ্ভুত এক মায়ায় মনটা জড়িয়ে আছে। এতো আবেগে
ভাসা মেয়ে……..এই কঠিন, নিষ্ঠুর পৃথিবীতে টিকে
থাকতে পারবে তো? কত বিপদ ওঁত পেতে আছে।
মাথায় হাত পড়েছে, চেয়ে দেখি মা বলছে তোরা তো ছোটবেলা থেকেই ঝড় ঝাপটাতেই বড় হয়ে
ছিস। তবে এতো চিন্তা কেন? আল্লাহ আগেও রক্ষা করেছেন আমাদের, এখনো করবেন তিনি ইনশাআল্লাহ। বুকে সাহস রাখ্। আমি হেসে বলি,
কে কাকে বলে !!! আমরা তোমার জন্য দুশ্চিন্তায় মরি,আর তুমি আমাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছো !!!
মা বলল,বলতে চাই না। কিন্তু রাগে,দুঃখে, ক্ষোভে
বলতে ইচ্ছে করে বড়লোকদের মেয়েগুলো শুধু
আমার সংসার টাই তছনছ করতে আসে কেন?
ঝগড়া ঝাঁটি করবো না বলে কারো সাথে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলি না। তবুও অশান্তি আমার পিছু ছাড়ে না।
আমি বলি, এইতো আমাকে বুঝিয়ে তুমি আবার চিন্তা শুরু করলে। মা বললো,সাধে কি আর চিন্তা করি বাবা? ওরা মানুষ তো ভালো নয়,তাই এতো ভয় আমার। তবে আজ হাদি না আসলে, ওকে আমি জীবনেও মাফ করতাম না। আমি বলি, কি বুঝবো তাহলে ভাইয়া পুরোপুরি মাফ পেয়ে গেল?
মা হেসে বলে, আমার নানী বলতো সন্তান এমন এক সম্পদ,এরা ঘা দেয়ার পরও আবার ধরতে মন চায়। আমি হেসে বলি, তাহলে এখন ভাইয়ার জন্য স্পেশাল কি হচ্ছে? সারাদিন পর মায়ের হাসিমুখ দেখা গেল। আস্তে করে বললো, কাঁঠাল বিচীর ভর্তা ভীষণ ঝাল দিয়ে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলি, তুমি কি জানো যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা হচ্ছো তুমি। মা বলছে,সব বাচ্চার কাছেই
তার মা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মা।
কিছুক্ষণ পর যারা গিয়েছিল সবাই ফিরে এসেছে।
ছোট চাচা বললো,বড়ভাবী আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ফাহিম কে বলেছি সাদির মনে অন্য কিছু থাকলে তিন বছর ধরে এই মেয়ের ঘ্যানঘ্যান
সহ্য করতো না। বিয়ে করে ফেলতো। তখন কি করতে, বোনকে বিধবা তো করা যেত না। সুতরাং,
সাদি বা তার পরিবারের গায়ে যেন তোমার বোন পালানোর আঁচ না লাগে। কিন্তু আপনি দেখেন আজকালকার বাচ্চাগুলো নিজের ছাড়া অন্য কারো কথাই ভাবে না। ওর মা মুখে যতোই শক্ত
দেখান না কেন,আস্তে আস্তে ভাঙ্গতে কিন্তু শুরু করেছেন। মা এবার বলছে, আমার ভয় আমার বাচ্চাদের নিয়ে। বড়ফুপু এবার বললেন, কিচ্ছু হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন তো। ছোট চাচা এবার বলছেন, তাহলে এবার আমি উঠি ভাবী। ক্লিনিকে যেতে হবে। হাদি আমাকে ও বড়বুবু কে পৌঁছে দিয়ে যাবে। মা রে রে বলে তেড়ে এসেছে,
চারটা ভাত মুখে দিয়ে যাও। টেবিলে রেডি করে
রেখেছি, দেরি হবে না।
ভাইয়া এতোক্ষণ কোনো শব্দ করেনি। চাচা, ফুপু
ও অভিকে সাথে নিয়ে চারজন খেতে বসেছে। মা সবাইকে দুপুরের আইটেম সহ এখনকার গুলো দিয়ে পরিবেশন করছে। অভি এরমধ্যে হাঁক ছাড়ল, এই দোলা মজা করে এককাপ চা বানা।
ভাত খাওয়ার পর আমি চা খাই। দোলা জিজ্ঞেস করলো,আর কেউ খাবে কিনা। এর আরো ঘন্টা আধেক পর আসর ভাঙ্গলো। ওরা যাবার আগে
অভি একা আমাকে ডেকে নিয়ে বললো,যে যাই
বলুক ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিও সাদি ভাই। চোখ কান খোলা রেখো, এই ক’দিন দরকার ছাড়া তুমি বাইরে যেও না। আমি বলি, কালকেই তো সিলেট যাচ্ছি। অভি বলছে,যে কোনো দরকারে ২৪ ঘন্টার যে কোনো সময় সংকোচ না করে দয়া করে তুমি আমাকে ফোন দিও। চলে যাবার সময় ভাইয়া দু
হাতে আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরে আছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। শুধু অস্পষ্ট বুঝা গেছে আল্লাহর হাওলা
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমুতে গেছি, চোখ বুজলেই দেখি রাগী চোখে,বিষন্ন চোখে,কান্নায় লাল হওয়া চোখে শাওন চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে, কাওয়ার্ড কোথাকার !!! আমি যে নিখোঁজ সেটা গায়ে লাগে না। বোকা হাদারাম একটা ছেলে। একে আর জীবনেও মানুষ করা যাবে না। ধড়ফড়
করে উঠে বসে পানি খেলাম। সারা রাত আর ঘুম
আসলো না। নির্ঘুম রাত কাটানোর কষ্ট বড্ড বেশি
পরেরদিন নাস্তায় দেখি মেঘলা আইরিন আপুর বাসায় খাওয়া সেই চিজ টোষ্ট বানিয়েছে। বারবার বলছে, ইচ্ছে মতো খা ছোট ভাই অনেক গুলো আছে। মোজারেলা চিজ কিনে এনেছি গতকাল।
সত্যি অনেক মজা হয়েছে, আইরিন আপুর বাসার
টা থেকেও। ভাইয়ের জন্য বোন এতো ভালবাসা ও মায়া দিয়ে বানিয়েছে বলেই হয়তো। মনে মনে ভাবছি,এই ভালবাসা কেউ কোটি টাকা দিয়েও
কিনতে পারবে না যদি মন থেকে না আসে। সারা
দিন ভেবেছি, এইমাত্র হয়তো শুনবো শাওন কে পাওয়া গেছে। কিন্তু শাওন যেন কর্পুরের মতো কোথায় উড়ে চলে গেছে। কি এক অস্থিরতা বুকে নিয়ে,সময় কাটালাম। কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারছে না আমায়।এ আবার মনের কোন গতি কে জানে !!! কাল সিলেটে রওনা দিব ইনশাআল্লাহ।
সকালে আমরা দুজন কে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করে অবশেষে মা বিদায় দিল। আমি বেশ বুঝতে পারছি,মেঘলার জন্য মা যতটা চিন্তিত ঠিক ততটুকু আমার জন্য চিন্তিত। আমি মনে মনে বলি, সবসময় ঘরে থাকতে হবে? এভাবে কি জীবন চলে নাকি? না আদৌ সেটা সম্ভব? মানুষ ই মানুষের প্রকৃতি কে ভয় পাচ্ছে…………আজব না
ব্যাপারটা? ট্রেন সময়মতো ছাড়লো। মেঘলা সব সময়ের ই চুপচাপ। মনের ভাব প্রকাশ করতে তার ভাষার যেন বড় অভাব। দুই বার শুধু আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি খুব সাবধানে থাকবে ছোট ভাই। আমি ফোন দিলেই সাথে সাথে ধরবে কিন্তু। আমি বলি,হ্যা ধরবো। তোরা একটু বেশি বেশি ভাবছিস। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তাহলে তো ভালো ই। ওইদিন তার সবকিছু ঠিক করে দিয়ে রাতের ফিরতি ট্রেনে ঢাকা ফিরলাম।
ট্রেনে আমার ঠিক পেছনের সিটে বসা ভদ্রলোক কে দেখে মনে হলো, কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু ঠিক কোথায় আমি মনে করতে পারছি না। হঠাৎ
মনে হচ্ছে ইনি তো আমাদের সাথে ঢাকা থেকে এলেন। সিলেটে এক রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চ করার
সময়ও একে দেখেছি। মনে পড়লো অভির কথা,
ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিও সাদি ভাই। চোখ,কান খোলা রেখো। ফাহিম ভাই কি তবে পেছনে ফেউ
লাগিয়ে দিল? ভাবতে চেষ্টা করি উল্টৌপাল্টা কিছু কখনো বলেছি নাকি? হাসি পেল এবার, কি
অবস্থা সাদি? এতো ভয় পেলে চলে? এরপর থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে বসে ফোন টিপতে লাগলাম। মা একটু পর পর ফোন দিয়ে কিরে কি করছিস বলছে। এবার আমি বাধ্য হয়ে ফোন সাইলেন্ট করে দিলাম।
ভোরবেলা ঢাকাতে পৌঁছে বাসায় গেইটের ভেতরে ঢুকে দেখি মা উঠোনে হাঁটছে। আমি নিশ্চিত মা সারা রাত ঘুমায়নি। বড়চাচার বাসার সামনে দেখি অনেকগুলো রঙের টিন রাখা। মায়ের দিকে আমি
তাকাতেই বললো, তোর বড়চাচা কাল সকালে আসছেন। বলবো না বলবো না করে করেও বলি,
শাওনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে মা? রাজ্যের
বিরক্তি নিয়ে জবাব এলো,কই আর এলো? মেয়ে টা একটা ফোন তো পরিবারকে করতে পারে।এই
বাচ্চাগুলো কেন যে এমন অবুঝ হয়, আল্লাহ মালুম। মেয়ের চিন্তায় মা বিছানা নিয়েছে। কি যে
এক জগাখিচুড়ী অবস্থা করে রেখেছে মেয়েটা। আমি চোখ বুজে হাঁটছি আর আপনমনে বলছি,
যেখানে ই থাকিস নিরাপদে থাকিস শাওন আর এই কাওয়ার্ড কে মাফ করে দিস।
(চলবে)
.